Friday, February 21, 2025
Homeসাহিত্যগল্পঅভিসম্পাত

অভিসম্পাত

নুসরাত সুলতানা

সাদা জনের জন্য কেনা হয়েছে লাল থান আর লালচে জনের জন্য ঘিয়া। দুজনের জন্যই কেনা হয়েছে মাদলি, মালা, দুজনের কপালেই দেয়া হল চন্দনের ফোঁটা। তাদের জন্য আজ জাউ রান্না হয়েছে। আনা হয়েছে তরমুজ, বাঙ্গি, কলা ইত্যাদি ফল। খাবার পরিবেশনের আগে দুজনকেই গরম জল আর লাক্স সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়েছে। দুজনকে সাজিয়ে
খাবার খাইয়ে পরিবারের সবাই মোমবাতি হাতে পূজা দিয়ে তবেই খেতে বসেছে গোশালার পাশে।

পঞ্চ ব্যাঞ্জন, লুচি, বেগুনি শেষ পাতে আছে দই আর সন্দেশ। খেতে খেতে দশ বছরের অশোক দিদাকে জিজ্ঞেস করছে -“ঠাম্মা আইজ কী কও তো? গরু দুইডারে হাজাইয়া- গোজাইয়া ভালো খাওন দেলা। আবার মোরাও এই গোয়াল ঘরের পাশে বইয়া খাইলাম।” অচলা বলেন – “দাদো খাওয়া শ্যাষ অইলে হুইয়া হুইয়া তোমারে কমু হানে।” খেতে খেতে বাড়ির দুই পুত্রবধূ আর শ্বাশুড়িরা গুনকীর্তন করছেন সেই গোপাষ্টমী দিনের শ্রীদেবী রাধার পুরুষ সাজের। অচলা বলছেন- “অইবে না ক্যা কও! ভগবান কৃষ্ণর পরাণসখী বইলা কতা। কৃষ্ণ ঠাকুর যাইবেন গোষ্ঠে আর দেবী রাধা বুঝি না যাইয়া পারেন!” অশোকের ভেতরটা তখন উত্তেজনায় ফেটে যাচ্ছিল কোনসময় সে ঠাম্মার কাছে এসব শুনবে!

খেয়েদেয়ে অচলা কেবল বসেছে। এরভেতরই আসেন তার দূর সম্পর্কের জা শেফালী রাণী। শেফালীর হাতে সন্দেশ এনে দেন অচলা। জায়ের হাত থেকে হাসতে হাসতে সন্দেশের বাটিটা নিয়ে নেন শেফালী। সে হাসিতে যেন রাশি রাশি আনন্দ ফুল ঝরে। অচলা বলেন “নে এইটুক খা। এরপর দুইজন একলগে জদ্দা দিয়া পান খামু।” শেফালী বলেন-” তা ও দিগো গোমাতাদের পূজা দেলা বুজি!” অচলা হাসতে হাসতে বলেন – “দিমু না ক্যা? হগল সময়ই তো দেই। ফলও পাই ভালো। হারাবছর দুধে – বাছুরে আতাল ভরা থাহে।”

০২.

