হৃদয়ে ফুটল কুসুম || পর্ব:৩

0
68

শংকর ব্রহ্ম

শ্রাবণ মাসের শেষ। তিনদিন ধরে টানা বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তা ঘাটে প্যাচপ্যাচে কাদা। হাঁটা দায়। এই ক’দিনের বৃষ্টিতে ঠাকির্দার ঠান্ডা লেগে জ্বর এসেছে। বুকে কফ জমেছে। রাতে তার কাশতে কাশতে ঘুম ভেঙে যায়। ভাল ঘুম হয় না। শরীরটা দুর্বল হয়ে পড়েছে। পিকলু তাকে স্থনীয় ডাক্তার অতুল হালদারের কাছে নিয়ে গেল। ডাক্তার তাকে পরীক্ষা করে দেখে বরলেন,  চিন্তার কোন কারণ নেই। বুকে কফ জমেছো। আমি ওষুধ লিখে দিচ্ছি। খাওয়ার পরে তিনবার করে খাবেন। জ্বরের জন্য তিনি ‘প্যারাসিটামল’, আর তার সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক ‘সেপটার্ম’ ট্যবলেট। আর একটা কাশির সিরাফ ‘কসোভো-এলএফ’ লিখে দিলেন তিনি। বললেন এগুলি খাওয়ার পর দিনে তিনবার করে খাবেন। কশির সিরাফ খাওয়ার পর আধ-ঘন্টা জল খাবেন না।  ওষুধগুলি খেয়ে তিনদিন পর এসে রোপোর্ট করবেন, পেশেন্ট কেমন আছেন। 

আচ্ছা বলে, আমি ঠাকুর্দাকে নিয়ে তার চেম্বার থেকে বেরিয়ে এলাম। তারপর ঠাকুর্দাকে বাসায় রেখে, তার জন্য প্রেসক্রিপশনে লেখা ওষুধগুলি কিনতে গড়িয়া গেলাম।

                    সেখানে দেখা হল পরিমলের সঙ্গে। পরিমল সাহা। হাইস্কুলে সে আমার সঙ্গে পড়ত। এখন মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিভ হিসাবে ওষুধের দোকানে ওষুধ সাপ্লাই করে। পুরনো দিনের অনেক গল্প হল তার সঙ্গে। তারপর ওষুধের দোকান থেকে বেরিয়ে, এককাপ চা খেয়ে, মোবাইল নাম্বার আদান প্রদান করে বিদায় নিলাম।

                    বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। তাই কয়েকদিন বাবাকে দেখতে হাসপাতালে যাওয়া হয়নি। বাবাকে আজ দেখতে যাব ভাবলাম।

                     কুলসুম কিছুদিন পিকলুকে কম্প্যুটার সেন্টারে  না দেখতে পেয়ে অস্থির হয়েে পড়ল মনে মনে।  ভাবল পিকলুর কিছু হয়নি তো? সে কম্প্যুটার সেন্টার থেকে পিকলুর ঠিকানা জোগাড় করে, তার এক সেখানকার বান্ধবীকে নিয়ে, ঠিকানা খুঁজে খুঁজে পিকলুদের বাড়িতে এসে হাজির। পিকলু বাড়ি ছিল না। বাবাকে দেখতে হসপিটালে গেছিল। ঠাকুর্দা তাদের দেখে বলল, কে মা তোমরা পিকলুকে খুঁজছো?

– আমরা কম্প্যুটার সেন্টার থেকে আসছি। ও অনেকদিন সেখানে যাচ্ছে না দেখে খোঁজ নিতে এসেছি।

– ওহ্, আচ্ছা। পিকলুর বাবা খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি আছে। সেখানে রোজ পিকলুকে যেতে হয়। তাই যেতে পারছে না।

– কি হয়েছে ওঁনার?

– কিডনি, লিভারের সমস্যা।

– তাই নাকি?

– হুম।

– এখন কেমন আছেন?

– ভাল আছেন।

– বেশ। ওকে বলবেন, আমরা এসেছিলাম।

– কি নাম তোমার?

– কুলসুম।

– তোমরা মুসলমান।

– হ্যাঁ আমি মুসলমান আর ও (পাশের মেয়েটিকে দেখিয়ে বলল, আমাদের বন্ধু হিন্দু। ওর নাম কাবেরী।

– বেশ। বলব।

                   হিন্দু মুসলমানের চিরন্তন এই সৌহার্দপূর্ণ মিলন দৃশ্যটি অবিনাশ বাবুর মনে খুব রেখাপাত করে। সত্যি সব মুসলমানরা তো খারাপ নয়। কিছু কিছু মানুষের জন্য তাদের সকলের বদনাম হয়।

                   পিকলু কয়েকদিন পর বাবাকে হসপিটালে দেখতে গেল। গিয়ে দেখল বাবা ভাল আছেন।

– তুই এতদিন আসিসনি কেন?

– ঠাকুর্দা অসুস্থ ছিল।

– কি হয়েছে বাবার?

– তেমন কিছু না। ঠান্ডা লেগে সর্দি কাশি জ্বর হয়েছিল।

– এখন কেমন আছে

– ডাক্তারের ওষুধ খেয়ে একটু সুস্থ আছেন এখন।

– আচ্ছা।

– তোমার কিছু লাগবে, এনে দেব?

– না, আমার কিছু লাগবে না।

                পিকলু বাবাকে দেখার পর ভাবল, একবার দেখে যাই, ওই মহিলা কেমন আছেন, যাকে পিকলু সেদিন হসপিটালে ভর্তি করে দিয়ে গিয়েছিল। সেখানে গিয়ে জানতে পারল, মহিলা বাইকের ধাক্কায় পিচ রাস্তায় পড়ে গিয়ে মাথা দারুণ আঘাত পাওয়ায় তার পুরনো স্মৃতি তিনি ফিরে পেয়েছেন। স্মৃতিভ্রংশ অবস্থা তার কেটে গেছে। তার মনে পড়ে গেছে, পুরনো দিনের সব কথা। তার স্বামী, তার দেওয়র, তার শ্বশুরের কথা মনে পড়ে গেছে। বাড়ি কোথায় তাও মনে পড়ে গেছে। 

                  হসপিটালে বলেছে, তার বাড়ি যাদবপুরের একটা উদ্বাস্তু কলোনীতে। শ্বশুরের নাম অবিনাশ সরকার। স্বামীর নাম অনিল সরকার, আর দেওয়রের নাম সুনীল সরকার।

এইসব শুনে পিকলুর বিস্ময়ের ঘোর কাটতে একটু সময় লাগল। মাকে চিনতে পেরে তার, মা গো বলে ডাক ছেড়ে পায়ে লুটিয়ে পড়তে ইচ্ছে হচ্ছিল তার। হসপিটালে এটা করলে বড্ড নাটকীয় হয়ে যাবে, বলে নিজেকে সে সংবরণ করে নিল। 

                   সে কর্মরত নার্সকে বললেন, উনি আমার মা হন। ওনাকে আমি এখান থেকে বাড়ি নিয়ে যেতে চাই।

– আপনিই না সোদিন ওনাকে এখানে ভর্তি করে দিয়ে গেছিলেন?

– হ্যাঁ।

– তখন তো বলেননি, উনি আপনার মা হন।

– আমি কি তখন জানতাম ছাই। 

– মানে?

– উনি আমার জন্মোর কয়েকদিন পরেই স্মৃতিভ্রংশ হয়ে, কাউকে কিছু না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলেন। বাবা কাকা কত খোঁজা-খুঁজি করেছেন, থানায়ও জানিয়েছিলেন, কোথায়ও পাননি।

– ওহ আচ্ছা

নার্স আলমারি থেকে একটা ফর্ম বের করে তাকে, পিকলুর নাম ঠিকানা লিখে, সেখানে পিকলুকে বন্ড সই করে, হসপিটালের রেজিষ্টারে সে সব নথিভুক্ত করে, তাকে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিলেন।

পিকলু তাকে নিয়ে এলেন বাড়িতে।

               ঠাকুর্দা পিকলুকে দেখে বললেন, কিরে তোর বাবা কেমন আছে এখন?

– বাবা ভাল আছে দাদাভাই।

– ইনি কে? 

– দেখ তো চিনতে পার কিনা?

ঠাকুর্দা চশমার কাঁচ মুছে, ভাল করে নিরক্ষণ করে বললেন, দেখে তো খুব চেনা চেনা লাগছে। অনিলের বউ প্রতিমা বলে মনে হচ্ছে যেন। 

– বাবা বলে মহিলা এবার ঠাকুর্দার পায়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ঠাকুর্দা তাকে দু’হাত দিয়ে তুলে বুকে টেনে নিলেন।

পিকলুকে বললেন, কোথায় পেলি একে?

পিকলু তাকে সব ঘটনা খুলে বলল।

ঠাকুর্দা শুনে প্রতিমাকে বলল, এতদিন কোথায় ছিলিস মা?

– জানি না বাবা

– কি করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছিলিস তুই?

– কিছু মনে নেই আমার।

আচ্ছা, চল চল, ঘরে চল। বলে ঠাকুর্দা তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন।

            ঠাকুরদা মোটেই আস্তিক নয়, বরং তাকে  যুক্তিবাদী নাম্তিক বলেই মনেহয় আমার। তবুও তিনি এসময় দু’হাত উপরের দিকে তুলে বললেন,  অসীম কৃপা তোমার। তোমার লীলা বোঝা ভার। প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই বোধহয় এইরূপ দ্বিধা দ্বৈরথ দন্দ্ব কাজ করে।

           এর কিছুদিন পর বাবাও সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে এলেন। তাকে হসপিটাল থেকে খাওয়ার জন্য প্রেসক্রিপশনে কতগুলি ওষুধ লিখে দিয়েছেন ডাক্তারবাবু। আর কতগুলি খাবার খেতে বারণ করে দিয়েছেন। বাবাকে বলেছেন, নিয়ম মেনে  চললে, আর ওষুধগুলি ঠিক মতো খেলে সুস্থ থাকবেন আপনি।

             হঠাৎ লটারীর টিকিটে প্রথম প্রাইজ পেলে, যেমন কোন লোকের খবই আনন্দ হয়। মা বাবাকে একসঙ্গে কাছে পেয়ে, পিকলুরও তেমন খুশির জোয়ার আসে মনে। মায়ের সান্নিধ্য সে তো কোনদিনই পায়নি। বাবাকেও কাছে পায়নি সে কোনদিন তেমনভাবে। পিসির কাছে থেকেই সে মানুষ হয়েছে বলা যায়। মা বাবাকে একসঙ্গে হঠাৎ করে, কাছে পেয়ে যেন পিকলুর হাতের মুঠোয় আচমকা চাঁদ সূর্য এসে ধরা দিয়েছে। পিকলুর জীবনটাই একেবারে যেন বদলে যেতে শুরু করেছে। আজকাল তার মন-মেজাজটা সব সময়ই ফুরফুরে থাকে।

                বড় ছেলে আর তার বৌকে ফিরে পেয়ে অবিনাশ সরকার খুব খুশি হলেন। তিনি ভাবতে পারেননি তাদের আবার কাছে পাবেন কখনও।

তার জীবনে তাই অনেকটা সানন্দ ফিরে এসেছে।

             বাবা ফিরে আসার কিছুদিন পর, ঠাকুর্দা একদিন মায়ের সামনেই বাবাকে বললেন, কিরে হারামজাদা, তোর নতুন বউটা কোথায় এখন?

ঠাকুর্দার কথা শুনে,  বাবা বললেন, আমি অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি হওয়ার পরই সে আমায় ছেড়ে পালিয়ে গেছে।

 ঠাকুর্দা তখন মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, জানো বউমা, হারামজাদা আবার একটা বিয়ে করে এখানে এনে তুলতে চেয়ে ছিল। আসার সঙ্গে সঙ্গে আমি ওদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছি। 

মা শুনে বলল, ও বিয়ে করলে, আমি সতীন নিয়েও সংসার করতে কোনও আপত্তি করতাম না। কারণ, আমি তো জানি, আমায় ছাড়া ওনার থাকতে কত কষ্ট হয়েছে। তাছাড়া আমি যে আমার ফিরে আসব, তারও কোন নিশ্চয়তা ছিল না।

ঠাকুর্দা মার এই শুনে বাবাকে বললেন, দ্যাখ প্রতিমা তোকে কত ভালবাসে। 

ঠাকুর্দার কথা শুনে, বাবা চুপ করে, অপরাধীর মতো মাথা নীচু করে রইলেন।

                সরকার থেকে বাঘাযতীনে ঠাকুরদার নামে দোকানের জন্য একটু গুমটি ঘর তৈরী করে দিয়েছে। সেখানে গিয়ে বাবা নতুন করে দোকানের মালপত্র সাজিয়ে নিয়ে বসা শুরু করলেন।

               ঠাকুর্দার কথা মতো, বাড়িতে দেওয়া  চা-ঘুগনি, বিড়ি-সিগারেটের দোকানটাও আজকাল ভাল চলে কাকার। বাবাও আর আগের মতো উড়নচন্ডী নেই। অনেকটা সংসারী হয়েছে। সংসারে সাচ্ছন্দ ফিরে এসেছে।

               মা তো তার সংসার ফিরে পেয়ে, খুবই খুশি। কাকিমার সঙ্গে তার ভাব হয়েছে খুব।   সংসারের সব গুরুত্বপূর্ণ কাজ কর্ম মায়ের মত না নিয়ে করে না কাকিমা। ফলে সংসারে কোন অশান্তি নেই। ঠাকুর্দাও আগের চেয়ে অনেক চনমনে হয়ে উঠেছেন মনে-প্রাণে। 

                  কম্প্যুটার সেন্টারে অনেকদিন যাওয়া হয়নি পিকলুর। তাই সে ভাবল আজ একবার কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে ঘুরে আসবে। সন্ধ্যার সময় সেখানে গেল পিকলু। সেখানে গিয়ে পুরনো বন্ধু অনেকের সঙ্গেই তার দেখা হয়ে গেল। এতদিন পর তাকে সেখানে দেখে কেউ কেউ তার এতদিন অনুপস্থিতির কারণ জানতে চাইল। পিকলু তার বাবার অসুস্থতার কথা বিস্তারিতভাব তাদের সকলকে জানাল। এখন কেমন আছে বাবা, তারা জানতে চাইলে, পিকলু বলল, এখন তিনি ভাল আছেন আগের চেয়ে অনেকটাই। পিকলু আশা করেছিল, আজ এখানে অনেকদিন  কুলসুমের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্ত তার সঙ্গে দেখা হল না। দেখা না হওয়ার সে মনে মনে হতাশ হল খুব। ভেবেছিল, কুলসুমের সঙ্গে দেখা হলে তার মাকে ফিরে পাওয়ার রোমাঞ্চকর কাহিনি শুনিয়ে সে তাকে  তাক লাগিয়ে দেবে। ঠাকুর্দার কাছে সে শুনেছে, কুলসুম কম্প্যুটার সেন্ট্রারের একজনকে নিয়ে তাদের বাড়িতে তার খোঁজ করতে গেছিল।

         এবারের পুজোটা সবাই মিলে খুব আনন্দে কাটল। অষ্টমীর দিন মা আর কাকিমা অঞ্জলী দিতে মন্ডপে গেল। অনেকে পুজো মন্ডপে মাকে দেখে খুব উচ্ছ্বাস প্রাকাশ করল। ওদের উচ্ছ্বাসের প্রকাশ দেখে মাও ভীষণ আপ্লুত হল। নবমীর দিন পাড়ায় অরন্ধন পালন হল। সকলে মিলে প্যান্ডেলে নিরামিশ খাওয়া-দাওয়া হল। ফ্রাইড-রাইস, আলুর দম, খেজুর-আমসত্ত্বের চাটনি, পাঁপর আর একটা করে বড় কমলাভোগ।ঠাকুর্দা ছাড়া বাড়ির আর সকলে গেছিল। ঠাকুর্দা সেদিন বাড়িতে দুধ মুড়ি কলা খেয়েছিল।

দশমীর দিন মা আর কাকিমা একটা ঠাকুরের থালায়, সন্দেশ ও তেল সিঁদুর নিয়ে দুর্গা-মাকে বরণ করতে গেল। সেখানে গিয়ে লাইন দিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মাকে সিঁদুর পরিয়ে, মিষ্টি মুখ করিয়ে, সকলের সঙ্গে আনন্দ করে সিঁদুর খেলে ওরা বাড়ি ফিরলেন, খুশি মনে।

                    ঠাকুর্দার পায়ে ইদানিং বাতের ব্যথা শুরু হয়েছে। সকালে ঘুম থেকে উঠে, তিনি বারান্দায় এসে রোদে বসেন একটা টুল পেতে। মা এসে তার পায়ে, তেল গরম করে এনে মেখে দেন যত্ন করে। দাদুর তাতে খুব আরাম হয়। তখন তার মনে পড়ে উমারানীর কথা। তার স্ত্রী। সেও ঠাকুর্দার পায়ে এভাবে তেল মেখে দিতেন একসময়। যখন বরিশালের দেশের বাড়িতে, ঠাকুর্দা গ্রামে গ্রামে ঘুরে পাইকারী দরে নারকেল সুপারি কিনে এনে গঞ্জের হাটে বিক্রি করে, ক্লান্ত হয় সন্ধ্যায বাড়ি ফিরতেন। বের হতেন সকালে  কাঁচালঙ্কা আর পেঁয়াজ দিয়ে পান্তা ভাত খেয়ে।

তখন সবে অনিলের (বাবার নাম) জন্ম হয়েছে।

সুনীল আর বুড়ির জন্ম হয়নি। দিনগুলি কী সুন্দর কাটছিল তখন। তারপর একে একে সুনীল বুড়ির জন্ম হল। ধীরে তার পরিশ্রমের শক্তি কমে এলো। আগের মতো অত গ্রাম ঘুরে সুপারি নারকেল কিনতে পারতেন না। সল্প মাল নিয়েই গঞ্জের হাটে বেচে আসতেন। তাতেও সংসার চলে যাচ্ছিল কষ্টে আনন্দ করে। একদিন বাগানে পাঁকা পেঁপে গাছ থেকে আঁকশি দিয়ে পাড়তে গিয়ে, সাপের কামড় খেয়ে উমারানী ঘরে ফিরল। তখন গ্রামে কোন ডাক্তার বদ্দ্যি ছিল না তেমন। তাই সাপের বিষ ঝাড়ার ওঝা ডেকে আনলেন ঠাকুর্দা। ওঝা নানা চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না। বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। তার কথা খুব মনে পড়ছে আজ এতদিন পর। ঠাকুর্দা ভাবতে ভাবতে। সুদূর অতীতকালে চলে গেছিলেন তিনি। 

              রোদ সরে গেছে। চলুন এবার ঘরে দিয়ে বসবেন। মায়ের কথায়  তন্ময়তা কাটল তার। 

– হ্যাঁ, চলো। বলে ঠাকুর্দা টুল থেকে উঠে, মায়ের হাত ধরে, নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন।

                  কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে যেতে ভাবছিল শাহিন, বেশ কিছুদিন ধরে পিকলুর সঙ্গে দেখা না হওয়ায় মনটা তার উদ্বিগ্ন ছিল। বাড়িতে গিয়েও পিকলুর দেখা পায়নি। শুনে এসেছে তার বাবা অসুস্থ হয়ে হসপিটালে ভর্তি আছেন বলে, সেখানে তাকে যাতায়াত করতে হচ্ছে, তাই পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে যেতে পারছেন না। 

এখনও কি তাহলে তার বাবা সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেননি। এসব কথা ভাবতে ভাবতেই আর একটা কথা তার মনে হল, আচ্ছা সে যে দিন দিন পিকলুর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়ছে, এর পরিণতি কি? তার বাবা মা তো, হিন্দু ছেলেকে তার হাসবেন্ড হিসাবে কখনোই মেনে নেবে না, তাদের প্রাণ থাকতে। কারণ তারা খুব ধর্মপ্রাণ মানুষ। আল্লা অন্ত তাদের প্রাণ, মান। তাহলে উপায়?

ঘর থেকে পালিয়ে সংসার গড়া ছাড়া তার কোন উপায় থাকবে না। তাছাড়া পিকলুর বাড়ি থেকে যে তাদের সম্পর্ক মেনে নেবে, তারই বা নিশ্চয়তা কি? এইসব ভাবতে ভাবতে কুলসুমের মাথাটা ঝিমঝিম করছিল। সে অন্যমনস্ক হয়ে পথ হাঁটছিল, এমন সময় পাশের গলি থেকে একটা মোটরবাইক, কোন হর্ণ না দিয়েই, আচমকা বেরিয়ে এসে শাহিনকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে দ্রুতগতিতে পালিয়ে যায়। কয়েকজন পথচারী এসে তাকে তুলে ধরে বসায়। কোমড়ে ভীষণ চোট লেগেছে তার, দাঁড়াবার উপায় নেই।

উঠে বসে শাহিন দেখে, তার হাতের ব্যাগটা দূরে ছিটকে পড়েছে। তার কথায় একজন ব্যাগটা সেখান থেকে তুলে এনে তার হাতে দেয়। কুলসুম ব্যাগটা খুলে মোবাইল বের করে, বাবকে ফোন করে, তার অ্যাক্সিডেন্টের কথা জানায়। খবরটা শুনে তার বাবা উদভ্রান্তের মতো ছুটে আসেন।  একটা ট্যাক্সি ধরে তাকে পার্কসার্কাসের ট্রাই নামে একটা নার্সিংহোমে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করান।

                  পরদিন পিকলু কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে শোনে কুলসুমের বাইক অ্যক্সিডেন্ট হয়েছে। সে এখন পার্কসার্কাসের একটা নার্সিংহোমে ভর্তি আছে। এই শুনে পিকলু কম্প্যুটার সেন্টার থেকে বেরিয়ে কুলসুমদের দরগারোডের বাড়িতে চলে যায়। সেখান থেকে নার্সিংহোমের ঠিকানা ও বেড নাম্বার নিয়ে কুলসুমের সঙ্গে দেখা করতে ছোটে।

পিকলুকে নার্সিংহোমে দেখে কুলসুমের বুকের ভিতরে অভিমানের মেঘ জমে। কান্না পায়। বৃষ্টির মতো ঝরঝর করে ঝরে পড়তে চায়। কিন্তু সে তা পারে না। কষ্টটা বুকের মধ্যে চেপে রেখে সে মলিন হেসে পিকলুকে বেডের পাশের টুলটা দেখিয়ে বলে, বসো। 

– কে খবর দিল, এখানকার?

– কম্প্যুটার সেন্টারে গিয়ে তোমার অ্যাক্সিডেন্টের খবর পেয়ে, তোমাদের বাড়িতে গেছিলাম। সেখান থেকে এখানকার ঠিকানা ও বেড নাম্বার পেয়েছি।

শুনে কুলসুমের বুকের ভিতরটা খুশিতে ভরে উঠল। খুশির জোয়ারে বুকের জমা মেঘ যেন কোথায় ভেসে গেল। তার কথা এভাবে কেউ একজন ভাবে, এমন কেউ একজন আছে তার জন্য !  এই ভাবনার সৌরভ তার সারা মন জুড়ে রইল, যতক্ষণ পিকলু তার কাছে রইল।

আবার আসব, বলে পিকলু সেদিনকার মতো বিদায় নিল।

                 কুলসুম দু’সপ্তাহের বেশি নার্সিংহোমে ভর্তি ছিল। পিকলু মাঝে মাঝেই তার সঙ্গে দেখা করতে গেছে। একদিন কুলসুমের সঙ্গে দেখা করে ফেরার সময় পিকলুর স্কুলের বন্ধু পরিমল সাহার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। পরিমল ডাক্তারের সঙ্গে দেখা করে তাদের কোম্পানীর ওষুধ পেশেন্টদের প্রেসক্রাইব করার জন্য, ফ্রি স্যাম্পেল দিতে এসেছিল।

                পরিমল তাকে দেখে বলল, কিরে তুই এখানে?

– আমার পরিচিত একজন এখানে ভর্তি আছে। তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলাম। 

– আচ্ছা। কেমন আছিস তুই? কোন তাড়া নেই তো তোর? চল একটা চায়ের দোকানে বসে একটু চা খাই।

– না তেমন কোন তাড়া নেই। চল।

                   হাঁটতে হাঁটতে তারা পার্কসার্কাস চার নম্বর ব্রীজের কাছে এসে একটা চায়ের স্টলে এসে দু’কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে পরিমল পিকলুকে বলল, এখন তুই কি করছিস?

– কিছুই না। একটা কম্প্যুটার সেন্টারে আছি।

– আচ্ছা, তুই কম্প্যুটার জানিস? আমাদের কোম্পানীতে একজন কম্প্যুটার জানা লোক নেবে। তুই করবি?

– করব না কেন? তুই কথা বলে দেখ।

– আচ্ছা, তবে তুই কাল সকাল দশটার মধ্যে আমার সঙ্গে গড়িয়াহাটা মোড়ে ট্রেডার্স এসেম্বির নীচে দেখা কর।

– আচ্ছা। 

ওরা টি-স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে মাটির ভাড়ে চা খেয়ে, ভাড় দু’টি সামনে রাখা টিনের ড্রামে ফেলে দিল। পরিমল চায়ের দাম মিটিয়ে দিয়ে, পিকলুকে বলল, আচ্ছা আজ চলি তাহলে। কাল ঠিক সকাল দশটায় দেখা হচ্ছে।

– একদম। টা টা … 

(চলবে…)

Previous articleআন্দোলনভূমি
Next articleপড়ে ছড়া মজায়
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here