পঙ্কজ শীল
মৃৎশিল্প মানব সভ্যতার প্রাচীনতম শিল্পগুলোর মধ্যে একটি, যা আজও সংস্কৃতি, ধর্ম ও শৈল্পিক ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি মূলত মাটি দিয়ে তৈরি শিল্পকর্ম, যার মধ্যে প্রতিমার নানান অলঙ্কারিক সামগ্রী অন্তর্ভুক্ত। বিশেষত ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে মাটির প্রতিমার ব্যবহার ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করা যায়। দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা, কালীপূজাসহ বিভিন্ন পূজা-পার্বণে মৃৎশিল্পীদের হাতে গড়া মাটির প্রতিমার গুরুত্ব অপরিসীম।
বাংলাদেশ ও ভারতের গ্রামীণ সমাজে মৃৎশিল্প দীর্ঘদিন ধরে জীবিকা ও ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে টিকে আছে। কুমোর সম্প্রদায়ের কারিগররা নিপুণ দক্ষতায় মাটি থেকে আকর্ষণীয় প্রতিমা তৈরি করেন, যা কেবল ধর্মীয় প্রয়োজনেই নয়, শৈল্পিক সৌন্দর্যের জন্যও সমাদৃত। তবে প্লাস্টিক ও অন্যান্য আধুনিক সামগ্রীর কারণে মৃৎশিল্প আজ কিছুটা সংকটে পড়েছে। তবুও পরিবেশবান্ধব ও ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পের গুরুত্ব অনস্বীকার্য।
বর্তমানে মৃৎশিল্প সংরক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য নানান উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, যাতে এটি নতুন প্রজন্মের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সৃজনশীলতা ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন হিসেবে মৃৎশিল্প আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক-বাহক হয়ে টিকে থাকবে।
তেমনই একজন কলেজ পড়ুয়া তরুণ মৃৎশিল্পীর অবদান আপনাদের কাছে তুলে ধরব-
সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার সাচনা চৌধুরী বাড়ি সংলগ্নতে ১ জুলাই ২০০৬ সালে জন্ম নেওয়া এক তরুণের নাম পাপন পাল। পিতা প্রতিমাশিল্পী মধু পাল ও মাতা অর্চনা রানী পাল। খুব ছোটবেলা থেকেই প্রতিমাশিল্পী বাবার কাছ থেকে মাটির বুনন ও রংতুলির আঁচড়ে প্রতিমাশিল্পের সর্বপ্রথম হাতেখড়ি হয় তাঁর। ব্যস্ত বাবা যখন বিভিন্ন পুজার প্রতিমা তৈরি করতেন, তখন ছোট্ট পাপন পাল চোখের পলকে তা দেখে নিতো, কিভাবে তাঁর বাবা মাটির দলা দিয়ে প্রতিমা তৈরির পর রংতুলি দিয়ে রং করতেন। ২০১৯ সালে ষষ্ঠ শ্রেনীতে থাকাকালীন সময়েই খুব মনযোগ ও চোখের পলক না ফেলা চেষ্টা দিয়ে প্রতিমাশিল্প আয়ত্ত করতে পারতো পাপন পাল। পাপন ২০২৪ সালে সাচনা বাজার উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ব্যবসায় শাখায় এসএসসি পাস করে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয় জামালগঞ্জ সরকারি কলেজে। মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া এই তরুণের প্রতিমাশিল্প নেশা থেকে পেশায় পরিনত হয়েছে। ধীরে ধীরে তার বাবার কাজের সহযোগিতার পাশাপাশি এখন সে নিজেই এখন পাকাপোক্ত প্রতিমাশিল্পী। ধরেছে সংসারের হালও। একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা ছাড়াও সে সংসারের খরচ বহনসহ আরও দুই ভাইবোনের পড়াশোনার খরচ বহন করে দায়িত্ব পালনে ব্যস্ততম সময় পাড় করছে। ছোটভাই পঙ্কজ পাল সাচনা বাজার উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে এবং ছোটবোন প্রমা রানী পাল সাচনা আদর্শ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ছে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি, প্রতিমাশিল্পে সময় দিয়ে সংসারের হাল ধরা সাধারণ কথা নয়। এই অসাধারণ সাধ্যকে খুব সহজেই সাধন করে চলছে পাপন পাল।
প্রতিমাশিল্পের জন্য তার মা-বাবা,ভাইবোন, আত্মীয়স্বজনদের পাশাপাশি কলেজ সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকেও সবসময়ই উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা পায়।
পাপন জানায়, ২০২৪ সালে ৭৬ টি সরস্বতী প্রতিমা, ৬২ টি মনসা, ১২ টি কালী প্রতিমাসহ তাঁর ৬ বছরের অবদানে এই পর্যন্ত ৪২০ টি সরস্বতী প্রতিমা,
৩৭২ টি মনসা, ৭২টি কালীসহ ৫ টি দুর্গা প্রতিমা তৈরি করেছে। যা বড় বড় প্রতিমাশিল্পীর সমান প্রায়। এ-ই বয়সে দক্ষতার সঙ্গে প্রতিবছর বিভিন্ন পুজো ও ধর্মীয় উৎসবে নিয়মিত প্রতিমা তৈরি করে থাকে পাপন পাল। শুধু তাই নয়, প্রতিমাশিল্পের পাশাপাশি পাপন শখের বশে বিভিন্ন ছবিও আঁকে। পাপন চায় পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিমাশিল্পের উপর নির্ভর করে চলতে । তার ভাষ্যমতে বেকারত্ব করুণ এক অভিশাপ, বন্ধুদের সাথে বাজে আড্ডা ও সময় নষ্ট করার চেয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি প্রতিমাশিল্পে সময় দেয়া ইতিবাচক বিষয়। সে বেকারত্বকে দূরে ঠেলে ভালোভাবে জীবনযাপন ও পড়াশোনা করতে চায়। প্রতিমাশিল্পে কাজ করেই পড়াশোনা শেষ করে একজন ব্যাংকার হওয়ার স্বপ্ন দেখে পাপন পাল। পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত এইশিল্প যত্নের সাথে করতে চায়। প্রতিমাশিল্প নিয়ে পাপনের বড় স্বপ্ন হলো,সে দেশের বাইরে কোনো একদিন প্রতিমা তৈরি করবে। সেটা বিশ্বের যেকোনো দেশেই হোক না কেনো।
প্রতিমাশিল্প কেবল ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন নয়, এটি শিল্প, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক অনন্য বহিঃপ্রকাশ। মাটির প্রতিমা তৈরির প্রক্রিয়ায় শৈল্পিক দক্ষতা, ধৈর্য ও সৃজনশীলতার সমন্বয় ঘটে, যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে কুমোর সম্প্রদায়ের কারিগরদের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে। দুর্গাপূজা, সরস্বতীপূজা, কালীপূজার মতো ধর্মীয় উৎসবগুলোতে মাটির প্রতিমার ব্যবহার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রতীক হয়ে উঠেছে।
শিল্পটির পুনর্জীবিত করার প্রচেষ্টা হোক, যাতে প্রতিমাশিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীরা তাদের জীবনধারণ করতে পারেন এবং শিল্পটি টিকে থাকে। প্রযুক্তির সহায়তায় নতুন ডিজাইন ও বিপণন কৌশল গ্রহণ করলে প্রতিমাশিল্প আধুনিক বাজারেও নিজের স্থান ধরে রাখতে পারবে। আমাদের উচিত এই ঐতিহ্যবাহী শিল্পকে সম্মান জানানো এবং এর সংরক্ষণে সচেষ্ট হওয়া, যাতে ভবিষ্যত প্রজন্মও এর সৌন্দর্য ও গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারে।