বাবা তুলসি দাস একজন স্নুকার খেলোয়াড়। প্রায় প্রতি বছরই স্নুকার ক্লাব চ্যাম্পিয়ণশীপে খেলেন এবং ফাইনালেও ওঠেন। তবে ভাগ্য সহায় না হওয়ায় কোনোদিন চ্যাম্পিয়ন হতে পারেননি। সব ম্যাচ ভালো খেললেও কেন যেন ফাইনালে সব তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তুলসি দাসের বদঅভ্যাস হলো প্রচুর মদ খান। মাতাল হয়ে কি আর ফাইনাল জেতা যায়? পাশে বসে বসে নিরব দর্শক হিসেবে তুলসি দাসের দুই ছেলে এবং স্ত্রী তার হার দেখে। ছোট ছেলেটির মন খারাপ হয় সবচেয়ে বেশি। বাবার সাথে সেইতো নিয়মিত খেলা দেখতে আসে। বাবার খুব ভালো বন্ধু সে। তার বড় ভাই অবশ্য হতাশাবাদীদের দলে। সে সব সময় বলে তার বাবা কোনোদিনও উইনার বোর্ডে নাম লেখাতে পারবে না। কিন্তু ছোট ছেলেটি তা মানতে নারাজ। সে সিদ্ধান্ত নেয় তার বাবা না পারলেও সে নিজে একদিন চ্যাম্পিয়ন করবে। বার বছর বয়সী ছেলেটির নাম মিডি। মিডি চরিত্রে অসাধারণ অভিনয় করেছে বরুন বুদ্ধদেব। সত্য ঘটনা অবলম্বেনে নির্মিত চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০২২ সালে এবং একই বছর তা নেটফ্লিক্সেও রিলিজ হয়। পাশাপাশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। মৃদুল তুলসীদাস ছবিটি বানিয়েছেন নিজের জীবনের উপর ভিত্তি করেই। তবে সিনেমা মুক্তি পাওয়ার আগেই মারা যান তাঁর বাবা ও তাঁর বাবার চরিত্রে অভিনয় করা রাজীব কাপুর।৬৮তম জাতীয় পুরস্কারের তালিকায় মৃদুল তুলসীদাসের সিনেমা ‘তুলসীদাস জুনিয়ার’ পেয়েছে সেরা ছবির সম্মান। আশুতোষ গোয়ারিকর প্রযোজিত এই ছবি পরিচালকের নিজের গল্প অবলম্বনে তৈরি। ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে কাটানো মুহূর্তই এই ছবির বিষয়বস্তু। সঙ্গে এটাই অভিনেতা রাজীব কাপুরের শেষ কাজ। মারা যাওয়ার আগে এই ছবিতেই শেষবার অভিনয় করেছিলেন তিনি। আর সেই কারণে মৃদুল এই সম্মান উৎসর্গ করলেন নিজের প্রয়াত বাবা আর অভিনেতা রাজীব কাপুরকে।
বাবাকে বার বার হেরে যেতে দেখে মিডি নামের বার বছরের ছেলেটি সিদ্ধান্ত নেয় সেও প্রতিযোগিতায় খেলবে কিন্তু সে তো কখনো স্নুকার খেলা শেখেনি। নিয়মও জানে না। তারপরও সাহস নিয়ে সে ক্লাবে গিয়ে অনেকের কাছে হেল্প চায় কিন্তু কেউ তাকে খেলায় নিতে চায় না। বিশেষ করে ষোল বছর হয়নি বলে আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। কিন্তু মিডি হার মানবেনা বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তার বড় ভাই তাকে নানা ভাবে সহযোগিতা করে। সে আসলে একরকম জুয়ার নেশায় ছিল। ছোট ভাই মিডিকে দিয়ে সে আসলে টাকা আয় করতে চাইতো। ফলে কখনো ক্রিকেটার কখনো ব্যাডমিন্টন কখনো টেনিস খেলায় নিয়ে যেত। কিন্তু মিডি চাইতো বাবার মত স্নুকার খেলবে। একদিন সে একই ক্লাবের এক মেম্বারের নজরে পড়ে। তিনি সাদাসিধে মানুষ। ছোট্ট মিডিকে নিজের সাথে খেলতে বলে এবং নিয়ম কানুন শেখায়। তবে মজার বিষয় হলো তিনি নিজেই তেমন খেলা পারেন না। টাকাওয়ালা মানুষ তাই ক্লাবের মেম্বার হয়েছেন। ক্লাবের কেউ তার সাথে খেলতে চায় না।
খোজ নিতে নিতে মিডি জানতে পারে তার বাসা থেকে অনেক অনেক দূরে একটা জায়গা আছে সেখানে টাকার বিনিময়ে স্নুকার খেলা যায়। আর সেখানেই একজন পাক্কা স্নুকার খেলোয়াড় আছে যার নাম মোহাম্মদ সালাম। সবাই তাকে সালাম ভাই বলে ডাকে। মিডি সেখানে যায় এবং সেই বস্তির মত জায়গায় একটা ক্লাব খুজে পায়। সালাম ভাই আসে। বিশাল দেহি সালাম ভাই খেলা শুরুর আগে এক ঘন্টা ঘুমিয়ে নেয়। তার খেলা দেখে মিডি বিস্মিত হয়। সে সিদ্ধান্ত নেয় সালাম ভাইয়ের কাছ থেকে শিখবে। কিন্তু লোকটা যা বদরাগি। সবাই নিষেধ করে। তবুও সে দমে যায় না। দূর থেকে একটু একটু করে তাকে ফলো করে। একদিন সালাম ভাইয়ের নজর পড়ে তার প্রতি। তারপর সে সালাম ভাইকে অনুরোধ করে তাকে যেন শেখানো হয়। সে তার জীবনের গল্প বলে। সালাম ভাই রাজি হয়। এর পর থেকে রোজ সে বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে সালাম ভাইয়ের কাছে তালিম নেয়। সালাম ভাই চরিত্রে অভিনয় করেন প্রখ্যাত অভিনেতা সঞ্জয় দত্ত।
মুভিতে দেখা যায় সালাম ভাই একজন ভবঘুরে টাইপ মানুষ। কোথায় কী করেন তার কোনো খোজ নেই কিন্তু রোজ ক্লাবে এসে স্নুকার খেলেন। তার সাথে কিন্তু কেউ খেলে না। নিজেই স্টার্ট করে এক চান্সে সব ফেলে দেন। এরপর আসে ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপের সময়। মিডি তার ভাইকে নিয়ে আবেদন পত্র আনতে গেলে কেউ দিতে চায় না। তখন সেই যে ক্লাবের এক সাদাসিধে মেম্বার সে অনুরোধ করে চেয়ারম্যানকে। চেয়ারম্যান তাকেও ভালোভাবে বুঝায় যে ক্লাবের নিয়ম কি। ঠিক এরকম সময় মিডির বাবা তুলসী দাস এক খেলোয়াড়ের সাথে বাজিতে খেলে মাঝপথে খেলা ছেড়ে চলে যায়। অনেক গুলো টাকা হারে। এটা মিডি মেনে নিতে পারে না। সে তার ভাইকে সাথে নিয়ে ক্লাবে এসে লোকটিকে বলে খেলা এখনো শেষ হয়নি। তখন লোকটা বলে তোর বাবাতো চলে গেছে কে খেলবে আমার সাথে? তখন মিডি বলে আমিই খেলবো। সবাই খুব হাসে। কেউ তখনো জানতো না যে ভেতরে ভেতরে মিডি এই খেলায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। লোকটির সাথে মিডি খেলতে শুরু করে এবং অনায়াসে তাকে হারিয়ে দেয়। যখন সবাই উল্লাস করছে তখন সেখানে চেয়ারম্যান আসে এবং মিডির খেলা দেখে অভিভূত হয় আর সাথে সাথে তাকে প্রতিযোগিতায় খেলার অনুমতি দেয়।
প্রস্তুতি ভালোই চলছিল। প্রতিযোগিতা শুরু হলো। ফর্ম জমা দেওয়ার সময় ক্লাব থেকে নাম জানতে চাইলে সে বললো নাম লিখুন তুলসি দাস জুনিয়র! মিডি নাম না লিখে সে তার বাবার নাম লিখলো কারণ উইনার বোর্ডে সে তার বাবার নাম দেখতে চায়। একই প্রতিযোগিতায় তার বাবা তুলসি দাসও অংশ নিল। দেখা গেল প্রথম দিন মিডি তথা তুলসি দাস জুনিয়রের খেলা পড়েছে সেই শুভাকাঙ্খি ক্লাব মেম্বারের সাথে। মিডি তাকে অনায়াসে হারিয়ে দিয়ে পরের রাউন্ডে চলে গেল। অন্যদিকে তার বাবা তুলসি দাসও একের পর এক গেম জিতে সামনে এগিয়ে গেল। একসময় বাবা ছেলের দেখা হলো বা লড়াইয়ে নামার সময় হলো। সেই গেমে মিডি জিতলো তবে তার মন খারাপ। সে মনে করে বাবা তাকে ইচ্ছে করে জিতিয়েছে।
এভাবেই একে একে সে ফাইনালে উঠে গেল এবং প্রতি বার যার কাছে বাবা ফাইনালে হারে সেই জিমি টেন্ডনের সাথে খেলা পড়লো। খেলতে গিয়ে দেখা গেল প্রথমে বেশ ভালোই খেলছিল মিডি। খেলার এক পর্যায়ে সেখানে প্রবেশ করলেন মোহাম্মদ সালাম তথা সালাম ভাই। গার্ড তাকে ঢুকতে দিচ্ছিল না তখন এমন সময় মিডি বললো সে আার কোচ! যখন এই কথা বললো তখন সবাই তার দিকে ফিরে তাকালো। ক্লাবের প্রেসিডেন্টও তার দিকে তাকিয়ে দেখলো আরে তিনিতো পরিচিত মানুষ। তখন গার্ডকে নির্দেষ দিলেন আসতে দিতে এবং ঘোষণা করে জানিয়ে দিলেন সালাম ভাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন! চলছে ক্লাব চ্যাম্পিয়নশীপ সেখানে সালাম ভাই জাতীয় চ্যাম্পিয়ন ভাবা যায়। সালাম ভাইকে পেয়ে সবাই খুশি। তুলসি দাস জুনিয়রও ভালো খেলছে। ব্রেকের সময় বারে গিয়ে সে যখন লেমনেড খেলো তখন জিমি টেন্ডন বিয়ার খাচ্ছিল। এক পর্যায়ে জিমি টেন্ডন মিডি তথা তুলসি দাস জুনিয়রের আঙ্গুল ধরে এমন ব্যাথা দিল যে পরে তার খেলতে ভীষণ অসুবিধা হচ্ছিল। এসব দেখে সালাম ভাই উঠে বেরিয়ে গেলেন। যাওয়ার সময় ইশারা করলেন মিডিকে। মিডি বুঝলো তাকে কী করতে হবে। সালাম ভাই যেমন এক ঘন্টার ঘুম দিতেন সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিডিও সেভাবে একটা ঘুম দিল। জিমি টেন্ডন সহ বাকি সবাই বিস্মিত হলো এটা দেখে। জিমি টেন্ডনতো বললো বাচ্চাটাকে বাসায় নিয়ে ঘুম পাড়ান। ঠিক এক ঘন্টা পর মিডি তথা জুনিয়র তুলসি দাস উঠলো। হাতমুখ ধুয়ে নিল এবং একটু পর বাবা যে স্টিক দিয়ে খেলতেন সেটি নিয়ে আসলো। তার পর আর তাকে ফিরে তাকাতে হয়নি। জিমি টেন্ডনকে আর কোনো সুযোগই দেয়নি সে। একাই তরতর করে খেলে চ্যাম্পিয়ন হয়ে পুরো ক্লাবের ইতিহাসে সবচেয়ে কম বয়সী খেলোয়াড় হিসেবে উইনার বোর্ডে নাম লেখালো।
বিজয়ী ঘোষণার পর পরই সে ছুটে চলে গেল সালমান ভাইয়ের কাছে। সেখানে গিয়ে দেখলো সবাই চিন্তিত। মিডি গিয়ে দুই হাত উচু করতেই সবাই বুঝে গেল মিডি চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। অন্যদিকে পুরস্কার তুলে দেওয়া হলো তুলসি দাসের হাতে। বোর্ডে নাম উঠলো জুনিয়র তুলসি দাস।
সিনেমাটি বাস্তব জীবনের গল্প অবলম্বনে নির্মিত এবং ক্রিকেটের বাইরেও যে অন্য কোনো গেমস নিয়ে বানানো সিনেমা এতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে তার প্রমান এই সিনেমাটি। আপনি দেখতে বসলে ভালো না লেগে যাবে না। বরুন বুদ্ধদেব তথা জুনিয়র তুলসি দাস অসাধারণ অভিনয় করেছে। সেই সাথে বাকিরাও নিজেদের ছাড়িয়ে গেছে। নেটফ্লিক্সে মুভিটি দেখলাম।