Sunday, February 23, 2025
Homeইতিহাস ঐতিহ্যসনাতন-দীননাথঃ আপন আলোয় উদ্ভাসিত

সনাতন-দীননাথঃ আপন আলোয় উদ্ভাসিত

মতিয়ার চৌধুরী

মতিয়ার চৌধুরী

ছাত্র জীবন থেকেই লেখালেখি ও সাংবাদিকতার সাথে সম্পৃক্ত থাকার কারনে যখনই সময় পেতাম,
তখনই বিভিন্ন এলাকার সকল বয়সের মানুষের কাছ থেকে আমি তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে
রাখতাম, এ ছিল আমার নেশা। আশি ও নব্বইয়ের দশকে নবীগঞ্জ সহ বৃহত্তর সিলেটের গ্রামে-
গঞ্জে গিয়ে বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কথা বলে সেখানকার কুশীলবদের তথ্য, বিশেষ করে
সরপঞ্চদের সম্পর্কে জানার চেষ্টা করি এবং তা সংরক্ষন করে রাখি। আমার প্রয়াত পিতা
রফিকুল হক চৌধুরী ও আপন দুই চাচা আব্দুল কদ্দুস চৌধুরী ও সফিকুল হক চৌধুরী নবীগঞ্জ
থানার ৩ নম্বর সার্কেলের সরপঞ্চ হিসেবে দীর্ঘ ৩৫ বছর মানুষের সেবা করে গেছেন।
সরকারিভাবে সরপঞ্চদের তথ্য সেভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি, তাই মৌখিক ইতিহাস এবং সেই
সময়ের দলিল দস্তাবেজ ও অন্যান্য প্রমানাদি ঘেটে সরপঞ্চদের ইতিহাস সংরক্ষণই ছিল আমার
গবেষণার অন্যতম উদ্দেশ্য। 
১৯৮৫ সালে আমার লেখা বাংলাদেশের উপজেলা ভিত্তিক প্রথম ইতিহাসগ্রন্থ ‘নবীগঞ্জের
ইতিকথা’, ১৯৯০ সালে ‘সিলেট বিচিত্রা‘, ‘সিলেট ও সিলেটী ভাষা’ ১৯৯৯ সালে, ‘যুক্তরাজ্যে
সিলেটবাসী’ ২০০০ সালে, ‘সিলেট নাগরী হরফে’ বাংলা ও ইংরেজী অনুবাদসহ ১৯৯৫-২০০০ সিলেটী
ভাষা শিক্ষার বই এক থেকে অষ্টম খন্ড  ‘ছিলেটী লেখা আর পড়া’, এবং সিলেট একাডেমি ইউকে
এন্ড ইউরোপ কর্তিক প্রকাশিত, ‘ঐতিহ্য’ ১৯৯৮ সালে, আমার সম্পাদিত এবং বর্তমানে
আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক ফররুখ আহমদ চৌধুরী (ফখরু) কর্তৃক সিলেট থেকে প্রকাশিত
‘সিলেট গাইড’-১৯৮৯ সালে প্রকাশিত হয়। ‘টেন সিলেটী পয়েম’ বাংলাদেশের শ্রেষ্ট দশজন মরমী
সাধকের লিখা সিলেটী নাগরী থেকে বাংলা ও ইংরেজীতে অনুদিত আমার এবং ইংরেজ গবেষক ড.
