আমার বন্ধু অবন্তিকা আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলে দেখতে পেতো তার একটি ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। অবশ্য বেঁচে থাকলে আজকে যা ঘটেছে তা হয়তো ঘটতো না। তার এই ইচ্ছে পূরণের চেয়ে সে বরং বেঁচে থাকলেই আমি বেশি খুশি হতাম। অবন্তিকার খুব ইচ্ছে ছিলো তার ছবি পত্রিকায় ছাপা হবে। খুব বেশি বড় স্বপ্ন নয়।সে শুধু চেয়েছিল কোনো একটি বিজ্ঞাপন চিত্রের মডেল হবে। পরিবারের আর দশজনের সাথে তারও একটি দৃশ্য থাকবে। ছবির মাঝখানে দাঁড়িয়ে থাকবে। পত্রিকায় সেরকম ছবি ছাপা হবে।গ্রুপ ছবির মাঝখানে ছোট্ট একটি অংশ জুড়ে যে থাকতে চেয়েছিল সেই অবন্তিকার একার বড় বড় ছবি ছাপা হয়েছে দেশের প্রায় সব ছোট বড় পত্রিকার পাতা জুড়ে।সবগুলো টিভি চ্যানেলে তাকে নিয়ে প্রতিবেদন হয়েছে। তার ছবি দেখানো হয়েছে, তার বিগত দিনের কিছু স্মৃতিও তুলে ধরা হয়েছে। কিন্তু সেসবের কোনোটাই অবন্তিকা দেখতে পায়নি।সে তখন সব মায়ার উর্ধে অন্য জগতে পাড়ি জমিয়েছে। আমার কাছে অবন্তিকার ছিলো অনেক দাবী, অনেক ইচ্ছে।আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম একদিন সময় হলে সেই সব ইচ্ছে পূরণ করবো।কিন্তু অবন্তিকার কোনো ইচ্ছেই আমি পূরণ করতে পারিনি। তার আগেই সে চলে গেছে।আমি যখন ভীষণ ব্যস্ত সময় পার করছিলাম সেরকম একটি দিনে না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছে।
অবন্তিকার পুরো নাম ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা।বাড়িতে ওকে অবনি নামেও ডাকা হতো।জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে মেয়েটি মারা গেলো সে আমার ভালো বন্ধু ছিলো। সে মারা গিয়েছে ১৫ই মার্চ। যেদিন আমি আমার বাবাকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম। আমি যে কয়দিন ঢাকায় ছিলাম সে কয়দিন ইন্টারনেট থেকে দূরে ছিলাম,পত্রপত্রিকা,টেলিভিশন,ফেসবুক সব কিছু থেকেই দূরে ছিলাম। তাই ওর ঘটনাটা আমি জানতামই না।শুধু শুনেছিলাম একটা মেয়ে মারা গিয়েছে। আমি নিজে বাবাকে নিয়ে এতো বেশি বিজি ছিলাম, চিন্তিত ছিলাম যে আর কোনো দিকে নজর দিতে পারিনি। একটু আগে গুগলে কিছু বিষয় নিয়ে জানতে গিয়ে রিলেটেড নিউজ হিসেবে ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা নামটি চোখে পড়লো।সাথে সাথে মনে পড়লো আমারতো একটা অসাধারণ বন্ধু আছে এই নামে। রিভিউ হিসেবে ঘটনাটা জানতে গিয়ে গুগলে নাম লিখে সার্চ দিতেই যে ছবিগুলো আমার সামনে আসলো তা দেখে আমি হতবাক হয়ে গেছি। এই অবন্তিকাইতো আমার সেই বন্ধু। সে আমাকে অম্লান বলে ডাকতো। তার ছোট্ট একটা ভাই আছে অপূর্ব। তাকে নিয়েও কত গল্প হতো আমাদের। যে সব বাচ্চাদের সাথে আমার পরিচয় আছে অবন্তিকা তাদেরকে খুব পছন্দ করতো। লেখালেখি বিষয়ে সে আমার থেকে নানা সময়ে প্রশ্ন করে জেনে নিতো। পত্রিকায় ফিচার লেখার বিষয়ে আমি তাকে যথাসাধ্য পরামর্শ দিয়েছি।বেশ কিছু কিশোর কিশোরীর ইন্টারভিউ করিয়েছি তাকে দিয়ে আর সে অনুবাদ করতে পছন্দ করতো।
অবন্তিকা এয়ারফোর্সে গ্রীন কার্ড পেয়েছিল। ট্রেইনিং শেষ হলেই হয়তো কমিশন পেয়ে ফ্লাইং অফিসার হয়ে যেতো। আর এতোদিনে নিশ্চই সে পদন্নোতিও পেতে পারতো। আমার সাথে তার প্রচুর কথা হতো। সে নানা বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইতো। আমি সাধ্যমত পরামর্শ দিতাম। তার প্রথম প্রশ্ন ছিলো সে যে এয়ারফোর্স ছেড়ে আসলো এটা তার ভুল হয়েছে কি না। আমাকে কতবার তাদের ওখানে ঘুরতে যেতে বলেছে। যদিও আমাদের কোনোদিন দেখা হয়নি হয়তো কোনো একদিন দেখা হলেও হতে পারতো কিন্তু সে যে এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। তারমত সহাসী একটা মেয়ে কতটা নিরুপায় হলে এমনটি করতে পারে আমি ভাবতেও পারছি না। সে আমাকে বলতো জাজাফী তোমাদের গ্রামের বাড়িতে আমাকে নিয়ে যাবে? আমি বলেছিলাম অবশ্যই নিয়ে যাবো। আমি যখন কক্সবাজারে ছিলাম তখনও তার ইচ্ছে ছিলো কক্সবাজার ঘুরতে যাবে। প্রতিটি বিষয়ে সে তার মায়ের সাথে আলোচনা করতো। তার এই চলে যাওয়ার সময় সে যদি একটি বার মায়ের সাথে আলোচনা করতো তবে কতইনা ভালো হতো। একবার আমি কিছু মানুষের উপর বিরক্ত হয়ে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম। অনেককে আনফ্রেন্ড করেছিলাম। অবন্তিকা সাথে সাথে আমাকে মেসেজ দিয়ে জানতে চেয়েছিল তোমার কিছু হয়নিতো? আমি খুব ভয় পাচ্ছি। আমি তাকে আস্বস্থ করেছিলাম যে আমি ঠিক আছি। অ্যান্টি সুইসাইড স্কোয়াডের বিষয়ে তার জানাশোনা ছিলো। সে নিজেও এই মতবাদ প্রচার করতো যে কারো যদি খুব ভয় হয় যে আত্ম*হত্যার প্রবনতা বাড়ে তবে সে যেন কখনো একা না থাকে। ঘরে বন্দি না থাকে। সে যেন অনেক মানুষের ভীড়ে মিশে থাকে। সেই মানুষটি ১৪ই মার্চ বাগিচাগাও ফিরে গিয়ে এভাবে নিজেকে শেষ করে দিবে তা কেউ কল্পনাও করেনি।
অবন্তিকার কাছে আমি ছিলাম একটি রহস্য। সে বলতো “ আমার খুব ইচ্ছে তুমি মানুষটাকে একদিন দেখবো।রহস্য নিয়ে ঘাটাঘাটি ভালো লাগে।তুমি আমার কাছে একটা রহস্যের মতই। তুমি দেখা দিও কেমন? আমার খুব ইচ্ছে তোমাকে দেখার। তুমি আসলে কে সেটা জানার”।
আমিও ভেবেছিলাম সময় করে একদিন অবন্তিকাকে চমকে দেবো। দেখা করবো আর ও যে আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল তাও একদিন নিয়ে যাবো। কিন্তু কে জানতো মানুষের সব ইচ্ছে পূরণ হয় না।কখন কোন জমিনে কার মৃত্যু হবে তা মানুষ জানে না। এ কথাটি পবিত্র কুরআনে সুরা লোকমানের শেষ আয়াতে বলা হয়েছে।অবন্তিকাও এভাবে চলে যাবে তা সেও যেমন জানতো না আমরাও কখনো কল্পনা করিনি।
১৯ এপ্রিল ২০১৯ অবন্তিকা প্রথম আমাকে মেসেজ দিয়েছিল। তারপর নিয়মিত আমাকে মেসেজ দিতো। নানা বিষয়ে কথা বলতো। সে আমাকে দেখতে চাইতো। আমি তাকে বলেছিলাম নিশ্চই একদিন দেখা হবে। কিন্তু সেই একদিন আসার আগেই অবন্তিকা এভাবে চলে যাবে ভাবিনি। অবন্তিকাকে সর্বশেষ মেসেজ দিয়েছিলাম ৮ এপ্রিল ২০২৩। যখন ঈদ উপলক্ষ্যে সুবিধাবঞ্চিত শিশু কিশোর কিশোরীদের নতুন কাপড় কিনে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম তখন। যে মানুষটির সাথে এতো শত বিষয় নিয়ে আলাপ হতো সে এখন নেই। আমার ব্যস্ত সময়ে সে চলে গেছে। তার চলে যাওয়ার বিষয়টিও আমি জানতে পেরেছি অনেক দিন পর!
অবন্তিকা আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেতে চেয়েছিল। মা দিবসে আমার আম্মাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। অবন্তিকা মৃত্যুর আগে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিল তা আজ পড়লাম। তার এই মৃত্যুকে সে হত্যা*কান্ড হিসেবে আগেই চিহ্নিত করে গেছে। এরপরও জড়িত দু’জন সহ বাকিরা যদি শাস্তি না পায় তবে সেটা হবে খুবই দুঃখজনক বিষয়। অবন্তিকার একটা ছবি বহুদিন আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় খুব আলোড়ন তুলেছিল। যে ছবিতে অবন্তিকা একা একটি টেবিলে বসে অন্য টেবিলের দিকে তাকিয়ে আছে। যেখানে বন্ধুরা আড্ডা দিচ্ছে। ছবিটি নিঃসঙ্গতার বহিঃপ্রকাশ ছিলো।সেই ছবির অবন্তিকা আজ সত্যি সত্যিই একা হয়ে গেছে। বিয়ের পরিকল্পনা থেকে শুরু করে চাকরি জীবন সব নিয়ে সে আমার মতামত জানতে চাইতো। আমিও তাকে মতামত দিতাম।এয়ারফোর্স থেকে সরে আসার পর মানুষ তাকে কত যে কথা বলেছে। তা নিয়ে তার অনেক দুঃখ হতো। আমি তাকে সাধ্যমত বুঝিয়েছি যে তুমি ভুল কিছু করোনি। তার মন সেই সব শান্তনা বাক্য শুনে শান্ত হতো। এভাবে কয়েক বছর কেটে গেছে। তবে গত এক বছর তার সাথে আমার যোগাযোগ হয়নি। হাজারটা সমস্যা আর ব্যস্ততার মধ্যে আমি অনেক সময় অনেকের খোঁজ নিতে পারিনা।কেউ যখন আমাকে নক দেয় আমি তাকে সময় দিতে চেষ্টা করি। নিজ থেকে খোঁজ নেওয়া অনেক সময় হয়ে ওঠে না। আমি চাই বন্ধু,পরিচিতজনদের কারো সমস্যা থাকলে তা যেন তারা শেয়ার করে। আমরা যেন তাদের সমস্যার কিছু একটা বিহিত করতে পারি।
অবন্তিকার আগেকার দিনগুলোর বিভিন্ন সমস্যার কথা শুনে আমি তাকে সাহস জুগিয়েছি,বেঁচে থাকার জন্য অনুপ্রেরণা দিয়েছি। সে খুশি হয়েছে এবং সে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে গিয়েছে।যদিও আমার কখনো মনে হয়নি সে ডিপ্রেশনে ভুগছে। তবে আমি এটা মনে করতাম আশেপাশে মানুষের কটুকথা,খোঁচা মারা কথা শুনতে শুনতে যে কোনো মানুষের মন বিষাদে ভরে উঠতে পারে।ফলে আমি তাকে উৎসাহ দিতাম। সে বলতো সে ছেলেদের বিশ্বাস করে না কিন্তু সে এটাও মনে করতো জাজাফী নামের মানুষটি তার কাছে অসম্ভব ভালো। কিন্তু এখন সেগুলো মনে করে খারাপ লাগছে। ভালো মানুষটিই যে তার এই বিপদের সময়ে তার পাশে থেকে তাকে উদ্ধার করতে পারেনি। যদি ওইদিনও ওর সাথে কোনো কারণে আমার কথা হতো তবে আমি নিশ্চই চেষ্টা করতাম অবন্তিকার মনের সব কষ্ট কমিয়ে দিতে। অবন্তিকার এই পরিণতির জন্য যারা দায়ী তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করছি।
আমি দেখেছি এবং এখনো মনে আছে অবন্তিকা মাঝে মাঝে আমাকে বলতো এখন নামাজ পড়বো, তোমাকে নামাজ শেষ করে নক দেবো। ওই এই চলে যাওয়াটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে। আমি ভাবতেই পারছি না আমারই কোনো বন্ধু এভাবে চলে যেতে পারে।
আমি জানি আমার বন্ধু তালিকায় অসংখ্য মানুষ আছে যাদের সাথে নানা সময়ে নানা বিষয়ে কথা হয়। কারো যদি এমন কিছু সমস্যা থাকে যা কারো সাথে শেয়ার করা হয় না, যার সমাধান দরকার,মনোবল বৃদ্ধি করা দরকার তবে আমি চাই তারা আমার বা অন্য কোনো বন্ধুর সাথে তা শেয়ার করুক। নিশ্চই কোনো না কোনো পথ আমরা খুঁজে নিতে পারবো ইনশাল্লাহ । আমি জানি যে চলে গেছে সে আমার এই স্মৃতিচারণের কথা জানতেও পারবে না। এ থেকে তার কোনো উপকারও হবে না। তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
প্রিয় অবন্তিকা
আমার সাথে পরিচয়ের পর থেকে তোমার অসংখ্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছ,পরামর্শ চেয়েছ, মতামত চেয়েছ অথচ এমন একটি সময়ে তুমি যদি একবার বন্ধুকে নক দিতে তবে আগের মতই বন্ধুকে পাশে পেতে। তোমার যে বন্ধুরা সেদিন তোমাকে ফোন করেছিল হয়তো তুমি দেখেছ কারা কারা তোমাকে ফোন করেছে তাদের কারো ফোন কল যদি তুমি রিসিভ করতে কতইনা ভালো হতো।হয়তো মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের লেখা “হটলাইন” বইটির মতই তোমাকে আমরা আটকাতে পারতাম। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস তোমার সেই স্ট্যাটাসটা আমার চোখে পড়েনি সেদিন। আমিও তোমাকে কল দিতে পারতাম। ভাগ্য বদলাতো কি না জানি না তবে চেষ্টাতো করতে পারতাম। কোনো কিছুই আর আগের মত রইলো না। আর কোনোদিন তোমার কাছ থেকে মেসেজ আসবে না। আমার দেওয়া মেসেজেরও রিপ্লাই তুমি দিবে না। আর কোনো অবন্তিকা এভাবে ঝরে যাক তা আমি চাই না।
২০ মার্চ ২০২৪