– শর্মিলা বহ্নি
আমি বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। আমার কোন ভাই বোন নেই। অত্যন্ত ছা পোষা এক গরীব পরিবারে জন্ম হয়েছিলো আমার। জন্মের পর থেকে কখনো বাবা মায়ের মুখে হাসি দেখিনি। অভাবের করুণ পরিণতিতে মুখটা সবসময় মলিন হয়ে থাকে তাদের। হাতাশায় ভরা দুটি মুখে যতবারই শুকনো হাসি দেখেছি তাতবারই সে হাসির কারণ ছিল আমার পরীক্ষায় ভালো ফলাফল। আমার সাফল্যে তাদের পৃথিবী সমান আনন্দ হতো তবে সে আনন্দ প্রকাশ হওয়ার আগেই দারুন অভাবে দুমড়ে মুচড়ে ভোঁতা হয়ে যেত। মায়ের ঠোঁটের কোণের সেই এক চিলতে হাসিতে যেন এক আকাশ রহস্য লুকানো থাকতো। তার মধ্যে কতটুকু সুখের কতটুকু দুঃখের তা পরিমাপ করা কঠিন।
মাঝে মধ্যে স্কুল থেকে এসেই চিল্লাচিল্লি করতাম খাওয়ার জন্য। ঘরে খাবার থাকতোনা। কখনো মা আমাকে শান্তনা দিয়ে চুপটি করে বসিয়ে সংসারের অভাবের বর্ণনা দিতেন, আর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলতেন আমাকে অনেক বড় হতে হবে। ওটুকু মাথায় সেদিন মায়ের সংসারের অভাব আমাকে না ভাবালেও বড় হতে হবে এই ব্যাপারটা আমার মনে ধরতো। কখনো আবার মা পাশের বাসা থেকে খাবার এনে দিতো আমাকে। খেয়ে ঠান্ডা হয়ে যেতাম, চলে যেতাম খেলা করতে।
দেখতে দেখতে আমি বড় হয়ে গেলাম। গ্রামের কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করলাম। এ পর্যন্ত অভাবের কিছুই দেখতে বাদ রইলোনা। পড়াশোনার জন্য শহরে পাড়ি জমালাম। বাবা মা আমার জন্য কত মেহনতি করে লেখাপড়ার খরচ চালিয়েছেন তা আমার অজানা নয়। সংসারের এত অভাবের মধ্যে আমাকে পড়াচ্ছেন এটা অধিকাংশ লোকের কাছে শুধুমাত্র উপহাসের অট্টহাসি ছাড়া কিছুই না। তবুও বসে থাকিনি। সম্মুখে অথবা অন্তরালে মানুষের সেই বাঁকা হাসির জবাব দিবো একদিন।
পড়ালেখা শেষ করলাম। চাকরি মেলে না। আমার প্রিয়তমা একরাশ অভিমান নিয়ে আমাকে অকর্ম্য বলে বিবাহ করে নিলো এক বড় ব্যাবসায়ীর সাথে। সে অবশ্য ভুল করেনি। আমার অপেক্ষায় থাকাটা তার যথেষ্ট বোকামি হতো। আমি একের পর এক পরীক্ষা দিতে লাগলাম। আর রেজাল্ট এর অপেক্ষায় দিন গুনতাম। ওদিক সেই শুকনো মুখ দুটি চেয়ে আছে চাতক পাখির মত। আবার কবে ফুটবে সেই ভোঁতা হয়ে যাওয়া মুখে এক টুকরো স্বস্তির হাসি।
এখনো বাবা হাড়ভাঙা খাটুনি করে বাড়ি ফেরে বাবা। এটা দেখার চেয়ে বড় লজ্জার আর কি হতে পারে আমার কাছে।
একদিন বিকালে ঘুম থেকে উঠে আমি বিষন্ন মন নিয়ে ছাদে বসে আছি। বাড়ির কথা খুব মনে পড়ছে। কেমন আছে সেই মানুষ দুটো? এখনো কি রোজ মা মুখ লুকিয়ে কাঁদে? নাকি আমার উপর অভিমান করে বসে আছে?
সেদিনই জানতে পারি আমার একটা পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে। আমার একটা বড় চাকরি হয়েছে। এইতো ২ বছর আগে পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। আমি খুশিতে মুখের ভাষা হারিয়ে ফেললাম। আমার যত ভাষা সব চোখের কোণে এসে জমা হলো। এ ভাষা শুধু ‘মা’ ই বুঝবে। মা কে চিঠি লিখবোনা। মা পড়তে পারেনা। আমি তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাওয়ার জন্য রওনা হলাম। আজ খুশি উপছে পড়ছে আমার হৃদয় ভেঙ্গে। কখন দেখবো সেই বিবর্ণ হয়ে যাওয়া মুখের এক চিলতে জীবন্ত হাসি। না আজ আর শুকনো হাসি থাকবেনা।
মায়ের সেই হাসিমাখা মুখটা দেখতে কেমন হবে ভাবতে ভাবতে আমি রাস্তা পার হতে গিয়েই আমার সব স্বপ্ন নিমিষে শোকের বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে গেল। ট্রাকের নীচে পড়ে গেলাম আমি। খুব ইচ্ছে ছিল যে মাকে জানানো। খুব ইচ্ছে ছিল যে সেই শুকনো দুটি মুখের জীবন্ত হাসিটা দেখার। একবার বলা হলোনা মা আমার চাকরিটা হয়েছে। মায়ের সেই অনুভূতি দেখার আগেই যে আমার সমস্ত অনুভূতি এই সংসার ছেড়ে পালিয়ে গেল। (কাল্পনিক)