Tuesday, February 4, 2025
Homeসাহিত্যগল্পরোদের আড়ালে মেঘের ঘনঘটা

রোদের আড়ালে মেঘের ঘনঘটা

বিনতে ইউনুস

বিনতে ইউনুস


অবসর সময়ে এফবি স্ক্রল করছিল মালিহা। হঠাৎ একটা পোস্টে চোখ আটকালো। আনিশা কবিরের পোস্ট। মালিহার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড আনিশা। দুটো ছবি আপলোড দিয়েছে, একটা সিঙ্গাপুর পাসপোর্টের, অন্যটা এয়ারপোর্ট এরিয়ার। আনিশা আবার নিজের ছবি আপলোড করে না কখনো। ওর জীবনে পাওয়া আল্লাহর নিয়ামতগুলোর শোকরিয়া জানানোর জন্য বা দুআ চাওয়ার জন্য এটা সেটার ছবি আপলোড করে শুধু। এবারেও দুআ চাওয়া হয়েছে। ক্যাপশনে লেখা—সিঙ্গাপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করছি। দুআয় রাখবেন।

আর স্ক্রল করে যেতে পারলো না মালিহা। এটা স্কুলে লাস্ট বেঞ্চে বসে বই থেকে দেখে দেখে লিখা মেয়েটা না? ও চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর! আরে মালিহা! করলি কী জীবনে?

আনিশার পোস্ট দেখে প্রথমে এটাই মাথায় এলো মালিহার। পরক্ষণেই নিজেকে শাসালো, কেন, সিঙ্গাপুর যাওয়াই কি জীবনের উদ্দেশ্য নাকি এটাই সফলতার শীর্ষ চূড়া যে সিঙ্গাপুর যেতে পারিনি বলে জীবনে কী করলাম প্রশ্নটা আসবে?

তবু আনিশার পোস্টের স্ক্রিনশট নিয়ে নিজের হাসবেন্ডের ইনবক্সে সেন্ড করলো মালিহা। মেসেজ টাইপ করলো, “দেখো, এটা আমার স্কুল লাইফের ফ্রেন্ড। সিঙ্গাপুর যাচ্ছে। এগুলো আসলে কপালে নিয়ে আসতে হয়। আমি এসব নিয়ে আসিনি কপালে। আমার কপালে সিলেট দেখার ভাগ্যটাও জোটেনি, সেখানে সিঙ্গাপুর তো অনেক দূরের কথা। একমাস ধরে সেধে যাচ্ছি তিনটা দিনের জন্য সময় বের করতে।”
কথা সত্য। অফিসের কাজের জন্য টানা তিনদিনের ছুটি নিতে পারছে না আরমান। তাই সিলেট ট্যুর প্ল্যানটাও ঝুলে আছে।

ঘন্টাখানেক পর মালিহার ম্যাসেজ সিন করলো সে। বউয়ের খোঁটা শুনে রাগ হলো না তার। ইনবক্সে প্রায়ই মানুষের এরকম সৌভাগ্যের ফলক দেখতে অভ্যস্ত সে, বউয়ের বদৌলতে। তার রাগ গিয়ে পড়লো আনিশার উপর। কেন ভাই? সিঙ্গাপুর যাচ্ছিস যা না। ফেসবুকে এসে আমজনতার কাছে দুআ চাইতে হবে কেন? দুআ লাগলে মা-বাবার কাছে গিয়ে চেয়ে আয়!

হাসবেন্ড একটা গোলাপ এনে দিলে সেটার জন্যও আল্লাহর কাছে শোকরিয়া জ্ঞাপন করে ফেসবুকে এসে—এতো ভালো একটা জীবনসঙ্গী দেওয়ার জন্য। আল্লাহ তো মনের কথা শুনেন। ফেসবুকে এসে শোকরিয়া জানাতে হয় না তো। যদি এদের মগজে ঢুকিয়ে দেওয়া যেত এই সত্যিটা।

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

আরমান লিখলো, “তুমি না দাবি করো তুমি অন্যদের মতো না, তুমি আলাদা। এখন তোমার মেসেজ তো ইঙ্গিত দিচ্ছে তুমি ওর মতো সৌভাগ্য চাও। কিন্তু মালিহা, তুমি আলাদা একটা মেয়ে, তোমার লাইফও ওর থেকে আলাদা। তো তোমার কী এমন কিছু চাওয়া উচিত না যেটা তোমার লাইফের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ?”

মেসেজ সেন্ড হওয়ার মিনিট না পেরুতেই রিপ্লাই আসলো ওদিক থেকে, “আমি কি একবারো উল্লেখ করেছি যে আমি সিঙ্গাপুর যেতে চাই?”

“আচ্ছা আমি বসের সাথে কথা বলে দেখি তিনদিনের ছুটি ম্যানেজ করতে পারি কিনা।”
.
সপ্তাহখানেক পর সিলেট ট্যুরে গেল ওরা। সাথে তিনবছরের বাচ্চাটা। শ্রীমঙ্গল, জাফলং, বিছানাকান্দি ঘুরে দেখলো। বিছনাকান্দি থেকে ফেরার পথে গাড়িতে বসে দুদিনের তোলা ছবিগুলো দেখছিল মালিহা।

আরমান জিজ্ঞেস করলো, “তুমি কি এখন ফেসবুকে ছবি আপলোড দিবে?”

ছবিগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত মালিহা উত্তর দিলো, “হ্যাঁ। জাস্ট দুয়েকটা প্রকৃতির ছবি দিবো। তুমি তো জানোই আমি নিজের কোনোপ্রকার ছবি আপলোড করিনা।”

“সে-তো জানি। কিন্তু তুমি তো এতেই কাউকে না কাউকে ফাঁসিয়ে দেবে।”

“কীভাবে?” মালিহার কন্ঠে কৌতুহল।

“তোমার ওই বান্ধবী সিঙ্গাপুর যাওয়াতে তোমার আফসোস হয়েছিল না নিজের ভাগ্যের উপর? এর জেরে তুমি আমাকে খোঁচালে। এখন তোমার সিলেট ট্যুরের ছবি দেখে অন্য কেউ এমন হা-হুতাশ করলে? হাসবেন্ডের সামর্থ্যের বাইরে জোরাজুরি করলে? হয়ে গেল না তাকে ফাঁসিয়ে দেওয়া?”

“এতো কাহিনি শুনিও না তো।”

আর কিছু বললো না আরমান। মালিহা নিজেই বললো, “আমাদের সবার আসলে নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা উচিত। কারো জীবনই সুখে পরিপূর্ণ নয়। একেক জনের একেক ইচ্ছে অধরা থেকে যায়, একেক জনকে একেক রকম অপূর্ণতা পরিপূর্ণ হওয়া থেকে আটকায়। আমি তোমাকে ওইদিন এমনিতেই বলেছিলাম ওসব। ছুটি নিতে পারছিলেনা ওটার রাগও ছিল তাই। আমি আমার রবের কাছে ভালো কিছু চাইতে পারি কিন্তু অন্য কাউকে এটা দিলে আমাকে দিলে না কেন—এমন অভিযোগ তাঁর কাছে রাখতে পারি না। এমনিতেই তিনি আমাকে অনেকের চেয়ে বেশি দিয়েছেন। এরপর তো আমার নাশোকরী করা সাজে না!”
.
আরেকদিন, পড়ন্ত দুপুরে, ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে ফোন হাতে নিয়ে বসলো মালিহা। কিছুক্ষণ ফেসবুক স্ক্রল করার পর আঙ্গুল কেঁপে উঠলো আনিকা কবির নামের কারো পোস্ট দেখে। পোস্টে আনিশাকে ট্যাগ করা। মেয়েটা লিখেছে—মৃত্যুর কাছে নতি স্বীকার করে যায় উন্নত দেশের উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতিও। মৃত্যু যেখানে লিখা আছে সেখানে হাজির হওয়া শুধু। গুরুতর অসুস্থ হওয়ায় সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আপুর শাশুড়িকে। দেশে বেঁচে ফিরতে পারলেন না তিনি।

নিজের কাছেই বেকুব বনে গেল মালিহা। আনিশা সিঙ্গাপুর গিয়েছিল শাশুড়ির চিকিৎসার জন্য! অথচ ও কত কী ভেবেছিলো! অবশ্য এ দলে মালিহা একা নয়। কমেন্টে অনেকেই আনিশাকে উইশ করেছিলো সেদিন—হ্যাভ আ গুড জার্নি।

আমরা চোখের সামনে যেটা দেখি, অর্ধেকটা হোক কিংবা পুরোটা, বিশ্বাস করে নিই। আর সেই দেখা যদি হয় কারো লাইফের কিছু, তখন ভালোটাই দেখি বেশিরভাগ সময়। কারণ, মানুষ দুঃখগুলোকে প্রচার করে বেড়ায় না। যত শো-অফ সুখ, আনন্দগুলোকে নিয়েই।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments