একটা সিন্ডিকেটের বদমাইশিতে প্রতিনিয়ত কাগজের দাম যেভাবে হু হু করে বাড়ছে তাতে প্রকাশকরা চোখে অন্ধকার দেখছেন। ফলে বইয়ের দাম তাঁরা বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। এক বছর আগেও আমার ১০ ফর্মার (১৬০ পৃষ্ঠা) যে বইটির দাম ছিল ২৫০ টাকা সেই বই এখন ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা দাম রাখতে বাধ্য হচ্ছেন প্রকাশকরা। প্রকাশকরা কখনোই বইয়ের দাম বাড়তি রাখতে চান না তাতে বিক্রি কমে যায়। আর বই বিক্রি কমে গেলে প্রকাশক এবং লেখক উভয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে একটা পর্যায়ে হয়তো অনেক প্রকাশকই প্রকাশনা ব্যবসা গুটিয়ে নেবেন। লেখকরা তখন কী করবেন?
লেখালেখি যাদের পেশা তাঁদের তো লিখতেই হবে। তখন হয়ত বিকল্প হিসেবে নিজেদের লেখা ই-বুক হিসেবে বের করবেন। ই-বুক প্রকাশনায় কোন খরচ নেই উল্টো বিশাল পরিমাণে রয়ালটি দেয়া হয় ই-বুকে। যেমন দেশের বৃহত্তম ই-বুক প্রকাশনা সংস্থা সেইবই ৭০% রয়ালটি দেয়। অর্থাৎ ১০০ টাকা বইয়ের দাম হলে লেখক ৭০ টাকা পান রয়ালটি। তবে সমস্যা হল সেইবই ৪ মাস পরপর রয়ালটি দেয় যা দিয়ে লেখালেখির উপর নির্ভরশীল কারও পক্ষে চলা মুশকিল। তাছাড়া আমাদের দেশে ই-বুক সংস্কৃতি এখনো ততোটা জোরাল ভাবে গড়ে ওঠেনি যে হাজার হাজার বই বিক্রি হয়ে যাবে এক মাসে। যদি দেশের একটা বড়সড় পাঠক শ্রেণী ই-বুক পড়তেন তাহলে সেইবই বা বইটই এর মত আরও অনেক ই-বুক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠত। তাতে লেখক- প্রকাশক এবং পাঠক দারুণ উপকৃত হতেন। প্রকাশক কোন খরচ ছাড়া বই বের করতে পারতেন। লেখক ভাল রয়ালটি পেতেন এবং পাঠক খুব কম দামে বই কিনতে পারতেন। একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বুঝিয়ে দিচ্ছি।
কিছুদিন আগে অনন্যা প্রকাশনী আমার latest spy thriller অনুবাদ দা ইলেভেন্থ কমান্ডমেন্ট বইটি বের করেছে। ২২ ফর্মা (৩৫২ পৃষ্ঠা) বইটির মূল্য রেখেছেন প্রকাশক ৫৫০ টাকা। কাগজের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি না পেলে তিনি হয়তো আরও ১০০ টাকা কম রাখতে পারতেন। যাহোক, এ বইটির এককালীন পেমেন্ট বাবদ আমাকে প্রকাশকের বড় অঙ্কের একটি টাকা দিতে হয়েছে। কারণ সত্ত্ব প্রকাশকের। আর অনুবাদ বইয়ের সত্ত্ব প্রকাশকের থাকলে অনুবাদক একবারে বেশ কিছু টাকা পেয়ে যান, এখানে রয়ালটি হিসাব করা হয় না। তো এ বইটি পাঠককে দোকান থেকে হয়তো ২৫% কমিশনে অর্থাৎ ৪১৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে। সেইসঙ্গে দোকানে গিয়ে বই কেনার যাতায়াত খরচ বাড়তি। আর যারা রকমারির মত অনলাইন প্রতিষ্ঠান থেকে বইটি সংগ্রহ করছেন তাদেরকে কুরিয়ার খরচ দিতে হচ্ছে আরও ৪০ টাকা। তারমানে বইটির দাম দাঁড়াল ৪৫৫/।
এখন এ বইটি যদি ই-বুক হিসেবে বের হত তাহলে প্রকাশক হয়তো নতুন বই হিসেবে ১৫০ টাকা দাম রাখতেন। এবং পাঠক ১৫০ টাকা দিয়ে তার মোবাইলে বইটি ডাউনলোড করতেন । অতিরিক্ত আর কোন খরচ তাঁকে করতে হত না। ই-বুক যেহেতু রয়ালটি হিসেব করে, লেখককে আগাম কোন টাকা দিতে হত না প্রকাশককে। তাঁর এই খরচটাও বেঁচে যেত। কিন্তু লেখক? তিনি কী করবেন? পাঠকপ্রিয় একজন লেখক যখন জানতে পারছেন তাঁর ই-বুক মাসে ১০০০ কপি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, তিনি তখন নিশ্চিন্ত মনে প্রতিমাসে একটি করে বই লিখতে পারবেন। কারণ প্রকাশক যদি তাঁর ই-বুক থেকে মাসে ৫০% হারেও রয়ালটি দেন, লেখক ৭৫,০০০/ পাবেন। আর বইয়ের কাটতি থাকলে লেখককে মাসে মাসে রয়ালটি দিতে প্রকাশকের আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু মিলিয়ন ডলারের প্রশ্ন এটাই- বাঙালি পাঠক ই-বুক পড়বেন কিনা?
বিশ্বজুড়ে ৩৫ কোটি বাংলাভাষী জনগোষ্ঠী রয়েছেন। এর মাত্র ১% ও যদি নিয়মিত ই-বুক পড়েন তাহলে অবস্থাটি কী দাঁড়াবে – কল্পনা করুন একবার! ৩৫ লাখ বাঙালি একযোগে বাংলা ভাষায় লেখা ই-বুক পড়ছেন। তখন প্রকাশকরা প্রায় সবাই ই-বুকের দিকে ঝুঁকে পড়বেন। আর হারামি কাগজ সিন্ডিকেট ক্রেতার অভাবে পথের ভিখিরি হবে। তবে মুশকিল হল ই-বুক কালচার এর পালে আমাদের দেশে কবে হাওয়া লাগবে কেউ জানে না। এই যে লেখাটা লিখলাম , অনেকেই হয়তো বলবেন তাঁরা ছাপা বই পড়তেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কিন্তু তাঁরাই আবার বইয়ের মূল্য বৃদ্ধিটাকে মেনে নিতে চান না।
যদি ছাপা বইই পড়তে চান, বর্তমান পরিস্থিতিকে মেনে নিন। বইয়ের দাম বৃদ্ধির জন্য প্রকাশককে গালমন্দ করার আগে একবার ভেবে নিন- কতোটা বাধ্য হলে একজন প্রকাশক বইয়ের দাম বাড়ান। আর মূল্য বৃদ্ধির পেছনে লেখকের কোন হাত থাকে না। মূল্য নির্ধারণ করেন প্রকাশক বইয়ের বাজার অনুযায়ী যেখানে কাগজের দাম সহ বই ছাপার অন্যান্য অনুষঙ্গের মূল্য বৃদ্ধি দায়ী থাকে। আর যদি ছাপা বই পড়তে না চান, ই-বুক পড়ুন। বইকে অবসরের সঙ্গী করতে চাইলে যে কোন একটা দিক বেছে নিতেই হবে। আর যদি সিদ্ধান্ত নেন বইই পড়বেন না, তাহলে বলব- পড়ুয়া মানুষ আপনি! বই না পড়ে থাকতে পারবেন?