অনিকা
নিঝুম অন্ধকার রাত, রাস্তা পেরুতেই জঙ্গল দেখা যাচ্ছে,
চারপাশ স্তব্ধ, একটা পাতাও নড়ছে না।
রাত আটটা বাজতে কিছু মিনিট বাকি, চারপাশের পরিবেশে বুঝা দায় এখন রাত আটটা বাজে, মনে হচ্ছে যেন গভীর রাত,
জঙ্গল পেরিয়ে কিছুটা হাটলেই রিয়াদের বাড়ি।
ফুলতলী গ্রাম।
তিন বান্ধুবী মিতু, আদিবা ও লাবণী ঢাকা থেকে গ্রামে রিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে,
মিতু, আদিবা, লাবণী ও রিয়া চারজন একসাথে ঢাকার এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয় কিছুদিনের বন্ধ দেওয়ায় রিয়া বাড়িতে আসে।
আজ ১৬ এপ্রিল,
রাত ১২ টা বাজতেই ১৭ এপ্রিল, লাবণীর জন্মদিন।
২১ বছরে পা রাখবে,
এবাবের জন্মদিনে রিয়াদের বাড়িতে সবাই মিলে মজা করবে বলেই তাদের বাড়িতে যাওয়া।
লাবনীর কেমন জানি চারপাশটা পরিচিত লাগছে,
মনে হচ্ছে এর আগেও এই রাস্তা দিয়ে সে কোথাও গেছে।
ফোনে চার্জ শেষ ধ্যাত,
এ সময়ই চার্জটা যাওয়ার ছিল।
মিতুর মোবাইলেও চার্জ নাই আরো আগে থেকেই,
চার্জ থাকার মাঝে শুধু আদিবার মোবাইলেই ছিল,
তাও কম, যেকোন সময় বন্ধ হতে পারে।
আদিবার মোবাইলের টচের আলো দিয়েই হাটছে সবাই।
হঠাৎ চিৎকার দিয়ে উঠে আদিবা,
মিতু দেখ ঐ যে গাছের ঝোপটার পাশে সাদা কি যেন একটা দেখা যাচ্ছে,
কই মোবাইল দে তো দেখি
মিতু ঝোপের উপর মোবাইলের আলো ফেলতেই দেখে কালো এক বিড়াল,
অন্ধকারে তার চোখ সাদা দেখাচ্ছিল।
ছোট বড় গাছে রাস্তা প্রায় ঢেকেই পড়েছে,
এত ময়লা, আবর্জনা কয়েক বছর ধরে এই রাস্তা দিয়ে কেউ আসা -যাওয়া করেছে বলে মনে হয় না।
রিয়াদের বাড়িতে যাওয়ার বিকল্প কোনো রাস্তা আছে কিনা কারো জানা নেই।
রিয়াকে কলও করা যাচ্ছে না, জঙ্গলের ভিতর ঢোকতেই
নেটওয়ার্ক চলে গেছে,
বার বার চেষ্টা করছে রিয়াকে কল করার, কল কেটে আসে।
গাড়ি থেকে নেমে যখন রিয়াকে কল করছিল রিয়া বলছিল জঙ্গল পেরিয়ে কিছুক্ষণ হাটলে রিয়াদের বাড়ি।
তিনজনই ভয়ে ভয়ে হাটতে থাকে,
জঙ্গলে ঢোকার আগে পর্যন্ত চারপাশ কেমন চুপ ছিল,
জঙ্গলের ভিতর ঢোকতেই চারপাশে শেয়ালের ডাক।
আদিবা মোবাইল মাথার সমান উপরে তুলে নাড়াচাড়া করছে,
আদিবার মোবাইল নাড়াচাড়া করা দেখে মিতু বলে কি করছিছ আদিবা?
তারাতারি হাট,
সিফাতকে কল দিছিল আদিবা নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না।
সিফাত আদিবার বয়ফ্রেন্ড।
সামনে হাটতেই দেখতে পায় রাস্তার ঠিক মাঝখানে মস্ত বড় বাড়ি, এত বড় বাড়ি অথচ নোংরা, অপরিষ্কার, অযত্নে পড়ে আছে অবিশ্বাস্য!
দেখে মনে হচ্ছে বেশ পুরোনো বাড়ি,
বাড়িটা কার, বাড়িতে কি কেউ থাকে না?
এই জঙ্গলের ভিতর এত বড় বাড়ি কই থেকে আসলো?
বাড়ির চারপাশটা গাছ, লতাপাতায় ঘিরে আছে,
চারপাশ কতটা ভয়ংকর লাগছে।
ফুলতলী গ্রামের সবাই এই বাড়ি সম্পর্কে জানত, এখানকার সবাই এক নামে চিনি ফুলতলীর ভয়ংকর বাড়ি, বাড়ি তো দূর, ভয়ে এই জঙ্গলের
আশেপাশে কেউ আসে না।
বাড়িটাও কিছুটা পরিচিত লাগছে লাবনীর,
আদিবার মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়,
এখন এই অন্ধকারে সামনে হাটাও অসম্ভব ।
এখানে বেশিক্ষণ দাড়িয়েও থাকা যাবে না,
লাবনী লক্ষ্য করে বাড়ির দোতলায় অল্প অল্প আলো জ্বলছে,
বাড়িতে কি কেউ থাকে?
আলো কই থেকে আসলো?
মিতু বলে আয় আজ রাতটা আমরা এখানেই থাকি।
আজ রাত এখানে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই,
ভোর হলেই আবার রিয়াদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিতে হবে।
অন্ধকারে আস্তে আস্তে তিনজন বাড়ির দিকে যেতে থাকে।
বাড়ির ভিতরে ডোকতেই চারপাশের ময়লায় তাদের হাচিঁ আসে, নাকে-মুখে কাপড় দিয়ে ঢেকে বাড়ির দোতলায় উঠে,
দোতলায় উঠতেই দোতলার এক রুম থেকে কান্নার শব্দ শুনা যাচ্ছে,
কাঁদো কাঁদো গলায় কেউ একজন এদিকে আয় এদিকে আয় বলছে, ভয়ংকর ধরনের গলার স্বর।
নিচ তলা থেকেও শব্দ আসছে কেউ একজন ঘুন ঘুন করে গান গাইছে,
সবাই ভয় পেয়ে যায়, ভয়ে নিচে নেমেও যেতে পারছে না,
দোতলার বারান্দায় একে অপরকে ধরে গুটিসুটি মেরে বসে আছে মেঝেতে,
হঠাৎ কোনো রকম শব্দ নাই ।
অনেকক্ষণ যাবত কোনো রকম শব্দ হচ্ছে না,
এখন সবাই কিছুটা ভয়মুক্ত হয়েছে, ক্লান্ত শরীর নিয়ে কোন সময় যে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।
লাবনী ফুফু এই বাড়ি সম্পকে জানতো,
লাবণীর বয়স তখন নয়,
ঢাকা থেকে লাবনীর ফুফু তার গ্রামের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের
বাড়ি লাবণীকে নিয়ে বেড়াতে আসে।
তারই পাশের বাড়িটা ছিল এই বাড়িটা ,
ফুলতলী গ্রামে এই বাড়ির মত এত বড়, সুন্দর বাড়ি আর দুটো ছিল না।
লাবণীর ফুফুর আত্মীয়ের বাড়ি থাকা অবস্থায়
হঠাৎ সবাই একদিন ছুটাছুটি করছে আর বলছে মালার মেয়ে ইরানী গলায় দড়ি দিয়ে মারা গেছে, সবার সাথে লাবণী ও তার ফুফু ইরানীকে দেখতে যায়।
তাই লাবনীর এই বাড়ি পরিচিত লাগছে,
লাবণী তখন ছোট থাকায় তার কিছুই মনে নাই,
সবাই বলা বলি করছিল কিছু দিন আগে মেয়েটাকে কিছু নরপিশাচ দর্ষণ করে,
তখন ইরানীর বিয়ের কথা চলছিল,
মেয়ে ধর্ষণ হয়েছে শুনে পাএ পক্ষ বিয়ে ভেঙে দেয়, এই ঘটনা ভুলতে না পেরে গলায় ফাঁসি দেয় ইরানী।
ইরানীর গলায় ফাসি দেওয়ার ব্যাপারটা ইরানীর মা মালা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি,
মেয়ের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে
মালাও কিছুদিন পর মেয়ের মত ফ্যানে ঝুলে মারা যায়।
শুনা যায় তারপর থেকেই এই বাড়িতে তাদের আত্মা
ঘুরে বেড়ায়,
প্রায় কান্নার শব্দ শুনা যায়।
ভয় এ এই বাড়ির আশেপাশে কেউ আসে না,
রাত হলেই চিৎকারের শব্দ শুনা যায়,
ভয়ে আশেপাশে যত বাড়ি ছিল সবাই অন্য গ্রামে চলে যায়।
পাশের গ্রামের মানুষ বলাবলি করে ইরানীর মা মালার আত্মা একুশ বছর বয়সী মেয়েদের সহ্য করতে পারে না।
কারণ তার মেয়ে ইরানীর মৃত্যুর সময় তার বয়স ছিল একুশ,
মালার মেয়ে কষ্টে আত্নহত্যা করে, তাই সে তার মেয়ের বয়সী অন্য মেয়েদের সুখে থাকতে দেবে না।
আজ লাবণীর বয়স ও একুশ।
রিয়ার কাছে ফোন করে লাবনীর ফুফু।
লাবণী রিয়াদের বাড়িতে আসার সময় তার ফুফুকে বলে এসেছিল সে বান্ধুবীদের সাথে রিয়াদের বাড়িতে যাচ্ছে,
ফুফু রিয়ার কাছে কল দিয়ে জানতে পারে এখনো রিয়াদের বাড়িতে পৌঁছেনি তারা।
ফুফু রিয়াকে বলে, তারা নিশ্চয়ই ঐ বাড়িটাই আটকে পড়েছে।
লাবণী বিপদে আছে তুমি জলদি কিছু একটা কর,
মিতু আর আদিবার একুশ বছর হতে কিছু মাস বাকি আছে,
মালার আত্মা তাদের কোনো ক্ষতি করবে না,
রিয়াও ঐ বাড়ি সম্পকে জানতো,
এই বাড়ি সম্পকে তাদের আগে সর্তক করেনি বলে এখন আফসোস হচ্ছে।
রাত ১২ টা..
হঠাৎ করেই মস্ত বাড়িতে আলো জ্বলে উঠলো,
এখন শুধু দোতলা না, তিনতলার মস্ত বাড়ির সবখানেই আলো জ্বলছে।
লাবণীর ঘুম ভেঙে যায়,
সারা বাড়িতে আলো দেখে চমকে উঠে লাবণী,
আবার ও কান্নার শব্দ, শব্দটা আসছে বারান্দার এক রুম থেকে, লাবণীকে কেউ একজন তার নাম ধরে ডাকছে,
লাবণী ভয়ে ভয়ে
উঠে রুমটার দিকে যেতে থাকে।
লাবণী এগিয়ে দরজার কাছে যেতেই দেখে
মেঝেতে এক লাশ, লাশের পাশে বসে কান্না করছে এক ভদ্র মহিলা। গায়ে শাড়ি পড়ানো,
মাথায় ঘোমটা দেওয়া।
এই ভদ্র মহিলাই মালার আত্মা,
হাতের ইশারাই কাছে ডাকছে লাবনীকে,
ভয়ে গা শিউরে উঠে তার।
মিতু জেগে উঠে, পাশে লাবনী নাই
আদিবাকে ডেকে তুলে মিতু বলে
দেখ লাবনী নাই,
দুইজনে চারপাশ খুঁজছে,
এখন সারা বাড়িতে আলো জ্বলছে দেখে দু-জনে আরো বেশি ভয় পেয়ে যায়।
দরজার পাশে লাবণীকে দেখে টান দিয়ে নিয়ে আসে মিতু, আত্মার ইশারায় রুমে পা রাখলেই আজ লাবনীকে মেরে ফেলত।
সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে তিনজন ,
কান্না আবারও শুরু হয়, ভয়ংকর কান্নার শব্দ।
তৎক্ষণাৎ রিয়া আর রিয়ার ভাই তাদের নিতে আসে।
লাবণী বলে রিয়া তুই এখানে?
সব বলছি বাড়িতে গিয়ে, এখন জলদি এখান থেকে চল,
সাথে সাথেই সবাই ঐ বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।