Thursday, November 21, 2024
Homeসাহিত্যগল্পএকটি কিশোরীর ময়নাতদন্ত

একটি কিশোরীর ময়নাতদন্ত

পত্রিকার অফিসে মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার বিজ্ঞপ্তিটি দিয়ে সবে মাত্র বাসায় ঢুকতে যাবে এমন সময় হঠাৎ ফোনের রিংটি বেজে উঠল। ক্লান্ত শ্রান্ত রাহেলা বেগম ফোনের রিং শুনে আঁতকে উঠল। পরক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়ে তড়িঘড়ি করে গেটে দাঁড়িয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটি বের করল রাহেলা বেগম। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের ফোটা জমে আছে। মেয়ের চিন্তায় দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সারা রাত। তাই চোখের নিচে কালো দাগগুলো বেশ স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। গতকাল থেকে অনেক দখল গেছে তার ওপর। হাসিখুশি পরিবারটির মাঝে যে এমন একটি দিন আসবে কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। কথায় আছে মন্দ কথা বাতাসের গতির চেয়েও বেশি বেগে চলে। হয়েছেও এমনটি।

আশেপাশের চারদিকে শুধু রাহেলা আন্টির মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার কথাই শুনা যাচ্ছে বেশি। গতকাল সন্ধ্যা থেকে আমাদের পাশের বাসার রাহেলা আন্টির একাদ্বশ শ্রেণি পড়ুয়া মেয়েকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। নানুর বাসা, খালুর বাসা, বান্ধবীর বাসায় খুঁজতে খুঁজতে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত গিয়েছিল ধানমন্ডি থানায়। ধানমন্ডি থানায় মেয়ের নিখোঁজ হওয়ার একটি সাধারণ ডায়েরিও টুকে এসেছেন রাহেলা বেগম। থানা থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে তারা যত দ্রুত সম্ভব প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেবে। তবে রাহেলা বেগমের পরিবার একটি মাধ্যমের উপর ভরসা করে বসে থাকতে চায়নি। তারা অনেক ভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছে মেয়েকে খুঁজে পাওয়ার। নানাজন নানান পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

তবে এমনটি যে এই প্রথমবার হলো এটাও কিন্তু নয়। এর আগেও বেশ কয়েকবার এভাবে রাগ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল সিনথিয়া। যখনি গিয়েছে; হয় বাবার সাথে, না হয় মায়ের সাথে অভিমান করে। আর গিয়ে উঠেছিল নানু কিংবা খালুর বাসায়। তখন অবশ্য অভিমান ভাঙলে সে নিজ থেকে এক বা দুদিন পর ফিরে আসত। কিংবা তার কোনো আত্মীয় তাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে যেত। তাছাড়া সিনথিয়া যে এই ঢাকা শহরে কিচ্ছু চেনেনা এটাও কিন্তু নয়। সিনথিয়ার জন্ম – শৈশব, বেড়ে উঠা সবই এই শহরে। স্কুল থেকে কলেজে পা রাখতে রাখতে সে দেখেছে ঢাকা শহরের বদল। দেখেছে মানুষের ছুটে চলা। শিখেছে অনেক কিছু। সিনথিয়ার বেশ ভালো একটা ফ্রেন্ড সার্কেল আছে। মধ্যবিত্তের চেয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তানের আধিক্যই বেশি সেই সার্কেলে।  দামী মোবাইলে বন্ধুরা মিলে টিকটক করা। সময়ে-অসময়ে দামী রেষ্টুরেন্টে গিয়ে গেটটুগেদার করা ওসব ছিল তাদের নিত্তনৈমিত্তিক ব্যাপার।

সদ্য স্কুলের গণ্ডি ডিঙিয়ে কলেজে পা রাখা আদরের মেয়েকে অভাব কি জিনিস তা এতটুকুনও বুঝতে দেয়নি ঢাকায় তিলে তিলে বিশাল এক ঠিকাদারি ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলা নাজমুল সাহেব। একমাত্র মেয়ে যখনি যা কিছু আবদার করেছে তা সাথে সাথে পূরণ করেছেন। ছোটবেলায় বাবাকে হারিয়ে খেয়ে না খেয়ে যে কষ্ট নাজমুল সাহেব সহ্য করেছেন বাবা হিসেবে হয়তো তা মেয়েকে বুঝতে না দেওয়ার এক নিদারুণ প্রচেষ্টা। সিনথিয়া যে পড়াশোনায় খারাপ এমনও কিন্তু নয়। জিপিএ ফাইভ এসেছিল এসএসসিতে। সবাই মনে করেছিল হয়তো সেই ধারাবাহিকতা কলেজে গিয়েও থাকবে। কিন্তু ভুল। অনেক সময় অনুমানও নিজেকে ভুল প্রমাণিত করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ঠিক যেমনটি হয়েছিল সিনথিয়ার বেলায়ও। পড়াশোনাকে ছাপিয়ে টিকটক করা কিংবা অহেতুক আড্ডা দেওয়া এখন মূখ্য হয়ে উঠেছে তার কাছে।

