পঙ্কজ শীল
এক.
বছরখানেক আগে, নির্ঝরের নতুন ফ্ল্যাটের জানালাটা খোলার পর এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটেছিল। জানালার সামনের ফাঁকা জায়গাটা ছিল ছোট্ট একটা বাগান, তারপর একটা পুরোনো দোতলা বাড়ি। বাড়ির জানালাগুলো সবসময় বন্ধ থাকত, একেবারে সিল করা যেন। আশেপাশের কারও মুখেই শোনা যায়নি বাড়ির কোনো বাসিন্দার কথা।
কিন্তু সেদিন, জানালাটা খুলতেই কেমন যেন একটা অনুভূতি হয়েছিল নির্ঝরের। অদ্ভুত একটা সুর বয়ে এলো বাতাসে, যেন কোথাও কেউ ধীরলয়ে বেহালা বাজাচ্ছে। সে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সামনের বাড়িটার দিকে। সবকিছুই স্বাভাবিক মনে হলো, তবু কোথাও যেন কিছু একটা ঠিক নেই।
রাতে শোবার আগে সেই জানালাটা বন্ধ করতে গিয়ে সে আবিষ্কার করল, সামনের বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে কারও ছায়া দেখা যাচ্ছে। একঝলক মাত্র, তারপরই অন্ধকার। মনে হলো, কেউ তাকে দেখছিল।
দুই.
দিন কেটে যাচ্ছিল। নির্ঝর ব্যস্ত ছিল নিজের কাজে, কিন্তু জানালাটা তার মাথা থেকে যাচ্ছিল না। প্রতি রাতে সে লক্ষ্য করত, সামনের বাড়িটার জানালার ফাঁক দিয়ে কোনো এক ছায়া নড়ে উঠছে, কখনও একটা হাতের আভাস, কখনও মুখের ছায়া।
এক রাতে সাহস করে সে ফিসফিসিয়ে বলে উঠল,
— “আপনি কে?”
কোনো উত্তর এলো না।
পরদিন আবার রাতে সে একই কথা বলল। এবারও কোনো শব্দ হলো না, কিন্তু যেন বাতাসে একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ভেসে এলো।
নির্ঝর ভয় পেয়ে গেল, কিন্তু কৌতূহলও বাড়ল।
পরদিন বাজার থেকে ফেরার পথে সে পাশের বাড়ির এক বৃদ্ধার সঙ্গে কথা বলল।
— “এই বাড়িটা কি অনেকদিন ধরে খালি?”
বৃদ্ধা একটু থমকালো, তারপর বলল,
— “খালি? না রে বাবা, ওখানে একজন থাকত… এক তরুণী, কিন্তু বছরখানেক আগে সে…”
— “সে কী?”
— “সে মারা গেছে।”
নির্ঝরের গা শিউরে উঠল।
— “কিন্তু আমি তো প্রায়ই ওর জানালার ছায়া দেখি!”
বৃদ্ধা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন,
— “ছায়া তো থাকবেই। কেউ কেউ মরে গেলেও একেবারে চলে যেতে পারে না…”
তিন.
সেই রাতে নির্ঝর জানালার সামনে বসল, অপেক্ষা করতে লাগল। ঠিক মাঝরাতে আবার সেই ছায়াটা দেখা গেল। এবার আর ভয় পেল না সে।
সে বলল,
— “তুমি এখানে কেন?”
এবার যেন একটু দেরি করে একটা মৃদু স্বর এল,
— “আমি চলে যেতে পারছি না…”
— “কেন?”
— “আমার একটা গল্প অসম্পূর্ণ রয়ে গেছে।”
নির্ঝরের কৌতূহল বাড়ল। সে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করল,
— “কেমন গল্প?”
— “আমার ভালোবাসার গল্প।”
নির্ঝর থমকে গেল।
— “কে ছিল সে?”
ছায়াটি একটু নড়ল, যেন কষ্ট পাচ্ছে। তারপর বলল,
— “তুমি।”
নির্ঝরের মাথায় ঝড় বয়ে গেল।
সে জানালার পাশে বসে অনেক রাত ধরে ভেবে গেল। সে তো কখনও কাউকে চিনত না, কখনও প্রেম করেনি। তাহলে?
চার.
পরের দিন সে পুরনো কাগজ ঘেঁটে একটা সংবাদপত্রের কাটিং পেল।
“তরুণী লেখিকা অনামিকা আত্মহত্যা করেছেন। অনেকেই বলেন, তিনি একতরফা প্রেমে পরে ছিলেন। মৃত্যুর আগে শেষ উপন্যাসটি অসম্পূর্ণ রেখেছেন।”
নির্ঝরের মাথার ভেতর ঝংকার দিয়ে উঠল।
সে দ্রুত নিজের ল্যাপটপ খুলল, লিখতে শুরু করল।
“একজন তরুণী, যে একতরফা প্রেমে পড়েছিল, কিন্তু সে জানত না, তার ভালোবাসার মানুষ তাকে আগেই ভুলে গিয়েছে।”
লেখার প্রতিটি শব্দের সঙ্গে সঙ্গে জানালার ছায়াটি ম্লান হতে থাকল।
শেষ লাইন লেখার সঙ্গে সঙ্গেই জানালার অপর পাশটা একেবারে ফাঁকা হয়ে গেল।
নিষিদ্ধ জানালার গল্পটা শেষ হলো। কিন্তু নির্ঝর জানত, কিছু গল্প কখনও সত্যিই শেষ হয় না…