নিউমার্কেট থেকে ফিরছি। গন্তব্য রাইফেলস স্কয়ার। ওখানে আজ আমাদের ৯৩ ব্যাচমেটদের ইফতার পার্টি।প্রচন্ড গরম সেই সাথে প্রচন্ড জ্যামে পুরো শহর যেন থমকে গিয়েছে। পূর্বাভিজ্ঞতা বলে এই পথটুকু রিকশায় যাওয়ার চেয়ে হেটে গেলে অনেক দ্রুত যাওয়া যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। আমি রিকশায় না উঠে বরং হাটতে থাকি। ঢাকা কলেজের সামনের ফুটপাতগুলো বহুকাল আগেই হকারদের দখলে চলে গেছে। অবশ্য শুধু ঢাকা কলেজ কেন পুরো ঢাকা শহরের সিংহভাগ ফুটপাত এখন হকারদের দখলে। একবার এক হকারের সাথে এ নিয়ে কথা বলতে গেলে তিনি জানিয়েছিলেন স্যার ফুটপাতে না বসলে কোথায় বসবো। সামান্য যে পুজি তা দিয়েতো দোকান ভাড়া নেওয়ার ক্ষমতা নেই। আর তাছাড়া এই ফুটপাত দখল করে যে ব্যবসা করি আমরা সামান্য মানুষ আমাদের কি আর সেই ক্ষমতা আছে ফুটপাত দখল করার। জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন এখানে ক্ষমতাবানদের প্রশ্রয় আছে বলেই আমরা বসতে পারি। আর এই ফুটপাতে আমরা ব্যবসা করি বলেই পরিবার নিয়ে খেয়ে পরে বাচতে পারি। তাছাড়া অনেক মানুষ আছে যাদের বড় মার্কেটে গিয়ে কেনার সামর্থ নেই তারাও উপকৃত হয়। আমি আর কথা বাড়াই না।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামি নামি করছে। আমাকে দ্রুত পৌছাতে হবে। ঢাকা কলেজ পেরিয়ে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ। কলেজের দেয়াল ঘেসে তৈজসপত্র সাজিয়ে এক দোকানী বসে আছেন। তার দোকানে সৌখিন মানুষ ছাড়া তেমন কেউ আসে না। হাটতে হাটতে এক সময় সায়েন্সল্যাব মোড়ে চলে আসি। এই জায়গাটির সাথে অনেক স্মৃতি জড়িত। এক সময় এখানকার দোকান থেকেই গীটার এবং গীটারের যন্ত্রাংশ কেনা হতো। সেসব অবশ্য বহু পুরোনো স্মৃতি। কত কাল যে গীটারে হাত পড়েনি তার ঠিক নেই। মনে পড়ে একবার বাপ্পাদার সাথে টানা এক ঘন্টা একই সুরে গীটার বাজিয়ে তাকে মুগ্ধ করেছিলাম।তিনি বলেছিলেন তুমিতো বেশ বাজাও,কোথা থেকে শিখলে? আমি লাজুক মুখে বলেছিলাম কই আর বাজাই। গীটারতো আপনি বাজান। অমন করে যদি বাজাতে পারতাম! তিনিও আমার মতই আমার কথার বিপরীতে বললেন ধুর আমি আর কোথায় ভালো গীটার বাজাই। এই দেশে গীটার বাজায় আইয়ুব বাচ্চু। তার কথায় অবশ্য যুক্তি আছে। যাই হোক সেই সব স্মৃতিকে পাশ কাটিয়ে ফুটপাতে গিজগিজ করতে থাকা মানুষের ভীড় ঠেলে হাটতে থাকি। সিটি কলেজ পার হতে আমার দশ মিনিট লেগে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় না এই দশ মিনিটে কোনো রিকশা বা গাড়ি দশ হাতও সামনে এগোতে পেরেছে।
