পৃথিবীতে কিছু মানুষ জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ অবস্থায়। যাদের কেউ কেউ কথা বলতে পারে না, হাটতে পারে না, কথা শুনতে পারে না, চোখে দেখতে পারে না, মানসিক ভাবে ভারসাম্যহীন। পৃথিবীর মানুষ তাদেরকে নানা ভাবে আখ্যায়িত করে থাকে যার মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত শব্দটি হলো প্রতিবন্ধী। আবার অনেকে জন্মের সময় সুস্থ্য স্বাভাবিক ভাবে জন্ম নিলেও কোনো এক সময় রোগে ভুগে বা দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে শারীরিক ভাবে অক্ষম হয়ে যায়। তাদেরকেও আমরা প্রতিবন্ধী বলে থাকি। এই ধরনের প্রতিবন্ধীত্ব যারা বরণ করেছে তাদের দোষ দেওয়ার উপায় নেই।এবং নিরানব্বই ভাগ সময়ে এরা হয় নীরিহ। সমাজের কোনো রকম ক্ষতি এদের মাধ্যমে সাধিত হয় না। কিন্তু কিছু মানুষ আছে যারা জন্ম থেকে সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে জন্মেছে। যারা কথা বলতে পারে, দেখতে পারে,হাটতে পারে এবং তারা কোনো দূর্ঘটনা কবলিতও নয়। তারপরও তারা প্রতিবন্ধী।আমি তাদের বলি কুলাঙ্গার। এই কুলাঙ্গারেরা এমনিতে সুস্থ্য কিন্তু তারা জেনে শুনে এমন সব কাজ করে যা কোনো ভালো মানুষ করে না।এই শ্রেণীকে প্রধানত দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে।তাদের প্রধান হাতিয়ার হয় নবীন শিক্ষার্থীদের উপর শারীরিক ও মানসিক ভাবে অত্যাচার করা। যাকে আমরা বলি র্যাগিং।
এই র্যাগিং সংস্কৃতি পৃথিবীর আর কোনো দেশে আছে বলে আমার জানা নেই। একমাত্র বাংলাদেশের হীরের টুকরো ছেলে মেয়েরাই নবীন নীরিহ শিক্ষার্থীদের র্যাগিং দিয়ে বিকৃত এক আনন্দে মেতে ওঠে। প্রতি বছর অসংখ্য ছেলে মেয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহুতি দেয়,শিক্ষা জীবনের ইতি টানতে বাধ্য হয়। আমার বেশ মনে আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমার সাথে আমার এক বন্ধু ছিলো তার নাম শ্রাবণ। ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়ে র্যাগিংয়ের শিকার হয়ে পরীক্ষা না দিয়ে সে কাঁদতে কাঁদতে গ্রামে ফিরে গিয়েছিল।যে জানোয়ারের দল র্যাগিং দেয় তাদের কখনো শাস্তি হয় না। তারা তাদের এক শ্রেণীর আব্বাদের ছায়াতলে থেকে ঠিকই জীবন পার করে দেয়। তারপর তারা বড় হয় আর ইবলিশের অবতার হিসেবে আবির্ভূত হয়।আমি কখনো র্যাগিংয়ের শিকার হইনি কারণ আমি প্রিভিলেজড ছিলাম। কিছু অতিরিক্ত সুযোগ সুবিধা ছিলো আমার। বেশ প্রটেকশন ছিলো চারপাশে। র্যাগিংয়ের শিকার হলে আমিও হয়তো শ্রাবণের কাতারে নাম লেখাতাম।আমি দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে কী পরিমান র্যাগিং হয়। আর জাহাঙ্গীরনগরের র্যাগিংতো দেশের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়।
আমার ফেসবুক বন্ধুদের মধ্যে গুনে শেষ হবে না এমন সংখ্যাক শিক্ষার্থী র্যাগিংয়ের শিকার হয়েছে।যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর কত মেয়ে কেঁদে কেঁদে তাদের দুঃখের কথা শেয়ার করেছে। সেই সব দুঃখ বেদনা লিখে শেষ হবে না।আমার সাথে অনেকেই তাদের কষ্টের কথা শেয়ার করেছে। আমি নানা ভাবে তাদের বুঝিয়েছি। আমি জানতাম একদিন তারা সিনিয়র হয়ে হয়তো নবীনদেরকে একই ভাবে অত্যাচার করবে।এটা অনুভব করে আমি তাদের মধ্যে এমন কিছু বুনে দিতে চেয়েছি যেন তারা বদলে যায়।আমি একা আর কতইবার পারি।তাদের কেউ কেউ সিনিয়র হয়েছে এবং নবীন শিক্ষার্থীদের কাছে হয়ে উঠেছে আশ্রয়স্থল।
আমি প্রতিটি স্কুল,কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কর্মস্থলে এমন পরিবেশের স্বপ্ন দেখি যেন নতুন কেউ আসলে পুরোনোরা তার পাশে দাঁড়িয়ে অভয় দিয়ে বলতে পারে প্রিয় ভাই আমার,বন্ধু আমার, বোন আমার তোমার কোনো ভয় নেই। তুমি নতুন হলেও আমরাতো পুরোনো। তুমি প্রিয়জনদের ছেড়ে এখানে এসেছ। এই পরিবেশ তোমার কাছে নতুন। আমরা তোমার পাশে আছি।তোমার কোনো ভয় নেই। তোমার যা কিছু দরকার আমাদের বলবে। আমরা তোমাকে সহযোগিতা করবো।ক্যাডেট কলেজ গুলো কেন আর সব প্রতিষ্ঠান থেকে আলাদা হয় জানেন? যখন ক্লাস সেভেনে একটা বাচ্চা ভর্তি হয় তখন তার জন্য ক্লাস এইটে পড়ুয়া একজন গাইড নির্ধারণ করা হয়।প্রথম দিন কলেজে যাওয়ার পর পরই সেই গাইড তাকে সব বিষয়ে সহযোগিতা করে। আগলে রাখে। এমনকি সে ভুল করলে গাইড নিজে সাজা ভোগ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন এমন হয় না। প্রতিটি বিভাগে প্রতি বছর আগের বছরের সমান সংখ্যক শিক্ষার্থী ভর্তি হয়। তবে কেন সিনিয়ররা জুনিয়রদের গাইড হিসেবে আর্বিভূত হয় না?
একজন নবীন শিক্ষার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে কোথায় থাকবে, কি খাবে, কি করবে এটা বুঝে উঠতে পারে না। অথচ একজন সিনিয়র অনায়াসে তাকে সব বিষয়ে হেল্প করতে পারে।তখন সেই নবীন শিক্ষার্থী ভরসা পায়।জীবনে কোনো দিন ওই সিনিয়রের অবদান সে ভুলতে পারে না। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনা উল্লেখ করতে চাই। শাকুর মজিদ নামে আমাদের দেশে একজন লেখক আছেন। তিনি একই সাথে আরও অনেক অভিধায় অভিষিক্ত। তিনি একাধারে লেখক, সাংবাদিক,স্থপতি (বুয়েট, আর্কিটেকচার), নাট্যকার। ভ্রমণ গদ্যের লেখক হিসেবে তিনি বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন। তার জীবনের একটি ছোট্ট ঘটনা বলতে পারি। তিনি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে পড়তেন। তার যে সিনিয়র তাকে দিয়ে জুতা কালি করিয়েছিলেন বহু বছর পর (২০/৩০ বছর পর) শাকুর মজিদ তার লেখা একটি বই সেই সিনিয়রকে উৎসর্গ করেছিলেন,ভালোবেসে,স্মরণ করে। কেমন সিনিয়র ছিলেন যে জুতা কালি করিয়ে নেওয়ার পরও তাকেই বই উৎসর্গ করা যায়? এই সব সিনিয়রেরা জীবনে এমন কিছু অবদান রাখে যার কোনো বিনিময় মূল্য হয় না।
প্রসঙ্গক্রমে টুয়েলভথ ফেইল সিনেমার কথা বলতে হয়। মনোজের জীবনে তেমনই এক অসাধারণ সিনিয়র ভাই এসেছিলেন। যিনি নিজে সফল না হলেও মনোজের সাফল্যের পথে বিরাট অবদান রেখেছেন। বাস্তব জীবনে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে হয়তো খুঁজলে এক দুজন ওরকম সিনিয়র পাওয়া যাবে। অথচ আমি স্বপ্ন দেখি প্রতিটি সিনিয়র শিক্ষার্থী জুনিয়রদের কাছে এমনই অসাধারণ হয়ে উঠবে।মুখের দিকে তাকিয়ে বলবে কিরে তোর এমন মুখ শুকনো লাগছে কেন? সকালে নাস্তা করতে পারিসনি বুঝি? চল নাস্তা করি। কিরে এক্সামে এরকম খারাপ করলি কিভাবে? কোনো বিষয় বুঝতে অসুবিধা হলে আমার কাছে চলে আসিস আমি বুঝিয়ে দেবো বা অমুককে বলে দেবো সে তোকে বুঝিয়ে দেবে। কাউকে আনন্দিত দেখলে বলবে কিরে অনেক খুশি লাগছে।চল তোর খুশিটা আমরা ভাগাভাগি করে নিই।