“বৃন্দাবনে হেদিন চাইরোদিক খালি আনন্দ আর আনন্দ। কারণ কৃষ্ণ ঠাকুর পেত্থম গোষ্ঠে যাইবেন। লগে যাইবেন, বলরাম দাদা আর অন্যান্য গোপেরা। কৃষ্ণ ঠাকুর আর বলরামরে সাত রকমের ফুল, পাঁচ রকম পাতা আর পুরা এক বালতি দুধের ভিত্রে সোনা-রুপা ভিজাইয়া দিয়ে নাওন দেওন অইলো। হেরপর দুই দাদারে জসোদা মা খাইতে দেলেন পরমান্ন পায়েস, ননী, ক্ষীর, সন্দেশ, ফুলকো লুচি, সবজি,দই, আর রসগোল্লা। অন্যসব গোপেগোও যশোদা মা সন্দেশ আর পায়েস খাওয়াইলেন। গোকূলে অসুরগো আক্রমনে অতিষ্ট অইয়া গোপেরা নন্দমহারাজের ভাই উপানন্দের পরামর্শে বৃন্দাবন আইয়া থাহা শুরু করেন। কারণ বৃন্দাবন ঘাস- লতাপাতায় ভরা আছিল। আর এর ধারেই আছিল গোবর্ধন পর্বত। এর কিছুদিন পরই কৃষ্ণ ঠাকুর আর বলরাম গোষ্ঠে যাওয়ার আবদার জানায়।যশোদা মা আর নন্দ মহারাজ একটা অনুষ্টান কইররা অন্যান্য রাখাল গো লগে গোচারণে পাডান। কৃষ্ণ ঠাকুর গোষ্ঠে যাইবেন সেই আনন্দে বৃন্দাবনের আকাশ – বাতসও যেন আনন্দে থই থই করছে। ভগবান কৃষ্ণ যেইখান দিয়াই আইট্টা যান হের চাইরোপাশে নানান রোঙ্গের সুগন্দি ফুল ফোটতে থাহে। দক্ষিণ দিকে শুরু অইছে মিডা বাতাস। সমস্ত বৃন্দাবন জুইড়রা মৌ মৌ ঘ্রাণ। হেই ঘ্রাণ যাইয়া পোছে রাধারাণীর নাহেও। তিনি জাইননা যান – তাঁর পরাণ সখা কৃষ্ণ ঠাকুর আইজ গোষ্ঠে যাইবেন গরু চরাইতে। রাধারাণী শ্রীচরণ কমল দর্শনে অস্থির অইয়া ওডেন। কিন্তু ক্যাম্মে যাইবে হে তো মহিলা।” এভাবেই খুব আয়েশ করে নাতিকে বলছিলেন অচলা। অশোক যেন শুনছে না চোখেমুখে গোগ্রাসে গিলছে ঠাম্মার কথা। তারপর জিজ্ঞেস করে -“ঠাম্মা কও হেরপর কী অইল? রাধারাণী গেল?” অশোকের ভেতরটা যেন পাকা ডালিমের মতো ফেটে পড়তে চায়।
অচলা বলেন – “আরেএ হোনো ধীরে। না যাইয়া কী পারে?
কিন্তু যাওনের লইগগা তারে অন্য বুদ্দি আঁটতে অইছিল। রাধারাণীর চেহারা ছিল তার চাচাতো দাদা সুবল সখার মতো। রাধা সুবল সখার ধুতি পরলেন, জামা পারলেন, চুল উপরে উডাইয়া বাইন্দা পাগড়ি বানলেন। হেরপর গোষ্ঠের দিকে আডা (হাঁটা) শুরু করলেন। গোষ্ঠে যাইয়া ওডনের লগে লগেই কৃষ্ণ ঠাকুরের বুকের মইদ্দে ধক কইররা ওডে। কৃষ্ণ ঠাকুর সুবোলের দিকে চাইয়াই বুইজ্জা যান ওটা আসলে তাঁর পরাণ সখী। আর দৌড়াইয়া যাইয়া সুবোল সখা বইলা বুকে জড়াইয়া জোরে চাপ দেন। রাধারানী নিজেকে ছাড়াতে চাইলে গালে চুমু দিয়ে বলেন – আরে সখা তুমি আইছ! আমি যে কত্ত খুশি অইছি!” এই কথা শুনে অশোক হো হো করে হাসতে থাকে। বলে ঠাম্মা – “কৃষ্ণ ঠাকুর অনেক দুষ্টু আছিল না কি!” অচলা বলেন- “দাদো অ কয় না ভগবান না!” অশোক জিজ্ঞেস করে “হেরপর কী অইল?” “কৃষ্ণ ঠাকুর রাধারে চোউক টিপ দিয়া কইল এই চক্ষু তো সুবল সখার না। তাবৎ দুইন্নাইরে তুমি ফাঁকি দেতে পারো তাই বইলা কী আমারে পারবা? আর তুমি জল খাবার না খাইয়াই আইছ? রাধারাণী চক্ষু নামাইয়া নীচের দিকে চাইয়া থাহে। কাছেই ছিল দুইটা কলা গাছ।
কেবল এক কাদি কলা ধরছে। কৃষ্ণ ঠাকুর যেই গাছের দিকে চউক তুইল্লা চাইলো – সব কলা পাইক্কা গেলো। আরেকটা ছিল বড়ই গাছ কৃষ্ণ ঠাকুরের মন্ত্রে গাছ ভইরা গ্যালো পাকা বড়ইয়ে। রাধারাণী প্যাট ভইরা বড়ই খাইলেন, কলা খাইলেন। হেরপর হারাদিন গরু চড়াইয়া শ্যাষ বিয়ালে হগলডি বাড়ি ফিইররা গ্যালে দাদো।

যেই বিশেষ তিথীতে নন্দমহারাজ ও জ্যেষ্ঠ গোপেরা তাদের গোচারণের দায়িত্ব দেছেলেন, হেইডা আছিল দামোদর মাসের শুক্লাষ্টমী তিথী। আর এইডারেই কয় গোপাষ্টমী।”

০৩.

অশোক তার গায়ের স্কুল শায়েস্তাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেনিতে পড়ে। তার সবচেয়ে কাছের বন্ধুটি মুসলমান। তার নাম রিয়াজ। অশোক রাধা – কৃষ্ণর কাহিনি শুনে সারারাত কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণীকে স্বপ্নে দেখেছে। পরেরদিন স্কুলে গিয়ে রিয়াজের সঙ্গে দেখা হওয়ার সাথে সাথেই বলে- “হোন বন্দু তোর লগে এউক্কা কতা আছে।” রিয়াজ বলে – ক দেহি হুনি। অশোক রিয়াজের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে- “মুই কাইলগো রাত্তিরে ভগবানরে হপ্পনে দ্যাকছি।” রিয়াজ হো হো করে হেসে বলে- “তোগো তো বোলে আজার আজার ভগবান। তা কোন ভগবানরে দেকলি?”
অশোক বলে -“আরেএ হোন কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণীরে স্বপন দেকলাম।” রিয়াজ হেসে বলে- “ধুউর! বাদ দে চান্দু, অইসব কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণী সব কল্পনা। সত্য কেও নাই।” অশোক খুব কষ্ট পেয়ে বলে -“তুই মোর বন্দু অইয়া এইরহম কতা কইতে পাল্লি? মুই কোনোদিন তোর নবীরে লইয়া কইছি? তোরা নবীরে লইয়া গীত গাও হেও তো মুই হুনছি। মোর ভগবানরে মিত্তা কবি ক্যা তুই?” রিয়াজ বুঝতে পারে- বন্ধু কষ্ট পেয়েছে। বলে- “বন্দু তোর লগে হুদাহুদি ইট্টু ইয়ার্কি করছি। কী স্বপ্নে দেকলি – ক।” এরপর অশোক বলে- “দ্যাকলাম কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণী বৃন্দাবনে বড় মাঠে গরু চড়ায়। চাইরো পাশে লাল-নীল, সবুজ, বেগুনি ফুল আর ফুল। গরুগুলা কত্ত বড়, বড়!” এরভেতরই শ্রেনী শিক্ষক চলে আসেন। আর তারপর একটার পর একটা বিষয়ের শিক্ষক ক্লাস নিতে থাকেন।
স্কুলে একরকম সময় কেটে গ্যালো অশোকের।

উত্তম এসেই আজ অংক করাতে চায় অশোককে। কিন্তু অশোকের আজ বড্ড মন ছুটে গ্যাছে। সে তার প্রাইভেট শিক্ষককে বলে- স্যার রিয়াজ কয়- ভগবান কৃষ্ণ ঠাকুর আর দেবী রাধারাণী নাকি খালি কল্পনা?
উত্তম বলে- “অরে বড় কেউ হয়তো এইরহম কইছে। তুমি এইসব লইয়া ভাইবো না। ল্যাহাপড়া কর। কিন্তু রাধা-কৃষ্ণর কতা আইলো ক্যান?” অশোক বলে- “মাষ্টার মশাই মুই রাইতে কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণীরে স্বপন দ্যাকছি। মোগো বাড়ি কাইল গোমাতাগো পূজা অইছে আর ঠাম্মায় মোরে গোপাষ্টমীর ঘটনা কইছে। আর মুই রাত্তিরে কৃষ্ণ ঠাকুর আর রাধারাণী দেবীরে স্বপন দ্যাকলাম। কিন্তু স্যার এই গোপাষ্টমী ও কী মিত্তা?” উত্তম বলে- “কিছুই মিত্তা না। এই গো হত্যার কারণে এক ঠাকুরের অভিশাপে রামনগরের শক্তিশালী প্রধানমন্ত্রী অরুন্ধতী চৌধুরী মারা গ্যাছে। কারণ গোপাষ্টমীর দিন সে সাদু হত্যা করছিল। সাদুরা গোমাতা গো হত্যার বিরুদ্দে আন্দোলন করছিল। আগে ইট্টু পড় হেরপর হেই ঘটনা কমু।”

০৪.

“ষাটের দশকের শেষের দিকের এক সালের নভেম্বর মাস। বেশ শীত পড়েছে। রামনগর দক্ষিণ এশিয়ার অত্যন্ত শক্তিশালী একটি দেশ। এই দেশে শিখ আছে, মুসলমান আছে আর ইন্দু আছে। ইন্দুই বেশি। তো রামনগর যহন বিটিশগো ধারে অইতে স্বাধীনতা পায় তহন ইন্দুগো রাষ্ট্র ইসাবেই এর পরিচয় তৈরি অয়। তো উত্তর রামনগরের একদল সাদু
গোহত্যা না অয় সে ব্যাপারে আন্দোলন গইড়া তুললো।
হ্যাগো যুক্তি আছেলে- গরু অইল গিয়া মা। হে আমাগো দুধ দিয়া জেবন বাঁচায়। হের মাংস কি কইরা খাওন যায়? এই রামনগরে গো হত্যা বন্দ করতে অইবে। যদিও রামনগরে যহন মোঘল শাসন আছিল হেই সময় ও গো হত্যা বন্দ আছিল। কারণ কৃষি কাজ এবং পরিবেশের অসুবিদা যাতে না অইতে পারে। কিন্তু অই বছর প্রায় দুই আজার সাদু রামনগরের রাজধানী হনুমান ভূমির সীতা স্কয়ারে গো হত্যার বিরুদ্দে অবস্থান ধর্মঘটে বসলো। তহন প্রধানমন্ত্রী অরুন্ধতী চৌধুরী। এই অরুন্ধতী চৌধুরীই অইল রামনগরের শক্তিশালী রাজনৈতিক দল – সকলের জন্য রামনগর এর চেয়ারম্যান। এর দশ বছর আগে যহন ভোট অয় তহন উত্তর রামনগরের কৃষ্ণ ঠাকুরের মন্দিরের সাদু কৌরব তলাপাত্রের কাছে গেছিল আশীর্বাদ আনতে। সাদু তারে কইছিল- রামনগরে গো হত্যা বন্দ করতে। অরুন্ধতী চৌধুরী তারে কতাও দিছিল যে গো হত্যা বন্দ করবে। কিন্তু ক্ষমতা পাইয়া নিজের উদারতা প্রশ্নবিদ্দ অওনের ভয়ে সেই পিতিজ্ঞা অরুন্ধতী ভুইলা যায়। আর দশ বছরের মাতায় সাদুরা যহন গোহত্যা বন্দের জন্য আন্দোলন করে- তহন তার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত চট্টোপাধ্যায় বারোশত সাদু গুলি কইরা রাইতের আন্দারে খুন কইরা লাশ অটো চুল্লীতে পোড়াইয়া দেয়।
তহন সাদু কৌরব তারে অভিশাপ দেয়- তুমি যেমন গোপাষ্টমীর দিন সাদু হত্যা কললা তেমন কইরাই তুমি এবং তোমার বংশধররা গুল্লি খাইয়া গোপাষ্টমীর দিন মরবা।” এই অব্দি উত্তম বলে একটু থামে।

সব শুনে অশোক তার মাষ্টার মশাইরব জিজ্ঞেস করে – “স্যার সত্যইও কী গোপাষ্টমীর দিনই মরছিল অরুন্ধতী?”
উত্তম বলে- “হা। অরুন্ধতী এবং তার দুই পুত্রই গোপাষ্টমীর দিনেই দুর্ভাগ্যের শিকার হন। জিজ্ঞেস করে – স্যার আমনে জানেন হেই ঘটনা? উত্তম মাথা নাড়ায়। অশোক বলে- মুই হুনমু। উত্তম আগামীকাল বলে বেরিয়ে যায়।”

০৫.

সময় গড়াইয়া আশির দশক তহন। মে মাসের বিকাল পাঁচটা বাজে হেই সময়। সেঁজুতি সরকার কসমেটিকস আর শাড়ি গুছাইতেছিল। কয়ডা শাড়ি, কয়ডা থ্রীপিস, আর কয়টা জিন্স আর গেঞ্জি নেবে এসব ভাবছিল। ভেতরে ভেতরে খুশি খুব সেঁজুতি। কারণ আগামীকইলগোই তাগো ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে যাওনের কতা। এর মইদ্দে জেনারেল কুলদীপ আইসা বউরে বলে- “বউ কাইলগো হনুমান ভূমি থেইকা ডাক পাডাইছে যাইতে অইবে। এহন কী করমু কও? চাকরি বইলা কতা!” সেঁজুতি পেত্থম মন খারাপ করলেও পরে মাইন্না লয়।

সকাল দশটায় সেনা প্রধান আরোরার অপিসে জরুরি মিটিং বইছে। জেনারেল কুলদীপ, জেনারেল অরুণ আর কর্নেল সুমিত তিনজন মিলে। সেনা প্রধান আরোরা কইলেন- কুলদীপ রাইতের আন্দারে পাঞ্জাবের স্বর্নমন্দির দখলে নিতে অইবে। শিখ নেতা আন্দ্রাই স্বাধীনতা ঘোষণা করছে। পাঞ্জাব রামনগরের আতছাড়া অইয়া যাইবে। তোমার কতজন সৈন্য লাগবে কও? লগে বিগ্রেডিয়ার অরুণ আর কর্নেল সুমিতে দেতে আছি। কুলদীপ ইট্টুহানি ভাইবা কইলেন স্যার- এক হাজার সৈন্য, এক হাজার এল এম জি, একশো কামান আর দশটা ট্যাংক দেলেই অইবে। সেনাপ্রধান আরোরা কইলেন- মনে রাইখো পাশেই মুসলমান রাষ্ট্র পূণ্যভূমি। অরা কোনোদিনই রামনগরের বন্ধু না। রামনগর ভাঙলেই অগো লাভ। অরা রামনগররে অনেক বড় হুমকি মনে করে। সুতরাং এই অপারেশন ব্লু নাইট কোনোরহমই ছোডো মনে করন যাইবে না।

৪ জুন সকাল বেলা সাদা পোশাকে একজন অপিসার পাঞ্জাবের অমৃত সরের স্বর্ণমন্দিরের মইদ্দে গেছিল। আসলে অবস্তা বোজনের লইগগা গেছিল। আর দ্যাকতে গেছিল – আন্দ্রেই আগারওয়াল কই আছে। কারণ সেই শিখগো নেতা। গুরুদয়ারা ছাইড়া হে তহন স্বর্ণমন্দিরে আশ্রয় নিছিলো। এই ঘোষণাও দিছিল যে রামনগরের সৈন্যগো লগে যুদ্দ করবে। আর সমস্যা অইলে পাশের সাত-আট কি.মি. চাষের ক্ষ্যাত পার অইয়া পুণ্যভূমি যাইবে গা।

তারা ঠিক করেছিলে যে পুরা অপারেশনডা রাইতের আন্দারে চলবে। তাই রাত দশটার সময়ে মন্দিরের সামনের দিক গোনে আক্রমণ করে সৈন্যরা।

কালো পোশাক পরা প্রথম ব্যাটালিয়নের সৈন্যগো লগে প্যারাশুট রেজিমেন্টের কমান্ডোরাও আছিল। ভিতরে যাইয়া খুব দ্রুত আকাল তখতের দিকে যাওনের কতা কওয়া অইছিল তাগো। আকাল তখতেই মন্দিরের একটা জায়গা যেহানে আন্দ্রেই আগারওয়াল আছিল।

কিন্তু কমান্ডোরাযেই আউগাইতে লয় তাগো উপরে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল থেইকা গুলিবর্ষণ শুরু অয়।
অল্প কয়েকজন কমান্ডো বাঁইচ্চা আছিলেন।

হেগো সাহায্য করার লইগগা আউগাইয়া আইছিলেন লেফটেনান্ট কর্ণেল ইসরার রহিম খাঁ।

দশ নম্বর ব্যাটালিয়নের সদস্যরা সিঁড়ির দুদিকে আন্দ্রেওয়ালের সঙ্গীদের মেশিনগানগুলো অকেজো করতে পারছিলেন, কিন্তু সরোবরের উল্টোদিক গোনে প্রচন্ড গোলাগুলি শুরু অয়।

সেনাবাহিনী আন্দাজও করতে পারেনাই যে তাগো এইরহম ভয়াবহ প্রতিরোধের মুখোমুখি অইতে অইবে।

পেতথম পয়তাল্লিশ মিনিটেই পরে হেরা বুইজ্জা গেছিল যে অগো পরিকল্পনা। অস্ত্র ভান্ডার নিয়ে শিখরা ভালোই শক্তপোক্ত দূর্গই গইড়রা তুলছে। অগো এত সহজে বাগে আনা যাইবে না! রামনগরের সেনাবাহিনী ঠিক করে আকাল তখতের মইদ্দে স্টান গ্রেনেড ছুঁইড়রা মারবে।ওই গ্রেনেডে মানুষ মরে না। গ্রেনেডটা ফাটলে গ্যাস বাইর অয়। যাতে চউক দিয়া জল বাইর অয়। মাতা ঝিম ঝিম করে। কিন্তু গ্রেনেড ছোঁড়ার কোনও জায়গাই পায়নাই সেনারা। পেত্তেকটা জানলা, দরজায় বালির বস্তা রাহা আছিল। তার মইদ্দ দিয়া গ্রেনেড ছুঁড়লে হেগুলো সেনাবাহিনীর জওয়ানগো দিকেই উইডড়া আইতেছিল।

মন্দির চত্বরের উত্তর আর পশ্চিম দিক অইতেই যে শিখরা গুলি চালাইতেছিল তা না। ভূগর্ভস্থ নালাতে যে ম্যানহোল থাহে হেগুলোর ঢাকনা খুইললা গুলি চালাইয়া আবারও তারা মইদ্দে ঢুইক্কা পড়তেছিল।

এক প্রাক্তণ সেনা জেনারেল, শাহবেগ সিং আন্দ্রেয়ালের দলকে সামরিক প্রশিক্ষণ দিছিলো। তাগো শেখানো অইছিল সেনাসদস্যগো আডুর ধারে গুলি করতে। হেগো ধারণা আলহে সেনাবাহিনী গুলি চালাইতে চালাইতে আউগাইবে। হেই কারণে বেশিরভাগ সেনাসদস্যের পায়ে গুলি লাগছিলো।

আর যখন অউগাইতে পারনাই সেনাবাহিনী, তহন জেনারেল কুলদীপ নির্দেশ দেন আর্মড পার্সোনেল ক্যারিয়ার ব্যবহার করনের লইগগা।

ওই গাড়ি গুলি নিরোধক। কিন্তু গাড়িটা আকাল তখতের দিকে আউগাইতেই চীনে তৈরি রকেট লঞ্চার দিয়া উড়াইয়া দেওয়া অয়।

সেনাবাহিনী আন্দাজ করতে পারেনাই যে আগো ধারে রকেট লঞ্চার থাকতে পারে! গাড়িডা আউগাইতেই রকেট দিয়া উড়াইয়া দেয়।

ওই অবস্তায় ট্যাঙ্ক পাডানোর সিদ্ধান্ত নেয় জেনারেল কুলদীপ। আগে থেকে ট্যাঙ্ক আনার কতা ভাবেই নায়। কিন্তু আকাল তখতের ধারেকাছেও যহন পৌঁছন যাচ্ছে না তহন ট্যাঙ্ক আনার কথা ভাবা অয়। সেনাবাহিনীর আশঙ্কা আছিল ভোর অইলেই চাইরোদিক গোনে আজার আজার লোক আইয়া সেনাবাহিনীরে ঘিইররা হালাইবে। ভোর অইয়া আইতেছিল, কিন্তু কিছুতেই আউগানো যাইতেছিল না। তহন সেনাবাহিনী ঠিক করে যে ট্যাঙ্ক থেকে আকাল তখতের ওপরের তলাগুলারে লক্ষ্য কইররা গুল্লি মারা হইবে। ইঁট পাথর উপর থেইকা পড়তে থাকলে মইদ্দে থাহা লোকেরা ভয়ে বাইরাইয়া আইবে।

হঠাৎই সেনাবাহিনী দ্যাকতে আয় যায় যে ৩০-৪০ জন বাইরে বাইর অওনের জন্য দৌড়াইয়া আইছে। ওদিক থেইকা গুলি চালানোও বন্ধ অইয়া যায়। তহন সেনাসদস্যরা ভিতরে যাইয়া তল্লাশি চালায়। তহনই দ্যাকতে পায় যে জার্নাইল সিং আন্দ্রে ওয়ালে আর জেনারেল শাহবেগ সিং মইরা গ্যাছে। তবে পরের দিন গুজব ছড়ায় যে আন্দ্রে ওয়ালে রাইতের আন্দারে পূণ্যভূমি পলাইয়া গ্যাছে। পূণ্য ভূমির জাতীয় টিভিও ঘোষণা দেছেলে যে আন্দ্রেওয়ালে হেগো ধারে আছে। হেরা নাকি আন্দ্রেওয়ালেকে টিভিতে দেহাইবে যেকোনো সোময়।

কিন্তু জেনারেল কুলদীপ নিজেই শব শনাক্ত করে মৃতদেহ তাদের পরিবারের আতে তুইললা দেয়। হেগো অনুগামীরা লাশের পা ছুঁয়ে প্রণামও করছে।

এই পুরা অপারেশনে ৮৩ জন রামনগরীয় সৈনিক মারা গেছিলো। ২৪৮ জনের গুলি লাগছিলো

শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী মারা গেছিলো ৪৯২ জন আর দেড় আজারেরও বেশি লোক গ্রেপ্তার অইছিলো। অপারেশন ব্লু নাইটের ফলে শুধু রামনগর নয়, তামাম দুইন্নার শিখগো ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগছিল।

রামনগরের সেনাবাহিনী নিচ্চয়ই জয়ী অইছিল, কিন্তু রাজনৈতিক পরাজয় অইছিল রামনগর সরকারের।

আর হেই পরাজয়ের দাম পরবর্তীতে নিজের জীবনের উপর শোধ করতে অইছিল অরুন্ধতী চৌধুরীরে। আর সাদুর অভিশাপ ও ফইললা যায় এইভাবেই।

০৬.

১৯৮৪ সালের ৩১ শে অক্টোবর। হেইদিন ও গোপাষ্টমীর দিন। বেইন্নাকালে সাতটার মইদ্দেই নাশতার টেবিলে আইছিলেন অরুন্ধতী চৌধুরী। দুইডা পাউরুটির টোস্ট, অল্প সিরিয়াল, মুসাম্বির জুস আর ডিম আছিল হেদিনের নাশতা। যদিও আগের দিন অড়িশার রাজধানী ভুবেনশ্বর গেছিল অরুন্ধতী চৌধুরী। ৬৭ সালে অই ভুবেনশ্বরেই হের উপরে আক্রমণ অইছিল এলেকশনের প্রচার করতে গিয়া। নাহে আগাত লাগছিল নাক ফাইটটা গেছিল। ভুবেণশ্বরে হেদিন লেহা বক্তৃতা বাদ দিয়া আবেগী বক্তৃতা দেয় অরুন্ধতী চৌধুরী। আগের রাত্তিরে ঘুম অয়নাই রামনগরের প্রধানমন্ত্রীর কিন্তু চেহারা বেশ উৎফুল্ল। জাইগাই আছিল হারা রাত্তির। রাইত চাইরটার সময়ও ছোড পোলার ফরাসি বউ সামিরা চৌধুরীরে অষুদ দিয়া কইছে- দরকার পড়লে আমারে ডাইককো। আমি জাইগাই আছি। গেরুয়া রঙ্গের কালা পাইড়ের শাড়িতে অরুন্ধতী চৌধুরীরে দেবী দুর্গার মতোই লাগতেছিল হেইদিন।

জলখাবারের পরেই মেকআপ ম্যান তার মুখে সামান্য পাউডার আর ব্লাশার লাগাইয়া দেলেন। তহনই আজির হন তার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডাক্তার কে পি মাথুর।

পেত্তেকদিন ওই সময়েই অরুন্ধতীরে পরীক্ষা করতে যাইতেন অই ডাক্তার । ভেতরে ভোলাইয়া নেছেলেন ডাক্তার মাথুররে।
আসতে আসতে কইছিলেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি রোনাল্ড রেগান কী রকম অতিরিক্ত মেকআপ দ্যান। ৮০ বচ্ছর বয়সেও হের মাতার বেশির ভাগ চুল কালাই আছে। মাথুর কইলেন – আপ্নে গতকাল একটা রক্তাক্ত মৃত্যুর কথা বলে আমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছেন। অরুন্ধতী বললেন – আমি আমার মনের কথাই বলেছি। আমার শেষ রক্তবিন্দুও রামনগরের গনতন্ত্র, মানবতা, অসাম্প্রদায়িকতা আর উন্নয়নের জন্য উৎসর্গ করতে চাই।

ঘড়িতে যখন ন’টা বেজে দশ মিনিট,অরুন্ধতী বাইরে বের হলেন। বেশ রোদ ঝলমলে দিনটা। তবুও রোদ থেকে প্রধানমন্ত্রীকে আড়াল করতে সেপাই নারায়ণ সিং একটা কালো ছাতা নিয়ে পাশে পাশে হাঁটছিলেন।

কয়েক পা পেছনেই ছিলেন ব্যক্তিগত সচিব আর কে ধাওয়ান আর তারও পেছনে ছিলেন ব্যক্তিগত পরিচারক নাথু রাম। সকলের পেছনে আসছিলেন ব্যক্তিগত নিরাপত্তা অফিসার, সাব ইন্সপেক্টর রামেশ্বর দয়াল।

ঠিক হেই সময়েই সামনে দিয়ে এক কর্মচারী আতে একটা চায়ের সেট লইয়া পার অইয়া গেছিলেন । অই চায়ের সেটে তথ্যচিত্র নির্মাতা পিটার উস্তিনভকে চা দেওন অইছিল। অই তথ্যচিত্র নির্মাতার লগেই হেদিন অরুন্ধতীর পেত্থম মিটিং আছিল। হে অরুন্ধতীর জীবনের উপরে তথ্যচিত্র বানাইবে।

ওই কর্মচারীরে ভোলাইয়া অরুন্ধতী বলেছিলেন মি. উস্তিনভের জন্য যেন অন্য আরেকটা চায়ের সেট বাইর করা অয়। বাসভবনের লাগোয়া দপ্তর আছিল আকবর রোডে। দুইডা ভবনের মইদ্দে যাতায়াতের একটা রাস্তা আছিল।

হেই গেটের সামনে পৌঁছাইয়া অরুন্ধতী চৌধুরী তার সচিব আর কে ধাওয়ানের লগে কতা কইছিলেন। . ধাওয়ান তারে কইছিলেন যে অরুন্ধতীর নির্দেশমতো ইয়েমেন সফররত রাষ্ট্রপতি গিয়ানী জৈল সিংকে জানাইয়া দেওয়া অইছে যাতে তিনি সন্ধ্যে সাতটার মধ্যেই হনুমান ভূমি চইলা আসেন। পালাম বিমানবন্দরে রাষ্ট্রপতিকে রিসিভ কইরা সময়মতো যাতে রাজকুমারী অ্যানের ভোজসভায় পৌঁছাতে পারেন অরুন্ধতী হেই কারণে অই নির্দেশ। খুবই ব্যস্ত দিন হেদিন রামনগরের প্রধানমন্ত্রীর।

এই অব্দি শোনার পর উত্তম তার ছাত্র অশোকের দিকে তাকায়। চোখ জোড়া উদ্ভ্রান্ত, ব্যথিত আর উৎসুক। অশোক বলে- স্যার হেরপর কন। কী অইল হেরপর। উত্তম মুচকি হাসি দিয়ে বলে আচ্ছা হোন তাইলে।

হঠাৎই পাশে দাঁড়ানো নিরাপত্তাকর্মী দিয়ন্ত সিংকে অরুন্ধতী হাসিমুখে নমস্কার করে। দুই শিখ বডিগার্ডকে অরুন্ধতী স্নেহের চউক্ষেই দ্যাকতেন। দিয়ন্ত সিং রিভলবার বার করে অরুন্ধতীর দিকে গুলি চালায়।

প্রথম গুলিডা প্যাডে লাগছিল। অরুন্ধতী ডাইন আতটা ওপরে তোলছেলেন গুল্লির আতে গোনে বাঁচতে। তখন একেবারে পয়েন্ট ব্ল্যাংক রেঞ্জ থইকা দিয়ন্ত সিং আরও দুইবার গুল্লি চালায়। হেই দুইডা গুল্লি প্রধানমন্ত্রীর বুকে আর কোমরে লাগে।

ওই জায়গার ঠিক পাঁচ ফুট দূরে নিজের টমসন অটোমেটিক কার্বাইন নিয়ে খাড়াইয়া আছিল যশবন্ত সিং। অরুন্ধতী চৌধুরীরে মাডিতে পইড়রা যাইতে দেইক্কা যশবন্ত মনে হয় কিছুডা ঘাবড়াইয়া গেছিল। স্থির অইয়া খাড়াইয়া আছিল।

তখনই দিয়ন্ত চিৎকার কইররা যশবন্তকে কয়- গুল্লি চালাও।’ যশবন্ত সঙ্গে সঙ্গে নিজের কার্বাইন থেইকা চেম্বারে থাকা ২৫টা গুল্লিই অরুন্ধতীর শরীরে গাইত্থা দেয়। দিয়ন্ত সিং প্রথম গুলিটা চালানোর পরে প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে গিয়েছিল ততক্ষণে।

নিরাপত্তা কর্মীরা ওই সময়টায় কোনও প্রতিক্রিয়া দেহায়নাই। হতবাক অইয়া গেছিল হগলডি।

তারপরে যশবন্ত সিং গুলি চালাইতে শুরু করলে একদম পিছনে থাকা নিরাপত্তা অফিসার রামেশ্বর দয়াল দৌড়াইয়া আউগাইয়া আসেন।

যশবন্ত তখন একনাগাড়ে গুল্লি চালাইয়া গেছেন । মি. দয়ালের উরু আর পায়েও গুল্লি লাগছিল। অইহানেই পইড়রা গেছিল লোকটা।

অরুন্ধতী চৌধুরীর আশপাশে থাকা অন্য কর্মচারীরা ততক্ষুণে একজন অন্যজনরে চিৎকার কইরা নির্দেশ দিতেছিল।অইদিকে এক নম্বর আকবর রোডের ভবন থেকে পুলিশ অফিসার দিনেশ কুমার ভাট আউগাইয়া আইছিলেন শোরগোল হুইননা।

দিয়ন্ত সিং আর যশবন্ত সিং তহনই নিজেগো অস্ত্র মাডিতে হালাইয়া দেছে। দিয়ন্ত কইছিল, “আমাদের যা করার ছেল করছি। এবার তোমাগো যা করার করো। আমরা অপারেশন ব্লু নাইটের প্রতিশোধ নিলাম। আমাগো শিখ হত্যা আর আমাগো কালচারাল লাইব্রেরি ধ্বংসের প্রতিশোদ নেলাম।

অরুন্ধতীর আরেক কর্মচারী নারায়ণ সিং সামনে লাফাইয়া পইড়া দিয়ন্ত সিংরে মাডিতে হালাইয়া দেয়।

পাশের গার্ডরুম থেইকা বাইরা অইয়া সিসা রামনগর তিব্বত সীমান্ত পুলিশ বা আই টি বি পির কয়েকজন সদস্য দৌড়াইয়া আইয়া যশবন্ত সিংকেরেও ঘিইরা ফালায়।

সবসময়ে একটা অ্যাম্বুলেন্স রাহা থাকত অহানে। ঘটনাচক্রে হেদিনই অ্যাম্বুলেন্সের চালক কাজে আয়নাই।

অরুন্ধতীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা মাখনলাল ফোতেদার চিৎকার কইরা গাড়ি বাইর করতে নির্দেশ দ্যান।

মাডিতে পইড়রা থাহা অরুন্ধতীরে ধরাধরি কইরা সাদা অ্যাম্বাসেডর গাড়ির পিছনের আসনে বওয়াইয়া দ্যান আর কে ধাওয়ান আর নিরাপত্তা কর্মী দিনেশ ভাট। সামনের আসনে, ড্রাইভারের পাশে চাইপা বইলেন মি. ধাওয়ান আর মি. ফোতেদার।

গাড়ি যেই চলতে শুরু করেছে, সামিরা চৌধুরী খালি
পায়ে, ড্রেসিং গাউন পইরা ‘মাম্মি, মাম্মি’ কইয়া চিক্কাইর করতে করতে দৌড়াইয়া গাড়িতে উইট্টা বইলেন।

রক্তে ভেসে যাচ্ছিল অরুন্ধতী চৌধুরীর শরীল। সামিরা হের মাতাডা নিজের কোলে তুইললা নেলেন। পাশেই কে মাথুর। মাথুরের মনে পড়তে থাকে অরুন্ধতীর গতকালের বক্তৃতা –তিনি বলেছিলেন, “আমি আজ এখানে রয়েছি। কাল নাও থাকতে পারি। এটা নিয়ে ভাবি না যে আমি থাকলাম কী না। অনেকদিন বেঁচেছি। আর আমার গর্ব আছে যে আমি পুরো জীবনটাই দেশের মানুষের সেবায় কাজে লাগাতে পেরেছি । আর শেষ নিশ্বাসটা নেওয়া পর্যন্ত আমি সেটাই করে যাব। আর যেদিন মরে যাব, আমার রক্তের প্রতিটা ফোঁটা রামনগরকে আরও মজবুত করার কাজে লাগবে।”

খুব জোরে গাড়িটা ‘রামনগর ইন্সটিটিউট ফর মেডিক্যাল সায়েন্সের দিকে এগোতে থাকে। মাথুর সামিরা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন- এই তো সেদিন গোয়েন্দা প্রধানমন্ত্রীকে নোট দিয়েছিল – শিখ দেহরক্ষীদের না রাখার জন্য। অরুন্ধতী দেবী লিখেছিলেন – আরন্ট উই সেকুউলার?

সামিরার সমস্ত গাউন রক্তে ভাইসা যাইতেছে। চউখ দিয়া টপটপ কইরা জল পড়ে শ্বাশুড়ির গায়ে। অরুন্ধতী চৌধুরীর চোখগুলো যেন স্তির অইয়া যাইতেছে। ডাক্তার মাথুর ড্রাইভাররে তাড়া দ্যান- ড্রাইভার আরও তাড়াতাড়ি চালান। গাড়ি তাড়াতাড়ি আউগাইতে থাহে হাসপাতালের দিকে।

লেখক: নুসরাত সুলতানা
কবি ও কথাসাহিত্যিক

লেখক পরিচিতি :

নুসরাত সুলতানা, দ্বিতীয় দশকের কবি ও কথাসাহিত্যিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ মিলিটারী ইন্সটিটিউট অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজিতে সিভিলিয়ান ষ্টাফ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। স্বামী এবং একমাত্র পুত্র সন্তানকে সাথে নিয়ে বসবাস করছেন মিরপুর সেনানিবাস। প্রকাশিত গ্রন্থ:

গল্পগ্রন্থ : মৌতাত (২০২২)
নাচের শহর রূপেশ্বরী (২০২৪)
গদ্য গ্রন্থ: পায়রার পায়ে আকাশের ঠিকানায়-
মুক্তগদ্য (২০২১)
ফিরে দেখা কৃষ্ণচূড়া – স্মৃতি গদ্য (২০২৫)

কাব্যগ্রন্থ – ছায়া সহিস (২০১৯), গহিন গাঙের ঢেউ (২০২০)। মহাকালের রুদ্র ধ্বনি (২০২৩) ( কাব্যগ্রন্থ – চান্দ উটলে গাঙ পোয়াতি অয় (২০২৪)।
নিয়মিত লিখছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক, লিটল ম্যাগ এবং ওয়েব ম্যাগে। এরই ভেতর নিজস্ব ভাষা রীতি, চিত্রকল্প এবং ব্যক্তিগত জীবন দর্শনের মাধ্যমে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন নিজস্ব সিগনেচার।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments