লেখকঃ মোঃ আখতারুল ইসলাম খোন্দকার
আমি আমার এক বন্ধুর গ্রামের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। সময়টা জানুয়ারী মাসের প্রথম সপ্তাহের দিকে ছিল। সেখানে অসম্ভব রকমের কনকনে ঠান্ডা শীত। সারারাত টিনের চালে অবিরাম বৃষ্টি পড়ার মতো টুপটাপ শব্দ। ঘুমানোর সময় কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনতে হয়না। গাছের পাতার চুঁয়ে পড়া নিয়মিত শিশিরের রিনিঝিনি বাজনা অনেক মুগ্ধকর। আর পাশের ঘরে থেকে দাদীর মুখে রুপকথার গল্প শুনতে শুনতে কখুন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে যায় বলতে পারিনা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে মেঠো পথ ধরে হাঁটতে বের হই দুই বন্ধু মিলে। চারিদিকে এতো ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা সামান্য দূরে কি আছে কিচ্ছু দেখা যায় না। ওর মধ্যেই কাউকে কাঁধে লাঙ্গল নিয়ে আবার কাউকে শব্জির মাঠের দিকে রওনা হতে দেখা যায়। রাস্তার মাঝে মাঝে আগুনের কুন্ডলী দেখতে পাই। কাছে গিয়ে দেখি কিছু ছেলে-মেয়ে ও বড়োরা খড়-কুটা জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করছে। তাদের গায়ে শীতের কোন দামী ভাল পোশাক নেই। কেউ পুরানো কাঁথা কিম্বা চাঁদর আবার ছোটরা পরনের লুঙ্গি মাথা গলায় পেঁচিয়ে ঠান্ডার সাথে যুদ্ধ করছে। দু’একজনকে জ্যাকেট ও সুয়েটার পরে থাকতে দেখেছি সেটাও গুদ্রিপট্রি থেকে অল্প টাকায় কেনা। তারপরও কবে ধোলাই করা হয়েছে তা বলবার জো নেই যেন চিমটি কাটলে ময়লা উঠবে। তবুও তারা এতেই যথেষ্ট খুশী আছে বলে মনে হয়।
খুব সকালে আমাকে টাটকা খেজুরের রস খাওয়ানোর জন্য একটা মাঠের পাশে নিয়ে গেল। এক বৃদ্ধ লোক ঠান্ডায় জড়োসড়ো হয়ে বসে রস বিক্রি করছে। গায়ে হাফহাতা ছেঁড়া গেঞ্জি আর বিছানার চাদর জড়িয়ে আছে, এতে কোন ভাবেই শীতের সাথে মোকাবিলা করা সম্ভবপর নয়। তবুও গন্ডারের মতো দাঁপিয়ে বেড়াচ্ছেন যেন শীত লজ্জা পাবে তাদের এ সংগ্রামে। আমি মুড়ি দিয়ে কোন মতে দু গ্লাস রস খেয়ে ঠান্ডায় দাঁতে দাঁত চেপে রাখতে পারছিনা যেন তারা দন্দ বাঁধিয়েছে, আর অন্যরা তাদের ইচ্ছে মতো খেয়ে ফেলছে। কেউ মুড়ি না থাকায় বাড়ি থেকে গামছায় করে চাল ভাজা নিয়ে এসে মনের আয়েশ মিটিয়ে রস খাচ্ছে। ওদের খাওয়া দেখে আমারও চাল ভাজা দিয়ে খেতে মন চাইলো কিন্তু বলতে পারলাম না। একটু দূরেই চলছে খেজুর রসের গুঁড় বানানোর প্রক্রিয়া। গাছিরা রস সংগ্রহ করে নিয়ে এসে নতুন চুলা বানিয়ে বড় কড়ায়ে জ্বাল করছে। রসগুলো যখন টগবগিয়ে গাঁঢ় হয়ে লাল রঙ ধারণ করছে দেখতেই অনেক মনোমুগ্ধকর। খাঁটি গুঁড়ের মৌ মৌ সুগন্ধে মনটাই ভরে গেল। টাটকা গরম গুঁড়ের পাটালি খেতেও অপূর্ব সুন্দর, এর কতোখানি যে মজা তা বলে প্রকাশ করা যাবেনা এর জন্য গ্রামে আসতে হবে।
বিকেলে শীতের প্রয়োজনীয় পোশাক পরে ঘুরতে বের হলাম। কেননা, গ্রামে সকাল ও সন্ধ্যায় প্রচন্ড শীত জেঁকে বসে। তাই নিজেকে নিচ্ছিদ্র নিরাপত্তায় চাদরে ঢেঁকে ফেললাম যেন শীত স্পর্শ করতে না পারে। আবার বেড়াতে এসে ঠান্ডা – সর্দি বাঁধিয়ে নেয়া মোটেও ঠিক হবেনা। হাঁটতে হাঁটতে দেখি কিছু উড়তি বয়সের ছেলেরা খড় ও কাগজ দিয়ে গোল করে ফুটবল বানিয়ে খেলছে। তাতে ওদের কোন সংকোচ নেই বরং অনেক আনন্দ শোভা পাচ্ছে। আর ক’জন কে দেখলাম ক্রিকেট খেলছে। আমিও সেখানে দাঁড়িয়ে গেলাম ওদের খেলা দেখার জন্য। একজনের হাতে একটা সত্যিকারের কাঠের বানানো ব্যাট ও একটা বল আছে আর অন্যদের কাছে তাল পাতার ডাগরে কেটে অনেকটা ব্যাড আকৃতির করে এবং স্যান্ডেলের উইকেট বানিয়ে তা দিয়ে খেলছে তবুও চরম আনন্দ উত্তেজনার মধ্য দিয়ে। ওদের খেলা দেখলে অসম্ভব গম্ভীর লোকেরাও কোনভাবেই না হেঁসে পারবেনা। গ্রামের লোকেরা অনেক সহজ – সরল মনা বলে অল্প সামান্যতেই তাদের আনন্দের সীমা থাকেনা। অথচ শহরের ছেলে-মেয়েদের দামী দামী জিনিস পত্র থাকলেও তাদের চাহিদার কখনো শেষ থাকেনা। এমনকি খুশী করা যায় না একেকজনের পাষন্ড মনটাকে। আমার খুব ইচ্ছে করছিলো ওদের জন্য খেলার সামগ্রী কিনে দিতে। কিন্তু সম্ভব হলোনা কাছে যথেষ্ট পরিমাণ টাকা না থাকায়।
সন্ধ্যা রাত থেকে খালা আম্মা আমাদের জন্য কয়েক রকমের পিঠা বানাবেন বলে প্রস্তুতি নিচ্ছেন। খেজুরের গুঁড়, নারকেলের কুচি ও চালের গুঁড়ার মিশ্রণে তৈরি হবে ভাঁপা পিঠা। এর পর তৈরি করবেন চিতই পিঠা,রসে ভেজানো পিঠা ও পুলি পিঠা। সারারাত দুধ ও গুঁড়ের সেরাতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খাবার জন্য উপযোগী হয় রস ও পুলি পিঠা। তাই আমরা উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে ক’জন চুলার পাশে গোল হয়ে বসেছি ধোঁয়া উঠা গরম গরম ভাঁপা পিঠা খাওয়ার আনন্দে। তিনি বানিয়ে রাখতে না রাখতেই শেষ। কাঁড়াকাঁড়ি করে খেয়ে ফেলছে দেখে অন্যদের বকাবকি দিল আন্টি। যাকে উদ্দেশ্য করে করা হচ্ছে এসব আয়োজন তাকে না দিয়ে যে যার মতো খেয়ে ফেলছে এই জন্য। ইস্ ,গরম পিঠা খাওয়ার মজাই আলাদা, অন্য রকম স্বাদ গন্ধ যা আগে কোনদিন টের পাইনি। ইচ্ছে করছিল যেন একেবারে এখানেই থেকে যায়। গ্রামের সাধাসিধে সাধারণ মানুষ গুলোর এইতো এতোটুকু সামান্য চাওয়া। কঠোর পরিশ্রম করেও অল্পতেই তারা হেসে খেলে জীবন কাঁটিয়ে দিতে পারে। মোটা ভাত আর মোটা কাঁপড়ে হাসি-খুশি আর সাচ্ছন্দ্যে কাটিয়ে দিতে পারে সারাটি জীবন। শহরের অট্রলিকা আর দামী দামী সাজসজ্জায় বিলাসবহুল জীবন-যাপন হলেও সবাই অসুখী। প্রকৃত সুখ খুজতে হলে মাটির মানুষের কাছে অর্থাৎ গ্রামে বসবাস করতে হবে।
পিঠা-পুরি খেয়ে অনেক রাত করে শুয়েছি বলে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে পারিনি। গ্রামে রাত দশটা বাজলেই অনেক রাত হয়ে যায়। আবার ভোর থেকেই সবাই যে যার কাজে কর্মে ঝুঁকে পড়ে। আমার ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি, শীতের সময় সকালেই শুয়ে থাকতে বেশি ভাল লাগে। হঠাৎ বাইরে চিৎকার আর চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলাম। দৌঁড়ে অনেকে ছুটে গেছে বুঝতে পারলাম। আমিও আলসেমি ছেড়ে তাড়াহুড়া করে উঠে সেখানে গেলাম। ঘটনা যা ঘটেছে তা দেখে ও শুনে অনেক মর্মাহত হলাম। সকাল বেলা অনেক শীতার্ত মানুষেরা যথেষ্ট শীতের কাঁপড় না থাকায় খড়-কুঠোর জ্বালিয়ে শীত নিবারনের চেষ্টা করে। এমন সময় তের চৌদ্দ বছর বয়সের একটি মেয়ের গায়ে আগুনের একটা ফুলকি এসে পড়ে এবং মুহুর্তের মধ্যেই ছড়িয়ে যায় পরনের পোষাকে। সহযোগীরা যতই নিভানোর চেষ্টা করে ততই আগুন যেন পেখম মেলে উল্লাসিত হয়ে উঠে। চোখের সামনে মেয়েটার দাপাদাপি আর ছোটাছুটিতে অন্যরা আতংকিত হলেও আগুন যেন পূর্ণ উদ্দোমে তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। যদিও অনেক চেষ্টার পর আগুন নেভানো সম্ভব হয়েছিল। আশংকাজনক ভাবে অর্ধোউলঙ্গ অবস্থায় মেয়েটিকে তড়িঘড়ি করে কয়েকজনের সহযোগিতায় হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। শরীরের বেশির ভাগ অংশই আগুনে পুঁড়ে গেছে। ডাক্তারেরা একরকম আশা ছেড়েই দিয়েছেন, তবু চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু একদিন পর হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হলো। শীতের ভাল পোশাক না থাকার কারণে আজ মেয়েটির এমন অপমৃত্যু ঘটার সুত্রপাত হয়েছিল। এই হ্রদয় ভাঙ্গা কষ্টটি আমাকে বেশী ব্যথিত করেছিল। কেননা, মনটাকে কোনভাবেই গুছিয়ে রাখতে পারিনি চোখ ফেঁটে শুধু বোবা কান্না বেরিয়ে আসছিল। অনেক কিছু করার থাকলেও অন্তিম সময়ে তার জন্য কিছুই করার সৌভাগ্য আমার হয়নি।
বন্ধুর অনুরোধে গ্রামে গিয়েছিলাম অনেক অনন্দ উৎসব করার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করতে। কিন্তু ফিরতে হলো মনের কোনে জমানো একগাঁদা কষ্ট বুকে নিয়ে। গ্রামের সরলতা ও সামান্যতেই তুষ্ট থাকা এমন শুভ্র মনের মানুষের সাথে মিশতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেছি। তবে অজস্র যন্ত্রণায় ছটফট করেছি যখন তাদের দুঃস্বময়ে পাশে দাঁড়াতে পারিনি সেইদিন মনে মনে পণ করেছিলাম দুঃস্থ ও অসহায়দের কিভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা যায়? তাই একটা সেচ্ছাসেবী সংগঠন গঠন করার জন্য মনস্থির করলাম। সেখানে শুধু মাত্র হতোদরিদ্র মানুষদের জন্য কিছু করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাব। তাদের খুব অল্পতেই ওদের এতোটা খুশী করা যায় তা কল্পনার বাইরে অথচ বিত্তশালী পরিবারের লোকদের কোটি টাকা খরচ করেও সামান্য মন পাওয়া অত্যন্ত কঠিন।
————–******————-
আখতারুল ইসলাম খোন্দকার
গ্রামঃ- বিদির পুর
পোস্ট অফিসঃ- বসন্ত কেদার
উপজেলাঃ- মোহন পুর
জেলা- রাজশাহী
বাংলাদেশ।
[email protected]