আর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা কেমন হবেন? আমার মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের রুমগুলো ট্রান্সপারেন্ট করা দরকার। কাচের পার্টিশন থাকবে। বাইরে থেকে ভেতরটা স্পস্ট দেখা যাবে।একজন শিক্ষক একজন ছাত্রীকে একা নিরিবিলি সময়ে কেন তার চেম্বারে ডাকবেন? আপনার যদি এতোই তার প্রতি দায়বদ্ধতা থাকে এবং তাকে সহযোগিতা করতে চান তবে তাকে কেন নিরিবিলি একা ডাকবেন? বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাতো যথেষ্ট সম্মানি ব্যক্তি। বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজলে সুন্দরী,আকর্ষণীয়,ধনবান পাত্রীর অভাব হবে না।তারপরও কেন ছাত্রীদের দিকেই কুনজর পড়বে? অনেক শিক্ষক আছেন যাদেরকে আমরা বাবার মত শ্রদ্ধা করি। তাদের কিছু হলে এমনকি একদিন তাদেরকে না দেখলেও কষ্ট লাগে। সব শিক্ষক কেন তাদের মত মহান হতে পারেন না? সব শিক্ষার্থী কেন মনোজের সাপোর্টিং ভাইয়ের মত হয় না? কারণ ওর কুলাঙ্গার। আর এই সব বুনো শুয়োরের দল একসাথে হয়ে এক জোট হয়ে বহু মানুষের জীবন নষ্ট করছে প্রতিনিয়ত। বুনো শুয়োর সব একাট্টা থাকে। আপনি দেখবেন ভালো মানুষের মধ্যে খুব একটা জোট থাকে না। কিন্তু চোর,লুটেরা,বাটপার,শয়তান,কুলাঙ্গাররা সব সময় একজোট থাকে। তেড়ে আসে। হাসপাতালে হাসপাতালে দালালেরা একজোট হয়ে নিরীহ রোগী ও তার পরিবারকে কষ্ট দেয়। এইতো গত ১৮ মার্চ ২০২৪ তারিখে ঢাকার আগারগাও নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে দেখলাম এক বুনো শুয়োর তেড়ে যাচ্ছে শুভ্র দাড়িওয়ালা মুরুব্বির দিকে।
এই সব বুনো শুয়োর আর হায়েনাদের হাত থেকে আমরা কবে রক্ষা পাবো? বিচারের নাম করে বছরের পর বছর পার হয়ে যাবে কিন্তু ফল হবে না। তারপর নতুন কোনো সিমিন মরবে,অবন্তিকারা কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে।কিন্তু কুলাঙ্গারেরা থাকবে।মোবাইলের উপর পানি পড়ুক কিংবা পানির মধ্যে মোবাইল পড়ুক ক্ষতি কিন্তু মোবাইলেরই হবে। সাধারণ শিক্ষার্থীরা হলো সেই মোবাইলের মত। তাদের কোথাও যাওয়ার নেই। সব জায়গায় কুলাঙ্গারে ভর্তি। ক্ষতিটা তাদেরই হবে আর বুনো হায়েনার দল ঠিকই থাকবে। সুযোগ পেলেই খুবলে খাবে।তারপর এরা পরীক্ষায় পাশ করবে ক্ষমতাবলে দোষরদের হাত ধরে এবং কর্মজীবনে প্রবেশ করে আবার নিরীহদের উপর ছড়ি ঘুরাবে। এই সব মানসিক বিকারগ্রস্থ বুনো শুয়োরমুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় চাই,শিক্ষাঙ্গন চাই,কর্মস্থল চাই।দোষীদের বিরুদ্ধে এমন শাস্তি আরোপ করা চাই যা দেখে অন্য বুনো শুয়োরের দল ভুলেও আর ও পথে পা বাড়াতে না পারে। এ শহরের দেয়ালে দেয়ালে, বিলবোর্ডে আর রাস্তার মোড়ে মোড়ে ওই সব শুয়োরের দলের বড় বড় ছবি টাঙ্গিয়ে দেওয়া হোক। যাবজ্জীবন কারাবাস নয়,মৃত্যুদণ্ড নয় বরং কাকতাড়ুয়ার মত রাস্তার মোড়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হোক।পথচারি যেতে যেতে থুথু মারুক ওদের মুখে।
২১ মার্চ ২০২৪