মুহাম্মদ এনাম
টঙ্গীর তুরাগতীরে যখন ভোরের আলো ফোটে, বাতাসে তখনো ভাসতে থাকে রাতের শেষ প্রহরের দোয়ার সুর। দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসা মানুষের ঢল, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ, হাতে তসবিহ, চোখে অশ্রুর আভা—তাঁদের হৃদয়ে একটিই আকাঙ্ক্ষা, আল্লাহর সান্নিধ্য। এ এক ব্যতিক্রমী দৃশ্য! ব্যস্ত শহরের কোলাহল পেছনে ফেলে লাখো মানুষ এসে জমায়েত হয় তুরাগের তীরে, যেন এক মহাসমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে এই ধুলোমাখা শহরে।
মুসুল্লিরা এসেছেন কেউ সুদূর মরুপ্রান্তর থেকে, কেউবা সবুজ গ্রামবাংলার মেঠোপথ পেরিয়ে। কেউ এসেছেন ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগোলিক সীমানার ব্যবধান ভুলে এক মিলনমেলায় যোগ দিতে। এখানে নেই ধনী-গরিবের ভেদাভেদ, নেই কোনো জাতি-গোষ্ঠীর বিভাজন। এক পঙ্ক্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন কোটিপতি ব্যবসায়ী আর দিনমজুর, একসাথে মাটিতে বসে খাবার ভাগ করে নিচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের শেখ আর উপমহাদেশের সাধারণ কৃষক। এখানে সব পরিচয়ের ঊর্ধ্বে একটাই নাম—মুসলমান।
তাবলিগের দাওয়াতে সাড়া দিয়ে যারা এসেছেন, তাদের চোখে একটাই স্বপ্ন—পাপমুক্ত জীবন, আআল্লাহর পথে ফিরে আসা। ধুলোর শহরে দাঁড়িয়ে যখন তাদের কণ্ঠে উঠে আসে দোয়ার শব্দ, আকাশ তখন থমকে দাঁড়ায়, বাতাস স্তব্ধ হয়ে শোনে তাদের বুকচেরা আর্তনাদ—“হে আল্লাহ! আমাদের ক্ষমা করো! আমাদের কবুল করো!” এই আহাজারির মাঝে থাকে এক নিঃসঙ্গ আত্মার কান্না, থাকে গুনাহগারের ব্যাকুলতা, থাকে নতুনভাবে ফিরে আসার প্রতিজ্ঞা।
কখনো কখনো নির্জন এক কোণে বসে কেউ ডুকরে কাঁদছেন, বিগত জীবনের ভুলগুলোর ভার যেন তাঁর বুকে চেপে বসেছে। কেউবা শেষ রাতে নামাজে দাঁড়িয়ে এতদিনের গাফিলতির জন্য অনুশোচনায় বুক ভাসাচ্ছেন। এক সময় যে হৃদয় পাথরের মতো কঠিন ছিল, আজ তা গলে যাচ্ছে আল্লাহর ভালোবাসায়। এমন দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন—এই ইজতিমা কেবল শরীরের মিলন নয়, এটি আত্মার পুনর্জন্ম, এক অদৃশ্য আলোয় আলোকিত হওয়ার উপলক্ষ।
রাত যখন গভীর হয়, তখন তাবুর ফাঁক গলে বেরিয়ে আসে মৃদু আলোর রেখা। কারও কণ্ঠে কুরআনের সুর, কেউবা নিঃশব্দে সিজদায় লুটিয়ে পড়েছেন। চারপাশ নিস্তব্ধ, কিন্তু সেই নিস্তব্ধতার মাঝেও শোনা যায় কিছু শব্দ—কখনো ‘আমিন’, কখনো ‘আল্লাহু আকবার’! তুরাগের বাতাস বয়ে নিয়ে যায় সেই শব্দ, যেন আসমানের দরজায় গিয়ে কড়া নাড়ে!
এ এক অলৌকিক দৃশ্য। পৃথিবীর সবচেয়ে নির্জীব কণা—ধুলো, সেই ধুলোই যখন ঈমানের অশ্রুতে ধুয়ে যায়, তখন তা হয়ে ওঠে পবিত্র, হয়ে ওঠে সৌন্দর্যের প্রতীক। এই ইজতিমায় তাই কেবল মানুষের ভিড় হয় না, এখানে জমে ওঠে আত্মার এক অনন্য মেলা। ধুলোর শহর হয়ে ওঠে রঙিন, কিন্তু সে রঙ কোনো বাহ্যিক সৌন্দর্যের নয়; এটি তওবার, প্রেমের, আত্মশুদ্ধির রঙ।
তাই তো বিশ্ব ইজতিমা শুধু একটি আয়োজন নয়, এটি এক অনন্য অনুভূতি। এটি এমন এক স্থান, যেখানে ধুলোর শহরেও খুঁজে পাওয়া যায় জান্নাতের সুবাস, যেখানে মাটি আর আকাশের মাঝে তৈরি হয় এক সেতুবন্ধন—বিশ্বাসের, ভ্রাতৃত্বের, মানবতার!
আল্লাহ তায়া’লা আমাদের কবুল করে নিন।