সময় অসময়ে আবদার। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে ঘুরে বেড়ানো। এ যেন এক অন্যরকম সিনথিয়া। দেখতে দেখতে কলেজের ফাস্ট টার্মে এক সাবজেক্টে খরাপ করেছে সে। এক সাবজেক্টে অকৃতকার্য  হওয়ার জন্য যখন বাসায় মেয়ের নামে নালিশ আসল তখন একটু নড়েচড়ে বসেছে নাজমুল সাহেব। এ নিয়ে মেয়েকে বেশ কয়েকবার বকাঝকাও করেছিল রাহেলা বেগম। তবে সিনথিয়া যে এভাবে নিরুদ্দেশ হয়ে যাবে তা কল্পনাও করেনি কেউ। বড়জোর ভেবেছিল আগের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে হয়তো। আদরের মেয়ের কোনো হদিস না পেয়ে গতকাল থেকে নাজমুল সাহেব কোনো খাবারদাবার মুখেই তুলেনি। এর মধ্যেও রাহেলা বেগম একটু শক্ত থেকে সব কিছু সামাল দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

অবশ্য তিনিও মেয়ের ব্যাপারে খুব ভালো করে জানেন। সামান্য পান থেকে চুন কষলে যে মেয়ে রাগ করে বাসায় আসে না তা রাহেলা বেগম ভালোই বুঝেন। গত দুসপ্তাহ আগে পড়াশোনায় মনযোগ দেওয়ার জন্য যখন একটু বকাঝকা করেছিল তখনও সিনথিয়া এভাবে নিরুদ্দেশ হয়েছিল। কিন্তু পরেরদিনই নানুভাই এসে সিনথিয়াকে ফিরিয়ে দিয়ে গেছে। কিন্তু এবারেরটা পুরোই আলাদা। কারো সাথে না আছে মান,না অভিমান। হুট করে সদ্য স্কুল ড্রেস ছেড়ে গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন জড়ানো চঞ্চল মেয়েটি এভাবে কাউকে কিছু না বলে উদাও হয়ে গেল। সত্যি বিষয়টি রাহেলা বেগম আর নাজমুল সাহেবকে ভাবিয়ে তুলল। সেই যে ভোরে বের হলো রাহেলা বেগম পেটে সামান্য দানাপানিও পড়েনি। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে ধুরুধুরু মনে ফোনটি রিসিভ করলো সে। মেয়ের হদিস পাওয়া গেল এই বুঝি! ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসল, ‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। আমি ধানমন্ডি থানা থেকে এডিসি আবুল খায়ের বলছি।’

রাহেলা বেগম থরথর করে কাঁপছে। ‘হ্যাঁ, বলুন।’  ‘আসলে আজ দুপুর একটার দিকে রবীন্দ্র সরোবরের পাশে একটা কিশোরীর লাশ পাওয়া গেছে। আমাদের সাইবার ডিপার্টমেন্ট ওর ফোন থেকে মা লিখা এই নাম্বারটি খুঁজে বের করেছে। লাশটি এখন ঢাকা মেডিকেলের মর্গে রাখা আছে। দয়া করে আপনারা একটু ঢাকা মেডিকেলের মর্গে এসে লাশটা একটু শনাক্ত করে যাবেন।’ এডিসি আবুল খায়েরের মুখ থেকে কথাটি শুনে রাহেলা বেগমের মুখ দিয়ে কান্না ছাড়া আর একটি শব্দও বের হলো না। বিলাপ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। মাথা ঘুরিয়ে ঢলে পড়ে যাবে এমন সময় নাজমুল সাহেব আর ড্রাইভার আরমান রাহেলা বেগমকে ধরে ফেললেন।

