Friday, November 22, 2024
Homeসাহিত্যগল্পএক ছন্দময় গল্পের খোজে!

এক ছন্দময় গল্পের খোজে!

হিমু চন্দ্র শীল

রাত পেরিয়ে দিন আসে, দিন পেরিয়ে রাত।পুব দিগন্তে চিক চিক করে জেগে উঠা গোলাকার বৃত্তটি পশ্চিমে অন্তর্ধান করলেই বলি সন্ধ্যা। ঠিক এমনই একটি সন্ধ্যার দিনে প্রায় পাঁচ বছর আগে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে সীমান্তের কাঁটা তার ডিঙিয়ে অন্য সবার সাথে এদেশে আশ্রয় নিয়েছিল রশিদা, নূর তাজ, আসমন তারা। কেটে গেছে গুনে গুনে পাঁচটি বছর। নিজ দেশে অস্থির এক পরিস্থিতির কবলে পড়ে  যখন অজানা এক গন্তব্যে পা বাড়াচ্ছিল বড়রা, তখন ছোটরা তাদের জিজ্ঞেস করতে পারেনি কোথায় যাবে। বড়রা শুধু এইটুকু বলেছিল প্রাণ বাঁচাতে ছুটতে হবে। অর্ধাহার আর অনাহারের সেই ছুটে চলা একসময় এসে থেমে গিয়েছে এদেশের উখিয়ার জঙ্গল বেষ্টিত পাহাড়ে। পরে যেখানে গড়ে উঠেছে বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবির ‘রোহিঙ্গা ক্যাম্প।’ বলছি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশু রশিদা, নূর তাজ, আসমন তারা’র কথা। তখন দুপুর দুটোর কাছাকাছি। জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের অর্থায়নে পরিচালিত একটি লার্নিং সেন্টার সবে মাত্র তাদের প্রথম ব্যাচ ছুটি দিয়েছে। দ্বিতীয় ব্যাচ আসতে শুরু করেছে। রশিদা, নূর তাজ, আজমন তারা তিনজনই পড়ে দ্বিতীয় ব্যাচে। বয়সের ফারাকে একটু এদিক-সেদিক হলেও পড়ে একই সাথে একই লার্নিং সেন্টারে। কথা হয় তাদের সাথে। রশিদা আর নূর তাজ খুব সাবলীলভাবে কথা বললেও আজমন তারার চোখে মুখে ছিল লজ্জার চাপ। তারা তিনজনই এক সাথে থাকে। খেলাধুলাও করে একসাথে। যখন মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসছিল তখন তাদের বয়স ছিল অনেক কম। তাই মিয়ানমারের স্মৃতি বলতে তেমন কিছু নেই তাদের মানসপটে। তবে তারা মিয়ানমারে এক একজন এক একএলাকার অধিবাসী হলেও মিলিত হয়েছে এখানে এসে। এখন তাদের পরিচয় একটাই ‘শরণার্থী শিশু।’  রশিদার কাছ থেকে জানতে চাইলাম পড়াশোনা কেমন হচ্ছে। একটু লাজুকমাখা কণ্ঠস্বরে বলল, ‘ভালো হচ্ছে।’ এইবার তিনজনকে  জিজ্ঞেস করলাম পড়াশোনার বাইরে আর কি কি করো। সবাই একসাথে বললো, ‘খেলাধুলা করি।’ বিশেষ করে চাকতি বা ঢেলা দিয়ে আমাদের দেশের হাডুডু খেলার মতো একটা খেলা খুবই পছন্দ করে তারা। তবে এর বাইরেও পরিবারের নানান কাজে সহায়তা করে বলে জানাল তিনজনই। এছাড়া ক্যাম্পের বাইরে কোথাও খুব একটা যাওয়া হয় না বলে জানাল তারা। ক্যাম্পে ঘুরতে ঘুরতে কথা হয় আরও কয়েকজনের সাথে। তখন দুপুরের আকাশ আচমকা কালো মেঘে ছেয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর শুরু হলো মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টিভেজা রোহিঙ্গা ক্যাম্প দেখতে অনেক সুন্দর। চারিদিকে সতেজ সতেজ একটা ভাব। বৃষ্টির সময় ক্যাম্পের অলি-গলিতে তেমন কারো দেখা-সাক্ষাত না থাকলেও, খোলা জায়গায় জমে যাওয়া পানিতে বল কিংবা অন্যকিছু নিয়ে দুরন্ত শিশুদের হৈহল্লার কোনো কমতি থাকেনা। ঘন মেঘ ছাপিয়ে যে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল তা থামতে লেগে গেছে ঘন্টা দেড়েক। পাহাড়ারের পাদদেশে সাবধানে পা ফেলে হাঁটছি। ত্রিশ চল্লিশ ফুট নীচ থেকে শিস দিতে দিতে উপরে উঠে আসছে কয়েকজন শিশু। থমকে দাঁড়ালাম। তারাও লার্নিং সেন্টার থেকে আসছে। লার্নিং সেন্টার সবেমাত্র ছুটি হলো। কাছে গিয়ে গল্প জুড়ে দিলাম। একজনের নাম মোঃ কাসিম, দ্বিতীয় জনের নাম হোছাইন আহম্মেদ,  সবার ছেয়ে ছোটজনের নাম হামিদ উল্লা। হামিদকে জিজ্ঞেস করি বাড়ি কোথায়। হামিদ উল্লার বাড়ি মিয়ানমারের মংডুর ধুমছে পাড়ায়। অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাংলা বইয়ে বিপ্রদাশ বড়ুয়ার ‘মংডুর পথে’ প্রবন্ধ থেকে প্রথম জানতে পাড়ি মিয়ানমারের মংডু সম্পর্কে। মংডু মিয়ানমারের পশ্চিমে রাখাইন রাজ্যের একটি সীমান্ত শহর।  টেকনাফের নাফ নদীর ওপারে অবস্থিত রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বসবাস সবচেয়ে বেশি। চট্টগ্রাম বিশেষ করে কক্সবাজারের সাথে ওই রাজ্যটির যোগাযোগ অনেক আগে থেকেই। বিপ্রদাশ বড়ুয়া মংডু ভ্রমণ কাহিনীতে ফুটিয়ে তুলেছিলেন শহরটির অপরুপ সৌন্দর্য। দিয়েছিলেন মংডুর অধিবাসীদের খাবার-দাবার, পোশাক-আশাকের বিচিত্র সব বর্ণনা। মরিচ পোড়া আর তেঁতুলের টক, কলার থোড় দিয়ে নুডলস পরিবেশনের বর্ণনা পড়ে মনে হয়েছিল স্বয়ং আমিই খাচ্ছি, ঘুরে বেড়াচ্ছি মংডু শহরে। বিপ্রদাশ বড়ুয়া ‘মংডুর পথে’ প্রবন্ধের প্রতিটি লাইনে মংডু শহরের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা থেকেই মূলত মংডুর প্রেমে পড়া। পুরোনো শহরের কথা আবারও নতুন করে শোনার আগ্রহ জাগল আমার মনে। হামিদ উল্লার বয়স এখন দশ। তারা এসেছে প্রায় পাঁচ বছর হতে চললো। তাই ওপারের কথা খুব একটা মনে নেই তার। এবার জিজ্ঞেস করি কাসিমের কাছ থেকে। কাসিমের বাড়িও মংডু শহরে, তবে প্রাইংসেং এলাকায়। কাসিমের বয়স তেরো। তার স্মৃতিতে এখনো উজ্জ্বল প্রাইংসেংয়ে ফেলে আসা স্মৃতিগুলো। কাসিমের বাড়িটি ছিল কাঠের দোতলার। কাসিমের মতে বাড়িটা ইট-পাথরের বাড়ির চেয়ে মজবুত ছিল। রোজ সকালে পাড়ার ছেলেরা দল বেঁধে মকতবখানায় পড়তে যেত। পড়া শেষ করে দলবেঁধে শুরু হতো ছুটাছুটি। কখনো সবুজ ক্ষেতের আইল মাড়িয়ে মাছ ধরত। আবার কখনো মাঠের ধুলাবালি গায়ে মেখে পুকুরে ঝাঁপিয়ে স্নান করত। কমতি ছিলনা ফুল ফলেরও। আমের সময় আম, লিচুর সময় লিচু। কিন্তু এখন ওসব অতীত।  কথার ফাঁকে যোগ দিল হোছাইন আহম্মেদ। তারা চার ভাইবোন। হোছাইনের বাড়ি আবার বুথিডং শহরের গুদাম পাড়ায়। বুথিডংও রাখাইন রাজ্যের একটি শহর। তবে বুথিডং শহর নিয়ে খুব একটা জানাশোনা নেই আমার। শুনেছি বুথিডং শহরে অনেক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। হোছাইন আহম্মেদের স্পষ্ট মনে আছে বুথিডংয়ে ফেলে আসা  স্মৃতি। রোজ দলবেঁধে মক্তবে যাওয়া। একসাথে দিঘির স্বচ্ছ পানিতে ঝাঁপ দেওয়া। বাড়ির পাশের পেয়ারা বাগানে গিয়ে ইচ্ছেমতো পেয়ারা খাওয়া। আরও কতরকম তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ওসব নিয়ে কেউ কোনোদিন বারণও করেনি তাকে। জিজ্ঞেস করলাম লার্নিং সেন্টারে কি কি বিষয়ের উপর পড়াশোনা করো। হামিদ উল্লা বললো, ‘ইংলিশ, ম্যাথ, বার্মিজ, লাইফ স্কিল।’ বললাম কোন বিষয়টা তোমাদের সবচেয়ে প্রিয়, ‘তিনজনই সমস্বরে বলে উঠল, ‘লাইফ স্কিল।’ রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের জন্য লাইফ স্কিল হলো সবচেয়ে মজার একটি সাবজেক্ট। এই সাবজেক্টের মূল বিষয় বস্তু হলো প্রথাগত পড়াশোনার বাইরে গিয়ে বাস্তব জ্ঞান লাভ করা। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা, সাঁতারের বিস্তারিত কৌশল, দৈনন্দিন চলাফেরায় নিজে কিভাবে সতর্ক ও সংযত থাকবে এমন সব মজার বিষয় বস্তু  দিয়ে সাবজেক্টটি সাজানো বলে তাদের সবার এত প্রিয়। হোছাইন আহম্মেদকে বললাম, ‘লার্নিং সেন্টার ছুটি হওয়ার পর কি করো?’ পাশ থেকে কাসিম বললো, ‘স্কুলের ব্যাগটি বাসায় রেখে মাঠে চলে যায়।’ ফুটবল আর ভলিবলটা তাদের কাছে খুব প্রিয়। জিজ্ঞেস করলাম ক্রিকেট খেলো কিনা। হামিদ উল্লা জানালো, ‘ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে এখানে এসে জানতে পেরেছি। তবে কিভাবে খেলতে হয় এটা একটু একটু জানলেও খুব একটা খেলা হয়ে উঠে না।’ তার কথা শুনে বুঝতে পেরেছি রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুদের মাঝে এখনও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি ক্রিকেট। তবে তাদের কাছে ভলিবল খুবই জনপ্রিয়। আর এই ভলিবল দেখতে কিন্তু সাধারণ ভলিবলের মতো নয়। প্লাস্টিক দিয়ে বিশেষ কায়দায় তৈরি বলটি ওজনে খুবই হালকা। আর এই হালকা বল দিয়েই মূলত তারা খেলে। এবার তাদের অনুরোধ করলাম একটা বার্মিজ ছড়া শুনাতে। একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকিয়ে ছড়ার চেয়ে সবাই মিলে মিয়ানমারের জাতীয় সংগীত গাইবে বলে মনস্থির করলো। মিয়ানমারের ভাষায় জাতীয় সঙ্গীতকে কব্যয়া বলা হয়। তিনজন সমবেত কণ্ঠে সুর করে গেয়ে উঠল নিজের দেশের কব্যয়া। হয়তো নিজের দেশের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করতেই তারা জাতীয় সঙ্গীতই বেছে নিল বলে মনে হলো। আমার খুবই আফসোস হয়। ওপারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুরা নিজেদের সুন্দর পৃথিবীটা ছেড়ে এসে আজ আশ্রয় নিয়েছে এদেশে। তবে শুরুতে বেশ কষ্ট হলেও তারা এখন মানিয়ে নিতে শিখেছে। ধীর ধীরে একটা সুন্দর পৃথিবী গড়তে নিজেদের মনোনিবেশ করেছে । যে পৃথিবীতে তারা পড়ালেখা শিখবে, মনের আনন্দ নিয়ে খেলবে, রঙিন সব স্বপ্ন দেখবে, আর সেই স্বপ্নের ডানায় ভর করে হয়তো একদিন ফিরে যাবে নিজের জন্মভূমি মিয়ানমারে। 

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments