Saturday, February 22, 2025
Homeইতিহাস ঐতিহ্যমধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক এবং আধুনিক সার্জারির জনক আবুল কাসিম আল জাহরাউয়ি

মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক এবং আধুনিক সার্জারির জনক আবুল কাসিম আল জাহরাউয়ি

মোহাম্মদ মোশাররফ হুসাইন

মোহাম্মদ মোশাররফ হুসাইন

আল জাহরাউয়ি তখন আন্দালুসিয়ানে খলিফা দ্বিতীয় আল হাকামের রাজচিকিৎসক হিসেবে কাজ করছেন। আল হাকামের রাজসভায় তিনি দীর্ঘদিন কাজ করেছিলেন। আর এখানে থাকাকালীনই তিনি তার জীবনের শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘কিতাব আল তাশরিফ’ রচনার কাজ শেষ করেন। এই গ্রন্থ বদলে দিয়েছিল মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের ধারা। সে সময়কার মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের জন্য তার ত্রিশ খণ্ডের এই বিশ্বকোষটি ছিল অক্সিজেনস্বরূপ। সার্জারি থেকে শুরু করে মেডিসিন, ফার্মাকোলজি, অপথ্যালমোলজি, অর্থোপেডিকস, প্যাথলজি, দন্তবিজ্ঞান, পুষ্টিবিজ্ঞান, শিশু চিকিৎসা- সবই অন্তর্ভুক্ত ছিল আল তাশরিফের ত্রিশ খণ্ডে। ১০০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে এই মহাগ্রন্থ রচনার কাজ শেষ করেন আল জাহরাউয়ি। সে বছরই খলিফার সহায়তায় বইটি প্রকাশিত হয়। ত্রিশ খণ্ডের এই বিশ্বকোষের প্রথম খণ্ডটি ‘জেনারেল প্রিন্সিপালস অব মেডিসিন’ বা চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রাথমিক বিষয়গুলো দিয়ে সাজিয়েছেন তিনি। একজন চিকিৎসকের প্রাথমিকভাবে চিকিৎসার কাজ শুরু করতে যতটুকু মৌলিক জ্ঞান প্রয়োজন, তার পুরোটাই (মধ্যযুগীয় চিকিৎসাবিজ্ঞানের তুলনায়) এই খণ্ডে সংযোজন করেছেন জাহরাউয়ি। আর এর পরের খণ্ডেই তিনি প্যাথলজি বা রোগবিদ্যার সাথে ঔষধ প্রস্তুতির সমস্ত তথ্য-উপাত্ত যোগ করে দিয়েছেন। আল তাশরিফের এই খণ্ডটিকে অনেকেই মধ্যযুগের ফারমাকোলজি বা ঔষধবিজ্ঞানের বাইবেল বলে অভিহিত করেন।

আল-তাশরিফের শেষ এবং সবচেয়ে বড় খণ্ডটি শল্যচিকিৎসা নিয়ে রচিত। চিকিৎসক হিসেবে নিজের পুরো ক্যারিয়ারের অভিজ্ঞতাকে ‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস’ নামক এই খণ্ডে একত্র করেছেন আল জাহরাউয়ি। তার আল-তাশরিফ গ্রন্থটি মূলত বিশ্বনন্দিত হয়েছিল এই খণ্ডটির জন্যই। এতে তিনি দুই শতাধিক অস্ত্রোপচারের বর্ণনা দেন, যা সে সময়কার চিকিৎসকদের বিস্ময়ে বিমূঢ় করে দেয়। অবশ্য, আজকের সময়ে বসেও সেগুলো দেখলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না। তিনি নিজেও মূলত একজন শল্যচিকিৎসকই ছিলেন। নিউরোসার্জারি এবং নিউরোলজিক্যাল চিকিৎসায়ও জাহরাউয়ির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, পুরো ইসলামি স্বর্ণযুগে কোনো মুসলিম চিকিৎসককে যদি আলাদা করে নিউরোসার্জন বলতে হয়, সেটা কেবল জাহরাউয়িকেই বলা যায়।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

পৃথিবীর প্রথম হাইড্রোসেফালিক সমস্যার সমাধান করার কৃতিত্ব দেয়া হয় জাহরাউয়িকে। মানুষের মাথার ক্রেনিয়াল ক্যাভিটি থেকে ‘সেরেব্রোস্পাইনাল ফ্লুইড’ বা সিএসএফ নামক একপ্রকার তরল নির্গত হয়, যা মস্তিষ্ককে ঘিরে রাখে। হাইড্রোসেফালিক সমস্যা তখন হয়, যখন এই সিএসএফ তরল মস্তিষ্ক থেকে বেরিয়ে যেতে পারে না। ফলে এটি খুলির মধ্যে জমা হতে থাকে এবং শিশুদের মাথার আকৃতি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। কেননা শিশুদের খুলির অস্থিগুলো পরিপক্ক এবং একীভূত নয়। অন্যদিক প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে মাথার আকৃতি বাড়তে পারে না এবং প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হয়। এই সমস্যাকে অনেক সময় ‘মাথায় পানি জমা’ও বলা হয়। জাহরাউয়ি তার গ্রন্থে এই সমস্যার অস্ত্রোপচারের কথা সবিস্তারে লিখেছেন।

‘অন সার্জারি অ্যান্ড ইনস্ট্রুমেন্টস’ খণ্ডটিকে বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সচিত্র ‘সার্জিক্যাল গাইড’। এটি চিকিৎসাবিজ্ঞানে প্রযুক্তির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। আল জাহরাউয়ি এখানে কোন অস্ত্রোপচারে কোন বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করতে হবে, তা সবিস্তারে লিখেছেন, যা পরবর্তী কয়েক শতাব্দী জুড়ে ইউরোপীয়রা আদর্শ হিসেবে ব্যবহার করেছে। শল্যচিকিৎসায় প্রয়োজন হয় এমন প্রতিটি যন্ত্রের পৃথক পৃথক ডায়াগ্রাম এঁকে সেটিকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, তা স্পষ্ট করে বুঝিয়ে দিয়েছেন তিনি। বর্ণনাগুলো এতটা প্রাঞ্জল যে, কোনো সাধারণ মানুষও সেগুলো পড়ে শল্যচিকিৎসা শিখে ফেলতে পারবেন! জাহরাউয়ির মূল উদ্দেশ্য ছিল মেডিকেল শিক্ষার্থীদের জন্য শল্যচিকিৎসা শেখা সহজ করে দেয়া। সে উদ্দেশ্যে তিনি দারুণভাবেই সফল হয়েছিলেন। তার এই গ্রন্থ, আরব বিশ্ব ছাড়িয়ে ইউরোপের সকল বিখ্যাত মেডিকেল কলেজগুলোতে প্রায় ৫ শতাধিক বছর প্রধান পাঠ্যপুস্তক হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

ইউরোলজিতে জাহরাউয়ির অবদান লিথোটমি। তিনি মূত্রথলীর পাথর অপসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি ‘মিশাব’ নামক একটি যন্ত্র তৈরি করেন, যা কিনা অনেকটাই আধুনিক যুগের লিথোট্রাইটের অনুরূপ। এই যন্ত্র দিয়ে তিনি কোনো কাটাছেঁড়া ছাড়া মূত্রথলীর ভেতরেই পাথর ভেঙে ফেলতে পারতেন। তিনি ব্রোঞ্জ এবং রূপা দিয়ে দাঁত বাঁধাই করতেন। তাকেই বলা হয় পৃথিবীর প্রথম সফলভাবে দাঁত ‘ট্রান্সপ্ল্যান্ট’ করা চিকিৎসক। এসব অস্ত্রোপচারে তিনি ২০০ এর অধিক সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর একটি বড় অংশ আজও ব্যবহৃত হচ্ছে।

মধ্যযুগে আরব বিশ্বে এবং ইউরোপে, শল্যচিকিৎসার জন্য সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় নামটি ছিল আবুলকাসিস তথা আল জাহরাউয়ি। ১৪ শতকে ডাক্তারি করা ফ্রান্সের সর্বশ্রেষ্ঠ শল্যচিকিৎসক গাই ডি কলিক অকপটে জাহরাউয়ির শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করেছেন। রেনেসাঁর সময়ের আরেক বিখ্যাত শল্যচিকিৎসক পিয়েত্রো আরগালাতা তার সম্বন্ধে বলেছেন, “নিঃসন্দেহে তিনি সকল শল্যচিকিৎসকদের মাস্টার!” কর্ডোভায় যে গলিতে তিনি বসবাস করতেন, সে গলিটির নামকরণ করা হয়েছে ‘আবুলকাসিস স্ট্রিট’। এমনকি যে বাড়িটিতে তিনি বসবাস করতেন, সে বাড়িও সংরক্ষণ করেছে স্পেন সরকার। আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক এই মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীর বাড়ির সামনে একটি ব্রোঞ্জ প্লেট লাগানো আছে, যাতে লেখা, “এটিই সেই বাড়ি, যেখানে আল জাহরাউয়ি বসবাস করতেন।” সর্বোপরি, শল্যচিকিৎসা আলাদা করে না বলে, চিকিৎসাশাস্ত্রই আল জাহরাউয়ির নিকট ঋণী বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না।

Source-

Mulim’s contribution to science and technology

Wikipedia.

আমাদের অনুপম সভ্যতা- মুস্তফা সীবায়ী

1001 inventions : The Enduring legacy of Muslim civilization

Facebook Comments Box
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments