শংকর ব্রহ্ম
তোর বউ আছে, ছেলে বড় হয়েছে।
অনিল বললো, বউ কি আর বেঁচে আছে?
ঠাকুর্দা বললো, মরে গেছে তুই জানিস?
– এতে জানা বোঝার কি আছে? বেঁচে থাকলে এতোদিনে সে নিশ্চয়ই বাড়ি ফিরে আসতো।
ঠাকুর্দা পিকলুর বাবার কোন কথাই শুনলো না,
তার উপর ভীষণ রেগে গেল। চ্যালা কাঠ তুলে নিয়ে তাকে মারতে গেল। বাবা সরে না গেলে, তার মাথা ফাঁক হয়ে ফিনকি রক্ত বের হতে পারত। এসব দেখে বাবা নতুন বউ সহ বাড়ি থেকে পালিয়ে গেল। পাড়ার লোকেরা মজা দেখতে এসেছিল।
বাবাকে বউ সহ বাড়ি থেকে দূর করে তাড়িয়ে দিতে কেউ কেউ খুশি হল। আবার কেউ কেউ ঠাকুর্দার নিন্দা করতে লাগল। নতুন মাকে দেখে পিকলুর খুব পছন্দ হয়েছিল। টানা টানা চোখ, টিয়া পাখির মতো নাক, গায়ের রঙ চাঁপা ফুলের মতো সোনালি-হলুদ। দেখতে একেবারে পরির মতো।
জীবনে মায়ের সান্নিধ্য পায়নি পিকলু, তাই তাকে মা বলে খুব ডাকতে ইচ্ছে করছিল। ঠাকুর্দার রাগত ভয়াল মূর্তি দেখে, তা আর সাহস হয়নি পিকলুর। পিকলুর বাবা ঠাকুর্দার সেই ভয়ঙ্কর রূপ দেখে তখনই তার নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলো। লোকের মুখে এই ঘটনাটা ছড়িয়ে পড়েছিল সারা পাড়ায়। পিকলুর তাই পাড়ার লোকের কাছে মুখ দেখাতে লজ্জা করতো। তাই সে বেশিরভাগ সময়টাই কম্প্যুটার সেন্টারে কাটাতো।
শীতল বাতাস জানলা দিয়ে এসে ঘরে ঢুকছে। কোথায়ও বৃষ্টি হয়েছে বোধহয। কয়েকটা দিন ধরে উষ্ণতার মাত্রা এতো বেড়ে গেছিল যে আর সহ্য করা যাচ্ছিল না। ঠাকুর্দা বারান্দায় বসে, গুণগুণ করে কী গান ধরেছেন যেন। দূর থেকে শোনা যাচ্ছিল না। পিকলু তাই তার কাছে গিয়ে শুনতে চেষ্টা করল। ঠাকুর্দা গাইছেন,
‘হরি দিন তো গেল, সন্ধ্যা হল, পার কর আমারে’।
গানটা ঠাকুর্দার মুখে গানটা শুনে তার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল। একমাত্র আপন বলতে, ঠাকুর্দাই তার সম্বল। মা নেই, পিসি নেই, বাবা থাকতেও নেই।
কাকা কাকিমা আছেন, কিন্তু তারা নিজেদের সংসার নিয়েই ব্যস্ত। একমাত্র ঠাকুর্দার কাছে তার মনের চাহিদাগুলি জানাতে পারে। এরপর ঠাকুর্দা চলে গেলে, সে তো একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবে। সে ঠাকুর্দার কাছে গিয়ে বলল, তুমি এসব গান গাইবে না। শুনলে আমার ভীষণ মন খারাপ হয়ে যায়। শুনে ঠাকুর্দা গান থামালেন। তারপর ইশারায় তার পাশে বসতে বললেন। পিকলু তার পাশে বসলে, তার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে লাগলেন। পিকলু দেখল, ঠাকুর্দার চোখ দিয়ে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। পিকলু হাত দিয়ে তার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কেঁদো না ঠাকুর্দা।
কম্প্যুটার সেন্টারে পিকলুর এক বান্ধবী জুটেছে। নাম কুলসুম নূর। মেয়েটি বেশ
বুদ্ধিমতী। অল্পদিনের মধ্যেই কম্প্যুটারের প্রাথমিক পাঠটা শিখে নিয়েছে। সদালাপী এবং দেখতেও আকর্ষণী লাবন্যময়ী। কালোর উপর মুখখানা খুব মায়াবী। চাঁদের আলো মাখা। তাকে বন্ধু পেয়ে পিকলু যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেয়েছে। আজকাল পিকলুর বেশ আনন্দেই কাটছে।
ঠাকুর্দার মুসলমানদের উপর খুব রাগ। তাঁর বদ্ধমূল ধারনা, মুসলমানদের জন্যই তাদের বরিশাল ছেড়ে ছিন্নমূল হয়ে এদেশে পালিয়ে আসতে হয়েছে। তা না, হলে তারা ওখানে সুখেই ছিলেন। তাদের সুখ হরণ করেছে ওদেশের মুসলমানরা। এই বদ্ধমূল ধারনা ঠাকুর্দার মাথায় গেঁথে গেছে। তার মন থেকে এ ভাবনা দূর করা যাবে না।
পিকলু একালের ছেলে, তার মনে ঠাকুর্দার মতো কোনও মুসলমান বিদ্বেশভাব নেই। সে মুক্তমনা স্বভাবের। তাই শাহিনের সঙ্গে মিশতে তার মনে কোন দ্বিধা-দন্দ্ব নেই। সে স্বাভাবিকভাবেই তার সঙ্গে মেলামেশা করে।
একদিন কুলসুম, পিকলুকে তাদের বাড়ি নিয়ে গেছিল। পার্কসার্কাসের কাছে দরগা রোডে একটা ফ্ল্যাটের দোতলায় থাকে। ছিমছাম সাজানো দু’টি ঘর। সংসারে তার আছে, মা আর বাবা। বাবার সাথে পরিচয় হয়নি। শাহিনের মাকে দেখে, কথা বলে মনে হয়েছে, তিনিও শাহিনের মতো খুব মিষ্টি স্বভাবের মানুষ। সহজেই অপরকে আপন করে নিতে পারেন। খুব ভাল লেগেছে পিকলুর তার সঙ্গে পরিচয় হয়ে। শাহিন তার জন্য চা আর ডিম ভাজা করে এনেছিল। শাহিনের মা বলেছিলেন, খাও বাছা। চা আর ডিম ভাজা খেয়ে, কিছুক্ষণ বসার পর ফিরে আসার সময়, শাহিনের মা বলেছিলেন, আবার এসো বাছা। তার মিষ্টি স্বরে যেন আন্তরিকতা ঝরে পড়ছিল।
পিকলুর বাবা অসুস্থ হয়ে জলপাইগুড়ি টাউনের ময়নাগুড়ি হাসপাতালে ভর্তি আছে শুনে, ঠাকুর্দা অস্থির হয়ে উঠলেন। পিকলুকে বললেন, আমার তো অতদূরে যাওয়ার ক্ষমতা নেই। তোর কাকারও দোকান ছেড়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তুই যদি একবার গিয়ে দেখে আসতিস তবে ভাল হতো। বাবা অসুস্থ শুনে পিকুরও মনটা কেমন করে উঠল। মা কোথায় আছে, কেমন আছে, আছে কিনা কিছুই জানা নেই। বাবা এখনও আছে তার, দূরে থাকলেও আছে।
পিকলু ঠাকুর্দার কথা শুনে বলল, হ্যাঁ আমি যাব। কালই রওনা হবো। পিকলুর কথা শুনে ঠাকুর্দা যেন স্বস্থির নিশ্বাস ফেললেন।
ঠাকুর্দা সেদিনই ব্যাঙ্ক থেকে তুলে পাঁচ হাজার টাকা দিলেন পিকলুর হাতে। বললেন, অজানা অচেনা জায়গায় যাবি, সাবধানে টাকাটা রাখিস। কারও সাথে অযথা আলাপ জমাতে যাবি না।
পরদিন সকাল পাঁচটায় গড়িয়া থেকে শিলিগুড়ির বাস ধরে পিকলু রওনা হয়ে গেল।
এই প্রথম কলকাতা ছেড়ে পিকলুর কোথায়ও যাওয়া। কি খাবে, কোথায় থাকবে কিছুই জানা নেই পিকলুর। তার কাছে অকূল সমুদ্রে পাড়ি দেওয়ার মতো।
