শফিক হাসান
সময়টা যদি হয় শনিবার ৪ জানুয়ারি, ২০২৫, জায়গাটা যদি হয় রাজধানীস্থ বিশ্বসাহিত্য
কেন্দ্রের ইসফেনদিয়ার জাহেদ হাসান মিলনায়তন, সারা দেশ থেকে আসা তরুণ লেখকরা
এখানেই ভিড় জমাবেন— এটাই স্বাভাবিক। শুধু কি তরুণ! যশস্বী লেখক, প্রাজ্ঞ
সংস্কৃতজনসহ প্রায় সব শ্রেণির মানুষেই সর্বজনীন সমাবেশস্থল হয়ে উঠেছিল দোতলার
কক্ষটির সঙ্গে মিলিয়ে একচিলতে করিডোর। কয়েকদিন যাবত তীব্র শীত হুল ফোটালেও
শনিবার বিকালের প্রকোপ ছিল অনেকটাই সহনীয় মাত্রার।
অনুপ্রাণন প্রকাশনের নিয়মিত আয়োজনের আরেকটি জমকালো আসর বসেছিল এই দিন।
লেখক সম্মেলন, নির্বাচিত ৩টি বইয়ের পাঠ-উন্মোচন ও তরুণ পাণ্ডুলিপি পুরস্কার-২০২৫
প্রদান— এমনই ছিল অনুষ্ঠান পরিকল্পনায়। কিন্তু ৩ পর্বের অনুষ্ঠান যে ৪ পর্বে গিয়ে
পৌঁছাবে এটা আয়োজকদের কল্পনারও বাইরে ছিল। শেষপর্যন্ত সেটাই হলো। গত ২৩
ডিসেম্বর, ২০২৪ তারিখে গতায়ু হন অনুপ্রাণন সম্পাদনা পর্ষদের অন্যতম সদস্য সুলতানা
শাহ্রিয়া পিউ। বরাবরের মতো এই অনুষ্ঠানেও তার উপস্থাপনা করার কথা ছিল। তার
অনুপস্থিতি ও শোকাকুল পরিস্থিতিতে উপস্থাপনার হাল ধরলেন রূপশ্রী চক্রবর্তী। বাচিক
শিল্পী, কবি ও অনুবাদক সুলতানা শাহ্রিয়া পিউকে শ্রদ্ধা-স্মরণের মাধ্যমেই শুরু হয়
অনুষ্ঠান। ড. অনুপম কুমার পাল ‘তুমি কি কেবলই ছবি/ শুধু পটে লেখা…’ গানটি গাওয়ার মধ্য
দিয়েই সূচনা হয় অনুষ্ঠানের। হলভর্তি মানুষের মধ্যে নেমে আসে নৈঃশব্দ্য। বাতি নিভানো
অন্ধকারের মধ্যেই সবাই অজাতশত্রু পিউর স্মরণ-সংগীতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যান।
স্মৃতিচারণ করেন পিউর ঘনিষ্ঠ সহচর রুখসানা কাজল, আমিরুল বাসার ও মারুফ রায়হান।
শিক্ষক ও লেখক রুখসানা কাজল আবেগাকুল স্মৃতি তর্পণ করে বলেন, ‘পিউ ছিল এক নদী।
মিষ্টি স্বভাবের জন্য সবার প্রিয় হয়ে ওঠে। অনুপ্রাণন সাহিত্য ম্যাগাজিন ও প্রকাশনারও
একান্ত আস্থার জন ছিল সে।’
‘সাম্প্রতিক’ সম্পাদক ও প্রকাশক আমিরুল বাসার অনুপ্রাণনের সঙ্গে সুলতানা শাহ্রিয়া
পিউর দৃঢ় বন্ধনের ইতিবৃত্ত তুলে ধরে বলেন, ‘তার মতো সৃষ্টিশীল মানুষ যদি পাশে না থাকেন,
আমরা বড় একা হয়ে যাই।’
কবি ও সাংবাদিক মারুফ রায়হান বলেন, ‘পিউর সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল মানুষের উপকার
করার। তিনি সৃষ্টিশীল মানুষদের অনুপ্রাণিত করতেন। শিল্পের বিভিন্ন শাখায় সরব ছিলেন
পিউ।’ সুলতানা শাহ্রিয়া পিউর নির্বাচিত রচনা কিংবা রচনাসমগ্র প্রকাশ করার পরামর্শ
দেন জ্যেষ্ঠ এই সাহিত্যিক।
স্বাগত বক্তব্যে সম্পাদক ও প্রকাশক আবু এম ইউসুফ অনুষ্ঠানের ধারা পরম্পরা বর্ণনার
পাশাপাশি সুলতানা শাহ্রিয়া পিউ ওতপ্রোতভাবে অনুপ্রাণনের কার্যক্রমের সঙ্গে কীভাবে
যুক্ত ছিলেন স্মৃতিমেদুর কণ্ঠে যুগ-পেরোনোর গল্পগাথা তুলে ধরেন। স্মৃতিতর্পণ শেষে তিনি
আরও বলেন, ‘অনুপ্রাণন কোনো দল নয়, গোষ্ঠীও নয়। বাংলাদেশের সব লেখকের একটা
প্লাটফর্ম। বিশেষ করে তরুণ লেখকদের। দল-মত নির্বিশেষে সব লেখকেরই প্লাটফর্ম এটা।
প্রগতিশীল হিসেবে নিশ্চয়ই আমরা প্রতিক্রিয়াশীলতাকে সমর্থন করি না। বিগত ১৫ বছর
যাবত শিল্প-সাহিত্যচর্চায় কাজ করে যাচ্ছে অনুপ্রাণন। এটা আরও এগিয়ে যাবে। আমাদের
লক্ষ্য থেকে কখনো বিচ্যুত হব না।’
প্রকাশকের বক্তব্যের পরে আমন্ত্রিত ৮ জন বিশেষ অতিথি— ইসহাক খান, নীরু
শামসুন্নাহার, মণীশ রায়, সরকার আবদুল মান্নান, শোয়েব শাহরিয়ার, গোলাম কিবরিয়া পিনু,
মোজাম্মেল হক নিয়োগী ও স্বকৃত নোমানকে ফুল দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এরপর শুরু হয়
বই আলোচনা। আবদুল মান্নান সরকারের ‘উদ্বাস্তু’ উপন্যাসটি আলোচনা করেন সরকার
আবদুল মান্নান। এসময় তিনি সরস ভঙ্গিতে দুজনই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাহাঙ্গীরনগর)
শিক্ষার্থী হওয়ার পাশাপাশি অভিন্ন নাম থাকার কারণে কী ধরনের বিড়ম্বনা সৃষ্টি হতো তা
উল্লেখ করেন। পরে একজন নিজ নামাংশ সরকার-এর স্থানচ্যুতি ঘটালেও আপাত সমস্যার
সমাধান হয়। কিন্তু প্রকৃত অর্থে বিভ্রান্তি আর ঘুচল না!
উপন্যাসটির ভূঁয়সী প্রশংসা করে সরকার আবদুল মান্নান বলেন, ‘সমাজের অচ্ছুত ধাঙ্গড়
শ্রেণির মানুষকে নিয়ে রচিত উদ্বাস্তু। এই উপন্যাসের কোনো নায়ক নেই। আমরা মনে করি,
সমাজের প্রতিটি মানুষই একেকজন নায়ক-নায়িকা। তাকে কেন আলাদাভাবে নায়ক-নায়িকা হতে
হবে! ধাঙ্গড়দের সমাজটা কেমন, তারা জীবনকে কীভাবে উপভোগ করে, এর সঙ্গে রাজনীতি
আছে কিনা, ধর্মের সম্পর্ক কেমন, ধর্মকে তারা কোন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে— এসব বিষয়ে
উঠে এসেছে উপন্যাসে।’
সরকার আবদুল মান্নান আরও বলেন, ‘এই বিপুল সমাজে ধাঙ্গড়রা নিজেদের অবস্থানকে
কীভাবে মূল্যায়ন করে? কীভাবে তারা বঞ্চিত হয়, প্যাটার্নটা কেমন! মানুষের নানা রকমের
বিভাজনকে আমরা আবদুল মান্নান সরকারের অনন্য সাধারণ উপন্যাস উদ্বাস্তুর মধ্যে পাই।’
মোখলেস মুকুল রচিত উপন্যাস ‘বঙ্গালী ভইলী’র আলোচনা করেন শোয়েব শাহরিয়ার। চর্যাপদে
খুঁজে পাওয়া সেকালের জনজীবন নিয়ে এই উপন্যাসের অবয়ব গঠিত। উপন্যাসটির গুরুত্ব ও
প্রেক্ষাপট বর্ণনা করে শোয়েব শাহরিয়ার বলেন, ‘বাঙালির জাতির গৌরবোজ্জ্বল দিকগুলো
নিয়ে উপন্যাস কমই লেখা হয়েছে। মোখলেস মুকুল এই উপন্যাসে এমন সব শব্দ ব্যবহার
করেছেন— এটা আশ্চর্য ঘটনা। প্রাচীন আমলের প্রচুর শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সব
মিলিয়ে এটা অসাধারণ বই।’
প্রাজ্ঞ এই আলোচক আরও বলেন, ‘ইতিহাসকে কেন্দ্র করে কালোত্তীর্ণ, রসোত্তীর্ণ বা
চিরায়ত উপন্যাস বেশি লেখা হয়নি। বঙ্গালী ভইলী উপন্যাসে মোখলেস মুকুল যে বিষয়গুলো
সন্নিবেশিত করেছেন, সেটা ধারণ করা ও বিশ্লেষণ করা সহজ বিষয় নয়। দীর্ঘকাল পর
চমৎকার একটি উপন্যাস পড়লাম।’ প্রবীর বিকাশ সরকার রচিত ‘জানা অজানা জাপান’ পাঁচ
খণ্ডের বইটির দীর্ঘ আলোচনা করেন নীরু শামসুন্নাহার। তিনি বলেন, ‘অন্য একটি দেশে গিয়ে
সেই দেশের ভাষা-সংস্কৃতি আত্মস্থ করে লেখালেখি করা চাট্টিখানি বিষয় নয়। লেখাজোকা
নিরন্তর চর্চার বিষয়। বিচিত্র বিষয় নিয়ে লিখেছেন প্রবীর বিকাশ সরকার। প্রত্যেক রচনার
পেছনে যথেষ্ট সময় দিয়েছেন তিনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রবীর বিকাশ সরকার বিরলপ্রজ লেখক। বাংলাদেশের গর্ব। বাংলাদেশ-
জাপান সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও তিনি কাজ করেছেন। অন্তর্গত তাগিদ থেকে তাকে দিয়ে
এসব লেখা কেউ লিখিয়ে নিয়েছে।’
পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত বইটিতে প্রবন্ধ রয়েছে ১২৫টি। নির্বাচিত একটি অংশ পড়ে শোনান নীরু
শামসুন্নাহার।
অনুষ্ঠানের শেষ পর্বে (অনূর্ধ্ব ৪০ বছর বয়সী) অনুপ্রাণন পাণ্ডুলিপি পুরস্কার বিজয়ী
তরুণদের বই নিয়ে আলোচনা করা হয়। পুরস্কারজয়ী পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ— মনিকা মারইয়ামের
‘নীল সমুদ্র স্নানে’, ফাগুন মল্লিকের ‘সন্তের মতো একা’, নুসরাত জাহান চ্যাম্পের ‘ছন্দে
বাঁধা দ্বিধা’, হাসনাইন হীরার ‘ব্রাত্যভিটার নকশা’, এমরান হাসানের ‘মোহনীয় মৃত্তিকাগণ’
নিয়ে চুলচেরা আলোচনা করেন ষাটের দশকের যশস্বী কবি গোলাম কিবরিয়া পিনু।
তরুণদের পাঁচটি গল্পগ্রন্থের আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মণীশ রায়। পুরস্কারজয়ী
বইগুলো হচ্ছে— নিবেদিতা আইচের ‘প্রজা কাহিনি’, ফরিদুল ইসলাম নির্জনের ‘সে শুধু আড়ালে
থাকে’, আরিফুল আলমের ‘আধ্যাত্মিক’, আহাদ আদনানের ‘সেদিন বর্ষাকাল’, জয়শ্রী
সরকারের ‘ঈশ্বরকে বল দুখী ডাকছে’।
তরুণদের ৩টি বিজয়ী উপন্যাসের আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক মোজাম্মেল হক নিয়োগী।
বইগুলো হচ্ছে— কামরুল হাছান মাসুকের ‘শরণার্থী’, মিলন আশরাফের ‘ভাগ্য এক কৌতুকের
নাম’, আলিফা আফরিনের ‘বহুরূপী’।
পুরস্কারজয়ী ২ তরুণের প্রবন্ধের বইয়ের উপর আলোচনা করেন কথাসাহিত্যিক স্বকৃত
নোমান। বই দুটি হচ্ছে— মুহাম্মদ ফরিদ হাসানের ‘চিত্রকলার জগৎ’, কাদের পলাশের
‘চাঁদপুরের সংস্কৃতি, লোককথা ও অন্যান্য’।
আলোচকরা তরুণ লেখকদের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরিয়ে দেওয়াসহ
লেখালেখির উৎকর্ষ সাধনের জন্য প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেন। বিশেষ করে মোজাম্মেল হক
নিয়োগী এক নামে বাংলা সাহিত্যে কতটি উপন্যাস আছে সেই পরিসংখ্যান তুলে ধরেন।
নামকরণের বিষয়ে লেখকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
ইসহাক খান বিশেষ অতিথির বক্তব্যে সুলতানা শাহ্রিয়া পিউ’র সঙ্গে পরিচয় ও সম্পর্ক-
রসায়ন বর্ণনার পাশাপাশি অনুপ্রাণনের সঙ্গে তার সেতুবন্ধনের বিষয়টিও তুলে ধরেন। তিনি
বলেন, ‘বাংলাদেশে যত সাহিত্য পুরস্কার আছে, সেসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় হচ্ছে অনুপ্রাণন
পাণ্ডুলিপি পুরস্কার।’
অনুষ্ঠানের শেষ দিকে পুরস্কার বিজয়ীদের উত্তরীয় পরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তাদের হাতে
সম্মাননা স্মারক (প্রত্যয়নপত্র), উপহার ও নগদ অর্থ তুলে দেন বিশেষ অতিথিরা।
অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে শুরু থেকে শেষপর্যন্ত ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন। শুরুতে
ছিল যৌথ পরিবেশনার দুটি গান— ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তিরও বারি/ শুষ্ক হৃদয়ে আছি
দাঁড়ায়ে…’, ও ‘হায় রে আমার মনমাতানো রে/ হায় রে আমার সোনাফলা মাটি…।’
অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় পর্ব শুরু হয় বৃন্দ আবৃত্তি দিয়ে। যৌথ এই পরিবেশনার শিরোনাম ছিল—
‘আমার সীমার বাঁধন টুঁটে’। একক নৃত্য-গীত পরিবেশন করেন রূপতি।
শেষাংশে আফরা তারান্নুম গেয়েছেন— ‘তুমি যে সুরের আগুন লাগিয়ে দিলে মোর প্রাণে/ এই
আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে…।’
খুদে শিল্পী পূর্বা ও পৃথা গেয়েছে বাউল শাহ আবদুল করিমের গান— ‘কেমনে চিনিব তোমারে/
মুর্শিদ ধনহে…।’
রবিউল ইসলাম গেয়েছেন দুটি গান— ‘কতদিন পরে এলে/ একটু বসো/ তোমায় অনেক কথা বলার
ছিল/ যদি শোনো…’ ও ‘পৌষের কাছাকাছি রোদমাখা সেই দিন/ ফিরে আর আসবে কি কখনো/
খুশি আর লজ্জার মাঝামাঝি সেই হাসি/ তুমি আর হাসবে কি কখনো…।’ বৃন্দ নাচ পরিবেশিত হয়
মিথিলা আচার্য’র পরিচালনায়।
সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘শিল্পবাংলা’ ও সিদ্ধেশ্বরী গার্লস কলেজের ললিতকলা কেন্দ্র’র
শিক্ষার্থীদের অনবদ্য পরিবেশনা দর্শকচিত্ত প্রফুল্ল করতে রেখেছে বিশেষ ভূমিকা।
মুগ্ধতার রেশ ফুটে উঠেছিল অনেকের চোখে-মুখে। সাংস্কৃতিক পর্বগুলোতে অংশ নেওয়া শিশু-
কিশোরদের হাতে উপহার তুলে দেন অনুপ্রাণন প্রকাশক আবু এম ইউসুফ ও অনুপ্রাণন
সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য কথাসাহিত্যিক সোলায়মান সুমন।
অনুষ্ঠান উপস্থাপক রূপশ্রী চক্রবর্তীর সহযোগী ছিলেন মিতা আক্তার শিখা ও খাইরুন্নাহার
তামান্না।