নবী হোসেন নবীন
আবুর প্রবল ইচ্ছা সে দেশের এক জন মন্ত্রী হবে। মন্ত্রী হয়ে দুর্নীতিবাজদের রাজ্যছাড়া করবে। প্রবাদ আছে ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। উপায় হিসেবে সে জনসেবার কাজ শুরু করে দেয়। আর্থিক অবস্থা তেমন ভালো না থাকায় জনসেবার কাজ কিছুটা বাধাগ্রস্থ হলেও কোথাও কেউ মারা গেলে তার জানাজায় অংশ নেয়, বিপবে আপদে সবার খোঁজ খরব নেয়, ঈদ এলে এলাকার গরীরদের মাঝে সাধ্য মত সেমাই-চিনি বিতরণ করে। এ ভাবে সে তার নিজ এলাকায় কিছুটা পরিচিতিও পেয়ে যায়। তার এ পরিচিতিকে কাজে লাগিয়ে এবং বন্ধুবান্ধবদের সহায়তায় এক সময় সে এলাকার মেম্বার হয়ে যায়। মেম্বার হওয়ার সুবাদে সে জনসেবার কাজ আরও বাড়িয়ে দেয় ফলে তার পরিচিতি আরও বেড়ে যায়। জনসেবার দ্বারা গড়ে উঠা পরিচিতির সিঁড়ি বেয়ে পরের নির্বাচনে সে ইউনিয়ন পরিষদের চ্যায়ারম্যানও হয়ে যায়। চেয়ারম্যান হওয়ার পর সত্যি সত্যিই তার হাতে জনসেবার এক বিশাল সুযোগ চলে আসে। এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে সে মানুষের মন জয়ে নিজেকে পুরোপুরি নিয়োজিত করে। রাত দুটার সময় কারও মৃত্যুর খবর কানে এলে তখনি সে তথায় চলে যায়। এলাকার মানুষে ঝগড়া বিবাদ মিমাংশায় সে সব সময় ন্যায়ের পক্ষে কাজ করে। ফলে তার ইউনিয়নে মামলা মোকাদ্দমার সংখ্যা অনেক কমে যায়। এক জন যোগ্য চেয়ারম্যান হিসেবে তার সুখ্যাতি চর্তুদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার মানুষ তাকে আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীর হওয়ার জন্য আহবান জানায়। তাদের আহবানে সাড়া দিয়ে সে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার করার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু থেকেই ভাগ্য তার সাথে ছিল এবার ভাগ্য তাকে ছেড়ে যায়নি। মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে এক সময়ের আবু মেম্বার জাতীয় সংসদ সদস্য হয়ে যায়। এবার তার জনসেবার সুযোগ আরও বৃদ্ধি পায়। মানুষের এ ভালোবাসার প্রতিদান দিতে সে আরও বেশি মনোযোগী হয়ে উঠে। তার জনসেবা মানুষের কাছে যথার্থ বলে প্রতিয়মান হওয়ায় সে মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়। ফলে এলাকার জনগণ তাকে বারবার ভোট দিয়ে এমপি বানায় ফলে উপর মহলে তার গুরুত্ব বেড়ে যায়। সর্বশেষ নির্বাচনে জয় লাভ করে সে বাণিজ্য মন্ত্রীর পদ লাভ করে।
এবার সত্যিই তার হাতে দুর্নীতি দমনের কিছুটা সুযোগ আসে। সে সিদ্ধান্ত নেয় সারা দেশের না পারলেও অন্তত বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি সে বন্ধ করবেই। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত থাকায় তার নিজ পরিবারে দায়িত্ব পালনে এখন সে খুব একটা সময় দিতে পারে না। একদিন রাতে তার স্ত্রী বলল আগের গোয়ালা দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
পরের দিন সে হাবু গোয়ালাকে ডেকে এনে প্রতিদিন দশ লিটার করে দুধ দেওয়ার জন্য বলে দেয়। শর্ত একটাই দুধ হতে হবে খাঁটি। হাবু গোয়ালা নিয়মিত দুধ দিতে থাকে। এক মাস পর তার মনে সন্দেহজনক এক প্রশ্নের উদয় হয়। হাবু তাকে খাঁটি দুধ দিচ্ছে তো। নাকি দুধে ভেজাল দিচ্ছে। তা পরীক্ষা করার জন্য কাউকে কিছু না বলে সে উপজেলা ফুড ইন্সপেক্টরকে নিয়োগ করে দেয় প্রতিদিন দুধ পরীক্ষা করার জন্য। এক মাস নিয়মিত দুধ পরীক্ষা করে ইন্সপেক্টর কোনো ভেজাল না পেয়ে হতাশ হয়ে একদিন হাবুকে নিজ অফিসে ডেকে নিয়ে বলল মন্ত্রীর দশ লিটার দুধ হতে প্রতিদিন তাকে এক লিটার করে দুধ দিতে হবে। হাবু কিছুতেই এ প্রস্তাবে রাজি হচ্ছে না দেখে ইন্সপেক্টর বলল আমার প্রস্তাবে রাজি না হলে আমি তোমার বিরোদ্ধে মন্ত্রীর কাছে রিপোর্ট দেবো যে তুমি দুধে ভেজাল দিচ্ছ। তখন তোমার ব্যাবসাও যাবে শাস্তিও পেতে হবে। নিরুপায় হয়ে গোয়ালা তার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তাকে এক লিটার দুধ দিয়ে এক লিটার পানি মিশিয়ে তা পূরণ করে মন্ত্রীর বাসায় দিতে থাকে। এ ভাবে চলে যায় আরও এক মাস।
এবার আবুর মনে নতুন প্রশ্ন ইন্সপেক্টর বেটা সঠিক ভাবে দায়িত্ব পালন করছে তো নাকি কাজে ফাঁকি দিচ্ছে? এ প্রশ্নের উত্তর খোঁজার জন্য সে ইন্সপেক্টরের পিছনে এক জন গোয়েন্দা নিয়োগ করে দেয় গোয়েন্দা অফিসার কিছু দিন গোয়ালা ও ইন্সপেক্টরকে নজরদারিতে রেখে তাদের অপ-কর্ম হাতে নাতে ধরে ফেলে। এবার তারা দুজনই তার কাছে জিম্মি হয়ে গেল। সুযোগ বোঝে গোয়েন্দা অফিসার বলল, এক শর্তে তোদের রেহাই দিতে পারি যদি আমাকে প্রতিদিন দুলিটার করে দুধ দিতে আপত্তি না করিস। এত সহজ শর্তে বিষয়টি নিষ্পত্তি হবে তারা ভাবতেও পারেনি। অতএব কাল বিলম্ব না করে তারা উক্ত প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়। হাবু গোয়ালা এখন দশ লিটার দুধ হতে ফুড ইন্সপেক্টরকে এক লিটার গোয়েন্দা অফিসারকে দুলিটার দুধ দিয়ে তিন লিটার পানি মিশ্রিত করে আবুল হোসেন মন্ত্রীর বাসায় সরবরাহ করতে থাকে।
ভালোই চলছিল তাদের দুর্নীতি রোধে কুনীতি চর্চা। কিন্তু বিপত্তি ঘটে যখন হঠাৎ একদিন মন্ত্রীর কিচেনে হৈ চৈ পড়ে যায়। মন্ত্রীর পাঁচক যখন দুধ কলসী হতে কড়াইয়ে ঢালতে যায় তখন একটি ছোট টাকি মাছ লাফ দিয়ে মাটিতে পড়ে গেলে চারিদিকে হৈ হুল্লোড় শুরু হয়ে যায়। মুহূর্তের মধ্যে খবর পৌঁছে যায় মন্ত্রী আবুল হোসেনের কাছে। শুরু হয় আলোচনা সমালোচনা। একেবারে টক অব দ্যা কান্ট্রি। দুধের মধ্যে মাছ কোথা থেকে কিভবে এলো? ছোট বড় সবার মুখে একই প্রশ্ন। চা-স্টলে চায়ের কাপে ঝড় উঠেছে। নানা জনের মুখে নানা রকম উত্তর ঘুরপাক খাচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, তোমরা যে যাক বলো না কেনো এটি একটি অসুভ লক্ষণ। আমাদের সামনে বিপদ আছে। এখনি সতর্ক না হলে আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
পরের দিন হাবু গোয়ালা, ফুড ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা অফিসারকে মন্ত্রণালয়ে তলব করা হলো। মন্ত্রী মহোদয় বললেন আমার আবু মেম্বার হতে আবুল হোসেন মন্ত্রী হওয়ার ত্রিশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এমন ঘটনা কখনও দেখিওনি শুনিওনি। এবার গোয়েন্দা অফিসারকে লক্ষ্য করে বললেন আজ আমি আপনার কাছে শোনতে চাচ্ছি দুধের মাঝে মাছ কিভাবে আসতে পারে? অফিসার বলল, স্যার আমার মনে হয় গোয়ালা বেটা যে গাভির দুধ আনে সে গাভিটি কোনো জলাশয়ে পানি পান করার সময় মাছটি তার গলা দিয়ে পেটে চলে যায় আর দুধ দোহনের সময় তা গাভির বান দিয়ে বের হয়ে আসে। উত্তর শোনে মন্ত্রী সাব বললেন তোমার উত্তর যৌক্তিক হলেও অদ্ভুত। তোমার মত অফিসার আছে বলেই দেশের দুর্নীতিবাজরা আজও ধরা ছোঁয়ার বাইরে আছে। এবার মন্ত্রী ফুড ইন্সপেক্টরের কাছে জানতে চাইলেন দুধের মাঝে মাছ এলো কোথা থেকে? উত্তরে ইন্সপেক্টর বলল, স্যার আমার মনে হয় গোয়ালা বেটা খুবই বজ্জাত প্রকৃতির লোক সে দুধের মাঝে খণ্ডকালীন মাছের চাষ করে। উত্তর শোনে মন্ত্রী বললেন, তোমার উত্তর শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মত যাতে শাকও পাকেনি মাছও ঢাকেনি। আর তোমার মত ফুড ইন্সপেক্টর আছে বলেই দেশের মানুষ ভেজালমুক্ত খাবার হতে বঞ্চিত। সব শেষে মন্ত্রী হাবুকে বললেন, দুধের মাঝে মাছ চাষের গল্লটি বলো। হাবু শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলল গত কাল দুধের মাঝে টিপ কলের পানি দিতে পারি নাই। তাই বিল থেকে পানি দিয়েছিলাম। মনে হয় ঐ সময় মাছটি পানির সাথে চলে এসেছে। স্যার আমার কোনো দোষ নাই। আমি প্রথম থেকেই আপনাকে খাঁটি দুধ দিতেছিলাম। আমার পিছনে এদেরকে লাগিয়ে দিয়ে আপনি বড় ভুল করেছেন,স্যার। মন্ত্রী বললেন হ্যাঁ, আমি বড় ভুল করেফেলেছি। প্রায়শ্চিত্ত আমাকেই করতে হবে। এবার মন্ত্রীর নির্দেশে তার নিরাপত্তা রক্ষীরা ফুড ইন্সপেক্টর ও গোয়েন্দা অফিসারকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল। মন্ত্রী হাবু গোয়ালাকে আগের মত দুধ দিতে বললেন। হাবু মন্ত্রী পা ছোঁয়ে সালাম করে চলে এলো। পরের মাসের এক তারিখ সকাল বেলায় মন্ত্রীর পিয়ন হাবুর বাড়িতে গিয়ে হাজির। মন্ত্রীর পিয়ন দেখে হাবু চিন্তায় পড়ে গেল। মনে মনে ভাবল মন্ত্রীর বাসায় দুধ দেওয়ার দায়িত্ব নেওয়াটা তার মোটেও ঠিক। হয়নি। কারণ গরীবদের সব সময় ধনী এবং ক্ষমতাসীনদের থেকে দূরে থাকতে হয়। তা না হলে বড় রকমের ঝামেলায় পড়ার ঝুকি থাকে। এমনি কোনো ঝামেলার শংকা নিয়ে সে পিয়নের কাছে এলো। পিয়ন তার হাতে একটি নয় ইঞ্চি লম্বা খাকি রঙের খাম ধরিয়ে দিয়ে বলল মন্ত্রী মহোদয়ের চিঠি। হাবু পিয়নকে বলল, আমি তো খাঁটি দুধ দিচ্ছি। তবে কেন আমার নামে…। পিয়ন বলল আগে খোলেই দেখ না তার পর যা বলার বলো। ভয়ে ভয়ে খাম খোলে হাবু আনন্দে হাউ মাউ কেঁদে ফেলল। মন্ত্রী তাকে উপজেলা ফুড ইন্সপেক্টর নিয়োগ করেছেন। সাথে একটা চিরকুট তাতে লিখা রয়েছে,
প্রিয় হাবু আমার ভালোবাসা নিও। আমি দুর্নীতি দমনের অভিপ্রায় নিয়ে রাজনীতিতে এসেছিলাম, কিন্তু দুর্নীতির শেকড় যে মাটির এত গভীরে চলে গেছে আমি তা কল্পনাও করিনি। দুর্নীতির জালে টাকি মাছটি ধরা না পড়লে আমি কোনো দিন তা জানতেও পারতাম না। এখানেই আমার বড় ব্যর্থতা। আর দ্বিতীয় ব্যর্থতা হচ্ছে তোমার মত সমাজের নিচু স্তরের মানুষদের অবিশ্বাস করা। আর এর জন্য আমি তোমার কাছে ক্ষমা প্রার্থী। এখন আমি বুঝতে পারছি আমাদের দেশের গরীব মানুষগুলোই সৎ। তারা কোনো দুর্নীতি করে না। দুর্নীতি করে ধনী এবং ক্ষমতাশালীরা। আমি তোমাকে ফুড ইন্সপেক্টর নিয়োগ করে আমার ব্যর্থতার দায় ভার কিছটা কমাতে চাই। আশা করি তুমি তা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাবে না ইতি আবুল হোসেন।