জীবন নদীর বাঁকে

রাসেল রবি

0
127


রাসেল রবি

সারা রাত অস্থিরতায় ঘুমাতে পারলো না মনোয়ারা। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে মধ্য
রাত পেরিয়ে গেল। শেষ রাতে যখন দু’চোঁখ ঘুমে জরিয়ে আসছে। তখন কানে ভেসে
আসে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ফাটল ধরেছে। মসজিদের মাইক থেকে প্রচার করা হচ্ছে।
মাইকের আওয়াজ ভেসে আসছে।
প্রথম দফার বন্যার পানি বাড়ি থেকে নামতে না নামতেই দ্বিতীয় দফায় আবার বন্যা দেখা
দিয়েছে। প্রথম দফার বন্যার পানি কমতে থাকলে, এবারের মতো বড় বানের হাত থেকে রক্ষা
পাওয়া গেল। এই আশায় বুক বাঁধে মনোয়ারা। সাত বার প্রমত্তা যমুনার ভাঙ্গা গড়ার
খেলার সাথে সংগ্রামী জীবন তার। গত পাঁচ বছর আগে সর্বশেষ স্থায়ী ভাবে মাথা
গুজিয়েছে পারতিতপরল গ্রামে। এবারও বুঝি রক্ষা করা গেল না। কথাগুলো ভাবতেই,
মনোয়ারার অস্থিরতায় আরও বেড়ে গেলো। আর তখনি মনোয়ারা ভয়ার্ত গলায় ডাকে, ও
মনির ; মনির। কোন জবাব এলো না। মনির গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
মুষল ধারে বৃষ্টি হচ্ছে। টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে দু’কানে কিছু শোনা যাচ্ছেনা।
মনোয়ারা হাত উচিয়ে বেড সুইচ চাপলেন। বিদ্যুৎ নেই। কাছে গিয়ে মনিরকে
জাগিয়ে দেয়ার শক্তিও মনোয়ারার নেই।
আশি ঊর্ধ্ব বৃদ্ধা মনোয়ারা। গত নয় বছর ধরে প্যারালাইসিস এ আক্রান্ত। কোমরের নিচে
থেকে প্যারালাইসিস হয়েছে। অসুস্থ মনোয়ারার দেখা-শুনার দায়ীত্ব পরেছে সপ্তম
শ্রেণীতে পড়া মুমুর ওপর। যেন মনোয়ারার সেবা করার জন্যই আভাগী পৃথিবীতে এসেছে।
সুরমা তেমন দেখা-শুনা করে না শ^াশুড়ির।
বৃষ্টির মাত্রা অনেক কমেছে। কলকল শব্দ করে পানি ঘরে ঢুকছে। সে শব্দ শুনতে পাচ্ছে
মনোয়ারা। মনোয়ারা এবার ডাকে সুরমাকে, ও বউ মা; বউ মা। পাশের ঘর থেকে সুরমা
বিরক্তি স্বরে বলে, চুপ থাকেন। রাত-বিরাতেও চিল্লানী।

  • বউ মা পানি আসে।
  • আসুক।
    ইতোমধ্যে সুরমা ঘুম থেকে জাগা পেয়েছে। হারিকেন জ্বালাতে হাত কাঁপছে। দমকা
    বাতাসে লাইটার বারবার নিভে যাচ্ছে। পানি দেখে ভয়ে আতঙ্কে মুমুর লাবণ্যে ভরা
    শ্যামবর্ণের মুখটা নিরস পাথর হয়ে গেছে।
    উঠানে হাটুর ওপরে পানি। পানি বেড়েই চলছে। মনির উত্তোজিত হয়ে বলে, ভাবি মরণের
    ঘুম দিছো। পানিতে সব ডুবে গেল।
    মুয়াজ্জিনরে আযানের ধ্বনি ভেসে আসছে। দূরে নদী পারের বাড়ি গুলোতে আলো হাতে
    মানুষের ব্যস্ত চলাফেরা দেখা যাচ্ছে। একজন অন্যজনকে চিল্লানী দিয়ে ডাকাছে।

