তারিকুল আমিন
মাঠ ছিল সবুজ আর সেই সবুজে ঘেরা বাহারি রঙের ফুলে ফুলে ভরা। বন জঙ্গলসহ
সবজায়গায় পশুপাখির কলকাকলী। আহা! কি সুন্দর! সেখানে কোন মানুষজন নেই। বটবৃক্ষের
ছায়ায় ছেলেমেয়েদের খেলতেও দেখা যায় না। দূরে পাখিগুলো এলোমেলো ভাবে ছুটতে আর
চেচামেচি করছে। হঠাৎ চোখ গেলো গায়ের কিছু অধবস্ক রমনী। এক নিমিশেই যেনো
সকল সতেজতা হারিয়ে গেছে গহিন বনের বন পাহারের ঐপাড়ে।
Ñ হায়… খোদা!
Ñ হায়… ভগবান!
Ñ এ কী হইলো? কীভাবে হইলো?
Ñ এতো সুন্দর একটা মাইয়ারে কে মারলো…?
Ñ কোন পাষন্ড এমন জঘন্য কাজ করতে পারলো…?
গায়ে যেনো রৈ রৈ কাণ্ড থৈ থৈ অবস্থা। এই মৃত্যুর কোন ক‚ল বা কিনারা পায় না গাঁয়ের
মানুষ। কে মারলো…? কে বা মারতে পারে…?
গাঁয়ের ঠিক মাঝখানে একটি বিশাল বটগাছ। এই বটগাছে এখন আর কেউ ঝারি সারি
গান, বাউল গান, ভাটিয়ালি বা কৃর্তন শোনে না আর। গাঁয়ের সবাই মনে করে এই
গাছের নিচে ভ‚ত বাস করে।
Ñ হায় টু ডায় ইউ টু লিভ হুইচ ইজ বেটার অনলি গড নোজ… হা হা হা হা।
গাঁয়ের ছোট ছেলেরা পাঠশালায় যেতে এবং আসতে পাগলটার সাথে পাগলামি করে।
পাগলটাকে খুব খ্যাঁপায়। পাগলও ওদের গায়ে ইট মারে। ওরাও পাগলকে মেরে রক্তাক্ত করে। গায়ের
মুরুব্বিরা বাচ্চাদের তাড়িয়ে যে যার মত হাটে চলে যায়।
ভোর বেলা। আশহাদু আন্না মুহাম্মাদার রাসূলুল্লা-হ…
‘আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ দাওয়াতিত তাম্মাতি ওয়াস সালাতিল কায়িমাতি
আতি মুহাম্মাদানিল ওয়াসিলাতা ওয়াল ফাদিলাতা….’ মুসুল্লিরা আযানের দোয়া পড়তে
পড়তে মসজিদের দিকে যাচ্ছে নামায আদায় করার জন্য। কেউ কেউ পুকুরে অজু করছে। একই
পুকুরে পুরোহিত মশাই ¯œান করছে। ¯œান করেই পুরোহিত মন্দিরে গিয়ে শঙ্খ বাজায়।
প্রদ্বীপ ও ধূপ জ্বালায়। ঘন্টা বাজায়।
গাছে আমের মুকুল ধরেছে। আম গাছের ফাঁক দিয়ে সূর্য মশাইকে উকি দিয়ে
আসতে দেখা যাচ্ছে। চারিধারে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ শোনা যায়। ভোরের বাতাস দোল
দিয়ে যাচ্ছে আর তাতে টুপটাপ করে শিশির যেনো ঝরে পড়ছে। রাঙা ফুলগুলো যেনো শরীর
ঝারা দিয়ে তার পাপড়ির আঙুলগুলি দিয়ে কাকে যেনো ডাকছে নিরবে। প্রজাপতি মধুর লোভে
তার রঙিন পাখায় উড়তে উড়তে হাজির হল ফুল কাননে। পিছু নিয়েছে রহিম ও কৃষ্ণ চন্দ্র।
রহিমের হাতে কায়েদা আর মাথায় টুপি। অন্যদিকে কৃষ্ণ চন্দ্রের গায়ে পৈতা ও পড়নে ধূতি।
কলসি কাঁখে রহিমা ও পূজা আসছে নদীর ঘাটে।
বাদলের সঙ্গে বাতাস মেতে উঠেছে, গাছের পাতা কাঁপছে। হাতে ব্যাগ নিয়ে হাটে
যাচ্ছে গায়ের মুরব্বীরা। বারান্দায় বসে আশি উর্ধ্ব দিদিমা দেখছে। পুরোহিত আর ইমাম
কালগপ্পো করে হাটের দিকে যাচ্ছে বুঝা যাচ্ছে। রাস্তায় একটি পাগল বসে আছে। রোজ
আসতে যেতে দেখা যায়। তবে পাগলটাকে কেউ চিনে না। কোথা থেকে আসলো তাও জানে
না। রোজ কেউ না কেউ খাবার দেয়। সেটা খায়। বসে বসে মাটিতে আঁকা ঝোঁকা করে।
গাঁয়ের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে অনেক সখ্যতা। একদিকে নামাজ পড়ে অন্যদিকে পূজা হয়।
কেউ কারো সাথে তর্ক বা ঈর্শ্বা নেই। যাকে বলে মানবতা। এমন কি এ গায়ের প্রতিটা
মানুষের মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নেই। নেই জাত পাত ধর্মের বিরোধ।
চারিধারে জঙ্গল। একটি ছোটো নদী বয়ে গেছে। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। ময়না ও
পূজার হাতে ভাতের বাটি নিয়ে হারিকেন হাতে পথ চলছে। হঠাৎ চিৎকার…
গায়ের মানুষ দৌড়ে আসে। এসে দেখে পূজা পড়ে আছে। সবাই ধরে পূজাকে নিয়ে
যায় বাড়ি। আমাদের জীবনে ছোটো খাটো কত ঘটনাই ঘটে। ঝুরুঝুরু শীতল বাতাস
বইছে। নীচে একটা পুকুরে সূর্যের আলো ঝিলমিল করছে…
পুরোহিত এসেছে ¯œান করতে। সূর্যের ঝিলমিল আলো ভেদ করে দেখে একটি রমনীর দেহ…
এর কিছুক্ষণ পড়ে নামাজ করে আসে মুসল্লিরা। হঠাৎ পাগল চিৎকার করে উঠে…
খুনি! খুনি! খুনি…
গায়ের মুসল্লিরা পাগলের কথায় বিশ্বাস করে পুরোহিতকে মারদোর করে। ময়নার নিথর দেহ
তোলার কথা বেমালুম ভুলে যায়। ইমাম সাহেব দৌড়ে এসে সব শুনতে চায়। তখন ইমাম বলল,
একটি পাগলের কথায় তোমরা কৃষ্ণ চন্দ্র বাবুর সাথে এমনটা করা মোটেও ঠিক হয়নি।
কে কার কথা শোনে। আবার মারে। অন্য সনাতনীরা এসে লাঠি চোটা নিয়ে আসে। এরপর
দু’পক্ষের সাথে হাতাহাতি হয়। দু’সম্প্রদায়ের মধ্যে সাপে নেওড়ে সর্ম্পকে চলে যায়।
কিছুক্ষণ পর সব ঠিক হলেও দু’সম্প্রদায়ের সর্ম্পক আর ঠিক হয়নি। এখন রোজ তাদের মধ্যে
কিছু না কিছু নিয়ে যুদ্ধ চলেই। ধীরে ধীরে গায়ের শান্তি নষ্ট হয়ে যায়। সেই বটগাছের
নিচ দিয়ে মানুষ সব সময় হাটে যায়। প্রথমে মরলো প্রীতি রানী পাল। এরপর ময়না। সবার
প্রশ্ন মনে উঁকি দিলেও কেউ সমাধান করে না। সবাই শুধু বলে। এ কোন ধূম্রজালের কবলে
পড়লো আমার সোনার বাংলা…?