শর্মিলা বহ্নি
গেটের বাইরে বসে আছি। ভিতরে যাওয়ার সাহস হচ্ছেনা। উঁকি দিতে গেলেও যে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিচ্ছে। অপেক্ষায় বসে আছি, পেটে খিদে অপেক্ষা করা ছাড়া আর উপায় কি! অবশ্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করে থাকার অভ্যাস আমাদের আছে। এ আর তেমন কি! বড়ো ধুমধাম আয়োজনই হচ্ছে। বসে থাকলে হয়তো একটু পেটের খাবার জুটবে। এর চেয়ে বেশি আশা নেই, করিও না। আধপেটা খেতে পেলেই চলবে।
না পেলেও ক্ষতি নেই, কারণ আমরা অভিযোগ করিনা। সকাল থেকেই বসে আছি। সাথে ওপাশেও বসে আছে আমাদের দলেরই আরও কয়েকটা। লোকজন যাওয়া-আসা করছে। আর যাওয়ার পথে একটু একটু তাড়া করে যাচ্ছে আমাদের। আবার কেউ বা তাড়া না দিয়েই অগ্রাহ্য করেই হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে বাড়ির ভিতরে। এত এত মানুষের ব্যস্ততার ভীড়ে কেবলমাত্র আমরাই যেন সুক্ষ নিরব দর্শক। দুপুর হলো তখনো অপেক্ষার শেষ হয়নি, বাড়ির ভিতরে আয়োজনের কমতি নেই। অবশেষে বিকালের কিছু আগে রোগা পটকা একটা লোক এসে গেটের বাইরের কিছু দূরে মুরগির অশৃষ্ট অংশ ফেলে দিয়ে চলে গেলো। মুহূর্তের মধ্যে ছুটে এলো ডজনখানেক কুকুর। আমিও আর দেরি করলাম না, চলে গেলাম দৌড়ে। যদি কিছু আহার মেলে।
ইতিমধ্যে খাবার নিয়ে তাদের মধ্যে মারামারিও শুরু হয়ে গিয়েছে। আমিও প্রাণপণ চেষ্টা করছি নিজের এক অংশ পাওয়ার। আমাদের মারামারি কাড়াকাড়িতে লোকজন বিরক্ত হয়। আমরা সেটা জেনেও এমনটা কি ইচ্ছে করে করি? নাহ্ পেটের দায়ে করি। আমি কিছুটা খাবার পেয়েছি, সেটাই খাচ্ছিলাম। হঠাৎ এক লোক খুব জোরে একটি কাঠের চলা ছুঁড়ে দিলো আমাদের দিকে। দুর্ভাগ্যক্রমে সেটা এসে লাগলো আমার বাম পায়ে। ওরাও দৌড় দিলো কিছুটা দূরে। আমিও ব্যাথা পা নিয়ে দৌড়ে গেলাম ওদের সাথে দ্বিতীয় আঘাত আসার আগেই। দূরে গিয়ে বসলাম। লোকটা বাড়ির মধ্যে চলে গেলে ওরা আবার গিয়ে ভাগ বসালো বাকি অংশে। আমার যাওয়ার ক্ষমতা নেই। খিদে যেন পালিয়েছে কোথায়, বুকটা একটু কাঁপছে। আমি চুপচাপ বসে রইলাম। আমার তো আর ভাঙা পা নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাওয়ার তাড়া নেই, তাড়া নেই ঔষধ লাগানোর। ব্যথায় আমার চোখ দিয়ে পানি বের হয়ে আমার গাল বেয়ে পড়লো। কেউ দেখলোনা।
কারণ, আমাদের চোখের পানি কেউ দেখেনা।
সে বাদে আরো মাস দেড়েক পরে, শীতের সময়। সন্ধ্যা হবার কিছু আগে আমি এক কসাইয়ের দোকানের পাশে বসে আছি। বলতে গেলে অনেকটা দূরেই। লোকজন দোকানে আসছে মাংস কিনছে, চলে যাচ্ছে।
আশেপাশে অনেক কুকুর ঘোরাফেরা করছে, কোথাও একটু ফেলনা খাবার পেলে সেটা খাচ্ছে। আমিও খাই। আজ ইচ্ছা করছে না দৌড়াদৌড়ি করতে। বাজারে মানুষ জনের রমরমা ভিড় আর দোকানির কাজের ব্যস্ততা। তার মধ্যে দোকানের পাশে আমার বসে থাকাটা বেমানানই বটে। আমি বসে আছি, উনার প্রচুর কাজের মধ্যে একটু অসচেতনা হলেই এক টুকরো মাংস নিয়ে পালানোর জন্য নয়। তবে, নিজ ইচ্ছাকৃতভাবে মাংসের অশৃষ্ট অংশ ছুড়ে ফেলে দিলে সেটা খেতে আপত্তি করবোনা।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। পাশের মসজিদ থেকে মোয়াজ্জিন সাহেবের কন্ঠে আজানের সুর ভেসে আসছে। অতি সুমিষ্ট সুর। আমি আজান শুনছি, কিন্তু মানুষেরা এত ব্যস্ত কেন? এই সুমধুর বাণী কি তাদের কানে পৌঁছাচ্ছে না? তাদের ব্যস্ততা এতই বেশি যেখানে দুই মিনিট এই বাণী শোনার লোক খুবই কম। কেউ কেউ আজান শুনে সাদা টুপি মাথার উপর দিলেন।
আজানের সময় আমরা ডাকাডাকি করি এটা কারোরই অজানা নয়। অন্যান্য কুকুরের সাথে আমিও ডেকে উঠলাম, আমরা কুকুরেরা আজান শুনলে ডেকে উঠি কারণ আজানের শব্দ শুনে শয়তান বায়ু ত্যাগ করতে করতে পালিয়ে যায়। বুঝতে পারি আজানের সময় আমাদের এই অহেতুক ডাকাডাকিতে অনেকেরই বিরক্তির সীমা নেই। আবার মানুষের মনে এ নিয়ে প্রশ্নেরও শেষ নেই। কত জায়গায় দেখেছি নিজেরাই বলাবলি করে, দেখছো ভাই এই কুকুরগুলোর স্বভাবটা কেমন আজান শুনলেই বেয়াদবের মতো চিল্লাই ওঠে, যা বেটা ভাগ। তাড়িয়ে দূরে সরিয়ে দেওয়া জন্য উদ্বুদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসেন অনেকে।
বরাবরের মতোই এবারও আমাদের ডাক শুনে ওপাশের কয়েকজন লোক হেয় হেয় করে তাড়িয়ে দিলো এদিকে। ওরা দৌড়ে এদিকে আসতেই কসাইয়ের দোকানের সামনে থাকা মাংসের খদ্দের আর কুকুরের ডাকাডাকিতে সে এক বিশৃঙ্খল কান্ড শুরু হলো। লোকজনও হৈ চৈ শুরু করেছে যেন এই সভ্য মানুষের ভীড়ে আমাদের জায়গা না হওয়ায় উচিত। কসাই বেটা রেগে গিয়ে হাতের কাছে থাকা লোহার একটা সিক ছুঁড়ে মারলো।
আমি এরপর আর চোখে দেখতে পেলাম না। পৃথিবীর সমস্ত অন্ধকার আর তীব্র যন্ত্রনা আমার চোখ জুড়ে। মতিষ্কে যেন রক্তস্রোত বয়ে যাচ্ছে। আমার বাম চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত ফোঁটা। লোকটা যে লোহার সিকটা হাতে তুলে নিয়েছিলো সেটা আর কারো নয়, আমার বাম চোখে এসে বিঁধেছে। আমি ততক্ষণে দৌড়ে অনেকটা দূরে চলে এসেছি। দোকানি আমার চোখে বিঁধা দেখলো কিনা জানিনা, উনি দেখলে অনুশোচনা করতো কিনা তাও জানিনা। তবে আশেপাশে শুনতে পাচ্ছি কেউ কেউ বলছে, ইস! কুকুরটার চোখে কে মারলো এভাবে! চোখটা একদম নষ্ট হয়ে গেছে যে
আহা!
দু’মাস হলো এই নষ্ট চোখ নিয়ে ঘুরছি। পৃথিবীর এই নিষ্ঠুরতা দেখার জন্য একটা চোখ ভালো আছে। ডান চোখ দিয়ে দেখতে পাই, তবে ইদানিং চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরে। নষ্ট চোখের পাশে থেকে ডান চোখটাও যেন সেই পথে হাঁটা ধরেছে। এই হলো এক সমস্যা শরীরের কোন একটা অঙ্গ নষ্ট হলে বাকি অঙ্গগুলোও যেন অকেজো হতে থাকে। যাকে বলে সিমপ্যাথেটিক রিঅ্যাকশন। আমার ক্ষেত্রেও ভিন্ন হওয়ার নয়। এই যে ডান চোখটাতেও যেন দৃষ্টি কমে আসছে ক্রমশ।
কেউ কেউ আমাকে দেখে বড্ড দুঃখ করে। ডেকে খেতে দেয়। পেট ভরে খেয়ে দোয়া করে চলে আসি। মাঝেমাঝে ভাবি দুনিয়ার সবাই যদি ভালো মানুষ হতো তাহলে পশুপাখিদের এমন করুণ দশা হতোনা, আবার ভাবি সবাই যদি ভালো মানুষ হতো তাহলে এত অবহেলা লাঞ্ছনার পর কিছুসংখ্যক ভালো মানুষের আমাদের জন্য এই অপ্রাপ্য মায়ায় হয়তো এতটা আত্নতৃপ্তি পেতাম না। দুনিয়ার সবাই যদি ভালোবাসে তাহলে আর তৃপ্তি থাকলো কোথায়!
প্রচন্ড শীতের রাত। বালির মধ্যে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছি। চোখের যন্ত্রণা বড্ড বেশি কষ্ট দেয়। মাঘের শীতে ব্যথা আরো বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। আচ্ছা আমার মতো চোখের অবস্থা যদি কোন মানুষের হতো তাহলে কি মানুষ এভাবে যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো? নিশ্চয়ই না। একি বৃষ্টি নেমে গেলো। আমি উঠে পড়লাম তৎক্ষণাৎ, হয়তো এখনি ছুটতে হবে কোন আশ্রয়ের খোঁজে। আমি দৌড়াতে লাগলাম। শরীরটা বড্ড বেশি দূর্বলতা অনুভব করছে, চেষ্টা করেও আমার দৌড়ের গতিবেগ উন্নতি করতে পারছিনা। এতক্ষণে আমি পুরো ভিজে গেয়েছি তাই আর বৃথা চেষ্টায় আশ্রয়ের প্রয়োজন মনে হচ্ছেনা। আজকাল মানুষের সন্নিকটে যেতে ভয় হয়। অন্ধকার রাত। রাস্তার মাঝখানে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। ক্লান্ত ঢলমলে শরীরে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হচ্ছেনা।
তবুও যেন সব দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে এসে অনুভূতিহীন পাথরের মত ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছি জন্মান্তরের নির্মম অধ্যায়ের শেষ পৃষ্ঠায়। আমি দূরের জঙ্গলের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম, এখানে মরে থাকলে সকালে মানুষজনের বেশ অসুবিধাই হবে। অসুবিধায় ফেলতে চাইনা। মুহূর্তে যেন আমার সমস্ত অস্থিরতা গ্রাস করে ধরেছে। আবার কিসের যেন একটা পরম শান্তি অনুভূত হচ্ছে ভিতরে। হয়তো মুক্তির শান্তি।ধীরে ধীরে এগোচ্ছি। আজ যেন গন্তব্যে পৌঁছে গিয়েছি, একেবারে শেষ গন্তব্যস্থলে। বুনো গাছপালায় ঢাকা ঘন জঙ্গলের কাছে যেতেই তড়িৎ গতিতে আমার শরীরটা প্রাণশূণ্য হয়ে লুটিয়ে পড়লো ছপছপে কাঁদায়।
সমাপ্ত