জেমস লয়েড উইলিয়ামের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশ করে লন্ডনের স্টার প্রকাশনী। আমার লেখা ও
সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ এবং বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ, ভারত, ইংল্যান্ড সহ ইউরোপের বিভিন্ন
দেশের  দৈনিক, সাপ্তাহিক পত্রিকা ও মাসিক ম্যাগাজিনে বিভিন্ন বিষয়ে নিবন্ধ আকারে
প্রকাশিত হয়েছে। আজকের নিবন্ধ সেরকমেরই গবেষণার একটি অংশ। 
ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির ঢাকা বিভাগের শ্রীহট্ট/সিলেট জেলার নবীগঞ্জ থানার
গুরুত্বপূর্ণ একটা পরগণা হচ্ছে জন্তরী পরগণা। [বাংলার প্রথম নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ (সূর্য
নারায়ণ মিশ্র) এর আমলে রাজস্ব আদায়ের সুবিধার্থে সুবে বাংলা কে ১৩টি ‘চাকলায়’ বিভক্ত
করা হয়। আবার প্রত্যেক চালকায়ে কয়েকটি রাজস্ব জিলায় ভাগ করেন। চাকলায়ে সিলেটকে ১০টি
রাজস্ব জিলায় ভাগ করা হয়। রাজস্ব জিলা গুলো হলোঃ ১. সিলেট ২. জৈন্তা, ৩.পারকুল, ৪-
তাজপুর, ৫.হিঙ্গাজিয়া, ৬. নবীগঞ্জ, ৭. রসুলগঞ্জ, ৮. লস্করপুর, ৯. শংকরপাশা, ১০.
জোয়ানশাহী। তৎকালীন সময় সিলেটের সীমানা ছিল কুমিল্লার সরাইল এবং ময়মনসিংহের
জোয়ানশাহী পর্যন্ত বিস্তৃত। এর অন্যতম দুটি রাজস্ব জিলা হচ্ছে নবীগঞ্জ ও রসুলগঞ্জ ।
নবীগঞ্জ রাজস্ব জিলায় ১৬টি পরগণা ছিল। রাজস্ব জিলা নবীগঞ্জ ও রসুলগঞ্জের  আওতাধীন
পরগনা সমূহ হলো- ১. দিনারপুর, ২. মান্দারকান্দি, ৩. চৌকি, ৪. মুড়াকরি, ৫. বানিয়াচং, ৬. কুর্শা,
৭. জোয়ার বানিয়াচং, ৮. আগনা, ৯. বিথঙ্গল, ১০. জলসুখা, ১১. জন্তরী, ১২. বাজেসুনাইত্যা, ১৩.
সত্রসতী, ১৪. জোয়ানশাহী, ১৫. বাজেসত্রসতী, ১৬. কিংকুর্শা। পরবর্তীতে বাজেসুনাইত্যা পরগণা

ভেঙে আরও একটি নতুন পরগণা গঠিত হয় ১৭. সিক সুনাইত্যা। সিক সুনাইত্যা পরগনার
তৎকালীন জমিদার ছিলেন কামারগাঁও চৌধুরী পরিবারের আদিপুরুষ শ্রীমান হরিবল্লভ চৌধুরীর
উত্তরসূরী জমিদার শ্রীমান আজিম চৌধুরী ও শ্রীমান মাছুম চৌধুরীর পূর্বপুরুষ শ্রীমান বাহরাম
খান চৌধুরী। পরগণা গুলির মধ্যে জন্তরী পরগণা গুরুত্বপূর্ণ। কারন এই পরগণার অন্তর্ভুক্ত
হাট নবীগঞ্জ মৌজায় নবীগঞ্জের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত। এই পরগণার অন্তর্ভুক্ত ছিল ৩৯
টা গ্রাম। ব্রিটিশ শাসনামলে খোদ জন্তরী গ্রামেই ২৫০ জন সরকারি চাকুরিজীবী ছিলেন। এ
থেকেই অনুমেয় তৎকালীন সময়ে জন্তরী গ্রামে শিক্ষার হার কেমন ছিল। এই পরগণার প্রথম
জমিদার ছিলেন নবীন চন্দ্র পুরকায়স্থ]। জন্তরী পরগণার অন্তর্গত ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ
একটি গ্রাম মুক্তাহার। ‘মুক্তাহার’ নামেরও একটি বিশেষত্ব রয়েছে, এই গ্রামের বিশিষ্ঠ
ব্যক্তিত্ব শ্রীমান গঙ্গারাম দাস। শ্রীমান গঙ্গারাম দাস সম্ভবত নবীগঞ্জ মুন্সেফ কোর্টের
পেশকার বা এ জাতীয় কর্মচারী ছিলেন। [“হিস্ট্রি এন্ড স্ট্যাটিস্টিক অব ঢাকা ডিভিশন” নামক
