মোঃ আসিফুর রহমান
চারদিকে নিস্তব্ধতার কালো পর্দা ঝুলে আছে। আকাশের নীলিমায় হতাশার আলপনা যেন অদৃশ্য কালিতে আঁকা। ছাত্রসমাজের চোখে-মুখে চিন্তার গভীর রেখা। তাদের হৃদয়ে প্রশ্নের ঝড়—কী করবে তারা? কোন পথে এগোবে? স্বপ্নের ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যেন দুরূহ। অর্থবিত্তের ঘরের সন্তানেরা বিদেশের মাটিতে নতুন জীবনের স্বপ্ন বোনে। কিন্তু মধ্যবিত্তের সন্তানেরা? তারা দিশেহারা পথিকের মতো—না দেশে প্রতিষ্ঠার পথ, না বিদেশে স্থিতির আশা।
নিলয়ের মনেও এমনই হাজারো চিন্তার জট পাকিয়ে উঠছে। তার পরিবারের সঙ্গে সে পরিকল্পনা আঁটে—কীভাবে দেশের সীমানা পেরিয়ে নতুন জীবন গড়া যায়। কিন্তু দেশের মাটিতে স্বপ্নের ভিত শক্ত করার আশা ক্রমশ ম্লান হয়ে আসে। সাম্প্রতিক সময়ে সুপ্রিম কোর্ট থেকে কোটা পদ্ধতির আইন পাস হয়েছে। এই আইনে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান ও নাতি-নাতনিদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ফলে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। তাদের আস্থা ভেঙে চুরমার। সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় তাদের মনে গেঁথে যায়।
নিলয়ের মতো হাজারো তরুণের মনে একই প্রশ্ন—কেন এমন বৈষম্য? কেন তাদের স্বপ্নের পথে কাঁটা বিছানো? ছাত্রসমাজের মধ্যে ক্ষোভের আগুন জ্বলে ওঠে। তারা আর চুপ থাকতে পারে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ থেকে মিছিলের ঢেউ ওঠে। ছাত্রজনতা রাস্তায় নেমে আসে, দাবি আদায়ের অঙ্গীকারে অটল। তাদের কণ্ঠে একটাই সুর—ন্যায়বিচার।
কিন্তু আন্দোলনের পথ কখনো মসৃণ নয়। ছাত্রজনতার মিছিলে বাধা আসে। ছাত্রলীগের সঙ্গে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। রাস্তায় উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন শিক্ষার্থী আহত হয়। রক্তের দাগ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনা প্রধানমন্ত্রীর নজর এড়ায় না। তিনি টেলিভিশন, পত্রিকা ও সামাজিক মাধ্যমে এই সংঘাতের খবর দেখেন। জাতির উদ্দেশে তিনি বক্তৃতা দেন, শান্তি ও সমঝোতার আহ্বান জানান।
কিন্তু তাঁর বক্তব্য বিকৃত হয়ে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ফেসবুক, টিকটক, ইউটিউবে মিথ্যা খবরের ঝড় ওঠে। কেউ বলে, ছাত্র নিহত হয়েছে। কেউ বলে, সরকার নিপীড়ন শুরু করেছে। এই প্রচারণা আন্দোলনের আগুনে ঘি ঢেলে দেয়। সারা দেশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজনতা আরও বেগে মাঠে নামে। আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে।
এই বিশৃঙ্খলার সুযোগ নেয় বিরোধী রাজনৈতিক গোষ্ঠী। তারা ছাত্রদের আন্দোলনকে ঢাল করে নিজেদের উদ্দেশ্য হাসিলে মেতে ওঠে। সামাজিক মাধ্যমে মিথ্যা প্রচারণা আরও জোরালো হয়। বিশ্ব মিডিয়াও এতে যোগ দেয়। আন্দোলন যেন আরও বেগবান। প্রধানমন্ত্রী চাপের মুখে পড়ে ছাত্রদের দাবি মেনে নেন। তিনি আশ্বাস দেন, সুপ্রিম কোর্ট থেকে ছাত্রদের পক্ষে রায় আসবে। কিন্তু বিরোধীদের প্ররোচনায় ছাত্ররা থামে না। তাদের আন্দোলন আরও তীব্র হয়।
নিলয়, তানিশা, নির্জন ও দিয়া এই আন্দোলনে যোগ দেয়। রাস্তায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংঘর্ষে তারা অটল। তাদের কণ্ঠে ন্যায়ের দাবি, মনে অটুট সংকল্প। হঠাৎ একটি ইট এসে নিলয়ের কপালে আঘাত করে। রক্ত ঝরতে থাকে। তানিশা ভয় পেয়ে নিজের ওড়না ছিঁড়ে তার কপালে বেঁধে দেয়। কিন্তু নিলয়ের মনোবল অটুট। সে শপথ নেয়, “কোটা পদ্ধতি উঠে না যাওয়া পর্যন্ত আমি মাঠ ছাড়ব না।”
দিয়া হেসে বলে, “আন্দোলন শেষ হলে এই বর্ষায় আমরা নৌকা ভ্রমণে যাব।” নিলয় জবাব দেয়, “বিজয় এলে আমরা ঘুরতে বেরোব।” তাদের মনে আশার আলো জ্বলে ওঠে। প্রবল আন্দোলনের মুখে সুপ্রিম কোর্ট ছাত্রদের পক্ষে রায় দেয়। বিজয়ের উল্লাসে মেতে ওঠে তারা। কোটা পদ্ধতি উঠে যায়। ছাত্রদের স্বপ্নের পথে আর কাঁটা থাকে না।
