মিথিলা মেহজাবিন
[ ১]
পহেলা জানুয়ারি |নতুন বছর। জীবন নামক গল্পকথার আরো একটি গত হওয়া অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নব
অধ্যায় লেখা শুরু। নতুন বছরের গল্প খানা ক্যানভাসে রঙিন ছোঁয়ায় আঁকতে চায় জারা তাবাসসুম। প্রজাপতির
রং গায়ে মেখে হাসনাহেনার ঘ্রাণ চোখে মুখে লেপ্টে অ্যালবাট্রস পাখির মতো দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে দিগন্তে
মিলিয়ে যেতে চায় সে।
ইতিমধ্যেই চারিদিকে বহুদূর বিস্তৃত হয়ে সুবাস ছেয়ে গেছে তার। মাধ্যমিক স্কুলের প্রতিটি আনাচে কানাচে
সেই সৌরভ পাওয়া যায়। সকলেই এক নামে চেনে জারাকে। চিনবেই তো। পরপর চার বছর ‘বেস্ট স্টুডেন্ট অব
দ্যা ইয়ার’ খেতাবটা যে জারার ঝুলিতেই জমা হয়েছে। শুধু পড়াশোনা নয়; সেই সাথে আবৃত্তি, বিতর্ক, উপস্থিত
বক্তৃতাতেও তার জুড়ি মেলা ভার। চারিদিকে জারার বড্ড সুখ্যাতি। বাবা-মাকে কথা দিয়েছে জারা, ‘তাদের মুখ
উজ্জ্বল করবে। ভবিষ্যতে ডাক্তার হয়ে দেশ ও দশের সেবা করবে। বাবা মায়ের গর্বের কারণ হবে।’
নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় চমকপ্রদ রেজাল্ট করে এবছরও যখন ‘বেস্ট স্টুডেন্ট অব দ্যা ইয়ার’ এর
মেডেলটা নিয়ে আসলো; তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে প্রতিদান স্বরূপ স্রষ্টার প্রতি দুফোঁটা অশ্রু বিলিয়ে দেন
জারার বাবা মা। মেয়ের কৃতিত্বে বাবা-মায়ের হৃদয় এক অদৃশ্য গর্ব ও সুখের অনুভূতিতে ভরে উঠে।
জারার অন্তরাত্মায় খুশির জোয়ার বয়ে যায়। এই আনন্দ উল্লাস দ্বিগুনে পৌঁছায়, যখন তারই পুরাতন এক
স্কুল ফ্রেন্ড আয়াত তার স্কুলে এসে ভর্তি হয়। প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালীন বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল তারা।
বাহ্যিক অবয়বে দু’জনের মিললো বহুত। পার্থক্য শুধু এতটুকুই জারার সেই সখী তার চোখের জ্যোতি খুইয়ে ডাম্বেল আকৃতির দুটি ফ্রেমের মধ্যে কনভেক্স লেন্সে দৃষ্টি সহায়ক বসিয়েছে। আর এদিকে জারা অক্ষুণ্ণ জ্যোতির অধিকারী। কিছুদিন যেতেই তাদের দেখে আড়ালে আবডালে অনেকেই বলেছে, ‘এক পাটে বাঁধা বন্ধুত্ব’।
[২]
মে মাসের শেষ দিকে কোনো এক বর্ষার দিনে স্কুলের টিফিন পিরিয়ডে জারার হাতে কিছু বকুল ফুল গুঁজে দিল
আয়াত। মুহূর্তেই জারার বদনখানি হাস্যোজ্জ্বল হয়ে উঠল। তবে এই হাসির রেশ বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না।
পরক্ষণেই হতাশার গ্লানি নেমে আসলো জারার সরল চোখে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো জারা,
_ ‘জানিস, আয়াত। বকুল ফুল আমার বড্ড পছন্দ। এক আকাশ পরিমাণ ইচ্ছে হয়, কোনো এক ঝিরঝিরে বৃষ্টির
দিনে বকুল গাছতলায় ফুল কুড়াবো, তারপর সেই ফুলের মালা হাতে পড়ে সেটার মনমাতানো ঘ্রাণে পাগলপারা হয়ে
দুই হাত মেঘাচ্ছন্ন আকাশের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে চিৎকার করে বলবো_ বসুধা তুমি বড্ড বিভাবতী।’
_ জারার চোখের সরল বাসনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে দেখছে আয়াত। মুহূর্তেই আর্জি জানায় সে, ‘চল জারা।
আজকেই তোর এক আকাশ স্বপ্ন হাতে এনে দেই।’
_ ‘কিন্তু কি করে? স্কুল ছুটি হতে বিকাল চারটা বাজবে। তারপর কোচিং ক্লাসে যেতে হবে।’
_ ‘দেখ, জারা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। চল মিলন কাকুর দোকানের পাশে ব্রীজের ধারে যাই। সেখানে ব্রীজ ঘেঁষে
বকুল গাছ আছে। বকুল ফুলের সুবাস, সেই সাথে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি খালে পড়ে কেমন মুক্তো দানার মতো দেখায়,
দেখবি চল।’
প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্যের ডাক বেশিক্ষণ উপেক্ষা করতে পারলো না জারা। সৌন্দর্য কাছে ডাকে, পথে
কোনো বাধা নেই, আটকায় কিসে! তবে আটকে ধরলো এক অবুঝ প্রাণী,
_’জারা, তুই টিফিন পিরিয়ডে কোথায় যাচ্ছিস? তুই কখনো একটা ক্লাস-ও মিস দিস না যে?’
ব্যাচমেট রাফিয়ার এমন হকচকা প্রশ্নে জারা কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। গাঁইগুঁই করে কিছু একটা বলতে
যাবে তখন-ই মুখের কথা ছোঁ মেরে নিয়ে আয়াত উত্তর দিল,
_ ‘জারা একটু অসুস্থ রে রাফিয়া। তাই ওকে বাড়িতে দিতে যাচ্ছি। আমরা প্রিন্সিপাল স্যারের থেকে ছুটি
নিয়েছি।’
মিথ্যা বলতে পারে না জারা। এজন্যই রাফিয়া আর বাঁধা দেয়নি। জারা ভাবছে, ‘যাক, জীবনে প্রথম ক্লাস ফাঁকি
দিয়ে মিথ্যা বলে ঘুরতে যাওয়ার একমাত্র বাঁধা কেটে গেল। এবার তাহলে যাওয়াই যায়।’
কিন্তু এসবের মধ্যেই জারার মনের মধ্যে একটা কাঁটা খচখচ করছিল। তবে অনুশোচনার মালা বেশিক্ষণ গাঁথতে
দিল না আয়াত। কাঙ্ক্ষিত স্থানে পৌঁছাতেই আয়াত স্কুল ব্যাগের সবচেয়ে ভিতরের পকেট থেকে বের করলো
চকচকে গোলাপের পাপড়ি রঙা কভার দেওয়া একটা স্মার্টফোন। যেটা দেখে আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে
মুখের ভাষা প্রায় হারিয়ে ফেলেছে জারা।
_ ‘আয়াত! স্মার্টফোন! তোর কাছে ফোন কি করে এলো?’_ আমতা আমতা করে বললো জারা’স্কুলে ফোন আনা নিষেধ। কেউ দেখলে কি হতো? আর আঙ্কেল আন্টি জানলে কি হবে? এই ফোন কোথায় পেয়েছিস? আঙ্কেল আন্টি তোকে কস্মিনকালেও এই বয়সে ফোন ব্যবহার করতে দিবে না!’ জারার মুখে যেন আজ খই ফুটছে। অন্য সময়ে জারা অনেক অন্তর্মুখী স্বভাবের। ‘আরে বাবা, একটু শ্বাস নে আগে। প্রশ্নের বন্যা বইয়ে দিলি যে!’শঙ্কিত দৃষ্টিতে জারার দিকে চেয়ে উত্তর দিল আয়াত ‘না, আব্বু আম্মু আমাকে ফোন কিনে দেয়নি। ইভেন, আমার কাছে যে ফোন আছে সেটা তারা জানেও
না।’
_ বিস্মিত নয়নে হরিণের মতো চেয়ে প্রশ্ন করে জারা, ‘তাহলে? কোথায় পেলি স্মার্টফোন?’
_ যারার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে সন্দেহের উদ্রেকের আভাস পেতেই নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের চেষ্টায় তড়িৎ
উত্তর দিল আয়াত, ‘তুই আবার আমাকে চোর ভাবিস না জারা। এই ফোন আমি গিফট পেয়েছি। এটা
আমাকে……..।’
এইটুকু বলেই জিভে কামড় দেয় আয়াত। পাছে ভয় হয় তার, সত্যতা জানার পরে সেটা যদি সবাইকে বলে দেয়
জারা! তাই প্রসঙ্গ বদলাতে উৎসুক দৃষ্টিতে আয়াত বললো, ‘যারা ঐ ব্রিজের উপর উঠে দাঁড়া, তোর কিছু ছবি
তুলে দেই। 108 MP এর ক্যামেরা। বেশ ভালো ছবি উঠে।’
পুনরায় কোনো কৌতুহল না দেখিয়ে ভদ্র বাচ্চার মতো আয়াতের নির্দেশ পালন করলো জারা।
[৩]
স্কুল থেকে দশম শ্রেণীর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষার নোটিশ দিল আজ। শ্রেণিকক্ষের অধিকাংশ শিক্ষার্থীর
মুখটা বাংলা ‘ঙ’ এর মতো হয়ে আছে। হাওয়া বেরিয়ে চুপসে যাওয়া বেলুনের মতো মুখ নিয়ে জারার সম্মুখে এসে
আহাজারি করছে আয়াত।
_ ‘জারা, বড্ড টেনশন হচ্ছে। এতো তাড়াতাড়ি পরীক্ষার নোটিশ দেওয়ার ছিল! আমার কিচ্ছু পড়া হয়নি। এবার
যদি রেজাল্ট খারাপ হয়, তাহলে আব্বু আম্মু আমাকে মেরেই ফেলবে রে।’কাঁদো কাঁদো চেহারায় কথাটি বললো আয়াত। ‘আরে দোস্ত, টেনশন নিস না। ম্যা হু না; ম্যা কারুঙ্গি মেরি ইয়ার কি মাদাত। শোন এখন থেকে আমার সাথে
গ্রুপ স্টাডি করবি।’নক্ষত্র ভরা উজ্জ্বল আকাশের মতো জ্বলজ্বলে চোখে কথাটি বললো জারা। কিন্তু এতেও আয়াত নিশ্চিন্ত হতে পারলো না। মন খারাপ করে বসে রইল। টিফিন পিরিয়ড হতেই অনুনয়ের সুরে জারাকে এসে বললো, ‘আমার ভালো লাগছে না। চল না সখী, ঘুরতে যাই। আইসক্রিম কিনবো, পার্কে গিয়ে নাগরদোলায় চড়বো।‘
_ ‘তারপর স্কুল ফাঁকি দিয়ে পরীক্ষায় আন্ডা আনবো।‘
_ ‘আরে তুই তো তুখোড় ছাত্রী। একদিন ফাঁকি দিলে কিচ্ছু হবে না। সেদিনের কথা মনে আছে তোর? কত্তো মজা
করেছিলাম আমরা বৃষ্টিতে ভেজা, বকুল ফুল কুড়ানো, ফুচকা খাওয়া, ফটোগ্রাফী। আর শোন, আজ ঘুরতে গেলে সেই প্রশ্নের উত্তর খোলাসা করবো। কি করে ফোন পেয়েছি সেটাও বলবো।‘ স্বভাবতই জারা বড্ড কৌতুহলী। রহস্য উন্মোচনের নেশা তাকে ঘিরে ধরলো। আয়াতের ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারলো না।
[৪]
জারা লক্ষ্য করলো ফটোগ্রাফীতে বড্ড শখ আয়াতের। ফুল-লতা-পাতা, কিংবা পরিত্যক্ত জমিতে অযত্নে গজিয়ে ওঠা কোনো ফুলকুঁড়ি-র ম্লান মুখ, কখনো বা শিশির স্নানিত দেহ, আর কখনো বাতাসে দোল খাওয়া রৌদ্রোজ্জ্বল হাঁসি সবটাই অতি যত্নে সন্তোর্পনে মুঠোফোনে বন্দি করে রাখাই তার প্রিয় কাজ। অজান্তেই
আনমনে এমন একটা স্মার্টফোনের তীব্র তামান্না ঠাঁয় পেলো জারার হৃদয়-মননে।
পার্কের বেঞ্চে বসে আইসক্রিম খাচ্ছে তারা। উৎসুক দৃষ্টিতে জারা জিগ্যেস করলো,
_ ‘এবার বল তো সখী, স্মার্টফোন কে গিফট করেছে তোকে?’
ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি এনে অদূরে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা কলেজের ইউনিফর্ম পরিহিত দুইটা ছেলের দিকে
হাত বাড়িয়ে ইঙ্গিত করলো আয়াত। একজনের ঝাঁকড়া চুল, যেন কাকের বাসা। আরেকজনের চুল ঠিক আছে;
কিন্তু শার্টের কলার উঁচিয়ে রাখা। কলার উঁচিয়ে রাখা ছেলেটার প্রতি ইঙ্গিত করে আয়াত বললো,
‘এই দেখ জারা, মাই ফ্যাবুলাস হিরো। তোর দুলাভাই। এনিই সেই ব্যক্তি যে আমাকে ফোন গিফট করেছে।’
আয়াতের কথায় অবাক হয়ে ছানাবড়া চোখে তাকিয়ে আছে জারা। ছেলে দুটো কাছাকাছি দূরত্বে এসে তাদেরকে
সম্বোধন করলো,
‘হাই আয়াত। হুয়াটস আপ।’কলার উঁচিয়ে রাখা, আয়াতের বয়ফ্রেন্ড ওয়ালিদ মৃদু হেসে বাঁকা চোখে জারার দিকে তাকিয়ে বললো ‘এটাই তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড? হ্যালো জারা।’
জারা এবার রাগে ফুঁসছে। সাপের মতো শো শো আওয়াজে বেঞ্চে রাখা স্কুল ব্যাগটি কাঁধে নিয়ে চপল পায়ে হাঁটা
ধরলো জারা। হঠকারিতায় আয়াত যেন কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। তড়িঘড়ি করে ছেলে দুইটার থেকে বিদায় নিয়ে
জারার পিছু পিছু ছুটলো।
_ ‘জারা! ওয়েট। আমার কথা শোন। দাঁড়া, রাগ করলি নাকি?’
_ ‘রাগ করার মতো কাজ কি করিস নি তুই? একটা অচেনা, অপরিচিত ছেলে তোকে এতো দামি একটা
ফোন গিফট করলো আর তুই সেটা নিয়ে নিলি?’
_ ‘আরে দোস্ত, ওয়ালিদ অচেনা ছেলে হতে যাবে কেন। ওর সাথে আমার বিয়ে হবে। তখন তো ওর যা আছে সেটাই
আমার হয়ে যাবে।’
_ ‘মানে কি এসবের! তার উপর ছেলেটা কোন সাহসে আমার সাথে কথা বলতে আসে? তুই জানিস না, আমার আব্বু
আম্মু কোনো ছেলের সাথে আমাকে কথা বলতে নিষেধ করেছেন। আর তুই-ই বা কেন কথা বলিস। আবার নাকি
বিয়ে করবি তোরা! আঙ্কেল আন্টি জানলে কি হবে?’
_ ‘তুই একটু শান্ত হ। প্লিজ আব্বু আম্মুকে কিছু বলিস না। ওয়ালিদের কথা জেনে যাওয়ায় আব্বু অনেক ঝামেলা
করে পুরাতন স্কুল থেকে ট্রান্সফার করিয়ে নতুন স্কুলে এনে ভর্তি করিয়েছে আমাকে। এখন যদি আবার এসব
তার কানে যায়, তাহলে আমার জানাজা পড়িয়ে দিবে। প্লীজ কাউকে কিছু বলিস না।’
_ ‘সেই ভয় আছে তোর?’
আয়াত আর কথা বাড়ালো না। জারা-ও নিশ্চুপ। গোমড়া মুখে বাড়ি ফিরলো সে।
[৫]
মাগরিব নামাজের পর পড়তে বসেছে জারা। জুলাই মাসের গরমে অসহায় অবস্থা। প্রকৃতি যেন ঝিম ধরে আছে।
জারার মা ইসমত আরা মেয়ের জন্য লেবুর সরবত করে নিয়ে এলো। সারাদিন জুড়ে তাপসের রুক্ষ মেজাজ সহ্য
করার পর দিনশেষে এক গ্লাস ঠান্ডা সরবত যেন দেহ ও মনে প্রাণ এনে দেয়।
পদার্থবিজ্ঞান বই খুলতেই বইয়ের ভাঁজে নানারঙে ফুল আঁকানো একটা রঙিন কাগজ চোখে পড়ে জারার। কাগজে
কিছু একটা লেখা আছে। মনের মধ্যে সন্দেহের উদ্রেক হতেই বইটা বন্ধ করে দেয় জারা। পাশেই ইসমত আরা
দাঁড়িয়ে আছে।
_ ‘কি হলো মা, বই বন্ধ করলে কেন? এখন পড়বে না?’
_‘জি পড়বো। আগে ম্যাথ করবো।’
মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে স্নেহের চিহ্ন রেখে দিয়ে চলে গেল ইসমত আরা। জারা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো, যাক
তার মা কিছু ঠাহর করতে পারেনি।
কাগজটা পড়তে শুরু করলো জারা।
প্রিয় জারা,
আমি জানি, আমি তোমার কাছে অপরিচিত, কিন্তু তোমার চোখে এবং হাসিতে এমন কিছু আছে যা আমাকে
গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি চাই, তুমি আমাকে সুযোগ দাও। আমি তোমাকে প্রমাণ করতে চাই যে, আমি
তোমার বিশ্বাসের প্রতিদান দিতে পারি।
তোমার প্রতিক্রিয়া জানাও, আমি অপেক্ষা করবো।
ইতি,
সাদিক
ফোন নম্বর: 01*
চিঠিটা পড়ে জারা থ বনে গেছে। বুঝতে পারছে না, কি করে এটা বইয়ের মধ্যে এলো। তাহলে কি সে যা ভাবছে তাই!
রহস্য উন্মোচন করতে মায়ের ফোন থেকে আয়াতের বাড়িতে ফোন দিয়ে আয়াতের সাথে কথা বলে নিল। হ্যাঁ
জারার ধারণাই সঠিক। চিঠিটা পার্কে দেখা হওয়া ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটাই দিয়েছে। আর এটা বইয়ের মধ্যে পুরে
দিয়েছে আয়াত। নিজের ডিকশনারিতে যে কয়টি শ্রাব্য অশ্রাব্য গালিগালাজ ছিল সব ক’টাই প্রয়োগ করলো
আয়াতের উপর। তারপর চিঠিটা চারটুকরো করে জানালা দিয়ে বাইরে ফেলে দিল।
[৬]
শ্রাবণ মেঘের দিন। বাইরে মেঘের গুরুগম্ভীর আওয়াজ শোনা যায়। এই বুঝি আকাশ ফুঁড়ে জলধারা নেমে আসবে।
রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে জারা। বাতাসের ঝটকা এসে উড়িয়ে দিচ্ছে জারার ভ্রমর কেশ। এলো
চুলের ফাঁক দিয়ে আঁখি গিয়ে আটকালো জানালার বাইরে মাটিতে শুয়ে লুটোপুটি খাওয়া চারটুকরো কাগজের দিকে;
দিন তিনেক আগে হৃদয়ের সমস্ত ক্ষোভ মিটিয়ে যেইটা বাইরে ফেলে দিয়েছিল। আচমকা মেঘের গর্জনে চমকে
জানালার পাশ থেকে সরে আসে জারা। ড্রেসিং টেবিলের সামনে আয়নায় এলো চুল ঠিক করতে গিয়ে মনে পড়লো
সেই লাইনটা, “তোমার চোখে এবং হাসিতে এমন কিছু আছে, যা আমাকে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে।’’ আয়নায়
নিজের প্রতিচ্ছবি দেখে জারা ভাবছে, আসলে কি আছে এই হাসিতে! বাইরে মেঘের ডাক শুনতে পাচ্ছে জারা,
ভিতরেও আরেকটা ডাক শোনা যায়। ধুপ ধুপ ধুপ। হ্যাঁ এটা জারার হৃদয়ের ধ্বনি।
মুহূর্তেই বৃষ্টি নামলো। পড়ি কি মরি করে জারা দৌড়ে গেল বাড়ির পিছন টায়; চার টুকরো কাগজের কাছে। প্রায়
ভিজে চুপসে গেছে। ভাবছে, আহা! বৃষ্টির এতো তাড়া কিসের। একটু রয়ে সয়ে আসলেই পারে।
চার-টুকরো কাগজ, চার-দেয়ালের মধ্যে থেকেই চার কোণা ক্রিনের বদৌলতে সংযোগ ঘটালো দুটি হৃদয়ের। হোক
রাত, কিংবা দিন এই সংযোগের অবিরল স্রোত ধারা প্রবাহিত হতে থাকলো; ঠিক যেন ভিন্ন পথে প্রবাহিত
হওয়া দুইটি নদী হঠাৎ একত্রে মিলিত হয়ে বৃহৎ পরিসরে তীব্র স্রোতে প্রবাহিত হওয়ার মতো। দিন যায়,
ক্ষণ যায়; স্রোতস্বীনির স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যায়।
মায়ের কাছ থেকে ইউটিউবে ক্লাসের ভিডিও দেখা, গুগল থেকে তথ্য সার্চের বাহানায় স্মার্টফোন নিয়ে রেখেছে
জারা। জারার বাবা আজমল হোসেন এই ভেবে খুশি হলেন যে, ইদানিং বইয়ের সঙ্গে মেয়ের অন্তরঙ্গতা
অত্যাধিক বেড়েছে। কিন্তু এই অন্তরঙ্গতার আড়ালে যে ঘন কালো মেঘ পুঞ্জীভূত হয়েছে, সেটা তাদের
দৃষ্টিগোচর তৎক্ষণাৎ হলো না।
তবে একদিন ঠিকই নজরে পড়লো। যখন মেঘ গুরুগম্ভীর গর্জনে বজ্রধ্বনি হয়ে আগাম দুর্যোগের আভাস দিয়ে
গেল।
জারার দুঃসম্পর্কের এক চাচা তৌহিদ শেখ, আজমল হোসেনকে এসে জানালেন, ‘ভাইজান, কথাটা যে কি করে
বলবো! তবে না বলেও উপায় নেই। আপনার মেয়ে মানে, সে আমার-ই মেয়ে। তাই তার ভবিষ্যতের কথা ভেবেই এই
অনাকাঙ্ক্ষিত তীক্ত কথার রস আপনাকে দিতে আসতে হলো।’
কুঁচকানো ভ্রু, কপালে ত্রী-রেখার ভাঁজ জানান দিচ্ছে আজমল হোসেনের উদ্বিগ্নতা। যেই মেয়ের প্রশংসায়
সকলে পঞ্চমুখ থাকে, আজ কিনা তার সম্পর্কে তীক্ত কথার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অভয় বাণী পেয়ে তৌহিদ
শেখ আবার বলতে থাকলো,
‘ভাইজান। আপনার মেয়েকে পার্কে একটা ছেলের সাথে দেখলাম। তারা হাত ধরে খোশগল্পে মেতে হাঁটছিল। জারা
মামনি আমাকে দেখতেই……’
একটা আচমকা ধ্বনিতে কথা আর আগালো না। ইসমত আরার রুক্ষ স্বর শোনা গেল, তার মেয়ের নামে কেউ
বদনাম দিতে আসলে কাউকে ছেড়ে কথা বলা হবে না।
হাজার হলেও নাড়ি ছেঁড়া ধন; সন্তানের নামে কলঙ্ক যেন আগে বাবা মায়ের গায়ে আঁচড় কাটে। সবকিছুতে
আজমল হোসেনের মাথায় যেন বজ্রপাত হলো। দ্বিতীয় আরেকটি বাজ পড়লো, যখন জারার স্কুলের প্রধান
শিক্ষক ফোন দিয়ে জানালেন, জারা টেস্ট পরীক্ষায় জিপিএ-৪.১১ পেয়েছে। মেধাতালিকায় ১ থেকে দূরে গিয়ে ৪৯-এ ঠেকেছে।
[৭]
রাতে ডাইনিং টেবিলে সকলে খেতে বসেছে। কারো মুখে রা নেই। পিনপতন নীরবতা। কোনো এক অজানা কারণে
সকলেই নিশ্চুপ। কারণটা জারার বোধগম্য হচ্ছে না। নিরবতা ভাঙতে ইসমত আরা মৃদু স্বরে জারাকে জিগ্যেস
করলো,
_ ‘মা, তোমার লেখাপড়ার কি অবস্থা বলো তো।’
_ ‘আলহামদুলিল্লাহ আম্মু ভালো।’
_ ‘টেস্ট পরীক্ষার রেজাল্ট কি হয়েছে?’
_ ‘বরাবরের মতোই। ফার্স্ট হয়েছি আম্মু।’
আজমল হোসেন রাগে ফুঁসছে। সদা সত্যভাষী তার মেয়েটা এখন গুছিয়ে মিথ্যা বলতেও শিখে গিয়েছে! মুষ্টিবদ্ধ
হাতে, দাঁতে দাঁত চেপে ধৈর্য্যের সীমা টেনে রেখেছে। ইসমত আরা ধীরস্থির হয়ে আবারও প্রশ্ন করলো জারা-
কে,
_ ‘সাদিক কে?’
জারা হতভম্বের মতো একবার দৃষ্টি দিল বাবা মায়ের দিকে। আজমল হোসেনের চোখে জ্বলতে থাকা আগুনের
উত্তাপে সিক্ত হয়ে ভয়ে কাঁপছে জারা। পরক্ষণেই কোনো এক অদৃশ্য উৎস থেকে শক্তি সঞ্চার করে
আত্মবিশ্বাসের সাথে উত্তর দিল জারা,
_ ‘হি ইজ মাই ফ্রেন্ড, আম্মু।’
_ ‘ফ্রেন্ড?’
_ ‘ইয়েস, জাস্ট ফ্রেন্ড।’
কথাটি শুনে ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে গেল আজমল হোসেনের। দুচোখে জ্বলতে থাকা আগুন মুহূর্তেই বিস্ফোরিত
হলো।
_ ‘এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে? বেগানা পুরুষকে কিভাবে নিজের ফ্রেন্ড বলতে পারো? কিভাবে কোনো বেগানা
পুরুষের সাথে লাজ লজ্জা ভুলে গিয়ে খোশগল্পে মেতে উঠতে পারো? পার্কে ঘুরা ঘুরি করতে পারো? হাত ধরতো
পারো? ছি! জানো না এগুলো হারাম।’
_ ‘সবাই করে। সমস্যা কি এতে? স্কুলে প্রায় সব মেয়েদের ই ছেলে বন্ধু আছে।’
বাবার মুখে মুখে তর্ক করা দেখে ইসমত আরা এবার নিজের ধীরস্থির ভাব ধরে রাখতে ব্যার্থ হলো। ফলাফল
স্বরূপ আরো বেশি রাগের বিস্ফোরণ ঘটলো জারার উপর।
জারাও কর্কশ কন্ঠে সাফ জানিয়ে দিল, ‘জীবনটা আমার। যেভাবে খুশি আমি চালাবো, যা খুশি করবো। তোমরা
বলার কেউ না। আমার স্বাধীনতা চাই। স্বাধীনতা। তোমরা আমার ব্যাক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করলে আমি
বাড়ি থেকে বের হয়ে যেদিক সেদিক চলে যাবো।’
এই কথা বলেই চপল পায়ে নিজের রুমের দিকে অভিগমন ঘটলো জারার। তার চোখে যেন আগুনের হলকা বয়ে
যাচ্ছে। এই আগুনের স্ফুলিঙ্গ যে কার থেকে বিস্তার লাভ করেছে সেটা খুব ভালো করেই অনুধাবন করেন
আজমল হোসেন। নেপথ্যে ইসমত আরা এবং আজমল হোসেনের পায়ের নিচের মাটি থরথর কেঁপে উঠেছে।
চক্ষুশীতল করা সেই মেয়ে আজ কোথায়! বাবা মায়ের অনুগত মেয়ে আজ কোথায়! মিষ্টিমধুর সুরেলা কণ্ঠে আব্বু
আম্মু ডেকে প্রাণ জুড়িয়ে দেওয়া মেয়েটা আজ কোথায় হারিয়ে গেল!
ইসমত আরা ডুকরে কান্না করে উঠলো। সহসা আজমল হোসেনের ক্রোধ অভিমানে গড়ালো। আর তা থেকে হচ্ছে
বারিপাত।গলার কাছে কান্না দলা পাকিয়ে আসছে। হুট করেই সন্তানহারা ব্যার্থ পিতার অসহায় ভঙ্গিতে
মেঝেতে বসে পড়লো।
‘জারার মা, আমার জারা কোথায় গেল! এই মেয়ে কে? আমি চিনি না এই মেয়েকে। ও আমার মেয়ে হতে পারে না…
হতে পারে না।’কম্পিত কন্ঠে ছলছল চোখে নিজের হত বিহ্বলতা প্রকাশ করছে আজমল হোসেন ‘যেই মেয়েকে
একটু সুখী দেখার জন্য, দিবা-নিশি পরিশ্রম করি। নিজের রক্ত পানি করে দিয়ে উপার্জন করি। তার সমস্ত শখ
আহ্লাদ পূরণ করি। নিশি জাগরণে যার কল্যাণ কামনায় দুচোখের পাতা এক হওয়ার ফুসরত পায় না ; সেই মেয়ের
কাছে আমরা কেউ না? যার খুশিতে আমরা হাসি, যার চোখে দুনিয়া দেখি, যাকে ভালো রাখার জন্য নিজের কলিজা
ছিঁড়ে দিতে পারি; সেই মেয়ে আমাদের কলিজায় আঘাত হেনে স্বাধীনতার কথা বলে? ও কেন বুঝে না, ওকে আমরা
সুখী দেখতে চাই; আর কিছু চাই না। জারার মা! মেয়েটা যে আমাদের আলোর পথ ভুলে ঘোর আমানিশার পথে
হারিয়ে যাচ্ছে। কি করে ফিরিয়ে আনবো! কি করে বোঝাবো, রঙিন চোখে দুনিয়া দেখে নিজের জীবনের সব রং
ধুলোয় মিশিয়ে দিচ্ছে মেয়েটা। আর এই আগুনে ঘি ঢালছে তারই মতো বিপথগামী, জীবন সম্পর্কে অনভিজ্ঞ,
আনাড়ি কিছু বন্ধু বান্ধব। এই অন্ধকার জগৎ থেকে কি করে ফিরিয়ে আনবো আমার জারা কে!’
থমথমে রাত্রীর নীরবতায় আজমল হোসেনের আহাজারিতে গাছের পাতাগুলোও যেন সমব্যাথী হওয়ার জানান
দিয়ে ক্ষণকাল পর পর কম্পিত হয়। একটা শীতল হাওয়া বইয়ে দেয়। কিন্তু এই শীতল হাওয়া-টা উনুনের
উত্তাপের মতো তীব্র জ্বালাময়ী হয়ে ধরা দিচ্ছে ইসমত আরার অন্তরে।
রাত তিনটা ছুঁই ছুঁই। পৃথিবী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। থেকে থেকে ভুতুম পেঁচার ডাক শোনা যায়। মশার ভন ভনানি
কানে এসে তীব্র নিনাদের মতো ঠেকে। যেখানে বসছে, সেখানেই জ্বালা সৃষ্টি করে দিচ্ছে। মশারা ঘুমায় কখন।
নাকি সন্তানের ছোড়া তীরে ঘায়েল হয়ে সেই যাতনায় নির্ঘুম থাকে; আর গুনগুনিয়ে কেঁদে বেড়ায়!
‘জারার আব্বু, রাত তো অনেক হলো। এখন একটু ঘুমিয়ে নিন। চিন্তা করবেন না। আমার নাড়ি ছেঁড়া ধন নাড়ির
টানেই ফিরে আসবে আবার।’ অস্ফুট স্বরে চোখে এক রাশ হতাশার গ্লানি নিয়ে বিক্ষুব্ধ মনকে শান্ত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে ইসমত আরা। ঘরের পিছনে অদূরে অবহেলে ঠাঁই পাওয়া এক সুপারি গাছের মগ ডালে বসে থাকা ভুতুম পেঁচার ডাক শোনা যায়। এ যেন ঘরের মধ্যেকার দুটি প্রাণীর সন্তানের সঙ্গে অদৃশ্য দেয়াল তৈরির মনো যাতনায় দীর্ঘশ্বাসের প্রতিধ্বনি।
[৮]
সেপ্টেম্বর মাসের কোনো এক শেষ বিকেল বেলা|
গাছের পাতাগুলোতে ঝরে পরে সূর্যের শেষ সোনালী স্পর্শ। বাড়ির বাইরে প্রধান ফটকের পাশ ঘেঁষে একটা বকুল ফুল গাছ। গাছটি অনেক শখ করে মেয়েটা লাগিয়েছিল। বকুল ফুল তার বড্ড পছন্দ। বাতাসের মৃদু তালে গাছ থেকে ঝরে পড়ে ফুল। কিছু ফুল হাতে উঠিয়ে নেয় আজমল হোসেন। অনেক কথা জমাট বেঁধেছে বুকে। অনেক ক্ষোভ, হতাশা, গ্লানি ঘিরে ধরেছে। মেয়েটাকে বলতে পারলে শান্তি লাগতো। কিন্তু বলার উপায় যে নেই। আচ্ছা এই বকুল ফুল কি তার হয়ে কথা গুলো পৌঁছে দিতে পারবে তার চোখের তারা হৃদয়ের খনি_নয়নের মণির কাছে! অজস্র না বলা কথাগুলো দীর্ঘশ্বাস হয়ে প্রকাশ পায়।
বকুল ফুলকে দুহাতে তুলে আজমল হোসেন হৃদয়ের অপ্রকাশিত কথাগুলো অস্ফুটে বলে, “বকুল ফুল, আজ সপ্তাহ দুই হয়ে গেল, মেয়েটার সাথে কথা নেই। দেখি-ও না। যেই মেয়ের মুখের কোণে ফুটে উঠা কোমল হাসি দেখে
সারাদিনের পরিশ্রমের ক্লান্তি ভুলে যেতাম, সেই মেয়েটাকে যে আজ সপ্তাহ দুই ধরে দেখি না। ছোট্ট নিষ্পাপ
শরীরটা যখন দুহাতে জড়িয়ে রাখতাম, নিরাপত্তা পেয়ে কেমন নিশ্চিন্তে গা এলিয়ে দিত। আমার মুখের দিকে
চেয়ে, দুই ঠোঁটের অনুকরণে প্রথম কথা বলা শিখেছিল।
বকুল ফুল, বলতে পারিস তুই; এটা কেমন ভালোবাসা, যেই ভালোবাসা একটা মেয়ের প্রথম ভাষা
শিক্ষাদানকারীর সাথে কথা বলার পথ বন্ধ করে দেয়?
হাঁটি হাঁটি পা পা করে হাত ধরে হাঁটতে শিখিয়ে ছিলাম যাকে; তুই বলতে পারিস বকুল ফুল, এটা কেমন
ভালোবাসা, যেই ভালোবাসার কারণে সেই পা দিয়ে হেঁটে আমার থেকে দূরে সরে যায়?
তার পথের কাঁটা সরিয়ে পথ মসৃণ করতে গিয়ে কতো যে কাঁটা ফুটিয়েছি পায়ে, সে কিনা আমাকেই তার
ভালোবাসার পথে কাঁটা তূল্য করে এভাবে উপরে ফেলে চলে গেল ছেড়ে? এটা কেমন ভালোবাসা!
তাকে সম্মানিত করতে উচ্চশিক্ষা দিতে তৎপর ছিলাম; সে কিনা আমাদের সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়ে চলে
গেল আরেকজনের হাত ধরে?
এটা কেমন ভালোবাসা রে, বকুল ফুল; যেই ভালোবাসা একটা মেয়েকে তার পরিবারের অবাধ্য করে তোলে?
পড়াশোনার ক্ষতি করে অনাগত ভবিষ্যতকে নিকষ কালো করে তোলে? গায়ে কলঙ্কিনীর চিহ্ন এঁকে দেয়?
জন্মদাতা বাবার থেকে আলাদা করে দেয়?
তুই বলতে পারিস বকুল ফুল?
আচ্ছা বকুল ফুল, ঐ পাড়ার মিম নামক মেয়েটাও আমার জারার মতো প্রেমিকের হাত ধরে বেরিয়ে গিয়েছিল।
পালিয়ে গিয়ে কোর্ট ম্যারেজ করেছিল। বাবা মায়ের শত প্রচেষ্টার পরেও ঘরে ফেরেনি। তারপর একদিন মাস
তিনেক পরে ঠিকই ফিরেছিল ঘরে। কিন্তু জীবন্ত নয়, নিথর দেহ হয়ে। শশুরবাড়ির কটুকথা, স্বামীর অত্যাচার সইতে না পেরে পরপারে চলে গিয়েছিল। বল না বকুল ফুল, আমার মেয়েটার-ও তেমনি অবস্থা হবে? আমার
মেয়েটাও যে চোখেতে রঙিন চশমা এঁটে তেমনি এক কুলাঙ্গার-কে বেছে নিয়েছে।’’
আজমল হোসেনের হাত থেকে বকুল ফুলগুলো বৃষ্টিফোঁটার মতো পড়ে গেল। ডান হাতটা চলে গেল বুকের বা দিকে।
কেমন চাপ ধরে আসছে। যেন হৃদপিন্ডের ভিতরে অমিত এক তান্ডব শুরু হয়েছে_একটি অসীম যন্ত্রণা। গলার
মধ্যে কোনো কিছু বাঁধা দিয়ে আসছে। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে।
যেন পায়ের তলার মাটি সরে যায়। চোখের সামনে থেকে মেয়ের হাসি মুখটা কেমন মিলিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীটা হঠাৎ
নীরব হয়ে যাচ্ছে। মৃত্যু আর জীবনের সীমানা একে অপরকে ছোঁয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। তারপর হঠাৎ
আজমল হোসেন-ও নীরব হয়ে যায়। চিরদিনের জন্য। নিথর পড়ে রয়েছে বকুল গাছটির নিচে।
[৯]
মুষলধারে বৃষ্টি। আকাশের গায়ে মেঘের ঘন কালো ছাদ। অশ্রুভরা মেঘপুঞ্জ ভেঙে পড়ে, মাটিতে আছড়ে পড়ে
এক অবিরাম শ্রোত হয়ে। এক একটি বৃষ্টির ফোঁটা, কোনো এক বেদনার বহিঃপ্রকাশ। ঠিক যেন জারার দুঃখ
স্রোতের অনুরূপ। পনেরো দিন বাদে আজ বাড়ি ফিরেছে জারা। আজমল হোসেনের বড্ড খুশির দিন আজ। কিন্তু সে হাসছে না। মেয়েকে পেয়ে খুশিতে আত্মহারা হয়েও উঠছে না। বরং সবাইকে ফেলে চলে যাচ্ছে দূর অজানায়,চিরদিনের জন্য।
বকুল গাছটির নিচে দাঁড়িয়ে আছে জারা। অদূরে আজমল হোসেন কেমন নিশ্চিন্তে বিদায় নিল। স্টিলের খাটিয়ায় সাদা কাপড়ে মোড়ানো। চোখের সম্মুখে ছোট হতে হতে ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। জারা চিৎকার করে বলতে চাইলো, আমাকে ছেড়ে যেও না বাবা। দেখো আমি এসেছি। তোমার কাছে ফিরে এসেছি। কিন্তু বলতে পারলো না।
বৃষ্টির তীব্রতা কিছুটা কমেছে। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। আনমনে কিছু বকুল ফুল দু’হাতের মুষ্টিতে
পুরো আকাশের দিকে মেলে ধরে চিৎকার করে বলে উঠলো জারা, “বসুধা তুমি বড্ড বেদনাধারিণী।”
(সমাপ্ত)