শর্মিলা বহ্নি
বেলা দুপুর তিনটা বাজে। সময়টা ছিলো শীতকাল। আমি রোদে বসে কয়েক জন ছেলেমেয়েদের পড়াচ্ছিলাম। এমন সময় শুনতে পেলাম বিদেশীরা এসেছে। আমার পাশে বসে থাকা এক মহিলার দৌড় দিলো সে কথা শুনে। আমি প্রথম কিছু বুঝে উঠতে পারলাম না। ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানো ফেলে আমিও গেলাম মহিলার পিছু পিছু। মহিলাটি আমাদের পাশের বাসার ভাড়াটিয়া। সামনের বাড়িতে গিয়েই দেখি দুজন জাপানি ভদ্রলোক, সঙ্গে কয়েকজন বাংলাদেশি ছেলেও আছে। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম তাদের দেখার জন্য আগে থেকেই অনেক লোকজন সেখানে উপস্থিত হয়েছে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। আশেপাশের অনেক মহিলারাই সেখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। আমাদের বাড়ি কাছে থাকা সত্বেও আমাদের আগে আশেপাশের অনেক লোক এখানে এসে হাজির হয়েছে। আমাদের টের পেতে একটু সময় লেগে গেছে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে দেখি দু’জন জাপানি মেয়ে। তারা দুটি গামছা হাতে নিয়ে খুব উত্তেজনা ও আগ্রহ সহকারে দেখছে। খুব উত্তেজনা ও আগ্রহ সহকারে গামছা দেখা যদিও আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হচ্ছিলো কিন্তু তাদের কাছে অনেক কঠিন কিছু মনে হচ্ছিলো। কিভাবে এটা তৈরি করলো, কিভাবে এত সুন্দর ডিজাইন করছে তাঁত দিয়ে, এটাই তাদের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। খুব আগ্রহে তারা তাতে কাপড় বোনা তাদের ফোনে ভিডিও করে নিতে লাগলো। এলাকার কিছু লোক তাদের ছবি তুলে নিল। কেউ কেউ আবার তাদের সঙ্গে সেলফি তুললো। আমি কোন ছবি তুললাম না বরং একটু দূরে গিয়ে দাঁড়ালাম। জাপানি মেয়ে দুটি ছিল ফর্সা, ফর্সা মানে অনেক ফর্সা, যেন শ্বেত রোগী। নাক চ্যাপ্টা, চোখ ছোট ছোট, ভরু নেই বললেই চলে, চুল ছোট ছোট অর্থাৎ কাঁধ পর্যন্ত। তাদের ভাবভঙ্গি দেখে যতটা বুঝলাম তারা খুব ভদ্র ও নম্র। হয়তো বা বাইরের দেশে এসে ভদ্রতা একটু বেশি দেখাচ্ছিলো। যাই হোক, তারা কোন কথা বলছিল না শুধু আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। আর কি কথা বলবে তারা আমাদের ভাষা বুঝতে পারছিল না। তাদের থেকে বেশি উত্তেজিত ছিল আমাদের আশেপাশের লোকজন গুলো। যেন কোথা থেকে এক অদ্ভুত প্রাণী তাদের গ্রামে এসে হাজির হয়েছে। সাধারণ লোকজন তাদের কথা শোনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলে জাপানি মেয়ে দুটির মধ্যে একজন বলল “ হাউ আর ইউ”। অমনি ফট করে এক মহিলা উত্তর দিলো” ফাইন থ্যাঙ্ক ইউ” সকলেই তার কথায় হেসে উঠলো। মহিলাটি আমাদের পাশের বাড়ি একজন। জাপানি মেয়ে দুটি আর কোনো কথা বললো না। বারবার শুধু আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে চললো। আমাদের কথাবার্তা ইংরেজিতে বলে তাদের বুঝিয়ে দিচ্ছিলো বাংলাদেশি ছেলে দুটি। আমি তো দাড়িয়েই রইলাম, বাড়ি ফেরার কথা ভুলে গিয়েছিলাম, মা আমাকে দু’একবার ডাক দিলো তবুও আমি বাড়ি গেলাম না। সবার মতো আমিও তাদেরকে দেখতে লাগলাম অবাক দৃষ্টিতে। তাদের পিছু পিছু আমি আরেকটা তাঁত ফ্যাক্টরিতে গেলাম। সেখান থেকেও তারা অনেক ছবি তুললো। তার ফ্যাক্টরের কিছু ভিডিও করে নিলো। শ্রমিকরাও তাদের দেখে কিছুক্ষণের জন্য কাজ বন্ধ করে দিলো। কিছুক্ষণ সেখানে থাকার পর সেখান থেকে ফিরে এসে তারা চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে লাগলো। আমরা সবাই তাদের সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম। পাশের দোকান থেকে তাদের জন্য কিছু কোয়েল পাখির ডিম কিনে নিল তাদের সঙ্গে থাকা বাংলাদেশী লোক দুটি। তারপর তারা গাড়িতে উঠে পড়লো এবং আমাদেরকে ‘বাই বাই’ বলে বিদায় জানালো। আমাদের এখানের মহিলারাও তাদেরকে বাই বাই বলে বিদায় দিলো। বিদেশী মানুষ দুটির সাথে আমার চলে যেতে ইচ্ছে করলো। তারপর সকলেই বাড়ি ফিরে গেলো। আমিও বাড়ি ফিরে এলাম এবং আবার আমার ছেলে মেয়েদেরকে পড়ানো শুরু করলাম। বিদেশী মানুষ দুটো যতক্ষণ ছিলো বেশ ভালই লাগছিলো। মনে মনে বললাম আরেকটু থাকলে ভালো হতো।