উম্মে হাবিবা অহনা
পর্ব-১
আরমোড়া ভেঙে ঘুম থেকে উঠলো অরু… বালিশের পাশে রাখা ফোনটা ধরে দেখলো এখনও অনেক
দেরি, বেশ কয়েক ঘণ্টা আছে। কিন্তু উঠতে একদমই ইচ্ছে করছে না। আজ ইরফান কোনো টেক্সট
দেয়নি। ইদানীং ইরফান খুব বেখেয়ালি হয়ে গেছে। আগের মতো খুঁজে পাওয়া যায় না।
এমনই হয়তো হয়। সম্পর্কের প্রথমে সবাই খুব সিরিয়াস থাকলেও ধীরে ধীরে সেই টান কমে আসে।
অরু এইসব ভাবতে ভাবতে ফ্রেশ হয়ে নিলো। ভার্সিটি খুব কাছেই, তাই ওর এত তাড়াহুড়োর দরকার
হয় না। ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ সামনে নিয়ে
ইরফানকে কল দিয়েও পাওয়া গেল না। বান্দরবানের “বান্দর”টা যে কবে আসবে কে জানে!
আলমারি থেকে অরু দু’টা শাড়ি বের করলো। একটা নীল, যেটার উপরে সূক্ষ্ম নকশা করা।অরু
নিজের হাতেই করেছে। অরু মেয়েটা বড্ড গুণবতী ।আরেকটা মেরুন। এটা ইরফানের দেওয়া। মেরুন
রঙে নাকি অরুকে খুব মানায়।
অরু আর দেরি করলো না। ইরফানের প্রিয় রঙ মুহূর্তের মধ্যে নিজের মধ্যে ধারণ করে নিলো।
“অরু, আজকের প্রেজেন্টেশন যা হয়েছে রে দোস্ত!”
“সারারাত হয়তো প্র্যাকটিস করেছিস, তাই না?” মেঘ বেশ উৎসাহ নিয়ে বললো।
পাশ থেকে আদিত্য বললো, “ভাইরে ভাই, আমি তো আজকে অরুকে দেখে নতুন করে প্রেমে পড়ে
গেলাম। সত্যি রে । ইরফান ভাইয়া না থাকলে অরুকে কেউই আমার থেকে নিতে পারতো না।
প্রজেক্টরের আলোতে অরুকে যে কতটা সুন্দর লাগছিল!অরু, তোর জন্য তো প্রেমে পড়তে ইচ্ছে
করছে আবার!’”
সবাই আদিত্যের কথা শুনে হো হো করে হাসতে লাগলো।
ক্যান্টিনের বাম কোণের টেবিলটা ছিলো সবসময়ই তাদের আড্ডার স্পট। চা-কফির কাপের শব্দ
আর হাসির ঝড়ের মাঝে অরু আজ যেনো কোথাও হারিয়ে গেছে।”
“কীরে অরু, অসুস্থ নাকি?” রিয়া জিজ্ঞেস করলো।
“হ্যাঁ রে, আজকে বেশ চুপচাপ। কী হয়েছে? বয়ফ্রেন্ডের সাথে ঝামেলা?” মেঘ বললো।
আদিত্য মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললো, “আপু, কী ব্রেকআপের শোকে শোকাহত? তাহলে চলেন,
আমার ব্রেকআপ পার্টির মতো আপনারটাও সেলিব্রেট করি!”
অরু আনমনে বললো, “কিছু বলছিস?”
“আহা! কাকে কী বললাম এতক্ষণ?”
“ওই, কোথায় ছিলি? নিশ্চয়ই ইরফান ভাইয়ার সাথে ঘুরতে চলে গেছিস!”
“উমমমম… ওই যে একটা কথা আছে না—দেহ এক জায়গায় আর মন আরেক জায়গায়!”
