Friday, November 22, 2024

দ্বিধা

ভার্সিটির করিডোরে দাড়িয়ে আছি।ডিপার্টমেন্টের সামনে এহসানের জন্য অপেক্ষা করছি।ও নোটস নিয়ে আসবে।সামনে মাস্টার্স পরীক্ষা।গত তিনমাস ক্লাস করতে পারিনি।খুব অসুস্থ ছিলাম।হাসপাতালে থাকতে হয়েছে আগামী চারমাস পর পরীক্ষা। চোখে অন্ধকার দেখছি। এর মধ্যে প্রস্তুতি নিয়ে কি করে পরীক্ষা দেব।শরীর এখনো খারাপ। ডাক্তার পরীক্ষা দিতে বারণ করেছে।কিন্তু আমি জানি এবার পরীক্ষা না দিলে আমার আর পড়াশোনা হবে না।কেননা বন্ধুরা থাকবে না।পড়ালেখায় মাঝারি ধরনের আমি।

আমার ইচ্ছে দেখে বন্ধুরা এগিয়ে এলো।বললো ওরা সাহায্য করবে। এক ধরনের অস্থিরতা আমার মধ্যে কাজ করছিল।

এহসান এখনো আসছেনা।এতোই মগ্ন ছিলাম যে কখন একটা ছেলে পাশে এসে দাড়িয়েছে টের পাইনি।

-আপনার নাম কি জয়া?

সম্বিত ফিরে পেলাম।

-না!

খুব কঠিন ভাবেই বললাম।

ছেলেটি বললো

-হ্যা আপনিই জয়া। আপনার সাথে আমার কয়েক বছর আগে দেখা হয়েছিল কুষ্টিয়াতে। আপনার বাবার সাথে আমার বাবাও চাকরি করতেন।আমি আপনাকে চা করে খাইয়েছিলাম।

ছেলেটি নাছোড়বান্দা।

আমি বললাম

-হ্যা! আমি জয়া, তো কি হয়েছে?

-আমি আকাশ,আপনাকে অনেক খুঁজেছি।পাইনি।অবশেষে আজ দেখা হলো।

আমি কিছুটা বিভ্রান্ত।এর মধ্যে এহসানকে আসতে দেখে বললাম, আমার বন্ধু এসে গিয়েছে। আপনার সাথে কথা বলতে পারছি না। আমরা লাইব্রেরীতে যাব।

আকাশ বললো ঠিক আছে, আবার দেখা হবে।

আমি মনে মনে ভাবলাম আর কখনোই দেখা হবে না।আমাকে কোথায় পাবে।পরদিন ভার্সিটি থেকে বাসায় যাব রিকশা ঠিক করে উঠতে যাচ্ছি।প্রায় দৌড়ে সামনে এসে দাড়াল। বলে কতক্ষন থেকে তোমার জন্য দাড়িয়ে আছি।

কী সাহস! তুমি করে বলছে!

বাসায় এসে দেখি মা আমার জন্য অপেক্ষা করছে।

-এতো দেরি হলো যে।

মার সাথে আমার বন্ধুত্বের সম্পর্ক। গুটুর গুটুর করে দু’জনে গল্প করি।ভাত খেতে খেতে আকাশের গল্প করলাম।মা বললেন অনেক দিন পর দেখেছেতো তাই ওর ভাল লেগেছে।তুই আবার খারাপ ব্যবহার করিস না।মার কথা শুনে হেসে দিলাম।

-তুমি আমাকে কী ভাব বলোতো।

এর মধ্যে ছোট ভাইটা এসে খুনসুটি করে গেল। ওর আর আমার ভাবও বেশি ঝগড়াও বেশি।

পরদিন বন্ধুদের সাথে পড়বো বলে লাইব্রেরিতে গেলাম।পরীক্ষা এগিয়ে আসছে।লাইব্রেরী থেকে বের হয়ে দেখি আকাশ আকাশপানে তাকিয়ে আছে।কতক্ষন থেকে অপেক্ষা করছে।

-চলো!

-কোথায় যাব?

-টিএসসিতে যাব।

রাস্তা পার হওয়ার সময় নিঃসংকোচে আমার হাতটা ধরলো।আমি আমূল চমকে উঠলাম।কী ব্যাপার? আমি কি ইলেকটিফাইড নাকি?লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম।আমার মূখের দিকে কতক্ষন তাকিয়ে থেকে বললো আজ থেকে তুমি আমাকে তুমি করে বলবে।কিছু বললাম না।টিএসসিতে গিয়ে চা সিঙ্গাড়া খেতে খেতে অনেক গল্প করলো।বললো তোমার সাথে আমার কথা আছে, কালকে বলবো।

এতো দ্রুত সবকিছু ঘটছিল যে আমি বিব্রত বোধ করছিলাম।মাকেও বলতে পারছিলাম না।মা কিছু একটা বুঝতে পারছিল।পরদিন আমাকে দেখে মুগ্ধ চোখে কতক্ষন তাকিয়ে থাকলো আকাশ।শাড়ী পরেছিলাম,কপালে বড় একটা লাল টিপ, হাতে চুড়ি।বললো খুব সুন্দর লাগছে।

বললাম

-কী নাকি বলবে?

-হ্যা!

-আমার তাড়া আছে।

বললো চলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গিয়ে বসি।গিয়ে দেখি অনেকেই এদিক সেদিক বসে আছে।ভয় লাগছিল।কে না কে দেখে ফেলে।

আমাকে বললো আমি সিঙ্গাপুরে একটা চাকরি পেয়েছি।একমাস পর চলে যাব।দু’বছর পর ফিরে আসবো।এই দু’বছর তুমি একা থাকতে পারবে না?আমি তোমাকে ভালবাসি।প্লিজ আমাকে না বলো না।আমি অনেক বছর ধরেই তোমাকে ভালবাসি।

কী বলবো বুঝতে পারছিলাম না।আমারতো কোন মানসিক প্রস্তুতিই নেই।বলেই চলেছে প্লিজ প্লিজ না বলো না।বললাম আমাকে একটু সময় দাও। তাছাড়া সামনে আমার পরীক্ষা।

বাসায় ফিরেই ফোন পেলাম।

-কী ব্যাপার—ভেবেছ?

আমি কেন যে হেসে ফেললাম!

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে।আবহাওয়া খুব খারাপ।তবুও লাইব্রেরীতে গেলাম।ক্যান্টিনে চা খেতে খেতে বললো তোমাকে আমি পরীক্ষার হল থেকে তুলে নিয়ে যাব।তোমাকে জোর না করলে তুমি আমার হবে না।কী ভয়ংকর কথা।

মার সাথে গল্প করি ঠিকই কিন্তু সব কথা বলা হয়ে ওঠেনা।কেমন একটা সংকোচ।বাবার সাথে দুরত্বটা সবসময় বেশি।কেমন যেন একটা ভয়।

দু’জনে দিনের বেলা ভার্সিটিতে ঘুরে ঘুরে কাটাই।ওর উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছি।ভয় পাচ্ছি ও চলে গেলে কী করবো।চাইনিজ খেতে গিয়ে একদিন এক আত্মীয়র সামনে পড়ে গেলাম।আমার তখন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

পরীক্ষা চলে এলো। ও পরীক্ষা দিচ্ছে না।কেননা কয়েকদিনের মধ্যেই চলে যাবে।কিন্তু আমার পরীক্ষার হলের বাইরে দাড়িয়ে থাকতো।আর মাঝে মাঝে জয়া করে ডেকে উঠতো।চারদিকে নিস্তব্ধ। গমগম করে উঠতো।বারণ করলে হাসতো।বলতো তুমি আমার এটা সবাই জানুক।

একদিন পরীক্ষা শেষে বাসায় যাব রিকশাওয়ালাকে বললো কাজী অফিস যাবে?আমি বিব্রত।রিকশাওয়ালা হেসে বললো যাবো চলেন।দুষ্টুমী করছে শুধু আমার সাথে।

এর মধ্যে ওর যাওয়ার দিন চলে এলো।পরীক্ষার মধ্যে ওর সাথে সারাদিন বেড়ালাম যাওয়ার দিন।ও রাতে যাবে। বাসায় ফেরার পথে রিকশায় সারা পথ আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে ছিল।কান্না পাচ্ছিল। শুধু বললাম,চিঠি দিও।আকাশও কান্না সামলাচ্ছিল।

গভীর রাতে প্লেনটা আমাদের বাসার উপর দিয়েই চলে গেল।কী এক গভীর শুন্যতা।বালিশে মুখ গুজে কাঁদছিলাম।সারারাত ঘুমাইনি।পরদিন পরীক্ষা।মাকে কিছুই বললাম না।মা বললেন

-মূখ শুকনা লাগছে কেন?পরীক্ষার জন্য ভয় পাচ্ছ।

-হ্যা এটা কঠিন পেপার।

বলে মাকে কাটিয়ে দিলাম।

যাওয়ার কয়েকদিন পর আবেগ ভরা একটা চিঠি পেলাম।আমিও লিখলাম।এর মাঝে আমি একটা এনজিওতে জয়েন করলাম।বসে থেকে কি করবো। সময় কাটছিলনা।

দু’জনে চিঠি লিখে যাচ্ছিলাম।বছর খানেক কাটলো।বাসায় বিয়ে দেওয়ার জন্য বাবা মা তোড়জোড় শুরু করলো।আমি ওকে লিখে জানালাম। আরো জানালাম তোমাদের বাসা থেকে কেউ এসে আমার বাবা মার সাথে কথা বলুক।

বেশ কয়েকদিন পর উত্তর এলো,লিখেছে তুমি চাইলে অন্য যায়গায় বিয়ে করে নিতে পার।আমি কবে দেশে আসব ঠিক নেই।

আর এভাবে সম্পর্ক চলেনা।আমি হতবাক।মানুষটার এর মধ্যে এতোটা পরিবর্তন হল।যদিও চিঠি অনিয়মিত পাচ্ছিলাম। ভেবেছিলাম ব্যাস্ততা।

ঠিক সেই মুহুর্তে বিয়ে করতে মন সায় দিচ্ছিল না।একটা ব্রেকাপের পর আরেকজনকে গ্রহণ করা কঠিন ব্যাপার।

বছর খানেক পর একটা চিঠি পেলাম।আকাশ লিখেছে তোমার সব কিছু আমি হারিয়ে ফেলেছি।আমার যা তোমার কাছে আছে তা ফিরিয়ে দাও।

-কী ফিরিয়ে দেব?ভালবাসা?

এর কয়েকদিন পর বড় অদ্ভুত ভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর সাথে দেখা হয়ে গেল।ও কবে দেশে এসেছে জানতেই পারিনি।জানার কথাও অবশ্য নয়।আমি ওকে এড়িয়ে গেলাম।মনে হলো ও কিছু বলতে চাচ্ছিল।কিন্তু শোনার মত মানসিকতা আমার ছিলনা।ওর বন্ধুরা বললো যে ও ওর ভুল বুঝতে পেরেছে।কিন্তু আমার সিদ্ধান্তে আমি অনড়।যে তার ভালবাসা ফেরত চায় তার কাছে কিভাবে যাব?

বাসায় ফিরে মার কাছে শুনলাম বাবা এক জায়গায় আমার বিয়ের ব্যাপারে কথা দিয়েছেন।অনেক দিন আমার জন্য অপেক্ষা করেছেন।আর না।

আমার মধ্যে কী যেন একটা ঘটে গেল।অন্ধকার রুমে চুপচাপ বসে আছি।মা এসে মাথায় হাত রাখলো।কতক্ষন পর আস্তে করে মার হাতটা সরিয়ে দিয়ে চোখ মুছলাম।

তারপর ধীরে ধীরে বাবার ঘরের দিকে চললাম।বাবার সাথে জীবনে এই প্রথম একাকী মুখোমুখি হচ্ছি!

লতা হামিদ

ধানমন্ডি,ঢাকা

১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭

Facebook Comments Box
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments