Tuesday, December 3, 2024
Homeগল্পগল্পের প্রতিধ্বনিএকটি গল্পলিখার গল্প

একটি গল্পলিখার গল্প

একটি গল্প লিখার গল্প -আনিকা তাবাসসুম

-আনিকা তাবাসসুম



সকাল প্রায় ৮ টা।প্রতিদিন এ সময়ে ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে এক কাপ রঙ চা খান আমিন সাহেব।আজকেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।চেয়ারে গা এলিয়ে আরাম করে চিনি ছাড়া চা খাচ্ছিলেন আমিন সাহেব।এমন সময় রাফিকে স্যুটেড বুটেড অবস্থায় ফাইলপত্র হাতে রুম থেকে বের হতে দেখলেন তিনি।

ছেলেকে বেরুতে দেখে আমিন সাহেব উৎফুল্ল গলায় বলে উঠলেন,” মাশা আল্লাহ বাবা।”

রাফি অবাক হলো।আমিন সাহেব কথা কম বলা মানুষ। দরকার ছাড়া কথা তিনি বলেন না বললেই চলে।সেখানে সকাল সকাল তাকে দেখে মাশা আল্লাহ বলার কারণ সে বুঝতে পারছে না।

রাফি কৌতুহলী দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,” বাবা মাশা আল্লাহ কি আমাকে দেখে বললেন?”

“হু,তোমাকে দেখে বললাম।”

“মাশা আল্লাহর কারণটা কি জানতে পারি বাবা?”

“অবশ্যই জানতে পারো।তুমি যদি গরু হতা তাহলে গত কুরবানীর হাটে তোমার যত দাম উঠত এখন দাম তার চেয়ে বেশি উঠবে।এজন্যই মাশা আল্লাহ বললাম।”

রাফি লজ্জা পেলো।রুমে শুয়ে-বসে ইদানীং তার ওজন কিছুটা বেড়েছে কিন্তু এটা যে কারোর চোখে পড়বে সেটা সে ধারণা করেনি।চেহারার লজ্জাভাব লুকানোর চেষ্টা করতে করতে রাফি তার বাবাকে জিজ্ঞেস করল,”বাবা আপনি কি আমাকে অপমান করলেন?”

আমিন সাহেব চেহারায় হাসি হাসি ভাব ধরে রেখে বললেন,”নারে বাবা।তোমাকে আমি অপমান কেন করব!আমার উচিত তোমার পা ধরে চুমু খাওয়া।সন্তানের পায়ের নিচে পিতার বেহেশত।” 

রাফি আর কথা বাড়ালো না।সদর দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো। 

রাফি বাড়ি ফিরল সন্ধ্যায়।সারাদিনের ক্লান্তিতে স্যুটটা কোনোভাবে চেয়ারে ছুঁড়ে ফেলেই বিছানায় গা এলিয়ে দিল।সে যে খুব দরকারি কাজ করেছে এমন কিছুই না।চাকরির ইন্টারভিউ দিয়েছে খুবই বাজে।ইন্টারভিউ বারোটার মধ্যেই শেষ।তারপর উদ্দেশ্যহীনভাবে ঢাকার রাস্তায় কেবল ঘুরেছে সে।ঘুরতে ঘুরতেই দেখা হয়েছে ছোটবেলার এক বন্ধুর সাথে।বন্ধুর সাথে কথা বলে জানতে পারল বই লিখে বেশ ভালো উপার্জন করছে তার সেই বন্ধু।বিয়েও করে ফেলেছে সম্প্রতি।সেই বন্ধু লেখালেখি নিয়ে বিস্তর উপদেশ দিয়েছে রাফিকে।কাজটা নাকি খুবই সহজ।কেবল একটু কল্পনাশক্তি দরকার।বন্ধুর কথা শুনে রাফির কাছেও মনে হয়েছে তেমন কঠিন কিছু না।লেখালেখির একটা চেষ্টা করে দেখা যায়।টাকাপয়সার একটা সংস্থান হবে।একের পর এক মেয়ে দেখা হচ্ছে বাসা থেকে।বেকার হওয়ায় বিয়ে হচ্ছে না। 

পরদিন সন্ধ্যায় রাফি বিপুল উদ্যম নিয়ে লিখতে বসল।সে লিখবে প্রেমের গল্প।প্রেমের গল্প মানেই হিট।দুইটা ছেলেমেয়ে ধরে প্রেম করিয়ে দিলেই পাবলিক খুশি।এইরকম চিন্তাধারা নিয়ে রাফি লেখা শুরু করল।

“এক দেশে ছিল একটা মেয়ে।মালিহা তার নাম।মেয়েটার অনেক ইচ্ছা ছিল প্রেম করবে।কিন্তু ভালো ছেলে খুঁজে পাচ্ছিল না।আরেকটা ছেলে ছিল তার নাম রবি।সেও একটা ভালো মেয়ের সন্ধানে ছিল।কিন্তু ভালো মেয়ে খুঁজে পাচ্ছিল না।”

এতটুকু লেখার পর রাফির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো।তার প্রস্রাব লেগেছে।প্রস্রাব খুবই খারাপ জিনিস।দুনিয়ার সব গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে সে এসে হাজির হবে।রাফি হাতের কলম রেখে বাথরুমে ঢুকে গেলো।তখনই তার গল্পের নায়িকা মালিহা গল্পের নায়ক রবিকে ডাক দিলো।

“এই রবি,শুনছো?”

“হু,শুনছি।” রবি উত্তর দিল।

“এই গাধাটা এইগুলা কী লিখছে?”

“কেন কী সমস্যা?”

“কী সমস্যা মানে?এটা কোনো গল্প হলো?এইটুকুতেই বোঝা যাচ্ছে যে এরপর তোমার সাথে আমার প্রেম হবে।তারপর আমরা সুখে শান্তিতে সংসার করব।”

“তাতে সমস্যা কী?”

“বিশাল সমস্যা।এত বাজে একটা গল্পের নায়িকা আমি হতে চাই না।লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে।”

“সেটা বুঝলাম কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই।আমরা কেবল গল্পের চরিত্র।লেখক যেভাবে চাইবে আমাদের সেভাবেই সাজাবে।”

“মোটেও না।এই মাথামোটা লেখক যদি আমাদের সুখে-শান্তিতে বসবাস করায় আমি কাগজ থেকে বের হয়ে একে চড় লাগাবো।”

“বলো কী!তাহলে তো এ বুঝে যাবে যে আমরা কাগজ থেকে বের হতে পারি।”

“বুঝুক,এর বোঝা উচিত।তাহলে আর লিখতে যাবে না।”

রবি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ মালিহার দিকে তাকিয়ে বলল,”তোমার মন চাইলে তুমি বের হও।আমি এসবে নেই।”

মালিহা তাকে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তখনই রাফি বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল।মালিহা আর রবি সাথে সাথে নিশ্চুপ হয়ে গেলো।রাফি আবার লেখা শুরু করলো।

“একদিন রবি আর মালিহার দেখা হয়ে গেলো একটা শপিং মলে।কাজলকালো হরিণচোখী মালিহাকে দেখে সাথে সাথে প্রেমে পড়লো রবি।পুরো শপিংমল ভর্তি মানুষের সামনেই মালিহাকে প্রপোজ করলো সে।মালিহাও হাসিমুখে এক্সেপ্ট করলো তার প্রপোজাল।শপিংমলের সবাই হাততালি দিলো।অতপর ধুমধাম করে তাদের একদিন বিয়ে হয়ে গেলো।তারপর সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগলো তারা।”

এতটুকু লিখে রাফি পুরো গল্পটা একবার পড়লো।প্রথমবার হিসেবে সে বেশ ভালো লিখেছে।গল্পটা আরেকটু বড় করা যেত কিন্তু এখন মানুষ বড় গল্প পড়তে চায় না।সে হিসেবে এটাই ঠিক আছে।

পরদিন খুবই ব্যস্ত একটা দিন গেলো রাফির।বাসার সবগুলো পুরোনো ফার্নিচার নতুন করে রং করতে হয়েছে তাকে।তার কাজ শেষ হলো রাত একটায়।কাজ শেষে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজ রুমে ফিরে এলো সে।

রুমে ঢুকে রাফি ভয়ংকর রকম চমকালো।সালোয়ার কামিজ পড়া একটা মেয়ে তার লেখার টেবিল এ হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।চেহারা দেখে মনে হচ্ছে মহাবিরক্ত।রাফিকে দেখে মেয়ের চেহারায় বিরক্তি আরো বাড়লো।রাফি ভেবে পেলো না এত রাতে এই মেয়ে আসলো কোথ্থেকে!দরজা জানালা সব বন্ধ।বাইরে থেকে ঘরে ঢুকার কোনোই পথ নেই।

রাফিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মেয়েটা কথা বলল।

“এই হা করে আছিস কেন?মুখ বন্ধ কর।”

রাফি মুখ বন্ধ করল।সে কিছুই বুঝতে পারছে না।এই মেয়ে এখানে কীভাবে আসলো?কেন আসলো?তাকে তুই তোকারিই বা করছে কেন?

মেয়েটা আবার কথা বলা শুরু করল।

“এই তুই এইগুলা কী লিখিস?এত বাজে গল্প আমি আমার জীবনে পড়ি নাই।গল্প লিখসিস তো লিখসিস,নামটা দিসিস আমার।লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাওয়ার অবস্থা।তোর গল্প থেকে আমার নাম কাট।”

রাফি হতভম্ব হয়ে বলল,”আপনার কথা আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

মেয়েটা মুখ বিকৃত করে বলল,”বুঝবি না এইটাই তো স্বাভাবিক। তোর মাথায় আছে শুধু গু।”

রাফি অপমানিত বোধ করল।কে না কে এসে তাকে যা খুশি তাই বলে যাচ্ছে আর সে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে।এর কোনো মানে হয়না।

“আপনি কি দয়া করে আপনার পরিচয়টা বলবেন আমাকে?” রাফি নিজেকে সংযত করে বলল।

“আমি মালিহা।তুই যে গল্প লিখেছিস তার নায়িকা।”

“আপনি আমার গল্পের নায়িকা?”

“হু।”

“আপনার তো তাহলে কাগজের মধ্যে থাকার কথা।বের হয়েছেন কিভাবে?”

“আমি আল্লাহকে ডেকে বললাম আল্লাহ,আমাকে এখান থেকে বের করে দেও।তারপর বের হয়ে গেলাম।”

রাফি চোখ ছোট করে মেয়েটার দিকে তাকালো।খুবই স্বাভাবিক গলায় কথা বলছে।ভাব দেখে মনে হচ্ছে কাগজ থেকে বের হয়ে আসা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার।

“বুঝলাম আপনি কাগজ থেকে বের হয়েছেন।কিন্তু আমার কাছে কী চান?”

“তোর গল্প থেকে আমার নাম কাট।খুবই বিশ্রী গল্প।আমি এই গল্পের নায়িকা হতে চাই না।”

রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মেয়েটা যেই হোক,গণহারে তাকে অপমান করে যাচ্ছে।এভাবে কাউকে অপমান করা যে ঠিক না,সেটা তাকে জানানো দরকার।সে বলল,”কিছু মনে না করলে আপনাকে একটা কথা বলতে চাই।”

“অবশ্যই মনে করব।নারী জাতির প্রধান কাজ মনে করা।”

“ঠিক আছে।আপনি যা খুশি মনে করতে পারেন।তাও আমি বলছি।আপনি খুবই রুড।”

“রুড হওয়া আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।”

“আপনার কথাবার্তাও অসংলগ্ন।”

“অসংলগ্ন কথা বলা আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।”

“আপনি যে কী বলতে চাচ্ছেন আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”

“না বুঝিয়ে কথা বলা আমার জীবনের প্রধান লক্ষ্য।”

রাফি আর কথা বাড়ালো না।একটা অস্তিত্বহীন সত্তার সাথে কথা বলার কোনো মানেই হয়না।আজ সারাদিন অনেক পরিশ্রম গিয়েছে।তাই নিশ্চয়ই সে উল্টাপাল্টা দেখছে।রাফি তার বিছানার কাছে এসে শোয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগল।তাকে বিছানা গুছাতে দেখে মেয়েটা আবার কথা বলা শুরু করল।

“ওকি!তুই শুয়ে যাবি নাকি!আমার নাম কাট আগে গল্প থেকে। তারপর যা খুশি কর।”

রাফি কোনো উত্তর দিলো না।মেয়েটা গলা উঁচু করে বলতে লাগল,”এই খবরদার!শুবি না এখন।তুই শুয়ে গেলে আমি কী করব?”

রাফি মুখ খুলল,”আপনিও শুয়ে যান।”

মেয়েটা চোখ কপালে তুলে বলল,”আপনিও শুয়ে যান মানে?কই শুব আমি?তোর বিছানায়?তুই তো দেখি পার্ভার্ট।”

রাফি ভ্রূক্ষেপ করল না।বিছানা ঠিক করে একটা ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়লো সে।আধো ঘুমে ঘোরের মধ্যে শুনতে পেল মেয়েটা তখনো চিৎকার করছে,”এই পার্ভার্ট,ঘুমাইস না।ওঠ,আমার নামটা কাট।এই পার্ভার্ট,এইই…..”

রাফির ঘুম ভাঙলো সকাল ৮টায় তার মায়ের ডাকাডাকিতে।চোখ বোজা অবস্থায়ই সে শুনল মা গলা উঁচু করে বলছেন,”ওঠ লাট সাহেবের বেটা।মেয়ে দেখতে যাওয়া লাগবে আজকে।দাঁড়ি-গোফ শেভ কর তাড়াতাড়ি।” রাফি চোখ খুলে তার মাকে বলল,”আমি আজ কোনো মেয়ে-টেয়ে দেখব না।শরীর ভালো লাগছে না।”

“শরীর ভালো না লাগলে মেয়ে দেখবি না কেন?মেয়ে কি শরীর দিয়ে দেখবি?মেয়ে দেখবি চোখ দিয়ে।চোখ ভালো থাকলেই হলো।”

রাফি দীর্ঘশ্বাস ফেলল।মায়ের সাথে এ বিষয়ে কথা বলা অর্থহীন।তিনি সবসময়ই এমন অদ্ভুত সব যুক্তি দেন, রাফি বুঝে না তার আসলে কী বলা উচিত।অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে উঠে বসল।মেয়েকে বললেই হলো যে সে বিয়ে করতে চায় না।এটা বাবা-মাকে বলার চেয়ে বাইরের মানুষকে বলা সহজ তার জন্য।

রাফি খোয়া বাঁধানো একটা পুকুরঘাটে বসে আছে।ঢাকা শহরে কারোর বাড়িতে পুকুরঘাট থাকাটা এখন মোটামুটি অসম্ভব ব্যাপার।এ বাড়ির পুকুরঘাটটা নিশ্চয়ই অনেক আগে বানানো হয়েছে।জমিদারবাড়ি জমিদারবাড়ি ভাব আছে একটা।রাফি বসে আছে একটা বেতের চেয়ারে।তার মুখোমুখি আরেকটা চেয়ার রাখা।এ বাড়ির মানুষেরা নিশ্চয়ই খুব শৌখিন।চারপাশে অনেক ফুলের গাছ।এরকম সুন্দর একটা পরিবেশেও রাফির ভালো লাগছে না।কথা শেষ করে যত তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে পারবে রাফি তত খুশি। 

কিছুক্ষণ পরই মেয়েটাকে হেঁটে আসতে দেখল সে।সবুজ রঙের একটা শাড়ি পড়েছে।কপালে একটা টিপ।মাথায় ঘোমটা দেয়া।চেহারা দেখে বুঝা যাচ্ছে ছেলের সাথে দেখা করার ব্যাপারটায় সে খুশি নয়।নিতান্ত দেখা করা লাগবেই বলে দেখা করতে এসেছে।

মেয়েটা কাছে এসে রাফির মুখোমুখি রাখা চেয়ারটার সামনে দাঁড়িয়ে রইল।রাফি কিছুক্ষণ মেয়েটা বসার জন্য অপেক্ষা করল।তারপর জিজ্ঞেস করল,” আপনি কি বসবেন না?” 

“জি বসব।” মেয়েটা যথাসম্ভব গলা নামিয়ে উত্তর দিল।

“তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

“আমি ভেবেছিলাম আপনি আমাকে বসতে বলবেন।তারপর আমি বসব।এজন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম।” 

রাফি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,”আপনার বাড়িতে আপনি বসবেন,এতে আমার অনুমতি লাগবে কেন?”

মেয়েটা রাফির দিকে মুখ তুলে তাকালো।তারপর ছোট একটা শ্বাস ফেলে বলল,” জ্বি না,আপনার অনুমতি লাগবে না।অনুমতি চেয়ে ভুল করেছি।আর অনুমতি চাইব না।”

কথা শেষ করে মেয়েটা আস্তে করে চেয়ার টেনে সেখানে বসে পড়ল।

রাফি আগেই ঠিক করে এসেছে কেবল ভদ্রতাজনিত কারণে কোনো অতিরিক্ত কথা সে বলবে না।তাই সে কোনো রাখঢাক না রেখেই আসল কথা শুরু করল।

“দেখেন আপু,আপনাকে আমি সত্যি কথাই বলি।আপনার সাথে আমার বিয়ের কথা আগাবে না।আমার মানসিক অবস্থা ভালো নেই।কাল রাতে ভালো ঘুম হয়নি,উল্টাপাল্টা জিনিস দেখেছি।আমি আপনার সাথে দেখা করতেই আসতে চাচ্ছিলাম না।মায়ের জোরাজুরিতে আসতে হয়েছে।বিয়ের কথাবার্তা বলার মতো সিচুয়েশনে আমি নাই।সময় কাটানোর জন্য আপনার সাথে হালকা পাতলা কথাবার্তা বলে আমি চলে যাব।”

মেয়েটা কিছু বলল না।রাফির দিকে তাকিয়ে রইল।তাকে দেখে অবাক হয়েছে বলে মনে হচ্ছে না।

“আপনি কি বুঝতে পেরেছেন?” রাফি প্রশ্ন করল।

“জ্বি।আপনার মানসিক অবস্থা ভালো নেই বুঝা যাচ্ছে।”

“এটা কিভাবে বুঝেছেন!” 

“আপনি এইমাত্র আমাকে আপু ডেকেছেন।একটা ছেলে বিয়ে করতে এসে মেয়েকে আপু ডাকছে,এটা স্বাভাবিক ব্যাপার না।”

রাফি হেসে ফেলল।সে যে মেয়েটাকে আপু ডেকেছে সেটা সে খেয়াল করেনি।

“আপু ডাকায় আপনি কি রাগ করেছেন?”

“জ্বি না, রাগ করিনি।বাইরের মানুষের কথায় আমি রাগ করিনা।”

“ভেতরের মানুষের কথায় করেন?”

“জ্বি করি। “

“আজকে কি রাগ করার মতো কিছু হয়েছে?”

“জ্বি হয়েছে।আপনার সাথে বিয়েতে রাজি হওয়ার জন্য মা প্রেসার দিয়েছেন।রাজি না হলে চটকানা খাব।”

“বিয়েতে রাজি হয়ে যাবেন তাহলে?”

“জ্বি না।চটকানা খাব।”

রাফি হাসল।সে বিয়ে করার উদ্দেশ্যে আসেনি জানার পর থেকে মেয়েটা সহজ হয়ে গেছে।কোনো রাখডাক না রেখে সত্যি কথা বলছে।

“আমাকে বিয়ে করার জন্য আপনাকে প্রেসার দেয়া হচ্ছে কেন?আমি তো তেমন সুপাত্র না।” রাফি প্রশ্ন করল।

“আমার বিয়ে হচ্ছে না তাই।যত তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বিদায় হব,বাবা-মা তত খুশি।”

“ওহ আচ্ছা।”

রাফি খেয়াল করল মেয়েটা একটু একটু দুলতে শুরু করেছে।যতটা শান্তশিষ্ট নিজেকে সে প্রথমে দেখাতে চেয়েছিল বুঝা যাচ্ছে তত শান্তশিষ্ট সে আসলে না।হঠাৎ করে রাফির খেয়াল হল মেয়েটার নামই সে জিজ্ঞেস করেনি।

“আপনার নাম জানা হয়নি এখনো।নাম কী আপনার?”

“মালিহা।”

নাম শুনে রাফি চমকাল।মালিহা??এই নামের মেয়ের সাথে সে দেখা করতে এসেছে আজ?হচ্ছেটা কি এসব তার সাথে!

পরক্ষণেই সে নিজেকে সামলে নিল।কালকের স্বপ্নের সাথে আজকের ঘটনা মেলানোর মানেই হয়না।এইগুলো বোকা মানুষ করে।

রাফিকে চুপ করে থাকতে দেখে মালিহা প্রশ্ন করল,”আপনার নাম কী?”

রাফি উত্তর দিল,”পার্ভার্ট।”

মালিহা নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারল না।সে কি ভুল শুনেছে?

সন্দেহ দূর করার জন্য সে আবার জিজ্ঞেস করল, “কী বললেন নাম?পাভেল?” 

রাফি হাসল।”জি না,আপনি যা শুনেছেন আমি তাই বলেছি।”

“পার্ভার্ট কারোর নাম হয় না।” 

রাফি মুখের হাসি বজায় রেখে বলল,”ঠিক।এটা কারোর নাম হয়না।”

“তাহলে আপনি এটা বললেন কেন?”

“হঠাৎ এই শব্দটা বলতে মন চাইল,তাই বললাম।”

মালিহা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল,”বিয়ে করতে এসে কেউ এমন নাম বলবে না।”

রাফি হাসিমুখে বলল,”আমি বিয়ে করতে আসিনি।”

মালিহা হেসে ফেলল।পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল সে।এই অদ্ভুত মানুষটার প্রতি সে একরকম আগ্রহ পাচ্ছে।কিন্তু সেটা তাকে বুঝতে দেয়া যাবে না।মুখ আবার আগের মতো ভোঁতা করে সে বসে রইল।

পাশ দিয়ে কোথাও বোধহয় আইসক্রিমওয়ালা যাচ্ছে।রাফি আইসক্রিমের বেলের শব্দ শুনতে পাচ্ছে।রাফির হঠাৎ মনে হল মেয়েটাকে নিয়ে একটা আইসক্রিম খেলে মন্দ হয়না।সে চলে যাওয়ার পর মেয়েটা খুব সম্ভবত চড় খাবে।চড়ের আগের সময়টুকু অন্তত ভালো কাটুক।

“আইসক্রিম খাবেন?আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না।আসেন একটা আইসক্রিম খাই।”

“একটা আইসক্রিম দুজন খাব?”

“না না একটা দুজন খাব না।আপনি একটা,আমি একটা।” রাফি দ্রুতবেগে হাত নাড়িয়ে বলল।

মালিহা সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালো।তার মুখে হাসি।রাফি তাকে নিয়ে আইসক্রিম খুঁজতে বের হয়ে গেলো।

কিছুদূর গিয়েই আইসক্রিম পাওয়া গেলো।মালিহা গাড়ির ভেতর কিছুক্ষণ উঁকিঝুঁকি মেরে আইসক্রিম মামার দিকে তাকিয়ে বলল,”মামা এক টাকার আইসক্রিম নাই?”

মামা মুখ বাঁকা করে বললেন,’এক ট্যাকার আইসক্রিম কই পাবেন এহন।এক ট্যাকা চলেনি!”

মালিহা হতাশ গলায় বলল,”তাহলে কমলা কমলা যে আইসক্রিম পাওয়া যেত এক টাকা দিয়ে ওইগুলা পাওয়া যায় না?”

“ওইগুলা এখন পাঁচ ট্যাকা।”

“আছে আপনার কাছে?” 

“আছে।”

মালিহা বাচ্চাদের মতো হাত বাড়িয়ে বলল,”দেন আমাকে একটা।”

আইসক্রিম নিয়ে মালিহা ওখানে দাঁড়িয়েই খাওয়া শুরু করল।খুব সম্ভবত সে এখনই বাড়ি যেতে চাচ্ছে না।খেতে খেতেই রাফির দিকে তাকিয়ে সে জিজ্ঞেস করল,”আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না এটা আপনার কেন মনে হলো?”

“যে কান্ড করেছি আজ,তারপর আপনার আর আমার সাথে দেখা করতে চাওয়ার কথা না।”

“কান্ড করেছেন বলেই দেখা করতে চাইব আমি।আমার ইন্টারেস্টিং মানুষ পছন্দ।আপনি ইন্টারেস্টিং।”

রাফি শব্দ করে হাসল।হঠাৎ সে খেয়াল করল মালিহা আইসক্রিম এ কামড় দিয়ে সরাসরি সেটা গিলে না।মুখ ফুলিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দেয়।তারপর আস্তে আস্তে গিলে।সে জিজ্ঞেস করল,”আপনি মুখ ফুলিয়ে কি করেন?” মালিহা মুখ ফুলানো অবস্থাতেই একটা হাসি দিয়ে তারপর বলল,”আইসক্রিম গরম করি।” 

“আইসক্রিম গরম করতে হয়?”

“হু।তানাহলে ঠান্ডা লাগে।”

রাফি হাসল।হুট করে তার মন ভালো হয়ে গেলো।ইন্টারেস্টিং মানুষ তার নিজেরও পছন্দ। 

সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে।কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নামবে।দুইটা মন খারাপ করা মানুষ ভালো হয়ে যাওয়া মন নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিল।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments