শংকর ব্রহ্ম
পরিমলের সহায়তায় তাদের ‘সেভ লাইভ’ ওষুধের কোম্পানীতে কম্প্যুটারে কাজেের চাকরিটা হয়ে গেল পিকলুর। সকাল দশটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত ডিউটি। সপ্তাহে রবিবার বন্ধ থাকে কোম্পানী। অর্থাৎ সেদিন ছুটি থাকবে পিকলুর। প্রথম একবছর শিক্ষানবিশ (apprentice) হিসাবে কাজ শিখতে হবে। বৃত্তি (stipend) পাবে মাসে তিন হাজার টাকা করে। পিকলু কাজে লেগে গেল।
প্রথম মাসে তিন হাজার টাকা পেয়ে, পিকলু এনে ঠাকুর্দার হাতে তুলে দিল। ঠাকুর্দাই তাকে কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হবার সময়, ভর্তির জন্য টাকাটা ব্যাঙ্ক থেকে তুলে এনে পিকলুকে না দিলে, তার কম্প্যুটার শেখা হত না।
মাসের প্রথম বৃত্তিটা তুলে এনে ঠাকুর্দার হাতে দেওয়ায়, ঠাকুর্দা খুব খুশি হলেন।
নিজের কাছে দু’হাজার টাকা রেখে, পিকলুকে এক হাজার টাকা ফেরৎ দিয়ে বললেন, এটা তোর কাছে রাখ। তোরও তো কিছু খরচ আছে।পিকলু জানে, পায়ে হাত দিয়ে কেউ ঠাকর্দাকে প্রণাম করলে, ঠাকর্দা খুব খুশি হন। পিকলু তাই টাকাটা হাতে নিয়ে, ঠাকুর্দাকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল। ঠাকুর্দা পিকলুকে বুকে টেনে নিয়ে, মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করে বললেন, সুখি হও বাছা। দীর্ঘজীবী হও।
পুজোর পর এবার শীতটা পড়েছে বেশ জাকিয়ে। মাঝে মাঝেই কনকনে ঠান্ডা বাতাস ছুটে এসে শরীর কালিয়ে দিচ্ছে। ঠাকুর্দার বাতের ব্যথাটা আবার ক’দিন ধরে বেড়েছে। হাঁটতে গেলে পায়ে ব্যথা লাগে। তাই কেউ এনে তাকে বাইরে রোদে বসিয়ে না দিলে, তিনি একা ঘর থেকে হেঁটে এসে বসতে পারেন না। কাকিমা কাকার দোকানে কাকার সহয়তা করতে গেছে।
সকালে কাকার দোকানে খরিদ্দারের চাপটা একটু বেশি থাকে, তাই কাকামি সেসময় সেখানে গিয়ে কাকার সহায়তা করে। কখনও খরিদ্দারদের কাছে খাবার এগিয়ে দেয়। আবার কখনও খরিদ্দারদের কাছ থেকে হিসেব করে পাওনা টাকা বুঝে নিয়ে ক্যাশবাক্সে রাখে।
মা রান্নাঘরে রান্নার কাজে ব্যস্ত। আজ রবিবার। পিকলুর অফিস ছুটি। সে ঘর থেকে বারান্দায় এনে রোদে টুলে বসালেন ঠাকুর্দাকে। তিনি প্রসন্ন হয়ে , তার হাতের হাঁটার লাঠিটা ডান পাশে রেখে, পিকলুকে বাঁ পাশের ছোট জলচৌকিটা দেখিয়ে বললেন, বস এখানে। পিকলু তার কথা মতো সেখানে বসার পর, ঠাকুর্দা তাকে বললেন, কেমন চলছে তোর অফিস?
– ভালই।
– মন দিয়ে কাজ কর। চাকরি-বাকরি স্থায়ী হলে, তোর বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে শুরু করব।
– সে চেষ্টা কোরো না দাদাভাই।
– কেন? কারও সাথে কিছু …. এইটুকু বলে, ঠাকুর্দা চোখ তুলে পিকলুর দিকে তাকাল।
– আচ্ছা আমি যদি প্রেম করে কাউকে বিয়ে করি, তুমি কি রাগ করবে তাহলে?
– রাগ করব কেন? বেজাতের মেয়ে না হলেই হল।
– বেজাত মানে?
– হিন্দু নয় এমন কোন মেয়ে
– মুসলমান হলে?
– হারামজাদা, তাহলে তোকে আমি বাড়ি থেকে দূর দূর করে তাড়াব।
– আচ্ছা দাদাভাই, তোমার এত মুসলমানদের প্রতি রাগ কেন?
– ওদের জন্যই তো আমাদের দেশ ছাড়তে হয়েছে।
– দেশ কি তোমার জায়গা জমি ছিল।
– না ছিল না।
– তাহলে থাকতে কোথায়?
– সনাতন হাজরার একটা বড় সুপারি বাগান ছিল। তার অনুমতিতে সেখানেই একটা চালা ঘর তুলে তার অনুমতিতে বসবাস করতে লাগলাম। তারপর তোর ঠাকুমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। সেখানেই তার সঙ্গে থাকতাম।
– ঠাকুরমাকে তুমি পেলে কোথায়?
– তোর ঠাকুরমার মা সনাতন হাজরার বাড়িকেই কাজ করত। সে আমাকে খুব পছন্দ করত। সনাতন হাজরার কাছে সে তার মনের কথা জানায়। সনাতন বাবুর আন্তরিক প্রচেষ্টাতেই আমাদের বিয়েটা হয়ে যায়। সেই ঘরেই খুব সুখে দিন কাটছিল আমাদের। সেই চালাঘরেই তোর বাবা কাকা আর পিসিমার জন্ম হয়। একদিন সাপের কামড়ে তোর ঠাকুমার মৃত্যু হয়। তাকে বাঁচানো যায়নি।
– তবে তোমরা সে দেশ ছেড়ে চলে এলে কেন?
– সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হওয়ার পর, যখন বরিশাল জিন্নার পূর্ব পাকিস্থান হয়ে গেল। তখন সনাতন বাবু কি ভেবে, তারপরই মাকির হায়দারের সঙ্গে পারস্পরিকভাবে জমি হস্তান্তর করে এদেশে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ঘুটিয়ারি শরিফে চলে আসেন। জমির দখল নিয়ে মাকির হায়দারের আমাদের বাগান ছেড়ে উঠে যেতে বলেন। তখন কি করব? বুঝলাম আমাদের মতো অসহায় হিন্দুদের এদেশে থাকা নিরাপদ হবে না।
সেই কথা ভেবেই দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। অনেক অমানসিক কষ্ট আসার পথে সহ্য করে এদেশে এসে পৌঁছালাম। তারপর শিয়ালদহ স্টেশনে এসে কিছুদিন নরক যন্ত্রণা ভোগ করলাম। সে সময় তুই কোথায়? তোর বাবার বিয়েই হয়নি।
– তারপর?
– তারপর শিয়ালদহ স্টেশনে একদিন রেল পুলিশের কাছে বেধরক মার খাওয়ার পর, স্টেশন ছেড়ে পালিয়ে, কালীঘাটের পোড়াবস্তিতে একটা বস্তির ঘরে ভাড়ায় এসে উঠলাম। তোর বাবা হাজরার একটা সিগারেট বিড়ির দোকানে কাজ পেয়েছিল। সেখানেই বস্তির অনাথ একটা মেয়ের সঙ্গে তোর বাবার বিয়ে দিলাম। মেয়েটার বাবা মা কেউ ছিল না, পিসির কাছে থাকত মেয়েটা। ওর পিসি বাজারে সব্জি বেজে সংসার চালাত। খুব কষ্টে চলত ওদের। ওর পিসি একদিন আমাকে বলল, ওদের অবস্থার কথা জানিয়ে ওর মেয়েটার একটা গতি করতে, বিয়ের জন্য একটা সুপাত্র জোগাড় করে দিয়ে। শুনে আমি মনে মনে ভাবলাম, অনিলের সঙ্গে মেয়েটার বিয়ে দিলে মন্দ হয় না। মেয়ে নম্র স্বভাবের, কাজ কর্মেও পটু। তাই একদিন, অনিলে ডেকে বললাম, মেয়েটাকে তোর কেমন লাগে?
– ভালই। কেন বাবা?
– ওকে বিয়ে করতে তো তোর কোন আপত্তি নেই?
– তুমি যা ভাল বোঝ করবে। আমার আর তাতে আপত্তি করার কি আছে?
অনিলের মত পেয়ে, আমি ওর পিসিকে ডেকে বলি, তোমার মেয়ের পাত্র হিসাবে কি তোমার অনিলকে পছন্দ হয়?
– কি যে বলেন আপনি? অনিলের মতো ক’টা ছেলে আছে এ পাড়ায়?
– তবে তোমার ভাইজিকে বোলো, অনিলের সঙ্গে বিয়েতে ওর কোন আপত্তি আছে কিনা?
– বেশ।
তারপরই দু’পক্ষের সন্মতিতে অনিলের বিয়েটা হয়ে যায়,অনাড়ম্বর এক অনুষ্টানের মাধ্যমে।
– তারপর এখানে এলে কি করে?
– তোর বাবা দোকানে একজনের কাছে শুনে এসেছিল, তার দু-একদিনের মধ্যেই আমি এখানে এটা চালাঘর তুলে একা বাস করতে থাকি। বাবা কাকা পিসি তোর মা থাকত সেই পোড়াবস্তির ভাড়া ঘরেই।
– আচ্ছা দাদাভাই, মুসলমানরা যদি তোমাদের তাড়িয়ে দিয়ে, অপরাধ করে থাকে, তবে তোমরা যে ওদের জমি দখল করে এখানে বসবাস করছ এটা অপরাধ নয়?
ঠাকুর্দা পিকলুর মুখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, তুই বেশ বড় হয়ে গেছিস আজকাল।
– কেন?
– এটা একটা যুক্তিগ্রাহ্য কথা বলেছিস তুই। এভাবে আমি কখনও ভেবে দেখিনি।
– ভাবো ভাবো। ভাবা প্রাকটিশ কর।
ডানপাশে রাখা বলে হাতের লাঠিটা তুলে ঠাকুরবদা বললেন,
– ওরে হারামজাদা, তুই সিনেমার ডায়লগ মারছিস আমার কাছে।
হারামজাদা বলা ঠাকুর্দার একটা মুদ্রাদোষ।
পিকলু জলচৌকি ছেড়ে উঠে পালাল সেখান থেকে।
(সমাপ্ত)