ইলশে গুড়ির হিম বাতাসে নিষ্প্রাণ মন নিয়ে অপলক দৃিষ্টতে নিথর হয়ে পানির গতি
বিধি লক্ষ্য করছে সুরমা। এখন কি করা উচিত বুঝতে পারছেনা। দমকা হাওয়ায় হারিকেনের
আলো নিভিয়ে গেল। আপরদিকে বৃদ্ধা মনোয়ারা ঘরের ভিতরে শিশুদের মতো কান্না করছে।
আশি ঊর্ধ্ব মানুষ এই ভাবে কাঁদতে পারে তা আমার জানা ছিল না।
প্রতি দিনের ন্যায় আজও মাছের নেশায় যারা মধ্য রাতে মাছ ধরতে গিয়েছিলো ভরা
নদীতে। তারা এক হাতে জাল আন্য হাতে আলোর মশাল নিয়ে পানির ভিতরে লম্বা লম্বা পা
ফেলিয়ে এগিয়ে আসছে। পানির থপাশ থপাশ শব্দ হচ্ছে। তাদের মুখে শুনা যাচ্ছে বড়
বাড়ির আম, কাঁঠালের গাছ, বড় দুই ঘর সবি নদীর পেটে। আরা খালি হাত আর পা নিয়ে
আছে।
উঠানে পানি মাজা পর্যন্ত হয়েছে। মনির ছাগল ও এক বস্তা চাল কলা গাছের তৈরী ভেলায়
নিয়ে পাড়ি জমিয়েছে বেড়ী বাঁধের দিকে। ঘরের মেঝেতে রাখা চৌকি পানিতে
ডুবে য়াওয়ায় অসুস্থ মনোয়ারাকে স্থানান্তর করা হয়েছে কাঠের বাক্সের ওপর। শুয়ে শুয়ে প্রলাপ
বকছে।
বারান্দায় চৌকিতে বসে মনিরের অপেক্ষায় প্রহর গুনছে সুরমা ও মুমু। মনির কখন ফিরবে
তাদেরকেও বাঁধে নিয়ে যাবে। আর এর মধ্যে মনোয়ারার হাজারো প্রশ্নের উত্তর দিতে
হচ্ছে মুমুকে।
দড়িয়া দানবের রূপ নেয়ায় প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা পওয়া মানুষ গুলো শেষ সম্বল সঙ্গী করে
তারা ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ে। বান ভাসী মানুষরা বেড়ী বাঁধে ঘর উঠানোর কাজে
ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে। এক পরবিারের হয়ত দুই জন ঘর তৈরী করছে। অপর দিকে ঐ পরিবারের
অন্য সদস্যরা পানিতে তলিয়ে যাওয়া আসবাবপত্র নৌকাতে উঠানোর কাজে ব্যাস্ত। রাস্তা
সংলগ্ন যাদের নিজস্ব জমি সরকারি ভাবে অধিগ্রহণ হয়েছে। তারা সে জায়গায় ঘর
তৈরী করছে। অন্যদিকে বাঁধে যাদের কোন জায়গা নেই। তাদের ঘর তৈরীতে অনেক কাঁঠ-
খড় পুড়াতে হচ্ছে। অনেকে জমির মালিককে অর্থের বিনিময়ে সরকারি জায়গায়
আস্থায়ীভাবে ঘর উঠানোর অনুমতি নিচ্ছে। আবার কেউ কেউ ছুটছে মেম্বারের পিছু
পিছু।
“মেম্বার সাব এনা ছাপরা তুলার জাগা দেও। তিনডে ছোল নিয়ে কুটি থাকমু। বানে
সবি নিয়ে গেছে।”
বাঁধে মানুষ থাকার ঘরগুলো তৈরী হচ্ছে টিনের চাল বেষ্টিত। ঘরের চারপাশে টিনের শেড।
আবার কেউ কেউ পাঠকাঁঠি, পলিথিন, ত্রিপল, জিও ট্যা¯ক্স ব্যাগ দিয়ে শেড তৈরী করছে।
বয়ষ্করা ভেলায় চড়ে গবাদি পশুর জন্য পাঠের কচি পাতা সংগ্রহ করছে।
ইঞ্জিন চালিত নৌকা ভটভট শব্দ করে বাঁধের কিনারে ভিরছে। নৌকাগুলো মালামালে কানায়
কানায় পরিপূর্ণ। যুবকরা খাট, চৌকি, আলমারী সহ ভারী আসবাবপত্র, মহিলারা
ছাগলগুলো কোলে নিয়ে নিরাপদে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ ঘর তৈরীর কাজে
সহয়োগিতা করছে।

হাত গুটিয়ে বসে নেই কোমল মতি শিশুরাও। তারা কেউ স্বল্প ভারীর তৈজ¦স পত্র, কেউবা মিষ্টি
কুমড়া, মুড়ির টিন মাথায় নিয়ে দৌড়িয়ে নিরাপদে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা
অতি উৎসাহের সাথে ব্যাস্ত সময় কাটাচ্ছে।
বাঁধে আশ্রয় নেয়া হাজার হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু মানবেতর জীবন-যাপন করছে।
অনেকেই আবার মাথা গুজিয়েছে আশ্রয় কেন্দ্রগুলোতে। বানভাসী মানুষরা কেউ একবেলা,
কেউ অর্ধবেলা, কেউবা অনাহারে দিন কাটাচ্ছে। এছাড়াও পানি বাড়ার সাথে সাথে
যমুনার প্রবল ¯্রােতে চরাঞ্চালে ব্যাপক ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। সরকারী ত্রাণ ভান্ডার থেকে
বরাদ্দকৃত চাল বানভাসী মানুষদের মাঝে বন্টন করছে স্থানীয় মেম্বার। গত দু’দিনে কারও
কারও চুলায় জ¦লেনি আগুন। তিন বেলা শুধু চিড়া আর গুড় খেয়ে আছে। আর পুবের যমুনার
সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পশ্চিমের বাঙ্গালী নদীর পানিও। পশ্চিমের সবুজ ধানের ক্ষেত
পানিতে তলিয়ে গেছে। দু একটা আধিক উঁচু বাড়ি ছাড়া গ্রামের সবগুলো বাড়িই
পানিতে ভাসছে।
পানি অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আশেপাশের বিশ গ্রাম পানিতে ডুবে গেছে। চারদিকে
মানুষের মাঝে হাহাকার পরেছে। মনির তার মা, ভাবী ও মুমুকে নিয়ে আশ্রয় নিয়েছে
বাঁধের পাশে তৈরী আট টিনের ছোট এক খুপরি ঘরে।
ঘরের চারপাশে পাটকাঠির বেড়া। মনির গ্রামের কলেজ থেকে বিএ পাশ করে একটি
এনজিও সংস্থার মাঠ সংগঠক হিসাবে র্কমরত।
বন্যার পানিতে ভিজিয়ে যাওয়া বই-খাতাগুলো রোদে শুকাতে দিয়েছে মুমু। মনোয়ারা
অসুক বেড়ে গেছে। গত দুই দিন হলে তরল পানীয় ছাড়া কিছুই মুখে দেননা। কথাও
বলছেনা। চোঁখ দুটো স্থির করে শুধু তাকিয়ে আছে।
শ্রাবণের মেঘ মক্ত আকাশ। মুমু ও মনোয়ারা ঘুমাচ্ছে। মনির ও সুরমা খুপরি ঘরের
মেঝেতে বসে এফএম রেডিও’র খবর শুনছে। “উজান নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বগুড়ার
সারিয়াকান্দিতে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে”। বন্যার পানি কমায় তাদের মনে ঘরে
ফেরার আশা জাগিয়েছে। বাহিরে উথালি-পাথাল চাঁদের আলো। খুপরি ঘরের দরজা ভেদ করে
চাঁদের আলো ঘরে ঢুকেছে। পড়েছে তাদের গায়ে। মনে হচ্ছে আলোর ফুল ফুটেছে। এই
রকম চাঁদনী রাতে সুরমার মন খারাপ হয়ে যায়। চাঁদের সাথে মিশিয়ে দিতে হয়
অক্ষিগোলকে জমানো অজস্র আলোর ব্যথা। উষ্ণ চোখের জল। সুরমা বলল, আজ পূর্ণিমার
রাত। তাই না মনির ? – না ভাবী।
গত রোববার ছিল পূর্ণিমার রাত।

  • কি ভোলামন আমার। (দীর্ঘ নি:শাস ছেড়ে)
  • ভাবী গান শুনতে যাবে ? দেবু কাকার বাড়িতে।
  • না।
  • কেন ?
  • মুমু যদি জেগে ওঠে।
  • বেশিক্ষণ থাকবা না।
  • দেবু কাকার মেয়েকে না দেখলে মন জুড়ায় না দেবর ?
  • কি যে, বলো ভাবী।
  • চলো।
    অভাগী সুরমা কি জন্য যে মাটি কামড় দিয়ে এই বাড়িতে পড়ে আছে। আর থাকবেই
    না কেন ? ওর তো আর কেউ নেই। বিয়ের আগেই মা-বাবা মারা গিয়েছে। বড় দুই ভাই
    তেমন কোন খোঁজ খবরও রাখে না। বোনকে বিয়ে দিয়েই বোধ হয় তাদের দায়িত্ব শেষ
    হয়েছে। বাবা-মায়ের কবরের জায়গা যখন নদীতে ভেঙ্গে যাচ্ছিল, তখনই গিয়েছিল ভাইয়ের
    বাড়িতে। তার পর আরও দুু’বছর পেরিয়ে গেল।
    সুরমার স্বামী বিদেশে থাকে। আভাবের সংসারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতেই তার বিদেশে
    পাড়ি জমানো। পাঁচ বছর হয়ে গেল দেশে আসার কোন খবর নেই। লোক মুখে শোনা য়ায়
    বিদেশে নাকি আবার বিয়ে করেছে। প্রতি মাসে শুধু মায়ের চিকিৎসা জন্য যত
    সামান্য টাকা পাঠায়। মনির এনজিও’র একটি চাকুরী যোগার করে দিয়েছিল
    সুরমাকে। কিন্তু মনোয়ারার তীব্র প্রতিবাদে মুখে আর এগানো যায়নি। বাড়ির মেয়ে
    নাকি পর পরুষের সাথে কাজ করতে নেই।
    ঘড়ির কাটা রাত দশটা ছুঁইছুঁই করছে। মনির ও সুরমা হাঁটছে গানের আসরের পথ
    ধরে। বর্ষার বৃষ্টিতে রাস্তার বেহাল আবস্থা হলেও, চাঁদের আলোয় হাঁটতে মন্দ লাগছে না।
    গাছে গাছে বর্ষার কদম যেন বন্যার শোভা বাড়িয়েছে। বাঁধের পুবে যতদুর চোখ যায়
    শুধু পানি আর পানি। চাঁদের আলোয় পানি রূপালী রং ধারণ করেছে। রাস্তার দু পাশে
    ছড়িয়ে থাকা পাট কাঠিগুলো মানুষের মতো দাড়িয়ে আছে। আবার কোথাও কোথাও
    বাঁশের তৈরী আড়ে ঝুলিয়ে রাখা পাটের সোনালী আঁশগুলো ঝিরিঝিরি বাতাসে ললনার
    চুলের মত উড়ছে। বাঁধের পাশে ডেরা তুলে কয়েক জন ঝিটকি দিয়ে মাছ ধরছে। কমতি
    পানি তাই জালে বেশি মাছ ধরা পরছে। এক জন চিল্লানী দিয়ে বলছে, উঠছে রে। অন্য জন
    সুর মিলিয়ে বলছে, আজ তুর কপাল কপাল খুলছে। কেউ আনন্দে গান ধরেছে। কেউ
    বিড়ি ফুকাচ্ছে। আবার এক জন অন্য জনকে হাত এগিয়ে বিড়ি দিচ্ছে। ‘ধর খাঁ
    গাডা গরম কর।’ বাঙালির চিরাচরিত নিয়মে গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর মাঝে
    আথিতীয়তার কোন ঘাটতি নেই।
    দেবন্দ্রেনাথ দত্তের বাড়িতে প্রতি মঙ্গল বার গানের আসর বসে। কবে থেকে এই রেওয়াজ
    চালু হয়েছে। তা কারো জানা নেই। দেবন্দ্রে দত্ত দেখেছে তার বাবাকে, তার বাবা দেখেছে
    তার বাবাকে। এই ভাবেই চলে আসছে।
    বাঁধের আদূরেই চুন সুড়কির তৈরী দু’তালা বিশিষ্ট বিশাল উঁচু বাড়িটাই
    দেবন্দ্রেনাথ দত্তের। আশে পাশের দশ গ্রামের মানুষের কাছে দেবন্দ্রেনাথ দত্ত সংক্ষেপে দেবু
    দত্ত বলে সর্বাধিক পরিচিত। বাড়ির চারপাশ বর্ষার পানিতে টুইটম্বর। দেবন্দ্রেনাথ দত্তে
    বাড়ির প্রবেশ পথেই বড়সড় একটি বট গাছ দাঁড়িয়ে আছে। গাছটির ছায়া পরেছে
    মাটিতে। দত্তের মতো দেখাচ্ছে। কোথায় থেকে যেন ভেসে আসছে পাকা কদম ফুলের
    মিষ্টি গন্ধ। পচা পাটের নেশা জরানো মদকতার গন্ধ।
    রাতের আঁধারে গাছের ডালে বাদুরগুলোর ওরা-উরির শব্দে সুরমার গা ছমছম করে উঠল। তা
    একটু পরেই ঠিক হয়ে গেল। দেবু কাকার শূণ্য পূরণ বাড়িটা। বন্যায় প্রাণোবন্ত হয়ে