গ্রন্থে বৃহত্তর সিলেটে ৬টি মুন্সেফী আদালতের উল্লেখ রয়েছে। তন্মধ্যে নবীগঞ্জে ১টি
অন্যতম মুন্সেফী আদালত ছিল। যার আয়তন ছিল সত্রসতী পরগনার শেষ অর্থাৎ বর্তমান
মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল পর্যন্ত। নবীগঞ্জ মুন্সেফ কোর্টের অবস্থান ছিল বর্তমান
নবীগঞ্জ থানার দক্ষিণ দিকে শাখা বরাক নদীর তীরে শ্রীশ্রী কালী বাড়ি ও শ্রীশ্রী কানাইলাল
জিউর আখড়ার পাশে (১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ কালে পাক-হানাদার বাহিনী কর্তৃক ধ্বংস প্রাপ্ত
হয়ে বর্তমানে বিলুপ্ত) । ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে হবিগঞ্জ মহকুমা প্রতিষ্ঠিত হলে নবীগঞ্জের
মুন্সেফ কোর্ট বিলুপ্ত হয়ে হবিগঞ্জ মহকুমা সদরে স্থানান্তরিত হয়। উল্লেখ্য যে, নবীগঞ্জ
মুন্সেফী আদালতের শেষ মুন্সেফ ছিলেন সুরেন্দ্র নাথ ব্যানার্জি।] শ্রীমান গঙ্গারাম দাস শিল্প-
সংস্কৃতির একজন পৃষ্ঠপোষক ও সফল কৃষক ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র শ্রীমান সনাতন দাস ও
শ্রীমান দীননাথ দাস। তাঁর পুত্রদ্বয়কে তিনি পাঠশালা ও টোলে পড়াশোনা করান (তখনও এই
এলাকায় এম.ই. স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে নবীগঞ্জ যুগল-কিশোর উচ্চ
বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়)।
শ্রীমান সনাতন দাস (১৮৫৫–১৯৩৮): শ্রীমান সনাতন দাস ছিলেন ওই অঞ্চলের একজন শৌখিন
ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। পাখি শিকার ও ভ্রমন ছিল তাঁর অন্যতম শখ। সুন্দর, সুঠাম ও
শক্তিশালী গড়নের অধিকারী শ্রীমান সনাতন দাস লম্বা পাইপের (নলের) খাসার তৈরি ফস্বী
হোক্কায় তামাক টানতেন। তখনকার সময়ে গ্রাম-বাংলার মানুষের বিনোদনের উৎস ছিল
যাত্রাগান, পালাগান, ঘেটুগান ইত্যাদি। তিনি এসবের আয়োজন ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তিনি
ছিলেন শৌর্যের অধিকারী ও দূর্দান্ত সাহসী ব্যক্তি। এলাকার বিচার-বৈঠকে ছিলেন
অপ্রতিদ্বন্ধী। নিজের এলাকার বাইরেও তিনি বিচার বৈঠকে প্রশংসিত হন। তাঁর নিরপেক্ষ বিচারে
কেউ কখনো প্রশ্ন তুলতেন না। ব্রিটিশ শাসনামলের একটা সময় তিনি নবীগঞ্জ থানার ৩৯ নম্বর
সার্কেলের সরপঞ্চ নির্বাচিত হন। [ব্রিটিশ শাসনামলে নবীগঞ্জকে ৪১ টি সার্কেলে বিভক্ত করা
হয়। সার্কেলের প্রধান নির্বাহীকে সরপঞ্চ বলা হতো। সরপঞ্চ বর্তমানে ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যানের পদমর্যাদা। সরপঞ্চের পরিষদে দুইজন সরপঞ্চায়েত বা সহকারী সরপঞ্চ
থাকতেন। সরপঞ্চ বেশ কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করতেন। চৌকিদার নিয়োগ, টেক্স
কালেকশন, গ্রামীন বিরোধ নিষ্পত্তি, সালিশ-বিচার তথা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা প্রভৃতি। থানা
সার্কেল অফিসার বা প্রশাসনিক উচ্চ পদস্থ অফিসারের তত্বাবধানে সরাসরি হাত তুলার মাধ্যমে
সরপঞ্চ ও সহকারী সরপঞ্চ বা  সরপঞ্চায়েত নির্বাচিত হতেন। সরপঞ্চ দুইজন চৌকীদার
নিয়োগ দিতে পারতেন। ক্ষেত্র বিশেষে বিচার কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে সরপঞ্চ নিজস্ব
ক্ষমতাবলে ৪/৫ জন ব্যক্তিকে সালিশ কার্যে নিয়োগ করতে পারতেন। সরপঞ্চের মেয়াদ ছিল পাঁচ
বছর। ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান
সার্কেল প্রথা বিলুপ্ত করে ইউনিয়ন কাউন্সিল পদ্ধতি চালু করেন। কয়েকটি সার্কেল নিয়ে গঠন করা হয় একটি ইউনিয়ন কাউন্সিল।] শ্রীমান সনাতন দাস সরপঞ্চ (১৮৯৫ – ১৯০০) হিসেবে
সফলতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন এবং সরপঞ্চের দায়িত্ব পালন কালে তিনি অনেক সামাজিক
ও মানবিক কাজ করেন। তৎকালীন সময়ে গ্রামীণ সালিশী তথা বিচার ব্যবস্থায় এলাকায় ‘সনাতন
দাস’ ছিল এক অগ্রগণ্য নাম। সে সময়কার সমবায় সমিতি ব্যবস্থা, কৃষক উন্নয়ন ও গ্রামীণ
মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে তিনি আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার
অধিকারী ও সর্বভারতীয় কংগ্রেস দলের সমর্থক। সে সময়ে ব্রিটিশ রাজ প্রতিনিধি মহকুমা
সদরে সরপঞ্চ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গকে নিয়ে মিটিং করলে তিনিও সেই সব মিটিংয়ে
আমন্ত্রিত ব্যক্তিদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন। তাঁর স্ত্রী এক কন্যা সন্তান জন্ম দিয়ে
মৃত্যুবরন করেন।
শ্রীমান দীননাথ দাস (১৮৬০ – ১৯৪৩): শ্রীমান দীননাথ দাস ছিলেন স্বশিক্ষিত ও প্রজ্ঞাবান
ব্যক্তিত্ব। শারীরিকভাবে সুদর্শন, সুঠাম ও শক্তিশালী দেহের অধিকারী দীননাথ ছিলেন
সাহসিকতা ও বিচক্ষণতায় অনন্য। পড়তেন সাদা ধুতি ও পাঞ্জাবী। তিনিও ভ্রমণ পিপাসু এবং
যাত্রাদল সহ গ্রামীণ সংস্কৃতি বিকাশে কাজ ও পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তৎকালীন সময়ে গ্রাম-
বাংলা ছিল লোকজ সংস্কৃতির সূতিকাগার। যেখানে লোক জীবনের নানা উপাদান ছিল। দীননাথ
লোকজ সংস্কৃতির প্রতি গভীর টান অনুভব করতেন। জারি, সারি, লোকগানের আসর, যাত্রাপালা,
গ্রামীণ ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা প্রভৃতিতে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি অংশগ্রহণও করতেন। একটা
সময় সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তিনি এলাকায় সমাদৃত হন। বড় ভাইয়ের
পরবর্তীতে তিনি নবীগঞ্জ থানার ৩৯ নম্বর সার্কেলের সরপঞ্চ নির্বাচিত হন এবং সরপঞ্চ
(১৯০০ – ১৯০৫) হিসেবে দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন। শ্রীমান দীননাথ দাস ছিলেন
অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন নিরেট ভদ্রলোক। তিনি কংগ্রেসের সমর্থক হলেও
নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসুর অনুসারী ছিলেন। তাঁর দুই কন্যা ও এক পুত্র যথাক্রমে- শ্রীমতি
সরোজিনী বালা দাস, শ্রীমান দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস ও শ্রীমতি বিরহিনী বালা দাস। একমাত্র পুত্র