সময় বেশি নেই। আমার ব্যাচমেটরা নিশ্চই আমার উপর ক্ষেপে আছে। ওরা বলেছিল ইফতারির অন্তত এক ঘন্টা আগে যেন আমি উপস্থিত থাকি। কিন্তু ঈদের বাজারে ওরা চাইলেইকি আর ওদের মত করে আমি হাজির হতে পারি। ওরাতো বড় বড় চাকরি করে,দামী গাড়িতে চড়ে। আমার কথাতো ভিন্ন। একঘন্টার ছুটিতে আমার যে অসুবিধা হবে ওরা এক সপ্তাহের ছুটি নিলেও তার বিন্দু মাত্র অসুবিধা হবে না।সিটি কলেজ পার হয়ে সীমান্ত স্কয়ারের দিকে হাটছি। বার কয়েক ঘড়ি দেখলাম। তখনো অবশ্য মিনিট বিশেক সময় আছে। হাটতে হাটতে একসময় ডমিনোজ বিল্ডিংয়ের সামনে চলে এলাম। আমি হাটছিলাম ডমিনোজ বিল্ডিংয়ের উল্টো দিকের রাস্তা ধরে। যেই পাশ দিয়ে ধানমন্ডির দিকে গাড়ি চলে সেদিক দিয়ে। হঠাৎ দেখলাম এক রিকশাওয়ালা দাড়িয়ে আছে তার চোখ অশ্রুসজল। সারা শরীর ঘামে ভেজা,মুখ কপাল ঘামে জবজব করছে। কী মনে করে কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? তিনি আমাকে যে কথাটি বললেন তা শুনবো বলে আমি প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বললেন “ ভাড়াটা না দিয়ে লোকটা চলে যেতে পারলো? ভাংতি করে আনছি বলে মিথ্যা অপেক্ষায় রেখে চলে গেলো। ইফতারের সময়ও হয়ে আসলো” বুঝলাম কোনো এক যাত্রী ভাড়া না দিয়ে ভাংতি আনার নাম করে সটকে পড়েছে। এবং এও বুঝলাম এই রিকশাওয়ালা রোজাদার।
তার জন্য মায়া হলো। আমি জানতে চাইলাম কত ভাড়া হয়েছিল? তিনি বললেন ৪০ টাকা। আমি পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দেখলাম সেখানে খুব বেশি টাকা নেই। তার পরও লোকটির ঘর্মাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে খুব মায়া হলো। দুটো বিশ টাকার নোট বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম এই নিন। যে চলে গেছে সে তো ফিরবে না। কিছু মানুষই আছে এমন যারা নামে মানুষ কিন্তু আদতে অমানুষ। লোকটি আমার মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলেন। তার পর আমাকে বিস্মিত করে বললেন আমি নিতে পারবো না। আপনিতো আমার রিকশায় চড়েন নি তাহলে কেন আপনার থেকে টাকা নেবো? রোজা রেখে এই টাকা নেওয়া কি আমার ঠিক হবে? তবে আপনার কথা শুনে ভালো লাগছে। মনটা শান্ত হয়েছে। আমি তাকে বললাম এই টাকাটা আমি আপনাকে খুশি হয়েই দিচ্ছি। মনে করুন আমিই আপনার রিকশায় চড়েছিলাম। আর এটাতো কোনো দান নয়। তার পরও তিনি নিলেন না। তখন তাকে বললাম এক কাজ করুন আমাকে রিকশায় করে সীমান্ত স্কয়ারের সামনে নামিয়ে দিন তার পর টাকাটা নিন। তিনি বললেন তা কী করে হয়? এইটুকু পথ রিকশা ভাড়াতো ৪০ টাকা নয়। বড়জোর বিশ টাকা। আমি তখন উপায় না দেখে বললাম ঠিক আছে আপনি বিশ টাকাই নিবেন আর বাকি বিশ টাকা বকসিস হিসেবে রাখবেন। আমরা যখন হোটেলে খেতে যাই তখনোতো বকসিস দেই।