মিনিট চল্লিশেক পর যখন তারা ঢাকা মেডিকেলের মর্গে গিয়ে পৌঁছালেন তখন দুপুর ঘড়িয়ে বিকেল।  ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের একজন গাইনি ডাক্তার আর একজন নার্স লাশটি দেখানোর জন্য রাহেলা বেগম আর নাজমুল সাহেবকে মর্গের ভেতরে নিয়ে গেলেন। মর্গের সামনে  ইতিমধ্যে কিছু সাংবাদিক জড়ো হয়েছে ঘটনাটি লাইভ করার জন্য।  অপ্রীতিকর ঘটনা সামাল দিতে পুলিশও নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিয়ে রেখেছে মর্গের একপাশে। মর্গের সামনে থাকা নাম না জানা একটি ছোট গাছে থরে থরে ঝুলে আছে পলিথিনে মোড়ানো কিছু পার্স আর ডকুমেন্টস। সাথে কিছু জামা-কাপড়ও। ওসব নাকি বেওয়ারিশ লাশদের জিনিসপত্র। এর মধ্যে কিছু জিনিস পঁচেগলে নষ্ট হয়ে গেছে।

হয়তো ওয়ারিশ খুঁজে পেলে বেওয়ারিশ লাশগুলো আপনজনের ছোঁয়ায় একটু মাটি পেত। একটা ঠিকানা পেত। কিন্তু সেই ভাগ্য বেওয়ারিশ লাশদের কপালে নাই। মর্গের ভেতর প্রবেশ করতেই রাহেলা বেগম আর নাজমুল সাহেবের চেপে রাখা কান্না স্পষ্ট হতে শুরু করল। বাইরে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে কিছু স্বজন অপেক্ষা করে আছে। তুলতুলে এক কিশোরীর নিথর দেহের সামনে পৌঁছাতেই নাজমুল সাহেবের বুকফাটা কান্না। মুখ থেকে বের হলো একটি মাত্র শব্দ, ‘মা রে।’ পাগলপ্রায় রাহেলা বেগম নিথর কোমল শরীরটির ওপর হাত বুলাচ্ছে। আর বিড়বিড় করে বলছে, ‘দুষ্ট মেয়ে। আবদার রাখিনি বলে মা-বাবার সাথে এমন অভিনয় করতে হয়। উঠ মা, উঠ। লক্ষ্মীটি আমার।

এমন করিসনে। চল বাড়ি গিয়ে এইবার তুই যা যা বলবি সব শুনব।’ নিথর দেহটির স্পর্শ কাতর অঙ্গ গুলোতে মারাত্মক জখম। ছোপ ছোপ রক্তের দাগে পুরো জামা আর প্যান্ট ছেয়ে গেছে। গাইনি ডাক্তার নিজের ভাষায় সাংবাদিকদের বর্ণনা করে যাচ্ছেন, ‘আসলে মেয়েটি বিকৃত লালসার স্বীকার হয়েছে। অস্বাভাবিক এই বিকৃত কাজটাকে আমরা আমাদের মেডিকেলের ভাষায় প্যারাফিলিয়া বলি……….।’ মর্গের একপাশে একজন ডোম যাকে ফরেনসিক মেডিসিনের ভাষায় মর্গ অ্যাটনডেন্ট বা মর্গ সহকারী বলা হয় ওনাকে দেখা গেল কিছু চকচকে চাকু, কাঁচি আর একটা হাতুড়ি পরিষ্কার করতে। প্রাণ চঞ্চল একটি কিশোরী থেকে সদ্য লাশ হয়ে যাওয়া নরম তুলতুলে নিথর দেহটি কেটে চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের মৃত্যুরহস্যটা উদঘাটনে তিনিও হয়তো একটি মূখ্য ভূমিকা পালন করবেন। ‘হ্যাঁ, অবশ্যই স্যার। মেয়েটিকে ময়নাতদন্ত করার জন্য আমরা ওনার পরিবারকে বুঝিয়েছি। আর আমরা মেয়েটির কয়েকজন টিকটক ফ্রেন্ডদের গ্রেফতার করে আমাদের হেফাজতে নিয়েছি।’ ওয়াকিটকিতে এক কেতাদুরস্ত পুলিশ অফিসার এসব বলতে বলতে এগিয়ে আসলেন নাজমুল সাহেবের দিকে। তারপর সাইন করার জন্য বাড়িয়ে দিলেন ঢাকা মেডিকেলের লোগো সমেত একটি  ফাইল। যেখানে বড় বড় হরফে লিখা আছে  ” ময়নাতদন্ত।”

গল্পঃ ” একটি কিশোরীর ময়নাতদন্ত “

 হিমু চন্দ্র শীল

               

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments