ক্ষমতার রাজনীতির চর্চাকারী দলগুলোকে সবসময়ই রাজনীতির মাঠ সরগরম রাখতে হয়। বিরোধী দলের জন্য এটা অনেকটা বাধ্যতামূলক! এতে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সমর্থকরাও উজ্জীবিত হয়। গণতন্ত্রের (!) বিকাশের জন্য খুবই দরকারি উপাদান এটা। রাজনীতি চাঙ্গা রাখার কৌশল বাতলাচ্ছি আমরা। দলগুলো যার যার প্রয়োজন অনুযায়ী কাজে লাগাতে পারে—
লাশ চাই, অন্তত একটা…
রাজনীতিতে লাশের চেয়ে মনোহর শব্দ আর কিছুই হয় না! বিক্ষোভ মিছিল, সভা-সমাবেশ বা অন্য কোনো উপলক্ষে যে কোনোভাবে একটা লাশ ফেলতে পারলেই কেল্লাফতে! লাশের বদৌলতে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি পাওয়া যায়, মিডিয়ার কাভারেজও মেলে! লাশটি দলের কর্মীরই হতে হবে এমন নয়। কোনো নাদান পাবলিক মারা গেলে তাকেই দলের ‘একনিষ্ঠ কর্মী’ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া যায়। বুদ্ধিমান রাজনীতিকরা সেটাই করেন। যদিও মাঝে-মধ্যে মরহুমের অভিভাবকরা মিডিয়ার সামনে ‘আমার পোলা কোনো দল করত না’ বলে সাময়িক বিব্রতকর অবস্থা সৃষ্টি করে। কিন্তু সেটার সমাধানও সহজে করে নেওয়া যায়— ছেলে যে দল করত, অকাট্য প্রমাণ দেখিয়ে দেওয়া যায় দলীয় কার্যালয় থেকেই!
গণতন্ত্র সুরক্ষার অতন্দ্র প্রহরী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা কীভাবে দেওয়া হয়েছে, এর সুরক্ষা কীভাবে করতে হবে, ভিনদেশি মনীষীরা (যাদের নাম জটিল-কঠিন, কষ্টসাধ্য উচ্চারণের!) গণতন্ত্র সুরক্ষায় বিরোধী দলের অবদান কী ইত্যাদি আলোকপাত করতে হবে। অনুগত অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, পদলেহনকারী শ্রেণির মাধ্যমে লাগাতার প্রচারণা চালাতে হবে। বক্তৃতা, টকশো, পত্রিকায় জ্বালাময়ী কলাম লেখানোর মাধ্যমে সহজেই এ বিষবৎ জ্বালা ছড়িয়ে দেওয়া যাবে সাধারণের মাঝে। বুদ্ধিজীবীরা কথায় কথায় রেফারেন্স টানবেন; শান্তি, গণতন্ত্র, স্থিতিশীলতা, পরমতসহিষ্ণুতা ইত্যাদি শব্দ ব্যবহারে বাক্যকে এমনভাবে উপস্থাপন করবেন— শ্রোতা মনে করতে বাধ্য হবে এরচেয়ে ধ্রুব সত্য আর হয় না!
ইথিওপিয়া থেকেই রাষ্ট্র ধারণার উদ্ভব
পণ্ডিতি দেখাতে গিয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলতে পারঙ্গম এমপি, মন্ত্রীরা। এধরনের কথা যেমন হাস্যরস সৃষ্টি করে তেমনি মিডিয়ায়ও ভালো কাভারেজ পায়। বিসিএস পরীক্ষার্থীরা ‘আপডেট’ তথ্যটি মুখস্থ করে রাখে যথাসময়ে উগরে দেওয়ার জন্য। ইতোমধ্যে ‘অমুকের মাথায় মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছে’, ‘শুনেছি ড. কামাল হোসেন অনেক বড় ডাক্তার, তাকে তো কোনোদিন রোগী দেখতে দেখিনি’ কিংবা ‘রবীন্দ্রনাথের শ্রেষ্ঠ রচনা মহেশ’ ধরনের উল্টাপাল্টা কথা বলে অনেক নেতাই সুনাম (!) অর্জন করেছেন। এধরনের ব্যক্তির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। নতুন করে ‘ইথিওপিয়া থেকেই বাংলাদেশের উদ্ভব; রাষ্ট্র ধারণাও এসেছে সেখান থেকেই’ অথবা এমন কোনো কথা বলে সহজেই আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেওয়া যায়। এতে দল ফর্মে থাকবে, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও পাবেন জ্ঞানীর মর্যাদা!
৯৯৯ দলীয় জোট গঠন
বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো এখন এককভাবে নির্বাচন করে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না। জোট, মহাজোট, ঐক্যজোট, সম্মিলিত জোট ইত্যাদি নামকরণের মাধ্যমে দলগুলো ভোটের বাক্স ভরাতে তৎপর। যদিও কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় ১৩ দলের সমাবেশে লোকসংখ্যা ৭ জন, ৫ দলীয় জোটের প্রেস কনফারেন্সে ৩ দলই অনুপস্থিত! এসব বড় কোনো বিষয় নয়। জোট আছে, কাঁধে কাঁধ রেখে ভোটের হাওয়া গায়ে লাগানোর প্রচেষ্টাই হচ্ছে সার কথা।
এখন পর্যন্ত কোনো জোটই ১০০ অতিক্রম করেনি। ৯৯৯ কিংবা ৯৯৯৯ দলীয় জোট গঠন সহজেই প্রতিপক্ষকে ভড়কে দেওয়া যায়! এমনও হতে পারে, প্রতিপক্ষ পালানোর পথ খুঁজে না পেয়ে বৃহৎ জোটেরই শরিক হবে। তখন জোটে তার সদস্য সংখ্যা হবে ১০০০ কিংবা ১০০০০! (ক্ষমতায় যাওয়া ঠেকায় কে)!
মানসিক রোগীরাই সবচেয়ে ভালো প্রচার সম্পাদক
পাগলে কী না বলে, পাবলিক কী না খায়! যে কোনো দলের জন্য বর্তমানে মানসিক রোগীই হতে পারে সবচেয়ে ভালো প্রচার সম্পাদক। প্রচারের জন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিজ্ঞাপন, মাইকিং, চিকা মারা, লবিস্ট নিয়োগ— আরও কত কী করে! এসবের পেছনে অনেক অর্থকড়িও খরচ হয়। সহজেই প্রচারণার কাজটা চালানো যায়— যদি সেটা ছেড়ে দেওয়া হয় মানসিক রোগীদের হাতে। কিছু সংলাপ মুখস্থ করিয়ে দিলে তারা সব জায়গায় লাগাতার বলতে থাকবে। এও বলবে— অমুক দল হচ্ছে সবচেয়ে ভালো রাজনৈতিক দল। এই দলকে যে সাপোর্ট করে না সে কোনো মানুষই না; তার জন্য বাংলাদেশে বসবাস করাটাও অপরাধ!
মানুষ পরিচয় সমুন্নত রাখার পাশাপাশি নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও মানুষ এ দলের দিকে ঝুঁকবে!
আমরা সরকারে গেলে সব দাবি পূরণ করব
প্রবাদ আছে— যে যায় লঙ্কায় সেই হয় রাবণ! (নাকি রাবণরাই ক্ষমতায় যায়?) যে-ই ক্ষমতায় থাকুক, তার ওপরই ক্ষেপে থাকে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে চাহিদা পূরণ না হওয়া পেশাজীবীরা। এদের কারও বেতন কম, কারওবা নিয়মিত বেতন হয় না, কেউ বৈষম্যের যাঁতাকলে হিমশিম খায়…। এমন হাজারো সমস্যা লেগেই আছে। জাতীয় প্রেস ক্লাবে বেশিমাত্রায় দেখা মেলে এই সমস্যা-জর্জরিতদের। বিরোধী দল সমস্যাক্রান্ত মানুষদের ব্যবহার করে সুযোগটা নিতে পারে। প্রতিশ্রুতি দিতে পারে— আমরা ক্ষমতায় গেলে সব দেব; ঘরে ঘরে চাকরি দেব, বিদ্যুৎ দেব, বিদ্যুৎ চলে গেলে কেরোসিন দেব; চুলপড়া বন্ধ ও খুশকি দূরীকরণের জন্য বিশেষ ধরনের নারকেল তেল দেব…।
বোকা মানুষরা আশায় বুক বাঁধবে। বিরোধী দলের প্রতিশ্রুতির ফাঁদে পড়ে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ীই পরিচালিত হবে!
বিজ্ঞাপন আকারে সংবাদ প্রচার
বিজ্ঞাপনের স্বর্ণযুগ এখন। বিজ্ঞাপনদাতারা নানান কৌশল ব্যবহার করে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করছে। রাজনৈতিক দলগুলো বিজ্ঞাপনের সুযোগটা নিতে পারে। প্রচারমাধ্যমে নিজেদের পক্ষে সংবাদ এমনভাবে বিজ্ঞাপন আকারে পরিবেশন করতে হবে যাতে মানুষ ভাবতেই না পারে— এটা সংবাদ নয়, বিজ্ঞাপন! টেলিভিশন খবরের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ থেকে চুক্তিভিত্তিক সময় কিনে নিয়ে তাতে দলীয় প্রচারণা, বড় বড় নেতার গুণগান গাওয়া যেতে পারে। জনসমাবেশে উদ্ভট ঘোষণা, লাগাতার বিক্ষোভ কর্মসূচি, আজই শেষ দিন বলে সরকারকে আলটিমেটাম, দলপ্রধানের একাধিক জন্মদিন পালন, ছাত্র সংগঠনের সাহায্যে সহিংস তাণ্ডব, গণতন্ত্র সুরক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য বিদেশ থেকে পদক কেনা— এসবের বাস্তবায়ন করে তা প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালাতে হবে! আন্দোলন চাঙ্গা না হয়ে যাবে কোথায়!
—
শফিক হাসান