বাস উল্টোডাঙা পেরিয়ে দুরন্ত গতিতে ছুটতে শুরু করল। পিকলুর খানিকক্ষণ পর ঘুম ঘুম পাচ্ছিল। পিকলুর সঙ্গে এতগুলি টাকা, সে সতর্ক হয়ে ঘুম তাড়াল। বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাস চলছে তো চলছেই। দশটার পর মালদায় এসে গাড়িটা থামল। এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার চলতে শুরু করবে। পিকলু লাগেজ সঙ্গে নিয়ে বাস থেকে নেমে, একটা চায়ের দোকানে দাড়িয়ে চা-বিস্কুট খেল। বাসের অনেকেই সেখানে চা-বিস্কুট খাচ্ছে পিকলু দেখল। সামনে কয়েকটা ভাত পরটার দোকানও আছে। দু’একজন সেখানে ঢুকে পড়ল। কিছুক্ষণের মধ্যে তারাও ফিরে এল। বাস আবার ছেড়ে দিল।
বারটা নাগাদ পিকলু শিলিগুড়িতে এসে নামল বাস থেকে। একে একে সকলেই বাস থেকে নেমে গেল। বাস খালি হয়ে গেল।
পিকলু দেখল তার খুব খিদে পাচ্ছে।
সে একটু খোঁজাখুঁজি করতেই ভাতের একটা হোটেল পেয়ে গেল। সেখানে ঢুকে পড়ল। হাত-মুখে জল দিয়ে এসে সে একটা টেবিলে বসল।
একপ্লেট ভাত, ঝিরিঝিরি করে কাটা সামান্য আলু ভাজা, বিস্বাদ ফ্যানের মতো একবাটি ডাল আর একবাটি আলু-পটলের জন্য ১৩০ টাকা খরচ হয়ে গেল। কলকাতায় সত্তর টাকায় এসব জুটে যেত। কোন উপায় নেই। খেয়ে হাতমুখ ধুয়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে এল সে। বাস স্ট্যান্ডের দিকে হাঁটতে লাগল।
সে দেখল, শহরটা বেশ জমজমাট।
এখানে সেখানে মৌচাকের মতো মানুষের ভিড়।বাসস্ট্যান্ডে এসে দেখল। এখান থেকে অনেক জায়গায় যাওয়ার বাস পাওয়া যায়। ফালাকাটা, মালবাজার, নকশালবাড়ি, নাগরাকাটা, বীরপাড়া
আরও কত সব জায়গার। সে খোঁজ করে মযনাগুড়ি যাবে এমন একটা বাসে উঠে বসল।
মযনাগুড়ি এসে পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল। সেখানে নেমে সে হাসপাতালের খোঁজ করে সেখানে পৌঁছাল।
এনকোয়ারিতে ‘অনিল দাস’ বাবার নাম বলে খোঁজ করতেই,কাউন্টারে বসা লোকটি, একটি রেজিষ্টার খাতা খুলে দেখে, তাকে জানাল, ১৭ নম্বর বেডে খোঁজ করুন।
পিকলু ১৭ নম্বর বেড খোঁজ করে দেখল, বেডটা খালি, কেউ নেই। সে ভাবল, কি হল? বাবা তো এখানে নেই। সে ভাবনায় পড়ল। ভাবল একবার কি গিয়ে, এনকোয়ারির লোকটা বলবে, ১৭ নম্বরে কেউ নেই।
বেডের সামনে দাঁড়িয়ে, পিকলু অসহায় ভাবে ভাবছিল, তাহলে কি এতদূর থেকে এত কষ্ট করে এত খরচ করে এসে বাবার সঙ্গে তার দেখা হবে না। আবার তাকে ফিরে যেতে হবে কলকাতা? ফিরে গিয়ে কি জবার দেবে ঠাকুর্দাকে? যে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। পিকলু এইসব ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কখন এসে একজন শীর্ণকায় লোক সেই বেডে এসে বসেছে,পিকলু খেয়াল করেনি। লোকটার ডাকে পিকলুর সম্বিত ফিরল।
পিকলু তুই কখন এসেছিস?
কথাটা শুনে সে লোকটার দিকে তাকিয়ে বাবা বলে চিনতে পারল না। কী চেহারা হয়েছে তার। চোখ দুটি ভিতরে বসে গিয়ে ছোট হয়ে গেছে। গাল দু’টি চুপসে ভিতরে ঢুকে গেছে, দুু’পাশের হনু দু’টি বেরিয়ে প্রকট হয়ে পড়েছে।
পিকলু তাকে না চিনতে পারলে কি হবে? পিকলুর বাবা তাকে চিনতে পেরেছে। পিকলু বলল, তুমি কোথায় গেছিলে? আমি তো এসে তোমায় না দেখে খু্ব ঘাবড়ে গেছিলাম। শুনে মলিন হেসে তার বাবা বলল, পেচ্ছাব করতে ল্যাট্রিনে গেছিলাম।
– তুমি কেমন আছ, বাবা।
– ভাল নেই রে। তুই এখান থেকে আমাকে নিয়ে চল। এখানে থাকলে আমি আর বাঁচব না রে।
– ঠিক আছে দেখি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে।
সেই দুপুরে শিলিগুড়িতে একথালা ভাত খেয়েছিল । এখন সন্ধ্যায় বেশ খিদে পাচ্ছে তার। ভাবল, ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হলে, হাসপাতাল থেকে বাইরে বেরিয়ে, ঘুগনি-রুটি খেয়ে নেবে। ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হওয়ারও একঘন্টা পরে, ডাক্তার এসে বসেন। তখন বাবার ব্যাপারে তার সঙ্গে কথা বলে, বাবার কি হয়েছে জানতে পারবে। ভিজিটিং আওয়ারস শেষ হওয়ারও একটু আগে, পিকলু বাবার কাছে জানতে চাইল, বাবা তুমি কিছু খাবে এখন?
– কি আর খাব? পারলে, একভাঁড় দই এনে দে।
– আচ্ছা বলে পিকলু বাইরে বেরিয়ে এল। বড় রাস্তার কাছে একটা দোকানে বসে সে একটা পাওরুটি আর এক প্লেট ঘুগনি নিয়ে খেল। পরে ফেরার সময় একটা মিষ্টির দোকান থেকে ২০০ গ্রামের দইয়ের একটা ভাঁড়, আর দু’টো বড় বড় রাজভোগ কিনে নিল। তারপর সেগুলি নিয়ে বাবার হাতে দিয়ে বলল, নাও খাও। পিকলু দেখল, সেগুলো দেখে বাবার চোখ চকচক করে উঠল, খুশিতে। যেন কতদিন খায়নি এসব, এইভাবে সে দই- মিষ্টি খেতে লাগল।
পিকলু বলল, বাবা তুমি খাও, আমি দেখে আসি ডাক্তার এসে অফিস রুমে বসেছে কিনা।
বাবা তৃপ্তি সহকারে খেতে খেতেই বললেন, আচ্ছা যা। আমাকে এখান থেকে ছুটি করিয়ে নিবি। কথাটা শুনে পিকলুর খুব কষ্ট হল। চোখ ছলছল করে উঠল। সে৷ কিছু জবাব না দিয়ে, বাবার কাছ থেকে উঠে, অফিস ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। অফিসের সামনে গিয়ে দেখতে পেল, ভিতরে দু’জন বসে আছেন। একজন মহিলা, একজন পুরুষ মানুষ। তারা নিজেদের মধ্যে কী কথা বলছিল। পিকলু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, ভিতরে আসতে পারি?
মহিলা বলল, আসুন।
পিকলু ভিতরে ঢুকতেই, এবার পুরুষ মানুষটি জানতে চাইল, কাকে চান?
– আমি ডাক্তার বাবুর সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই।
লোকটি এবার বলল, কি বলবেন বলুন? আমিই ডাক্তার।
পিকলু এবার তাকে নমস্কার করে বলল, আমি ১৭ নম্বর বেডের অনিল দাসের অসুখের ব্যাপারে জানতে চাই, কি হয়েছে তার?
– আপনি কে হন তার?
– ছেলে।
– ও আচ্ছা। আপনি কি জানেন, আপনার বাবা মদ খান?
– না। উনি আমাদের সঙ্গে থাকেন না। উনি কখন কোথায় থাকেন, তাও আমরা জানি না। উনি এখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে যাত্রা নাটক করে বেড়ান।
ডাক্তার বাবু সব শুনে বললেন, অনিল বাবু মদ খেয়ে খেয়ে লিভার আর কিডনির বারটা বাজিয়ে ফেলেছেন। কিডনি কাজ করছে না। ওনাকে বাঁচাতে হলে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করতে হবে। এখানে সে ব্যবস্থা নেই, আপনাকে শিলিগুড়ির বড় হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তা করাতে হবে।
– কত খরচ হবে তাতে? পিকলু জানতে চাইল।
– তা কম করেও পাঁচ- সাত লাখ টাকা লাগবে।
শুনে পিকলুর মাথাটা ঘুরে গেল। সে ভাবল পাঁ…..চ….. সা……ত…… লা…….খ !
এত টাকা কোথা থেকে জোগার হবে? সে আর ভাবতে পারে না।
সে ডাক্তার বাবুর কাছে সব শুনে বাইরে বেরিয়ে এল। বাইরে বেরিয়ে এসে প্রথমেই কলকাতায় কাকাকে ফোন করল। কাকা ফোন ধরতেই সে কাকাকে সব কথা যতটা সম্ভব গুছিয়ে বলার চেষ্টা করল। সে সব শুনে বলল, তুই বাবার সঙ্গে কথা, একটু ধর, আমি বাবাকে ডেকে দিচ্ছি।
একটু পরে ঠাকুর্দা এসে বলল, হ্যাঁ পিকলু বল, কি হয়েছে?
পিকলু আবার তাকে ডাক্তারের বলা সব কথা গুছিয়ে বলল। দাকুর্দা সব শুনে বলল, তুই অনিলকে এম্বুলেন্স করে কলকাতায় নিয়ে আয়।
যা করার এখানেই করা হবে।
পিকলু ডাক্তারের কাছে গিয়ে বলল, আমি বাবাকে কলকতায় নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাব। আমি বন্ড লিখে দিচ্ছি, আমি নিজ দায়িত্বে বাবাকে কলকাতা নিয়ে যাচ্ছি। আপনি বাবাকে ডিসচার্জ সারটিফিকেট লিখে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
রাতটা হাসপাতাল চত্বরে কাটিয়ে, পরদিন সকালেই হাসপাতাল কতৃপক্ষর সাথে কথা বলে, একটা এম্বুলেন্স ভাড়া করে পিকলু বাবাকে ময়নাগুড়ি থেকে কলকাতায় নিয়ে আসার ব্যবস্থা করল। সঙ্গে কিছু কলা ও আর পাউরুটি কিনে নিল, খাওয়ার জন্য।
কলকাতায় ফিরতে ফিরতে দুপুর হয়ে গেল।
স্থানীয় কাউন্সিলার বিশ্বনাথ বাবুর সঙ্গে ঠাকুর্দার কাউন্সিলার হবার আগে থেকেই ভাল জানা পরিচয় ছিল। ঠাকুর্দার তার সঙ্গে কথা বলে অনিলকে বাঙুর হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিতে বললেন। বিশ্বনাথ বাবু মানুষটি সহৃদয় এবং মানবদরদী। তিনি হাসপাতালের সুপারকে তার প্যাডে অনিলের ভর্তির জন্য সুপারিশ পত্র লিখে পাঠালোর হাসপাতালে ভর্তি করে নেবার জন্য। হাসপাতালের সুপারকে বিশেষভাবে জানাল, অনিল ভীষণ দুস্থ ও অসহায় পরিবারের একজন লোক, তাকে হাসপাতালে ভর্তি করে না নিলে, সে হয়তো বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে।
পিকলু সেই সুপরিশ পত্র সঙ্গে নিয়ে, স্থানীয় একটা ক্লাব থেকে এম্বুলেন্স ভাড়া করে, বাবাকে নিয়ে বাঙুর হাসপাতালে গেল। সুপার সুপারিশ পত্র পড়ে, হাসপাতালের আনুষ্ঠানিক কিছু নিয়ম কানুনের ফর্ম তাকে দিয়ে পূরণ করিয়ে নিয়ে, বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি হবার ব্যবস্থা করে দিলেন।
বাবাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে, কয়েকদিন কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে পারেনি পিকলু। কয়েকদিন পিকলুর দেখা না পেয়ে শাহিন মনে মনে খুব অস্থির হয়ে পড়েছিল। ভেবেছে, এমন কি হয়েছে যে পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে আসছে না? তার আবার কিছু হয়নি তো? আগে রোজই কম্প্যুটার সেন্টারে দু’জনের দেখা হত বলে, কেউই কারও ফোন নম্বর সেভ করে রাখার কথা ভাবেনি। আজ শাহিনের মনে হল, পিকলুর নাম্বারটা সেভ করা করে রাখলে, আজ আর তাকে এতটা দুশ্চিন্তায় পড়তে হত না। তার সঙ্গে কথা বলে সব জানা যেত। তার নাম্বারটা সেভ করে না রাখার জন্য, তার খুব আপসোস হতে লাগল মনে মনে।
পিকলুর মনটাও অস্থির হয়ে পড়েছে, শাহিনের সঙ্গে কয়েকদিন দেখা না হওয়ার জন্য। ভাবল আজ বাবাকে বাঙুর হাসপাতালে দেখে ফেরার সময় কম্প্যুটার সেন্ট্রারটা একবার ঘুরে আসবে।
প্রতিদিনই বিকেলে ভিজিটিং আওয়ার্সের সময় পিকলু বাবাকে হাসপাতালে দেখতে যায়। বাবার জন্য কোনদিন কলা কোনদিন আপেল বা সরবতী লেবু কিনে নিয়ে যায়। বাবা মাস দেড়েক হল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। এখন অনেকটা সুস্থ। কিডনি বদলাতে হয়নি। ডাক্তার বলেছে, নিয়ম মেনে চললে, আর ঔষুধগুলি নিয়মিত খেলে তাকে আর এখনই কিডনি বদলাতে হবে না। ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠবে সে।
বাবাকে দেখতে যাওয়ার সময় হাসপাতালের গেটে প্রায় প্রতিদিনই এক পাগলিকে দেখতে পায় পিকলু। পরনে শতছিন্ন শাড়ি, মাথার চুলে জট পাকিয়েছে। সারা গায়ে নোংরার আস্তরণ। কোন দিনই বোধহয় স্নান করে না। কাছে গেলে তার গা থেকে দুর্গন্ধ নাকে এসে লাগে। অনেকেই নাকে কাপড় চাপা দিয়ে ওর সামনে দিয়ে চলে যায়। পাগলিটা তা দেখে ফিকফিক করে হাসে। পিকলুর তাকে দেখে খুব মায়া হয়। সে কোনও কোনও দিন বাবার জন্য কেনা কলা, আপেল কিংবা সরবতী লেবু তাকে দিয়ে যায়। তা পেয়ে পাগলিটা যে কী খুশি হয়।
সেদিন বাবাকে দেখে ফেরার সময়, পিকলু দেখে বড় রাস্তা পার হতে গিয়ে পাগলিটা, বাইকের ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে গিয়ে, মাথায় চোট পেয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে।
বাইকটা ধাক্কা মেরেই দ্রুত গতিতে ছুটে পালিয়ে গেছে। পিকলু তা দেখে, পথচারী কয়েকজনকে ডেকে তাকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে তাকে ভর্তি করে দিল। সেদিন এখানেই এত দেরী হয়ে যাওয়ায় তার আর কম্প্যুটার সেন্ট্রারে যাওয়া হল না।
(চলবে…)