শ্রীমান দীগেন্দ্র চন্দ্র দাস (১৯০৫ – ১৯৭৬) প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে নবীগঞ্জ যুগল
কিশোর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাইনর পাশ করেন। তিনি ফুটবল খেলার প্রতি আগ্রহী ছিলেন বেশি।
তরুণ বয়সে তিনি খেলার জন্য তাঁর টিম নিয়ে দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চলে যাতায়াত করতেন।
লোকগীতি ও যাত্রাগান তাঁর প্রিয় ছিলো। তিনি লোকউৎসব ও যাত্রাদলের উদ্যোক্তা ও
পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। কৃষি-ভিত্তিক জীবন যাপনের পাশাপাশি তিনি তাঁর মেধা, মনন ও সাহসিকতায়
এলাকার সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবিক কাজের মাধ্যমে অনন্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী হিসেবে
সামাজিকভাবে গ্রহনযোগ্যতা ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন।


সমাজসেবার পাশাপাশি সনাতন-দীননাথ ভাতৃদ্বয় ছিলেন সফল কৃষক। তাঁদের বিশ্বাস ছিল লবন ও
কেরোসিন ছাড়া মাটিতে সবকিছুই উৎপাদন করা সম্ভব। বাড়িতে বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু
প্রজাতির ফল-ফুলের গাছ সংগ্রহ করে রোপন করতেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুগামী
ছিলেন তাঁরা।  কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কৃষি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের কর্মসূচিতে
অনুপ্রানিত হয়ে তাঁরা নিজেদের জমিতে এর প্রতিফলন ঘটান। শৌখিন এই ভাতৃদ্বয়ের নৌকা
বাইচের খুব শখ ছিল। নিজেদের ছিল শখের দৌড়ের নৌকা ও একটি দুই মাইল্লা গোস্তী নৌকা
(দুইজন মাঝি পরিচালিত গোস্তী নৌকা)। মুক্তাহার গ্রামের পূর্ব ধারের শ্রীমান কালী চরন
দাসেরও [কালী সাধু; বঙ্ক চন্দ্র দাসের (মাস্টার) জ্যেঠাতুত বড়ো ভাই] দৌড়ের নৌকা ছিল।
তখনকার দিনে বর্ষাকালের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম ছিল নৌকা বাইচ। বর্ষায় এই দুই দৌড়ের
নৌকার প্রতিযোগীতা এলাকাবাসীদের আনন্দ দিতো। আর গোস্তী নৌকায় করে তাঁরা ছয়রে
(বেড়াতে) বের হতেন। তাঁদের গোস্তী নৌকায় থাকা-খাওয়া ও গান-বাজনার ব্যবস্থা ছিল।
তৎকালীন সময়ে মুক্তাহার গ্রামের যে সকল গুণীজনেরা অত্র এলাকার সামাজিক কার্যক্রমে

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

ভূমিকা রাখতেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন- শ্রীমান গোলক দাস, শ্রীমান কালীচরণ দাস
(কালী সাধু), শ্রীমান গরি দাস (গরি সরকার), শ্রীমান বিশ্বনাথ দাস (মাস্টার), শ্রীমান কুরু দাস,
শ্রীমান প্রহল্লাদ দাস (মাস্টার) প্রমুখ।
ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সুসন্তান সনাতন-দীননাথ ভাতৃদ্বয়ের পারিবারিক ও কর্মজীবনের বেশ কিছু
অমূল্য স্মারক, ছবি ও তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ দলিল দস্তাবেজ ছিল। যে গুলো ১৯৭১ সালের মহান
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাঁদের উত্তরসূরীদের দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া এবং রাজাকার কর্তৃক
বাড়িঘর লুটপাটের ফলে সবকিছু নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। তবে তাঁদের নাম এখনো মুছে যায় নি।
ইতিহাসের ধূসর পান্ডুলিপি থেকে এখনো জাগরুখ রয়েছে ক্ষণজন্মা দুই সহোদরের নাম। শ্রীমান
দীননাথ দাসের প্রৌপুত্রদ্বয় তরুন লেখক ও গবেষক রত্নদীপ দাস (রাজু) ও রত্নেশ্বর দাস
(রামু) কর্তৃক নবীগঞ্জ উপজেলার মুক্তাহার গ্রামে প্রতিষ্ঠিত ‘বীর মুক্তিযোদ্ধা শ্রী রবীন্দ্র
চন্দ্র দাস গ্রন্থাগার’- এ এই দুই কীর্তিমানদের স্মরণে গ্রন্থাগারের পাঠকক্ষের নাম ‘সনাতন-
দীননাথ পাঠকক্ষ’ নামকরন করা হয়েছে। যা চমৎকার একটা পদক্ষেপ। আমি গ্রন্থাগার
কর্তৃপক্ষকে আন্তরিক সাধুবাদ জানাই। যে দেশ ও জাতি তার পূর্বপুরুষদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য
সংরক্ষণ করে, সে দেশের জাতীয় ইতিহাস ততটাই সমৃদ্ধ হয়। আর এভাবেই আমাদের দেশের
প্রত্যন্ত অঞ্চলে সুশাসন, সাম্য, ন্যায় প্রতিষ্ঠা এবং আবহমান গ্রাম-বাংলার সাংস্কৃতিক
ঐতিহ্য সুসংহত রাখার মাধ্যমে দেশকে আলোকিত করা একেকজন সনাতন-দীননাথেরা আপন
আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে থাকবেন প্রজন্মান্তরে।

লেখক: ইউরোপ ব্যুরো চিফ, বার্তা সংস্থা এনএনবি। সাবেক প্রেসিডেন্ট, ইউকে বাংলা
রিপোর্টার্স ইউনিটি। সাবেক সেক্রেটারী, লন্ডন বাংলা প্রেসক্লাব। প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ
হিউম্যান রাইটস কমিশন, ইংল্যান্ড।

তথ্য ঋণ: বিভিন্ন সময়ে তথ্য দিয়েছেন- বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু শ্যামাপ্রসন্ন দাশগুপ্ত (বিধুবাবু;
সাবেক জমিদার ও চেয়ারম্যান, গ্রাম: গুজাখাইড়, নবীগঞ্জ), জনাব আব্দুল আজিজ চৌধুরী
(শিক্ষাবিদ, গণপরিষদ সদস্য, গ্রাম: চরগাঁও, নবীগঞ্জ), জনাব মুহাম্মদ নূরুল হক (ভাষা সৈনিক;
প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক, কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ, সিলেট এবং সিলেট অঞ্চলের
প্রাচীণতম মাসিক আল ইসলাহ এর সম্পাদক), জনাব মনির উদ্দিন চৌধুরী (ইতিহাস বেত্তা;
গ্রাম: জহিরপুর, জগন্নাথপুর, সুনামগঞ্জ), বাবু যোগেন্দ্র চন্দ্র দাস (মাস্টার; গ্রাম:
মুক্তাহার, নবীগঞ্জ), শ্রীযুক্ত রূপেশ চক্রবর্তী (রূপেশ ঠাকুর; বিশিষ্ট ব্যক্তি, গ্রাম:
মুক্তাহার, নবীগঞ্জ), বাবু ভাগ্যেশ্বর দাস (ভাগ্যেশ্বর বাবু; সাবেক নবীগঞ্জ থানা আওয়ামীলীগ
নেতা, গ্রাম: মুক্তাহার), ডা. কুটিশ্বর দাস (কুটিশ্বর বাবু; সাবেক চেয়ারম্যান, ৭নং করগাঁও
ইউনিয়ন, গ্রাম: মুক্তাহার, নবীগঞ্জ), বাবু চূড়ামণি দাস (চূড়ামণি সরকার; বিশিষ্ট ব্যক্তি,
গ্রাম: মুক্তাহার, নবীগঞ্জ), বাবু লক্ষ্মী কান্ত দাস (মাস্টার; গ্রাম: মুক্তাহার, নবীগঞ্জ), বীর
মুক্তিযোদ্ধা রবীন্দ্র চন্দ্র দাস (মাস্টার; গ্রাম: মুক্তাহার, নবীগঞ্জ, শ্রীমান দীননাথ দাসের
নাতি) প্রমুখ।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments