প্রিয় নবী (স),
আসসালাতু আসসালামু আলাইকা ইয়া সায়্যিদিল মুরসালিন।
জানি না আপনার কাছে মনের কথা এভাবে চিঠির মত করে লিখার ব্যাপারে কখনো কেউ ভেবেছে কিনা। কিংবা সাহস করেছে কিনা। কিন্তু আপনি তো আমার সবচেয়ে প্রিয় মানুষ। আর প্রিয় মানুষকে চিঠিতো লিখাই যায়। তাছাড়া আমি জানি যে আপনার কাছে আমার মত অনেক মেয়েরাই আসতেন তাদের প্রশ্ন, অভিযোগ বা অন্য যে কোন বিষয় নিয়ে।
সূরা মুমতাহানা’র ১২ নং আয়াতে আমি দেখেছি যেসকল মুমিন নারীরা আপনার নিকট এসে ইসলামের বাইআত গ্রহণ করত, আল্লাহ আপনাকে তাদের জন্য দোয়া করতে বলেছেন। সেখান থেকেই আমি সাহস পেয়েছি আপনাকে চিঠি লিখার।
আমার খুব আফসোস হচ্ছে, আমি যদি আপনার জীবদ্দশায় জন্ম গ্রহণ করতাম, হয়তো আপনার কাছে আসতাম এরকম প্লেজ অব অ্যালিজেন্স নিতে, আর আল্লাহর এই আদেশ অনুযায়ী আপনিও তখন আমার জন্য দোয়া করতেন। আপনি চলে যাওয়ার অনেক পরে আল্লাহ আমাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন বলে, পার্থিব জীবনে সরাসরি আপনার কাছে আসার সুযোগ যেহেতু আমার নেই, তাই এই চিঠির আশ্রয় নিচ্ছি।
আবার আফসোসের সাথে খুব ভয়ও হচ্ছে। কারণ আমি জানিনা, ধরিত্রীর বুকে আপনি ইসলামের সুবাতাস ছড়িয়ে দেয়ার আগে অ্যারাবিয়ান পেনিন্সুলার সেই অন্ধকার উপত্যকায় যদি আমার জন্ম হত, তাহলে আমার ভাগ্যে কি ঘটত! জাহেলিয়াতের সেই অভিশপ্ত সমাজ কি আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলত!
তাই একজন মুসলিম মেয়ে হিসেবে আপনার প্রতি আমার যত গ্র্যাটিচিউড অ্যান্ড অবলিগেশন, তার মধ্যে এটাইতো সবচেয়ে বড় যে, সমাজটাকে আপনি বদলে দিয়েছেন বলেই হয়তো আমি আজও বেঁচে আছি। কিন্তু এখনকার ঘুণেধরা সমাজ আপনার শেখানো পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে সেই একই কাজ করছে। শারিরীকভাবে না হলেও, নারীদেরকে পণ্য বানিয়ে তাদের সম্মান ও মর্যাদাকে তারা জাহিলিয়াতের যুগের মতই জ্যান্তই পুঁতে ফেলছে।
বুখারী শরিফের ২৭৩১ নং হাদিস থেকে জেনেছি, আপনি হুদায়বিয়ার সন্ধি’র সেই কঠিন সময়ে আপনার স্ত্রী, আমাদের মা, উম্মে সালামা (রা) এর সাথে কনসাল্ট করে তার পরামর্শ ফলো করেছেন। পবিত্র কোরআনে নারীদের বিষয়ে অবতারনার ব্যাপারে উম্মে সালামা (রা) এর একটা প্রশ্নের সূত্র ধরেই আপনার উপর নাযিল হয়েছিল সুরা আহযাবের ৩৫ নং আয়াত যেখানে আনুগত্য, সত্যবাদিতা, ধৈর্যশীলতা, বিনয়, দানশীলতা, সিয়াম পালন, শালীনতা ও আল্লাহকে স্মরণ করার জন্য পুরুষ ও নারীর জন্য ঘোষণা করা হয়েছে সমান ক্ষমা ও পুরষ্কার। এই আয়াতের ঘোষনা অনুযায়ী পুরষ্কার যেমন পুরুষের জন্য বেশী নয়, দায়িত্বও তেমনি নারীদের জন্য কম নয়।
কারবালা যুদ্ধের বিয়োগান্তিক ইতিহাস পড়তে গিয়ে দেখেছি, আপনার দৌহিত্রী জয়নব বিনতে আলী (রা), ফাতিমা (রা) এর জৈষ্ঠ্য কন্যা, ইয়াজিদের রাজসভায় সূরা আল-ইমরানের ১৭৮ নং আয়াত উল্লেখ করে ভীষণ জ্বালাময়ী এক বক্তব্য রেখেছেন।
আবার প্রখ্যাত তাফসিরকারক ইবন কাসিরের ‘আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া’ গ্রন্থে পেয়েছি, আপনার আরেক বংশধর সাঈদা নাফিসা (রা), ইমাম হাসানের পুত্র জায়েদ-আল-আবলাজ এর পুত্র আল-হাসান-আল-আনোয়ার এর কন্যা, ছিলেন চার মাজহাবের একটি শাফি মাজহাব এর প্রবক্তা ইমাম শাফি’র সরাসরি শিক্ষিকা। এমনকি ইমাম শাফি মিশরে আসার পর সাঈদা নাফিসা (রা) তার লেখাপড়ার খরচও বহন করেছেন।
বিশ্বাস করেন প্রিয় নবী (স), এসব যেখন দেখি, তখন আমার মনোবল ভীষণ বেড়ে যায়। সেজন্যই আপনার সহধর্মিনীদের, কন্যাদের, সাহাবাদের প্রচুর হাদিস বর্নণা করার মত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকায়তো বটেই এমনকি আপনার জীবদ্দশায় ও তার অল্প পরে তাবে-তাবেয়ী’দের সময়ে সম্মুখ সমরের মত প্রত্যক্ষ দ্বায়িত্বেও যখন মুসলিম নারীদের বীরত্ত্বগাঁথা খুঁজে পাই, তখন বুকটা গর্বে ভরে ওঠে।
মুসলিম শরিফের ১৯১২ নং হাদিসে রয়েছে, উম্মে হারাম (রা) একজন নারী হয়েও ইসলামের পক্ষে সমুদ্র পথে যুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য আপনার কাছে দোয়া চেয়েছিলেন। তার সামনেই আপনি সে দোয়া করেছিলেন। তিনি দীর্ঘদিন অপেক্ষা করেছিলেন কবে আল্লাহ আপনার দোয়া কবুল করবেন আর তিনি যুদ্ধে যাবেন।
অবশেষে আপনি পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার অনেক পরে হলেও, ২৮ হিজরিতে উম্মে হারাম (রা) বর্তমান সাইপ্রাসে ইসলাম প্রচারের জন্য মুসলিমদের প্রথম নেভাল এক্সপিডিশনে যোগ দেয়ার সুযোগ পান এবং একজন শহীদ হিসাবে আত্মত্যাগ করেন। সাইপ্রাসের লারনাকায় তাকে সমাহিত করা হয় এবং সে সমাধি আজো অক্ষত আছে।
এভাবে শুধু উম্মে হারাম (রা) নন, ওহুদ যুদ্ধে নুসাইবা বিনতে কাব (রা), খাইবার যুদ্ধে উমাইয়াহ বিনতে কায়েস (রা), হুনাইন যুদ্ধে উম্মে সুলায়েম (রা), ইয়ারমুক যুদ্ধে আসমা বিনতে আবু বকর (রা), মারজ-আল-সাফার যুদ্ধে উম্মে হাকিম (রা), সানিতা-আল-উকাব যুদ্ধে খাওলা বিনতে আল আজওয়ার (রা) এর মত মুসলিম মহিয়সী নারীরা যে অসীম সাহস ও বীরত্বের ইতিহাস আমাদের জন্য রেখে গেছেন তা পড়তে পড়তে আমি ভাবি – আপনার শেখানো প্রকৃত ইসলামে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের কি সুমহান মর্যাদাই না দেয়া হয়েছে!
আল্লাহ আপনার মাধ্যমে আমাদেরকে সুরা তাওবা’র ৭১ নং আয়াতটি পাঠিয়েছেন। সেখানে মহান আল্লাহ বলেছেন তার রহমতের ছায়াতলে প্রবেশ করতে হলে সালাত কায়েম, যাকাত প্রদান, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল হিসেবে আপনার আনুগত্য করার পাশাপাশি করতে হবে আরও দুটি কাজ – সৎ কাজের নির্দেশ দিতে হবে ও অসৎ কাজে নিষেধ করতে হবে। কাজ দুটো করতে হবে কাদেরকে? শুধু মুমিন পুরুষদেরকে? না, মুমিন নারীরাও যে মুমিন পুরুষদের সহযোগী বা বন্ধু (أَوْلِيَاء) হয়ে এই একই কাজ করতে হবে তাও তিনি বলেছেন এই আয়াতেই।
ইনশাআল্লাহ, সকল নারী আহলে-বাইত, সাহাবা ও তাবে-তাবেয়ীনদের মতই আপনার প্রিয় উম্মাহর জন্য আপনার শেখানো পথেই জিহাদ করে যেতে চাই পুরোটা জীবন।
আল্লাহু আকবার।