আবারও হাসির রোল পড়ে গেল টেবিলে।
পর্ব – ২
অরু বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। গোধূলির আলো ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। একটা অদ্ভুত বিষণ্ণতা ওকে
গ্রাস করে রেখেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে বারবার মেসেজ চেক করছে, তবুও আদিত্য বা মেঘের
মেসেজের রিপ্লাই দেওয়ার ইচ্ছাটাও যেন হারিয়ে গেছে।
বিকেল ৫টা বাজতে আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি। ও জানে, ওর বের হওয়া উচিত। কিন্তু শরীরটা তো
খারাপ, মনের অবস্থা আরও খারাপ।
কিছুদিন ধরেই অরু একটা দুঃস্বপ্ন দেখে আসছে। সেই স্বপ্নে একটা নির্দিষ্ট মেঘলা রাস্তা, ঝাঁকড়া
গাছের নিচে অন্ধকারে কেউ যেন দাঁড়িয়ে থাকে। কিন্তু সেই মুখটা সে কখনো পরিষ্কার দেখতে পায় না।
সেই স্বপ্নটা ওর জীবনের শান্তি কেড়ে নিচ্ছে।
মেঘ আজ সকালে ফোন করেছিল। ও জানে মেঘ কেমন চিন্তা করে ওর জন্য। কিন্তু আজ অরুর
মনের অবস্থা এমন, সে কারও সঙ্গে কথা বলতে চায় না।
“অরু, তুই ঠিক আছিস তো?”
মেঘের সেই কথাটা বারবার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
“ঠিক আছি” – এই কথাটা বলা কত সহজ! কিন্তু সত্যি কি সে ঠিক আছে?
রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন অরু ছাদে গিয়ে চুপচাপ বসে থাকে। সেই একই স্বপ্নের টুকরো
টুকরো অংশ বারবার তার মনে ভাসে। এই ইরফান নামের মানুষটা, যাকে নিয়ে সে এত গল্প করেছে
সবার সঙ্গে, আসলেই কি তার জীবনে আছে? নাকি এটা তার নিজের মনেই তৈরি করা একটা
মরীচিকা?
কেউ কি কখনো জানবে? নাকি সবকিছু ধোঁয়াশার মধ্যেই থেকে যাবে?
পর্ব – ৩
রাত গভীর হয়ে এসেছে। চারপাশে নিস্তব্ধতা, শুধু ছাদে অরুর পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাথার মধ্যে
সেই একই দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে—ঝাঁকড়া গাছ, অন্ধকার রাস্তা, আর সেই অস্পষ্ট মুখ। আজও সে
ঘুমাতে পারবে না, জানে।
হঠাৎ পেছন থেকে একটা শব্দ পেল অরু। চমকে তাকিয়ে দেখে, কেউ নেই। বুকের ভেতরটা ধড়ফড়
করতে থাকে। সে মনে মনে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করে, “এটা আমার মনের ভুল। কোনো কিছু নেই।“
ঠিক তখনই ফোনটা বেজে উঠল। স্ক্রিনে মেঘের নাম ভাসছে। ফোনটা ধরার কথা ভাবল, কিন্তু হাতটা
অজানা কারণে কাঁপছে। অবশেষে কলটা কেটে গেল।
একটু পর মেসেজ এল:
“অরু, তুই ভালো আছিস তো? প্লিজ একটা খবর দে।“
অরু মেসেজটা পড়ে চুপ করে রইল। রিপ্লাই দিতে পারল না। মনে হলো, সব শব্দ যেন হারিয়ে গেছে।
সেই মুহূর্তে ছাদের দরজায় একটানা ধাক্কাধাক্কির শব্দ শোনা গেল। অরুর গলা শুকিয়ে এলো। দরজার
দিকে তাকিয়ে দেখল, সেটা হালকা নড়ছে, যেন কেউ বাইরে দাঁড়িয়ে ধাক্কা দিচ্ছে।
“কে… কে ওখানে?” কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল অরু।
কোনো উত্তর নেই।
ধীরে ধীরে সে দরজার কাছে এগিয়ে গেল। বুকের ভেতরটা দৌড়াচ্ছে। হাত বাড়িয়ে দরজাটা খুলল। কিন্তু
বাইরে কেউ নেই।
তবে মেঝেতে একটা কাগজ পড়ে আছে। সেটা তুলে নিতেই দেখে, কাগজে লেখা:
“তুই জানতেও পারবি না, তোর চারপাশে কী চলছে।“
কাগজটা ধরে বসে পড়ল অরু। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। মাথার মধ্যে শুধু একটা কথাই
ঘুরছে—“ইরফান, এটা কি তুই?”
ফ্ল্যাশব্যাক:
তখন হঠাৎ তার চোখের সামনে একটি ছবি ভেসে ওঠে। বহু বছর আগে, এক অন্ধকার রাতের
দৃশ্য—রাজবাড়ির বিশাল উঠোন, যেখানে সে এক অদ্ভুত শান্তি অনুভব করেছিল। সেই রাতেই কি কিছু
হয়েছিল? সে কি ভুলে গেছে? কেন এই ছবি এখন আবার মনে পড়ছে?
অরু সেদিন সকালে এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে ঘুম থেকে উঠে। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা অপ্রকাশিত
রহস্য অপেক্ষা করছে তার সামনে। সিদ্ধান্ত নেয়, রাজবাড়ি সম্পর্কে আরও কিছু জানতে হবে। এর
জন্য সে রাহুলের কাছে যাবে।
রাহুল, পুরনো বইয়ের দোকানের মালিক, অরুর এক পুরনো পরিচিত। এক সময় সে এখানে প্রায়ই আসত,
কিন্তু এখন অনেক দিন পর এসে দেখে, দোকানটি আরও পুরনো হয়ে গেছে, যেন সময়ের সাথে
অদ্ভুতভাবে মিলেমিশে গেছে। দোকানে ঢুকতে গেলেই এক ধরনের নীরবতা এবং অদ্ভুত গন্ধ ভেসে
আসে।
“অরু! কতদিন পর!” রাহুল তাকে দেখে হাসল। কিন্তু অরুর চোখে ছিল কিছু চিন্তা, কিছু অস্থিরতা।
“রাহুল, আমি কিছু জানতে চাই। রাজবাড়ি সম্পর্কে,” অরু সরাসরি বলল।
রাহুল এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর একটি পুরনো বই তুলে এনে অরুর হাতে দেয়। “এটা ভালো করে
পড়ো। অনেক কিছু জানাবে। তবে সাবধানে থাকো,” রাহুলের মুখে একটা অদ্ভুত সতর্কতা
পর্ব – ৪
বইটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল অরু। রাহুলের কথা এখনও কানে বাজছে—”এটা
ভালো করে পড়ো। অনেক কিছু জানাবে। তবে সাবধানে থাকো।”
বইটা বেশ পুরনো। পাতাগুলো হলদে হয়ে গেছে, আর মলাটের কোণাগুলো ছিঁড়ে গেছে। অরু ধীরে
ধীরে পাতা উল্টাতে শুরু করল। প্রথম কয়েক পৃষ্ঠা রাজবাড়ির ইতিহাসের ওপর লেখা। রাজা আর
তার বংশধরদের বর্ণনা। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা পাতা থেকে কিছু বেরিয়ে পড়ে।
অরু নিচু হয়ে সেটা তুলে নেয়। একটা চিঠি।
চিঠিটা পুরনো, হাতে লেখা। অক্ষরগুলো প্রায় ঝাপসা। তবুও যা বোঝা যায়:
“আমি জানি তুমি কি দেখেছ। আর কেউ জানুক বা না জানুক, এই সত্যটা শুধু তোমার আর
আমার। ভুলে যেও না, কেউ আমাদের ক্ষমা করবে না।”
অরুর শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। এই চিঠি কাকে লেখা? আর এই “সত্যটা”ই বা কী?
রাত হয়ে এলো। বাড়ি ফিরে বইটা খুলে পড়া শুরু করল অরু। কিছু জায়গা রাজবাড়ির গোপন
কক্ষের উল্লেখ করছে। “রাজবাড়ির পশ্চিম দিকের ঘন গাছপালার আড়ালে একটা পাথরের দরজা।”
অরু জানে, এই জায়গাটা সে দেখেছে। স্মৃতিতে সেই অন্ধকার রাতের ঝাঁকড়া গাছের দৃশ্য আবার
ফিরে এলো।
ঠিক তখনই ফোনটা আবার বেজে উঠল। স্ক্রিনে ইরফানের নাম ভাসছে। কিন্তু… ইরফান তো…
ফোনটা হাতে নিয়েও ধরার সাহস হলো না। কলটা কেটে গেল। তারপরই মেসেজ এল:
“তুই যা খুঁজছিস, সেটা রাজবাড়িতেই লুকিয়ে আছে। তবে সাবধান, সবাই জানে না, সত্যটা কতটা
বিপজ্জনক।”
অরু চমকে উঠে ফোনটা হাত থেকে ফেলে দেয়। তার মনে শুধু একটাই প্রশ্ন—”ইরফান, এটা কি
তুই?”
