সাদা কাপড়ে দাগ লাগে বেশি। অল্প লাগলেও বেশ চোখে পড়ে। এটা পুরোপুরি সাদা কাপড়ের দোষ নয়। সে সাদা হয়েছে বলে চারদিক থেকে হুটহাট করে দাগ লাগবে আর সব দোষ তার উপর চাপানো হবে বিষয়টা মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়।সাদা কাপড় হয়েছে বলে সে নিশ্চই চারদিকে নজর রেখে চলাফেরা করবে কিন্তু চেয়ারের সিটে ঘাপটি মেরে বসে থাকা ময়লা যে তার গায়ে লাগবে না সেটার নিশ্চয়তা কে দিবে?এই আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী আরাভ লোকটাও তেমনই ময়লা যা খালি চোখে দেখা যায় না। তার চাকচিক্য আর আভিজাত্যর আড়ালে যে সে একজন খুনী এটা কে বুঝবে?
আমার বন্ধু সাকিব আল হাসান হলো সেই সাদা কাপড়ের মত। একটুতে একটু হলেও দাগ লেগে জাত গেলো জাত গেলো অবস্থা হয়।আমার অন্য বন্ধুরা বলে সাকিব হিমসেলফ ইজ আ ব্র্যান্ড।কথাটাতো ভুল নয়।তবে বন্ধু হিসেবে আমি এটাও স্বীকার করি সে ধোয়া তুলসীপাতা নয়।কিন্তু তাকে যেভাবে নানা সময়ে দোষারোপ করা হয় তা দেখে আমার হাসি পায়। এই যেমন দুবাইয়ের ঘটনাকে কেন্দ্র করে কত আলোচনা সমালোচনা হচ্ছে। আমারতো মনে হয় এ ক্ষেত্রে সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলমের সমালোচনা না করে বরং পুলিশ ও মিডিয়ার উচিত তাদেরকে ধন্যবাদ দেওয়া।
কেন ধন্যবাদ দিতে হবে? কারণ পুলিশ এবং মিডিয়ার কারো কাছে কোনো তথ্য ছিল না এই খুনী লোকটা কোথায় কোন অবস্থায় আছে। সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলম তার আমন্ত্রণে দুবাই গিয়েছে বলেই না সবার টনক নড়েছে। সবার মনে প্রশ্ন জেগেছে কে এই লোক যে তার স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে বিশ্ব সেরা অলরাউন্ডার সাকিব আল হাসান সহ নামি দামী ও আলোচিত সেলিব্রেটিদের গাটের টাকা খরচ করে দুবাইয়ের মত ব্যয়বহুল শহরে নিয়ে যাচ্ছে।
বাংলায় প্রবাদ আছে “ কেঁচো খুড়তে সাপ বের হওয়া” এখানেও হয়েছে তাই। সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলম যদি ওই আমন্ত্রণে না যেতেন তাহলে কি আপনারা জানতে পারতেন বা এই লোক সম্পর্কে খোঁজ নিতেন? এভাবে থলের বিড়াল বের হতো? মোটেই হতো না। এর পুরো কৃতীত্ব তাই সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলমকে দেওয়া উচিত। পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তা তারা করতেই পারে। যেহেতু আইন তাদের,ক্ষমতাও তাদের। কিন্তু আমি যদি প্রশ্ন তুলি সাকিব আল হাসান বা হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে আপনাদের গোয়েন্দাবিভাগের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলুন। তারা এতোদিন কী করেছে যে একজন খুনীর আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে,দেশ থেকে বিদেশে গিয়ে ঘাঁটি গেড়েছে অথচ আপনাদের কাছে তার কোনো তথ্যই নেই।
সাকিব আল হাসান পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের কেউ নন এবং আইন শৃঙ্খলাবাহিনীরও কেউ নন, এমনকি সাংবাদিকও নন। তিনি একজন সেলিব্রেটি ক্রিকেটার। তাঁরতো জানার কথা না কে কখন কাকে খুন করে বিদেশে পালিয়ে গিয়ে বিরাট ধনী হয়েছে।এই দায়িত্ব ছিল আমাদের প্রশাসনের। তারা কেন সব চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও খুনীদের নাম এবং ছবি প্রকাশ করে না? তাহলেতো সবাই মোটামুটি তাদের সম্পর্কে জানতে পারে এবং সচেতন হয়। যদি আপনারা আগে থেকে বলতেন যে হে সাকিব আল হাসান, হে হিরো আলম! আপনারা যার আমন্ত্রণে যাচ্ছেন তিনি একজন খুনী। তাহলে সাকিব আল হাসান বা হিরো আলম অতোটাও বোকা না যে কিছু টাকার লোভে পড়ে নিজেদের সম্মানের দিকে না তাকিয়ে সুড়সুড় করে দুবাই গিয়ে হাজির হবে। আমারতো মনে হয় এই দেশে যে কয়জন মাথাওয়ালা,বুদ্ধিমান মানুষ আছে তাদের মধ্যে সাকিব আল হাসান অন্যতম।
একজন সেলিব্রেটিকে যে কেউ তার একটি অনুষ্ঠানে পেতে চাইতেই পারে। আর সেলিব্রেটি মানুষটির এতোটাও সুযোগ নেই যে সেই লোকটি সম্পর্কে পুরো তদন্ত করে নিশ্চিত হয়ে তারপর তাকে হ্যাঁ অথবা না বলার। সেলিব্রেটিদের এক বা একাধিক এজেন্ট থাকে। কেউ সেই সেলিব্রেটির সাথে কোনো কন্টাক্ট করতে চাইলে প্রথমে সেই এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করে। এজেন্ট বিস্তারিত জেনে সেলিব্রেটিকে জানায় তারপর লেনদেনের বিষয়ে কথা হয় এবং যদি ওই একই সময়ে আগে থেকে কোনো শিডিউল দেওয়া না থাকে তবে শিডিউল দেওয়া হয়।
এই আলোচিত স্বর্ণব্যবসায়ী যে কিনা খুনের আসামী হয়ে পালিয়ে গেছে সেই লোকটা এখন প্রচুর টাকাপয়সার মালিক।সেও একই ভাবে সাকিব আল হাসানের সাথে যোগাযোগ করেছে। সাকিব আল হাসানের নিশ্চই জানা ছিল না লোকটি খুনের আসামী। তাছাড়া তারঁ পক্ষে জানা সম্ভবও নয়। বিশ্বাস হচ্ছে না? আপনি যদি নিজে পুলিশ হয়ে থাকেন বা সাংবাদিক হয়ে থাকেন তবে আপনি কি এই দেশের সব সন্ত্রাসী,খুনী আসামী সম্পর্কে জানেন? খবর রাখেন? ফলে এই ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে।
এর আগেই আমি বলেছি এই ঘটনায় সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করার আগে নিজেদেরকেই একবার নিজেরা প্রশ্ন করুন যে আপনারা কেন এতোদিন এই খুনী সম্পর্কে কোনো খোঁজ রাখেননি? কেন তার সন্ধান পাননি? এখন যে “রে রে জাত গেলো” বলে সবাই গলা ফাটাচ্ছে সেটাওতো সাকিব আল হাসানের কল্যাণেই হয়েছে। কিছু না হোক লোকটার সন্ধানতো মিলেছে।
কাকতালীয় কি না তা বলতে পারবো না, তবে নেটফ্লিক্সে বলিউড নির্মিত একটি চলচ্চিত্র দেখেছিলাম গত মাসে। সাকিব আল হাসানের এই ঘটনার প্রায় হুবহু একটি ঘটনা সেখানে দেখেছি। সিনেমার নাম একশন হিরো। এখানে সাকিব আল হাসানকে আমন্ত্রণ করা হয়েছে আর সিনেমায় নায়ককে কিডন্যাপ করা হয়েছিল।দুজনই সেলিব্রেটি। যে কিডন্যাপ করেছিল সে ছিল এক ডন। যেন তেনো ডন না বরং ইন্ডিয়ার মোস্টওয়ান্টেড ক্রিমিনাল। সবাই জানতো ওই ক্রিমিনাল বেঁচে নেই। কিন্তু নায়কে সেই ডন তার এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে নাচাবেন বলে কিডন্যাপ করে নিয়ে যায় এবং তার সাথে ছবি তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় দিয়ে দেওয়ার পর ঘটনাটা পুলিশের নজরে আসে।ঠিক একই রকম ঘটনা ঘটেছে সাকিব আল হাসানের ক্ষেত্রে। এতোদিন যে খুনীর কোনো সন্ধানই পুলিশ জানতো না, সেই খুনীর কথা আমরা সাকিব আল হাসানের কারণে জানতে পেরেছি।
ওই সিনেমায় অবশ্য নায়ককে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি কিন্তু সাকিব আল হাসানকে করা হবে।এই যে ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম এবার প্রসঙ্গে আসি। সাকিব আল হাসান দুবাই গিয়েছে মাত্র গতদিন।তার সাথে চুক্তি হয়েছে কিন্তু বেশ আগে। আর সেই চুক্তি হওয়ার পর এই স্বর্ণব্যবসায়ী খুনের আসামী দুবাইয়ে বসে সাকিব আল হাসান এবং হিরো আলমকে দিয়ে ভিডিও বানিয়ে তা নিজের ফেসবুকে শেয়ার করেছে। সেটাও কিন্তু গত মাসে মানে ফেব্রুয়ারিতে! পুরো একমাস পার হয়ে গেল আর পুলিশের চোখে পড়লো না? এ কেমন কথা? কিন্তু আমরা কিছু লিখলেই তখনতো ঠিকই আমাদেরকে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে তুলে নিয়ে লকাপে পুরে রাখেন।আমরাতো প্রাণ খুলে লিখতেও পারি না আপনাদের ভয়ে। অন্যদিকে মাননীয় প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে গত সপ্তাহে বলেছেন দেশে কথা বলার স্বাধীনতা আছে বলেই নাকি আমরা টকশোতে কথা বলি। কিন্তু আসলেই কি আমরা টকশোতে সেভাবে বলতে পারি?
প্রসঙ্গের বাইরে গিয়ে দুটো কথা লেখা দরকার। সাকিবের অনেক দোষ আছে। সে কেন বিশ্ব সেরা হলো? আমরা কেন হতে পারলাম না? সে কেনো এতো টাকার মালিক হলো? আমরা কেন হতে পারলাম না? সে কেনো এতো জনপ্রিয় এতো বড় সেলিব্রেটি? আমরা কেন হতে পারলাম না? তাকে কেন দুবাইতে আমন্ত্রণ করা হলো? আমাদেরকে কেন করা হলো না? এ যেন আমাদের আজীবনের আক্ষেপ। অন্য কারো উন্নতি আমরা সহজে মেনে নিতে পারি না। ফলে তার মধ্যে শুধু দোষ খুঁজি।শুধু সাকিব আল হাসানই নয় বরং ডক্টর মুহম্মদ ইউনুস থেকে শুরু করে আরো অনেকের ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটতে দেখেছি। যে মানুষ সম্পর্কে কারো কোনো দ্বিমত ছিল না,যার সাথে ওঠাবসায় কোনো সমস্যা ছিল না সেই একই মানুষ কী এমন করে ফেললো যে রাতারাতি ভোল পাল্টে গেল?
অপ্রাসঙ্গিক হলেও সাবেক প্রধান বিচারপতি সিনহার কথাও টেনে আনা যেতে পারে। আমাদের দেশের প্রেক্ষিতে প্রধান বিচারপতির মত এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ পদ সব সময় মূলত দলীয় বিবেচনাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। আমি যতটুকু আইন আদালত সম্পর্কে জানি,খোঁজ খবর রাখি তাতে আমার বেশ মনে পড়ে এই সিনহাকে নিয়ে সরকার খুবই সন্তুষ্ট ছিল।বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময়টাতে। সেই সিনহা এমন কি করলো যে রাতারাতি হিরো থেকে ভিলেন হয়ে গেল? ডক্টর ইউনুসও তাই। সারা বিশ্ব তাকে রোল মডেল মনে করে সম্মান দেয়,আমরাও দিতাম। কিন্তু হুট করে কী এমন করলেন যার দরুন তার প্রতি আমাদের বিদ্বেষের শেষ নেই? লিখলে কত কথাইতো লেখা যায়। কিন্তু সেসব লিখে আর লাভ কী? “বিচার মানি কিন্তু তালগাছটা আমার” বলে যে কথাটা আমরা প্রায়ই শুনেথাকি তা পুরোপুরি বাস্তবের সাথে সম্পৃক্ত। এখন আমরা যাই বলি,যাই লিখিনা কেন সেগুলো ততোক্ষণ পযর্ন্ত ঠিক আছে যতক্ষণ পযর্ন্ত স্বার্থে আঘাত লাগবে না।
স্বর্ণের দোকান উদ্বোধনের আলোচিত এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আমি মনে করি সাকিব আল হাসান বা হিরো আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করার বদলে বরং পারলে চেষ্টা করুন ওই দেশ থেকে খুনীটাকে ধরে আনতে। পারলে চেষ্টা করুন পিকে হালদারকে ধরে আনতে।পারলে চেষ্টা করুন সাগর রুণীর হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে। চেষ্টা করুন যারা ব্যাংক লুটের সাথে জড়িত তাদের ধরতে। সাকিব আল হাসানতো চিনিয়ে দিয়েছে,দেখিয়ে দিয়েছে আপনাদের কাছে মৃতপ্রায় বা অজ্ঞাত খুনীটা দিব্যি বেঁচে আছে এবং ব্যবসা করছে। এবার তাকে আপনাদের ক্ষমতাবলে ধরে এনে শাস্তি দিন।বিদেশে কারা কারা টাকা পাচার করেছে,কিভাবে পাচার করেছে তাদের তালিকা প্রকাশ করুন এবং সেই সব টাকা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করুন।
এমনকি ১৯৯০ সালে দেশের প্রথম ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার কথাও মনে করিয়ে দিতে চাই। সেবার ৫০ লাখ টাকা চুরি হয়েছিল যা আলোচনার শীর্ষে ছিল। সেই ফাঁকে ওই ঘটনার পরদিন পুলিশের দুটো স্টেনগান ছিনতাই হয়েছিল তা কেন এতোদিন গোপন ছিল?
আর সাংবাদিক ভাইয়েরা আপনারাও চেষ্টা করুন সাকিব আল হাসান বা পরীমণিরা কিছু উন্মোচন না করা পযর্ন্ত আপনারা যে কিছুই খুঁজে বের করতে পারেন না সেই ব্যর্থতার দায় স্বীকার করে নড়েচড়ে বসুন।
যাই হোক অনেক কিছু লিখলাম যা লেখা সঙ্গত না তাও লিখলাম। আগামী কাল স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিনে সবাইকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা।
১৬ মার্চ ২০২৩