হোটেলে খেলে যে বকসিস দেওয়া হয় এটা হয়তো তার জানা নেই। তিনি এবার মেনে নিলেন এবং আমাকে বললেন রিকশায় উঠতে। আমি তার রিকশায় উঠে বসলাম। তিনি গামছা দিয়ে মুখের ঘাম মুছে রিকশা চালাতে লাগলেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা রাইফেল্স স্কয়ারে পৌছে গেলাম। তার হাতে সেই চল্লিশ টাকা ধরিয়ে দিয়ে রিকশা থেকে নেমে সীমান্তস্কয়ার বিল্ডিংয়ের দিকে হাটতে শুরু করলাম। হঠাৎ মনে পড়লো লোকটিতো রোজাদার। তাকেওতো আমি চাইলে আমাদের ইফতার পার্টিতে নিতে পারি। এতে অবশ্য আমার ব্যাচমেটরা রাগ করতে পারে বা ছোট চোখে দেখতে পারে। ওরা হয়তো ভাববে ব্যাটা সারাজীবন ছোটলোক থেকে গেলি আর ছোটলোকদের নিয়েই চলাফেরা করতে থাকলি। আবার এমন ভাবনা নাও ভাবতে পারে। আমি চট করে ফিরে এলাম রিকশাওয়ালাকে আমাদের সাথে ইফতার করতে বলবো বলে কিন্তু হায় ফিরেই দেখি তিনি আরেক যাত্রীকে রিকশায় তুলে সবেমাত্র প্যাডেল চালাতে শুরু করছেন। তার রিকশার হাতলে ঝুলছে একটি পলিথিন। সেই পলিথিনের ভিতর থেকে উকি দিচ্ছে কিছু মুড়ি আর ছোলাবুট। হয়তো রিকশা চালাতে চালাতেই মাগরিবের আজান হবে আর তিনি ইফতার করবেন। জীবনের তাগিদে তাকে রিকশা চালাতে হয়। আমার সাথে একদিন ইফতার করে তার কোনো লাভ নেই বরং এই যে ইফতারি পলিথিনে ঝুলিয়ে যাত্রী নিয়ে যাচ্ছেন তাতে কিছু টাকা পাবেন যা দিয়ে তার সংসার চলবে।
কিছুক্ষণ দাড়িয়ে থাকার পর সম্বিত ফিরে পেয়ে দেখলাম রিকশাটা কখন চোখের আড়ালে চলে গেছে। আমি দ্রুত পায়ে আমার গন্তব্যের দিকে হাটতে শুরু করলাম। রিকশাওয়ালা আমাকে একপ্রকার মুক্তি দিয়ে গেছে। তাকে নিয়ে গেলে যে পরিস্থিতি তৈরি হতো তা হয়তো তাকেও আহত করতে পারতো।ইফতারের পাঁচ মিনিট আগে পৌছালাম। বন্ধুদের সাথে কুশল বিনিময় করলাম। টেবিলে টেবিলে নানা পদের ইফতারি সাজানো। হালিম,চপ,পিয়াজু,বেগুনী,বুন্দিয়া,খেজুর,পেয়ারা,পেপে,তরমুজ,আপেল আর মালটার মাঝে উকি দিচ্ছে ছোলা আর মুড়ি। মাগরিবের আজান হয়ে গেলো। সবাই ইফতার করতে শুরু করলাম। কয়েক মিনিট বাদে আমার বন্ধু বদরুলের ছেলে জারিফ বললো আংকেল তুমিতো শুধু ছোলা আর মুড়ি ছাড়া কিছুই মুখে দাওনি? তুমিকি ওগুলো খাও না? আমার মনের মধ্যে তখন সেই দৃশ্যটি ভেসে বেড়াচ্ছে। একটি রিকশা,ঘর্মাক্ত একটি মুখ আর রিকশার হাতলের সাথে ঝুলন্ত পলিথিনের মধ্যে কিছু মুড়ি আর ছোলা।সেই সব ভাবতে ভাবতেই হয়তো ইফতারে অন্য আইটেমের দিকে আর হাত যায়নি। জীবন বড়ই আশ্চর্য জনক।
গল্পঃ মিথ্যা অপেক্ষা
২৪ এপ্রিল ২০২২
ছবিঃ বিদ্যানন্দ – Bidyanondo