পরের দিন সকালে রাহুলের দোকানে আবার হাজির হয় অরু। রাহুল এবার তাকে একটু দূরে নিয়ে
গিয়ে বলে,
“তুই কি জানিস, এই বইটা কেন তোর কাছে পৌঁছে দেওয়া হলো?”
“মানে?” অরুর কণ্ঠে কৌতূহল।
“কারণ তোর নাম এই বইয়ের সাথে জড়িয়ে আছে। তোর জন্মের অনেক আগেই এই রাজবাড়িতে
কিছু একটা ঘটেছিল। আর সেটা তোর সাথে কোনোভাবে জুড়ে গেছে।”
“কিন্তু কীভাবে?”
“রাজবাড়িতে গিয়ে সেটা তোর নিজেকেই খুঁজে বের করতে হবে। তবে একটা কথা মনে রাখিস,
সবাই অতীত খুঁড়তে পারে না। অতীত মাঝে মাঝে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে।”
রাতে বইয়ের নির্দেশ মতো একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে ছিল অরু। হঠাৎ বাতাসের একটা ঝাপটা
মোমবাতিটা নিভিয়ে দিল। ঘর অন্ধকার। দরজার বাইরে কার যেন নড়াচড়ার শব্দ। বুকের
ভেতরটা কেঁপে উঠল।
দরজা খুলে বাইরে তাকাতেই কেউ নেই। কিন্তু মেঝেতে একটা ছোট বাক্স পড়ে আছে। সেটা খুলতেই
ভেতরে পাওয়া গেল একটা পুরনো চাবি। আর এক টুকরো কাগজে লেখা:
“তোর সত্যিটা তোর অপেক্ষায়। পশ্চিম দিকের দরজায় চাবিটা ব্যবহার কর।”
অরু বুঝল, এই চাবি তাকে রাজবাড়ির সেই গোপন দরজার কাছে নিয়ে যাবে। সিদ্ধান্ত নিল, পরের
দিনই সেখানে যাবে।
পরের দিন সকালে, সূর্যের আলো মুছে যাওয়ার আগেই অরু রওনা দিল রাজবাড়ির দিকে। বুকের
মধ্যে এক অজানা উত্তেজনা আর ভয়। ব্যাগে রাখা সেই পুরনো চাবিটা যেন বারবার নিজেকে
জানান দিচ্ছে।
রাজবাড়ির পশ্চিম দিকটা বেশ নির্জন। গাছপালার ঘন ছায়ায় জায়গাটা যেন সময়ের সঙ্গে আটকে
আছে। অরু গাছপালার ফাঁক গলে পাথরের দরজার খোঁজ করল। একটু খুঁজতেই পুরনো মসৃণ
পাথরের একটা দরজা দেখা গেল। দরজার উপর অদ্ভুত নকশা খোদাই করা। মনে হলো এগুলো
কোনো প্রতীক, যেন কোনো বিশেষ বার্তা লুকিয়ে আছে।
অরু চাবিটা পকেট থেকে বের করল। দরজার ছিটকিনির ছোট্ট ফাঁকে চাবি বসিয়ে ঘুরাতেই একটা
খটখট আওয়াজ হলো। দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। ভেতর থেকে একটা ঠান্ডা বাতাস এসে
অরুকে ছুঁয়ে গেল, যেন ভেতরের অন্ধকার তাকে স্বাগত জানাচ্ছে।
অরু ভেতরে পা রাখল। চারপাশে অন্ধকার। শুধু মোমবাতির আলোয় সামনের পথটা দেখা যাচ্ছে।
দেয়ালে কিছু অদ্ভুত পেইন্টিং, যেগুলো রাজবাড়ির অতীত জীবনের ছায়া দেখাচ্ছে।
হঠাৎ, একটা দেয়ালে বড় করে লেখা কিছু শব্দ অরুর নজর কাড়ল:
“যে সত্য লুকানো, তা কেবল সাহসীরাই খুঁজে পায়।”
পায়ের শব্দে মেঝে কাঁপছে। অরু এগিয়ে চলল। একটা ছোট কক্ষের সামনে এসে থামল। দরজার
গায়ে একটা প্রতীক আঁকা—যেটা বইয়ের মলাটেও ছিল। বুঝতে পারল, এটা সেই গোপন কক্ষ।
ভেতরে ঢুকতেই একটা বড় টেবিলের উপর রাখা রয়েছে পুরনো কিছু বই, চিঠি আর একখানা
ডায়েরি। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে শুরু করল অরু। ডায়েরির প্রতিটি পাতায় কোনো না
কোনো রহস্যময় বার্তা।
একটা পৃষ্ঠায় লেখা ছিল:
“ইরফান জানত। কিন্তু ইরফান বাঁচেনি।”
অরুর মাথা ঘুরে গেল। “ইরফান জানত”—মানে কী? ইরফান কি এই রাজবাড়ির রহস্য জানত?
তার মৃত্যুর সঙ্গে এই ঘটনার যোগসূত্র কী?
ঠিক তখনই পায়ের শব্দ শুনতে পেল। অরু দ্রুত লুকিয়ে পড়ল একটা টেবিলের আড়ালে। দরজার
দিকে তাকাতেই দেখল এক ছায়ামূর্তি ধীরে ধীরে ভেতরে আসছে।
কণ্ঠ শুনে চমকে উঠল। সেটা রাহুলের।
“অরু, বেরিয়ে আয়। আমি জানি তুই এখানে আছিস।”
অরু ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো।
“তুমি এখানে?”
10
রাহুলের মুখটা গম্ভীর। “তোর সত্যের খোঁজ চলছে। কিন্তু আমি তোকে একা এটা করতে দিতে পারি
না। অতীতের এই সত্য, একবার জেনে ফেললে তোর জীবন আর আগের মতো থাকবে না। তুই
কি সত্যিই প্রস্তুত?”
অরুর চোখে দ্বিধা। কিন্তু মনে সাহস এনে বলল, “আমি জানতেই হবে। যে সত্য এতদিন লুকানো
ছিল, সেটা কেন আমার সঙ্গে জড়িত?”
রাহুল এক মুহূর্ত চুপ করে রইল। তারপর একটা পাণ্ডুলিপি টেনে বের করল।
“এই পাণ্ডুলিপি খুলে দেখ। এতে তোর উত্তর আছে।”
অরু পাণ্ডুলিপিটা খুলল। ভেতরে একটা ছবি—একটা মেয়ের ছবি। মেয়েটার চেহারা হুবহু অরুর
মতো। নিচে লেখা:
“অরু, ১৮৮৫।”
পর্ব – ৫
অরু ছবি থেকে চোখ সরাতে পারছিল না।
“এটা… এটা কীভাবে সম্ভব? এই মেয়ে… আমার মতো দেখতে কেন?”
রাহুল শান্ত গলায় বলল, “এই কারণেই তো তোর সত্যের খোঁজ। এই মেয়ে তোর পূর্বপুরুষদের মধ্যে
একজন। তার নামও অরু ছিল। সে এই রাজবাড়ির শেষ উত্তরাধিকারী। কিন্তু তার মৃত্যু রহস্যে
ঘেরা। কেউ জানে না সে কীভাবে বা কেন মারা গিয়েছিল।
অরু ছবিটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল, “তাহলে… আমি কি তার পুনর্জন্ম? সে কি তার
জীবনের অসমাপ্ত সত্য আমায় খুঁজে বের করতে পাঠিয়েছে?”
রাহুল মাথা নেড়ে বলল, “আমিও নিশ্চিত নই। কিন্তু তার আর তোর মধ্যে যে অদ্ভুত যোগসূত্র
আছে, সেটা আর অস্বীকার করার উপায় নেই। তুই কি খেয়াল করেছিস, এই রাজবাড়ির প্রতিটি
রহস্য তোকে টানছে, তোর স্বপ্নে আসছে?”
অরুর শরীর হিম হয়ে গেল। সে চাপা গলায় বলল, “তাহলে কি এইসব স্বপ্ন আমার মনের কল্পনা
নয়?”
রাহুল বলল, “না, এই স্বপ্ন তোকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। সত্যের পথ দেখাচ্ছে। কিন্তু একটা কথা মনে
রাখ। এই পথ যেমন তোর কাছে সত্য নিয়ে আসবে, তেমনই বিপদও নিয়ে আসতে পারে।“
রাজবাড়ির সেই গোপন কক্ষ থেকে ফিরে আসার পর অরুর মন যেন পুরোপুরি এলোমেলো। নিজের
ঘরে বসে সে ছবিটার কথা ভাবছিল। পাণ্ডুলিপিতে অরুর মতো দেখতে মেয়েটির নিচে আরও কিছু
লেখা ছিল, যা রাহুল তাকে পড়ে শোনায়নি।
তাই অরু সিদ্ধান্ত নিল, আবার রাজবাড়িতে যাবে। এবার একা।
পরের রাতে, চাঁদের ম্লান আলোয় রাজবাড়ির পশ্চিম দিকটা আরও রহস্যময় লাগছিল। সেই গোপন
কক্ষে ঢুকে টেবিলের ওপর রাখা পাণ্ডুলিপিটা তুলে নিল অরু। এবার সে এক এক করে প্রতিটি পৃষ্ঠা
খুলতে শুরু করল।
শেষের দিকে একটা পাতায় লেখা ছিল:
“অরু যখন সত্য জানতে পারল, তখনই তার সর্বনাশ শুরু হলো। কেউ তার এই সত্য জানতে
পারুক, সেটা চায়নি।“
আরেকটা পাতায় অদ্ভুত এক চিত্র দেখা গেল—একজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনে একটা
ছায়ামূর্তি। মেয়েটা ভয় পেয়ে আছে। নিচে লেখা:
“অতীতের সত্য, ভবিষ্যতের প্রেত।“
পাঠ করতে করতেই পেছন থেকে হালকা এক ঝাপটা বাতাস এলো। অরু পেছনে ঘুরতেই দেখল,
আবার সেই ছায়ামূর্তি। এবার ছায়ামূর্তির মুখে কিছুটা আকার স্পষ্ট।
অরু থমকে গেল।
“ইরফান?”
ছায়ামূর্তি কোনো কথা বলল না। শুধু একটা ইশারা করল, যেন তাকে অনুসরণ করতে বলে।
অরু সাহস করে মোমবাতিটা হাতে নিয়ে ছায়ামূর্তির পেছনে চলতে শুরু করল। একটা সরু করিডর
দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ একটা ছোট দরজার সামনে পৌঁছল। ছায়ামূর্তি দরজার দিকে ইশারা করে
মিলিয়ে গেল।
অরু দরজাটা খুলল। ভেতরে ঢুকতেই দেখল, একটা পাথরের চাতাল, আর তার ওপর একটা কাঠের
বাক্স রাখা। বাক্সের ওপর একটা বড় তালা। তালাটা অদ্ভুতভাবে ঠিক তার পাওয়া চাবির মতো
দেখাচ্ছিল।
অরু চাবি দিয়ে তালা খুলল। বাক্সের ভেতরে পাওয়া গেল একটা পুরনো ডায়েরি। ডায়েরির প্রথম
পৃষ্ঠায় লেখা:
“এই ডায়েরি পড়লেই তুই জানবি, কেন তোর সঙ্গে এই রাজবাড়ির অতীত জড়িয়ে আছে। কিন্তু
পড়ার আগে সাবধান—সত্যটা জানার সাহস সবার থাকে না।“
অরু ডায়েরিটা হাতে নিয়ে পেছনে তাকাল। পুরো ঘরটা হঠাৎ যেন আরও ঠান্ডা আর অন্ধকার হয়ে
উঠল। মনে হলো, দেয়ালের ছায়াগুলো নড়ছে।
ডায়েরি খুলতেই প্রথম পাতায় বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল:
“আমার নাম অরু। আমি আমার মৃত্যুর রহস্য লিখে যাচ্ছি। যদি তুমি এটা পড়ো, তবে জেনে
রাখো, সত্য জানতে গিয়ে অনেক কিছু হারাতে হয়
ডায়েরির প্রথম লাইনগুলো অরুর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোতের মতো নামল। “আমার মৃত্যুর রহস্য
লিখে যাচ্ছি।“ তার হাত কাঁপতে শুরু করল। ডায়েরির পাতাগুলো উল্টাতে উল্টাতে চোখে পড়ল
আরও কিছু লেখা।
“যে দিনটা ছিল আমার জীবনের শেষ দিন, সে দিন শুরু হয়েছিল এক অদ্ভুত চিঠি দিয়ে। চিঠিটা
আমি আমার ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে পেয়েছিলাম। তাতে লেখা ছিল, ‘তোমার জীবন এখন শুধু
সময়ের অপেক্ষা। সত্যটা প্রকাশ পেলে তুমি আর বাঁচবে না।‘
আমি জানতাম, এটা রাজবাড়ির গোপন ষড়যন্ত্রের ফল। কিন্তু আমার ধারণা ছিল না, এর শিকড়
এত গভীর। আমার বাবার রাজত্বের পেছনে লুকিয়ে ছিল এক রক্তাক্ত ইতিহাস। আর আমি ছিলাম
সেই সত্যের সাক্ষী।“
অরু ডায়েরি পড়ে যত এগোচ্ছে, ততই এক অদ্ভুত অনুভূতি তার মনকে চেপে ধরছে। তার যেন
মনে হচ্ছিল, এই লেখাগুলো সে পড়ছে না, বরং তার নিজের স্মৃতির কণ্ঠে শুনছে।
পরবর্তী পৃষ্ঠায় লেখা ছিল:
“যে রাতে আমার মৃত্যুর দিন ঠিক করা হয়েছিল, সেদিন আমি পালানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু
রাজবাড়ির এক গোপন কক্ষে আটকে পড়ি। সেই কক্ষের মেঝেতে একটা অদ্ভুত প্রতীক আঁকা ছিল।
প্রতীকের মাঝখানে ছিল রক্তের দাগ। কেউ যেন সেখানে কোনো ভয়ঙ্কর কাজ করেছে।
আমি সেই প্রতীক স্পর্শ করার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে ঢুকে পড়ি। আর সেই অন্ধকার আমাকে গ্রাস
করেছিল। আমি এখন জানি, সেই প্রতীক ছিল অভিশপ্ত। আর সেটাই আমার জীবনের শেষ
অধ্যায়ের শুরু।“
ডায়েরির এই অংশ পড়তে পড়তে অরুর মনে ভয় জমতে লাগল। সেই প্রতীক কি এখনও আছে?
সেই অভিশাপ কি এখনো সক্রিয়?
ডায়েরির শেষ পৃষ্ঠাগুলোতে লেখা ছিল:
“যদি তুমি এই ডায়েরি পড়ে থাকো, তাহলে জেনে রাখো, এই অভিশাপ ভাঙতে হলে তোমাকে ওই
প্রতীকের কাছে যেতে হবে। সেখানেই আমার মৃত্যু হয়েছিল। সেখানেই সত্য লুকিয়ে আছে। কিন্তু
মনে রেখো, সত্যের পথ ভয়ঙ্কর। আর সব প্রশ্নের উত্তর জানাও সবসময় আশীর্বাদ নয়।“
ডায়েরির শেষ বাক্যগুলো পড়তেই মোমবাতির আলো কেঁপে উঠল। অরু টের পেল, তার চারপাশে
যেন কেউ আছে।
ঠিক তখনই দরজার বাইরে পায়ের শব্দ। সে দ্রুত ডায়েরিটা গায়ে চেপে ধরে দেয়ালের আড়ালে
লুকিয়ে পড়ল।
দরজাটা খুলে ভেতরে ঢুকল রাহুল। তার মুখে অদ্ভুত এক ধোঁয়াটে অন্ধকার। অরু তাকে দেখে
চমকে উঠল।
“তুই এখানে কী করছিস, রাহুল?”
রাহুল ধীরে ধীরে হাসল। “আমি তোকে বলেছিলাম, সত্যের খোঁজ করা সহজ নয়। তুই কি সত্যিই
ভাবলি, আমি শুধু বইয়ের দোকানের মালিক? তুই আর আমি, দু’জনেই এই অভিশাপের অংশ।
আমি এখানে তোকে পথ দেখাতে এসেছি। কিন্তু সত্যটা তোকে একা জানতেই হবে।“
অরু হতভম্ব। “তুমি… তুমি জানো সবকিছু?”
রাহুল আর কিছু বলল না। শুধু মেঝের দিকে ইশারা করল। অরু তাকিয়ে দেখল, মেঝেতে আঁকা
সেই প্রতীক, যা ডায়েরিতে বর্ণনা করা হয়েছিল।
রাহুল বলল, “এটাই সেই প্রতীক। আর এখানেই তোর উত্তর
শেষ পর্ব
অন্ধকার যেন পুরোপুরি অরুকে গ্রাস করল। তার চারপাশ থেকে অস্পষ্ট কণ্ঠস্বর ভেসে
আসছিল—“সত্য জানলে কি তুই মুক্তি পাবি, নাকি তোর সর্বনাশ হবে?”
অরু কাঁপা গলায় বলল, “আমি মুক্তি চাই। পুরনো অরুর অসমাপ্ত গল্প শেষ করতে চাই।“
হঠাৎ, প্রতীকের মাঝখানে একটা তীব্র আলো জ্বলে উঠল। অরুর চোখের সামনে ভেসে উঠল এক
ভৌতিক দৃশ্য—এক রাজকীয় কক্ষ, পুরনো অরু দাঁড়িয়ে আছে, চারপাশে কিছু ছায়ামূর্তি তাকে ঘিরে
রেখেছে। তাদের মধ্যে একজন কণ্ঠ চিৎকার করে বলছে, “তুই সত্য জানবি না! তোর জন্যই
আমাদের ধ্বংস আসবে।“
পুরনো অরুর চোখে ভয়। সে ফিসফিস করে বলল, “তুই যদি আমাকে দেখতে পাচিস, তবে সত্যটা
জান। আমার রক্তেই অভিশাপ আটকে আছে। আমায় মুক্তি দিতে হলে তোর নিজের জীবনও
বিপদের মুখে পড়বে। তুই কি সাহস করবি?”
অরুর মাথায় হাজারো প্রশ্ন। তবে সে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমি প্রস্তুত। সত্যটা জানতেই হবে।“
আলো আরও উজ্জ্বল হলো। দৃশ্য বদলে গেল। অরু এখন একটা পাথরের কক্ষে দাঁড়িয়ে। তার
সামনে সেই পুরোহিত, যার নাম ডায়েরিতে লেখা ছিল। পুরোহিত বলল, “তুই সত্যি শেষ করতে
এসেছিস? তবে শোন, তুই যা জানবি, তা তোর জন্য সহজ হবে না। এই অভিশাপ শুধু তোর
নয়, ভবিষ্যতেরও পথ বদলে দেবে।“
অরু প্রশ্ন করল, “কিন্তু এই অভিশাপ কেন শুরু হয়েছিল? এই সত্য চাপা দিতে সবাই এত মরিয়া
কেন?”
পুরোহিত জবাব দিল, “রাজপরিবারের এক পাপ, যা ঢাকতে তোর পূর্বপুরুষকে বলি দেওয়া
হয়েছিল। সেই পাপের শাস্তি তার রক্তধারায় বয়ে চলেছে। তুই যদি সত্য প্রকাশ করিস, তবে এই
রাজবাড়ি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর তুইও।“
অরু চিন্তায় পড়ে গেল। তবে সে বলল, “ধ্বংস হলেও সত্য প্রকাশ হবে। অভিশাপ আর কাউকে
গ্রাস করতে পারবে না।“
পুরোহিত হেসে বলল, “তাহলে দেখ তোর ভাগ্য।“
পুরোহিত মিলিয়ে গেল। প্রতীকের মাঝখানে দাঁড়িয়ে অরু অনুভব করল, তার মাথায় অদ্ভুত সব
স্মৃতি ঢুকে পড়ছে। অতীত আর বর্তমান যেন এক হয়ে গেল।
হঠাৎ করেই অরু চোখ খুলল। সে রাজবাড়ির মূল কক্ষের মেঝেতে পড়ে আছে। প্রতীকের ছায়া
বিলীন হয়ে গেছে। রাহুল পাশে দাঁড়িয়ে।
রাহুল বলল, “তুই পারলি। অভিশাপ শেষ।“
অরু ধীরে ধীরে বলল, “পুরনো অরু মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু আমি একটা জিনিস বুঝিনি—তুই এখানে
কেন?”
রাহুল হেসে বলল, “তুই যা ভাবছিস, তার থেকেও বড় গল্প আছে। আমি ছিলাম তোর পথপ্রদর্শক।
কিন্তু আমার সত্য এখনও তোর সামনে আসেনি। তুই তৈরি হলে আবার দেখা হবে।“
রাহুল হেঁটে অন্ধকারে মিশে গেল।
অরু রাজবাড়ি থেকে বেরোল। বাইরে সোনালী রোদ পড়েছে। কিন্তু তার মনে ছিল একটাই প্রশ্ন—এই
অভিশাপ শেষ হলেও কি রাহুল সত্যিই তার গল্প শেষ করেছে? নাকি আরেক রহস্য তাকে ডাকছে?