বর্ষার সন্ধ্যায় নিলয়, তানিশা, নির্জন ও দিয়া নৌকা নিয়ে বিলের জলে ভেসে বেড়ায়। চারদিকে শাপলা-পদ্মের মেলা। প্রকৃতির নির্মল রূপ তাদের মনকে আনন্দে ভরিয়ে তোলে। নৌকায় খাবারের আয়োজন। তারা গান ধরে, একসঙ্গে তাল মেলায়। আহা, কী আনন্দ! বিলের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ঘুরতে ঘুরতে তারা দেখে, গ্রামের যুবকেরা জাল ফেলে মাছ ধরছে। কেউ ভেসালে, কেউ ছিপে। শাপলার মাঝে মাছের ঝাঁক। হঠাৎ একটি বড় মাছ ভেসে ওঠে। দিয়া চিনতে না পারলেও নির্জন বলে, “এটা শৈল টাঁকি মাছ।”
সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ে। বিলের জলে ঘুরতে ঘুরতে তারা অনেক দূর চলে আসে। প্রকৃতির এই নির্মল আলিঙ্গনে তাদের মন শান্ত। কিন্তু হঠাৎ নিলয়ের ফোনে খবর আসে—শহরে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুজন নিহত, অনেকে আহত। সে জাতীয় সংবাদমাধ্যমে খোঁজ নেয়। দেখে, দেশের বিভিন্ন স্থানে হতাহতের ঘটনা। নির্জন অবাক হয়ে বলে, “আমাদের দাবি তো পূরণ হয়েছে, তবে ওরা কেন আন্দোলন থামাচ্ছে না?” নিলয় জবাব দেয়, “ওরা নতুন চৌদ্দ দফা দাবি নিয়ে মাঠে নেমেছে। এবার তারা সরকার পতনের ডাক দিয়েছে।”
আন্দোলন থামে না। বিরোধী দলগুলো—বিএনপি, জামায়াতে ইসলাম, হেফাজত ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদ—যোগ দেয়। ধ্বংসলীলা শুরু হয়। অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুরে দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মেট্রোরেল, বিটিভি ভবন—কিছুই রক্ষা পায় না। থানায় অগ্নিসংযোগ, অস্ত্র লুটপাট। আনুমানিক ছয়শত থেকে সাতশত ছাত্র নিহত হয়। পুলিশ, র্যাব সদস্যরাও প্রাণ হারায়। সিরাজগঞ্জে একদিনে চৌদ্দ পুলিশ নিহত। এক গর্ভবতী পুলিশ সদস্য বাঁচার আকুতি করেও রক্ষা পায় না। দেশ যেন বিশৃঙ্খলার আগ্নেয়গিরিতে।
আন্দোলন সরকার পতনের ডাক দেয়। ছাত্রজনতা ও বিরোধী দল গণভবন ঘিরে ফেলে। সরকার বাধ্য হয়ে পদত্যাগ করে। রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে সরকারপ্রধান ভারতে চলে যান। আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে। কিন্তু দেশের ক্ষতি অপূরণীয়।
নিলয়, তানিশা, নির্জন ও দিয়া এমন বৃহৎ আন্দোলন কখনো দেখেনি। বইয়ের পাতায় পড়া আন্দোলনের গল্প যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে। দিয়া বলে, “আমাদের উপমহাদেশে ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহ হয়েছিল, প্রথম মহাবিদ্রোহ।” তানিশা জানতে চায়, “কী ঘটেছিল তখন?” দিয়া বর্ণনা শুরু করে। সে বলে, “ব্রিটিশদের বৈষম্য, শোষণ আর .৩০৩ রিভলবারের কার্তুজ—যা গরু ও শূকরের চর্বি দিয়ে তৈরি—হিন্দু-মুসলিম সিপাহিদের ক্ষোভ জাগায়। তারা বিদ্রোহ করে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে।”
নির্জনও যোগ দেয়। সে বলে, “১৮৫৭ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত বাংলায় ছোট-বড় অনেক আন্দোলন হয়। ১৯০৫-এ বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, ১৯১১-তে তা রদ। তারপর ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২-তে রফিক, শফিক, সালাম, বরকতের রক্তে বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়।” সে থামে না। বলে, “এরপর ছয় দফা, এগারো দফা, ১৯৭১-এ স্বাধীনতার যুদ্ধ। বাঙালি কখনো দমে না।”
নিলয় বলে ওঠে, “আমাদের দেশ সংগ্রামের দেশ। বাঙালি রক্ত দিতে ভয় পায় না।” তানিশা, নির্জন, দিয়া একসঙ্গে বলে, “এ দেশে শুধু আন্দোলন। নাম রাখি—আন্দোলনভূমি!” নিলয় সম্মতি জানায়। সবাই চিৎকার করে বলে, “আমরা আন্দোলনভূমির সন্তান!”