উঠেছে। উঠানের পৃর্ব দিকে বড় বড় কয়েকটি টিনের ঘর দেখা যাচ্ছে। ঘরের ভেতরে
চার্জার লাইট জ্বলছে। পুরানো টিনের হাজারো ছিদ্রভেদ করে আলোর প্রতিফলন বাহিরে
আসছে। বড় বাড়ির বান ভাসীরাই এখানে আশ্রয় নিয়েছে। উত্তরের ছোট ছোট খুপরি
ঘরগুলোতে আশ্রয় নিয়েছে জেলে পাড়ার গুটি কয়েক বান ভাসি পরিবার। তাদের ঘরগুলোতে
পিদিমের আলো মিটমিট করে জ¦লছে। শিশুরা কান্না করছে।
গানের আসর বসেছে উঠানের দক্ষিণের মঞ্চে। মঞ্চের সামানে বসে আছে দুই শতাধিক
নারী-পুরুষ। সুরমা ও মনির বসেছে বাতাবি লেবুর গাছের গা ঘেষে। গান গাওয়ার জন্য
প্রস্তুতি নিচ্ছে দেবন্দ্রেনাথ দত্তের মেজো মেয়ে অঞ্চিতা দত্ত। ভারি মিষ্টি গলা তার। গান
ধরেছে Ñ ভেঙ্গ মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে/ ও বন্ধু আমার / না পেয়ে তোমার
দেখা/ একা একা দিন যে আমার কাটে না রে…….
প্রতিদিনের ন্যায় আজও সন্ধ্যায় চায়ের দোকানের টেলিভিশনে বন্যার র্সবশেষ পরিস্থিতি
জানতে ভীর জমিয়েছে বানভাসীর মানুষরা। অধীর আগ্রহ নিয়ে তীর্থের কাকের মতো
বসে আছে গ্রামের সরল মনা মানুষগুলো। কখন তাদের এলাকার বন্যা পরিস্থীতির খবর জানতে
পারবে।


“এদিকে প্রবল বর্ষণ ও উজান নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বগুড়ার সারিয়াকান্দিতে বন্যা
পরিস্থিতির একটু উন্নতি হয়েছে। আজ বুধবার পর্যন্ত সরকারী তথ্য অনুযায়ী সত্তর
হাজার মানুষ পানি বন্দী। গত আটচল্লিশ ঘন্টায় উপজেলায় যমুনার ভাঙ্গনে পাঁচটি
গ্রাম নদীগর্ভে বিলিন হয়েছে। বুধবার সারিয়াকান্দি পয়েন্টে বিপদ সীমার সাতান্ন
সেন্টিমিটার থেকে নেমে সাতচল্লিশ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহ রের্কড
করা হয়েছে। অপর দিকে ত্রাণের চাল চুড়ির ঘটনায় তদন্ত কমিটি সারিয়াকান্দি উপজেলার
চন্দনবাইশা ইউনিয়নের বন্যা দূগর্ত মানুষদের মধ্যে বিতরণ করা ত্রাণের চাল কম দেওয়ার
ঘটনায় তদারক কর্মকতাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্য বিশিষ্ট
কমিটি গঠন করা হয়েছে।”
খবরের ফাঁকে কেউ এক জন আক্ষেপের সুরে বলে ওঠে, শালারা গরিবের চাউল মারে খায়। তুর
ওপর আল্লার গজব পরবি।
টানা বার দিন হলো বিপদ সীমার ওপর দিয়ে বইছে যমুনা নদীর পানি। এতে খোলা
আকাশের নিচে আশ্রয় নেয়া শতশত উদবাস্তু মানুষরা মনবতরে জীবন যাপন করছে। দেখা
দিয়েছে তীব্র বিশুদ্ধ খাবার পানি ও খাদ্য সংকট। সরকারেরে বরাদ্দ কৃত ত্রাণ সহায়তাও
পযার্প্ত না। বন্যয় কারও কারো ভাগ্যে পাঁচ-সাত কেজি চাল জুটলেও,
আনেকের ভাগ্যে তাও জুটেনি। বান ভাসী পল্লীতে নেমে এসেছে সন্ধ্যা। কেউ ঘরের পাশে
বাঁধের উপরে আবার কেউ ঘরের সামানে ভাসমান ভেলার উপর চুলা বসিয়ে রান্নার
আয়োজন করছে।
অন্য দিকে স্কুলে পানি উঠায় মার্বেল খেলায় মেতে উঠৈছে পাড়ার শিশুরা। দিনে-রাতেও
সমান তালে চলছে তাদের দূরন্ত পনা। অনেকের বই-খাতা পানিতে ভেসে যাওয়ায় বড়দের
সাথে চায়ের দোকানে টিভি দেখে অলস সময় পার করছে।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

মনোয়ারা খুব অসুস্থ। শক্ত কাঠের চৌকিতে শুয়ে শুয়ে মৃত্যুর জন্য প্রহর গুণছে। দু’চোখ
স্থির করে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুমুর দিকে। মা হারানো মমু নানীকেই মা বলে
ডাকে। একবার বড় বন্যার সময় মুমুর জন্ম হয় নৌকাতেই। অসুস্থ মাকে যখন জামথল
থেকে নৌকা দিয়ে সারিয়াকান্দি সদর হাসপাতালে আনা হচ্ছিল। তখনি তার মা পথের
মধ্যেই মুমুকে পৃথিবীর আলো দেখিয়ে, নিজে না ফেরার দেশে পাড়ি জমায়। হাঁটি
হাঁটি পা পা করে মুমু কৈশরে পা রাখছে ……..
মুমু মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। সুরমা পায়ে তেল মালিশ করে দিচ্ছে। হতম্বভ হয়ে
দাঁড়িয়ে আছে মনির। ওর চোখ ছলছল করছে। প্রতিবেশী মহিলা ও কন্যা শিশুরা ভির
জমাচ্ছে দরজায়। কেউ সূরা ইয়াসীন পরছে। আরার কেউ শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ
মুছছে।
গত তিন দিন আগে ভোর রাতে মনির স্বপ্ন দেখেছিল তাদের পুরাতন বাড়ির উপর দিয়ে কলা
গাছের ভেলায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো একটি লাশ ভেসে যাচ্ছে। বড় বন্যা হওয়ায় লাশটি
কবর দেয়া সম্ভব হয়নি। তাই ভেসে দেওয়া হয়েছে……..

Facebook Comments Box
Previous articlePoem by IRENA JOVANOVIC || ইরিনা জোভানোভিচের তিনটি কবিতা
Next articleশীতকাল
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here