শংকর ব্রহ্ম
পর্ব: ১
পিকলুদের বাড়ির পিছনদিকে বড় একটি পানা পুকুর আছে। সেটা কচুরিপানায় ভরা। পুকুরের ধার ঘেষে একটি শিরীষ গাছ। জোরে হাওয়া বইলে, গাছের সরু ডালগুলি দুলে ওঠে। শনশন করে একটা ভূতুরে আওয়াজ হয় গাছটায়। কুচি-কুচি কিছু পাতা নাচেতে নাচতে গাছের নীচে ঝরে পড়ে। পূর্বদিকে পুকুরের ওপাশে, নিতাই মল্লিকদের বাঁশবন। শনশন হাওয়াটা সেখানে ঢুকে গিয়ে ফিসফিস করে কী সব কথা কয় যেন ! ঠিক বোঝা যায় না।
যেহেতু পুকুরের দিকটা বাড়ির পিছন দিক, তাই বাথরুম পায়খানা করার জায়গা ওদিকটায় করা হয়েছে। দিনের বেলা সেদিকে যেতে কোন অসুবিধা বা ভয় হয় না। রাতের বেলা একা একা সেদিকটায় যেতে গা ছমছম করে ওঠে ভয়ে। তার কারণ আছে।
পিকলুর এক ডিভোর্সি এক পিসি আছে। থাকে এখানে। পিকলুর মা নেই। পিকলুর জন্মের কয়েক মাস পরেই, তার মা মাথায় গোলমাল শুরু হয়। হঠাৎ একদিন সে, কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে যান বাড়ি ছেড়ে।
বাবা ভবঘুরে মানুষ। যাত্রা-গান করে বেড়ায়। থাকে এখানে সেখানে। বাড়ি আসে কালে-ভদ্রে। পিকলু এই পিসির কাছেই মানুষ। সে নাকি একদিন রাতে পায়খানা করে ফিরবার সময়ে, একটা ভূতকে শিরীষ গাছ থেকে নেমে পানা পুকুরের উপর দিয়ে হেঁটে বাঁশ বাগানের দিকে যেতে দেখেছিল।
তারপর থেকে বাড়ির সকলেই রাতে ওই দিকটায় যেতে ভয় পায়।
বাড়িতে পিসি ছাড়া আর থাকেন কাকা কাকিমা ও ঠাকুর্দা। পিকলু আর পিসি থাকে একসাথে। আর কাকা কাকিমা ঠাকুর্দা একসাথে থাকেন। দু’টো হাড়ি। কাকিমা নিজেদের জন্য রান্না করেন। পিকলুর আর নিজের জন্য রান্না করে তার পিসি। পিসির মনটা খুব ভাল। দয়া মায়া আছে মনে।
পিকলুরা আসলে উদ্বাস্তু। পূর্ববাংলা থেকে দেশ স্বাধীন হবার পর, তার ঠাকুর্দা অবিনাশ দাস ১৯৪৮ সালে বরিশাল ছেড়ে এদেশে চলে এসেছিলেন। তখন কী অবস্থা তাদের পিকলু শুনেছে ঠাকুর্দার মুখে। শ’য়ে শ’য়ে লোক এসে জড়ো হল শিয়ালদহ স্টেশনে।ঠাকুর্দারাও জড়ো হয়েছিলেন সেখানে। একবারে নরক-গুলজার অবস্থা। যেখানে রান্না খাওয়া, সেখানেই স্নানকরা, মলমূত্র ত্যাগ, এমন কি প্রকাশ্যে জৈব-ক্রিয়া সম্পন্ন হত। কাউকে সে ব্যাপারে কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেখা যেত না সে সময়। নিত্যদিন পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া অশান্তি লেগেই থাকত ঘুমের সময়টুকু ছাড়া। সেখানে বেশ কিছুদিন এই দুর্বিসহ অবস্থার মধ্যে থাকার পর, একদিন পুলিশের তাড়া খেয়ে ঠাকুর্দারা শিয়ালদহ স্টেশন ছেড়ে এসে উঠলেন, কালীঘাট পোড়া বস্তির একটা ভাড়া করা টালির ঘরে। একটা মাত্র ঘর। সেখানেই রান্না খাওয়া শোয়ার ব্যবস্থা করতে হত কষ্ট করে। আর একটি মাত্র বারোয়ারি খাটা পায়খানা ছিল সকলের মল-মূত্র ত্যাগ করার জন্য। সেখানে ভোর বেলা থেকে লাইন লেগেই থাকতো। সে এক কষ্টদায়ক পরিস্থিতি ছিল।
পিকলুর বাবা কাকা আর পিসির জন্ম বরিশালে। পিকলুর জন্ম হয়েছে চেতলা হাসপাতালে। তখন ওরা থাকত কালীঘাট পোড়া বস্তিতে। পোড়া বস্তি নাম হয়েছিল কারণ বিশ্বযুদ্ধের সময় ওখানে বিমান থেকে বোম পড়ে পুড়ে গেছিল বস্তিটা। সেবার হাতিবাগানেও নাকি বিমান থেকে বোম পড়েছিল।
একদিন ঠাকুর্দা অনিলের কাছে খবর পেলেন, অনিল যে সিগারেট বিড়ির দোকানে কাজ করে, সেখানে এক খরিদ্দারের কাছে শুনেছে, উদ্বাস্তুরা নাকি গড়িয়ার কাছে মুসলমানদের ছেড়ে যাওয়া জমিতে বসবাস করা শুরু করেছে।
তার কয়েকদিন পর ঠাকুর্দাও এসে এখানে একটা একচালা ঘর তৈরী করে একা বাস করতে থাকেন। সেটা ছিল একটা চাষের জমি। পাশেই ছিল বড় একটা পুকুর। যেখান থেকে জল নিয়ে চাষের জমিতে দেওয়া হত বোধহয়।
পিকলুর বাবা কাকা পিসি আর তার মা পোড়া-বস্তির সেই ভাড়া বাড়িতে থেকে গেল।
তারপর আদি-গঙ্গা দিয়ে অনেক জল গড়িয়ে গেছে। ঠাকুর্দার কাছে পিকলু শুনেছে প্রথম প্রথম রাতের দিকে মুসলমানরা ‘আল্লা হো আকবর’ ধ্বনি তুলে, হাতে ধারালো অস্ত্র দা-কাস্তে নিয়ে তারা উদ্বাস্তুদের তাড়া করে আসত। ঠাকুরদার মতো উদ্বাস্তরা তখন, ঘর থেকে স-দলবলে সকলে মিলে বেরিয়ে পড়ে, ‘বন্দে মাতরম্’ ধ্বনি তুলে হাতের কাছে পাওয়া দরজার খিল, আঁশ-বঁটি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলত। মুসলমানরা তাদের সংখ্যা দেখে আর এগোতে ভরসা পেত না। ফিরে যেত। ফিরে না গিয়ে এগোলে নিশ্চিতভাবেই একটা রক্তগঙ্গা দাঙ্গা বেঁধে যেত। মাঝে মাঝে এই গন্ডগোলের জন্য থানা থেকে পুলিশও আসত। ঘরে পুরুষদের পেলে ধরে নিয়ে যেত। তাই পুরুষরা পুলিশ আসছে খবর পেলেই, মেয়েদের ঘরে রেখে, নিজেরা বাড়ি ছেড়ে পালাত।
এরপর একটি রাজনৌতিক দল ‘উদ্বাস্তু সমিতি’ গড়ে তুলত। ধীরে ধীরে উদ্বাস্তুদের অধিকার কায়েম করল। তাদের সব দাবী দাওয়া নিয়ে সরকারের কাছে আবেদন জানানো হল । মিছিল করে গিয়ে থানায় ডেপুটেশন দেওয়া হল। তাদের সঙ্গে পিকলুর ঠাকুর্দাও গিয়েছিলেন।
এইভাবে যখন দু’এক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত হয়ে এল, তখন বাবা কাকা পোড়া বস্তির ভাড়া বাড়ি ছেড়ে এখানে এসে উঠলেন। ঠাকুর্দা সংসারের খরচ যোগাবার জন্য বাঘাযতীন বাজারে ফুটপাথের উপর একটা পান বিড়ির দোকান দিলেন। প্রথম প্রথম ঠাকুর্দার সঙ্গে পিকলুর বাবাও বসত দোকানে। একবার কালী পূজার পরদিন, বাজারে এক যাত্রাদল এলো যাত্রা করতে। যাত্রপালার নাম ‘সীতা হরণ’। তাদের অভিনয় দেখে অনিল এত মুগ্ধ হয়ে গেল যে, দোকানদারী করায় আর তার মন রইল না। সেই দিনই ঠাকুর্দাকে একটা চিরকূট লিখে, যাত্রাদলের সঙ্গে সে চলে গেল। প্রথমদিকে মাঝে মাঝেই সে বাড়ি আসত। ঘরে মন বসাবার জন্য ঠাকুর্দা এক গৃহস্থ ঘরের একমাত্র মেয়ে দেখে তার সঙ্গে তার বিয়ে দিলেন। তখন সে বাড়িতেই বেশীরভাগ সময় থাকত। মাঝে মাঝে যাত্রা দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখত। তারপর পিকলুর প্রসবের সময় বাঙুর হাসপাতালে বাবা যেতেন মার জন্য খাবার নিয়ে। সন্তান কোলে নিয়ে, বউকে রিক্সায় বসিয়ে বাড়ি ফিরে ছিল। ঠাকুরদা তা দেখে খুব খুশি হয়েছিলেন। ভেবে ছিলেন সন্তানের আকর্ষণে, অনিল এবার যাত্রাপালার আকর্ষণ ভুলতে পারবে। অনিল মানে পিকলুর বাবা। পিকলুর জন্মের দু’তিন মাসের মধ্যেই তার মায়ের মধ্যে মানসিক গোলমাল শুরু হলো। ঠিক মতো স্নান-খাওয়া করত না। ঘরের কোন কাজ কর্ম করতো না। তারপর হঠাৎ একদিন সে কাউকে কিছু না বলে, বাড়ি ছেড়ে কোথায় চলে যায়। সে ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর অনিল অনেক খোঁজ-খবর করেছিল তার। কোথায়ও খুঁজে না পেয়ে, আবার অনিল (পিকলুর বাবা) একদিন গৃহ ত্যাগ করল। সংসার থেকে তার টান যেন চিরতরে উঠে গেল।
ঠাকুর্দার বয়স হওয়ায় ঠাকুর্দা এখন আর দোকানে যেতে পারেন না। দোকানটা এখন কাকা চালান। তার নাম সুনীল।
পিসি দু’একটা বাড়িতে সকালে রান্নার কাজ করে। সেটা এই উদ্বাস্তু কলোনীর থেকে একটু দূরে, বস্তির বাইরে কেনা জমির বাবুদের বাড়ি। উদ্বাস্তু কলোনীতে কে রান্নার লোক রাখবে? কার এত টাকা -কড়ি আছে? পিসি পিকলুকে মুড়ি খেতে দিয়ে সেখানে কাজে যায়। দুপুরে পিকলু প্রাইমারী স্কুলে পড়তে যায়। সেখানে খাবার দেয়। বিকেলবেলা বাড়ি ফিরলে পিসি তাকে খেতে দেয়। পিসির ভাল নাম দুর্গা। ডাক নাম বুড়ি।
বাড়ির সামনের দিকে একটা পেয়ারা গাছ আছে। সেখানে টিয়া পাখি এসে মাঝে মাঝে বসে। পাকা পেয়ারা ঠুঁকরে খায়। নিচেও অনেক পাকা পেয়ারা পড়ে থাকে। দুপুরে বাড়ি থাকলে পিকলুও দু’একটা কুড়িয়ে নিয়ে খায়। পিসি তখন ঘরে ঘুমায়।
সেদিন দুপুরে তেমন দু’টো পেয়ারা নিয়ে পুকুরপাড়ে শিরীষ গাছের ছায়ায় বসে খাচ্ছিল। দেখল একটা কাঠবিড়ালি গাছটা থেকে তড়তড় কনর নেমে এলো। এ’দিক সে’দিক দু’এক চক্কর দিয়ে পিকলুর দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে রইল।
তা দেখে পিকলু বলে উঠল,
কাঠবিড়ালি কাঠবিড়ালি পেয়ারা তুমি খাও?
দুধ মুড়ি খাও?
কাঠবিড়ালি বলে উঠল, খাই খাই, সব খাই।
পিকলু তখন একটা পেয়ারা তার দিকে ছুঁড়ে দিতেই। কাঠবিড়ালি টুক করে সেটা লুফে নিয়ে, তড়তড় করে শিরীষ গাছটায় উঠে গেল।
সকালে পিসি তাকে মুড়ি খেতে দিলে, সে এসে কাঠবিড়ালিকে ডাকে, বন্ধু তুমি কোথায়? তার ডাক শুনে কাঠবিড়ালি গাছে থেকে নেমে এসে বলে, ডাকছ কেন?
– এই নাও, তোমার জন্য মুড়ি এনেছি, খাও।
পিকলু বলে।
কাঠবিড়ালি শুনে বলে, তুমি আমার ভাল বন্ধু।
তারপর কাঠবিড়ালিটা পিকলুর দেওয়া মুড়িগুলি খুঁটে খুঁটে খেতে থাকে।
এইভাবে কাঠবিড়ালির সঙ্গে পিকলুর খুব বন্ধুত্ব হয়ে যায়। পিকলু স্কুলে গিয়ে চম্পার কাছে কাঠবিড়ালির গল্প বলে। চম্পা বড় বড় চোখ করে তার কথা শোনে। বিস্ময়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে পিকলুর দিকে।
জানুয়ারি মাসে পুকুরটা কচুরিপানার বেগুনি ফুলে ভরে যায় । তখন পুকুরটাকে একটা ফুলের বাগান বলে ভুল হয়। চম্পা একদিন স্কুল ছুটির পর কাঠবিড়ালি দেখতে পিকলুদের বাড়িতে এসেছিল। সে পুকুরটাকে দেখে একটা ফুলের বাগান ভেবে ভুল করেছিল। তা জেনে পিকলু হেসেই বাঁচে না। সেদিন অবশ্য পিকলু চম্পাকে কাঠবেড়ালি দেখাতে পারেনি। কিন্তু চম্পার তাতে কোন দুঃখ ছিল না। সে পিকলুদের বাড়ির পাশে এমন সুন্দর একটা বেগুনি ফুলের বাগান দেখে মুগ্ধ হয়ে বাড়ি ফিরেছিল।
দু’তিন দিন কাঠবেড়ালি বন্ধুর সঙ্গে দেখা হল না পিকলুর। সে ভাবল বন্ধুর হল কি? সে আসছে না কেন? তিন-চার দিন পর তার সঙ্গে দেখা হল পিকলুর। তাকে দেখে পিকলু বলল, এতদিন আসনি কেন বন্ধু?
– আমি তো এখানে ছিলাম না
– কোথায় ছিলে?
– মাসির বাড়ি বেড়াতে
– কেন সেখানে কি?
– মাসির মেয়ের বিয়ে ছিল
– মাসির বাড়ি কোথায়?
– অই তো বাঁশবাগানের ধারে গাব গাছটায়।
– কি করে যাও সেখানে?
– কেন? এই কচুরিপানার উপর দিয়ে হেঁটে।
কাঠবিড়ালির কথা শুনে পিকলুর মনে পড়ল,
মাসিও বলেছিল, একটা ভূতকে শিরীষ গাছ থেকে নেমে পানা পুকুরের উপর দিয়ে হেঁটে বাঁশ বাগানের দিকে যেতে দেখেছিল।
সে কথা মনে পড়তেই পিকলু কাঠবেড়ালিকে বলল, তুমি এই শিরীষ গাছটার কোথায় থাক?
– অই মগডালের একটা কোটরে।
– আচ্ছা তুমি কি জানো, এই শিরীষ গাছে একটা ভূত থাকে?
– জানি তো। আমার খুব বন্ধু হয়
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ তো?
– কি করে ভূতটা?
– সারাদিন পড়ে পড়ে ঘুমায়। রাতে এ”পাড়া সে’পাড়া ঘুরতে বের হয়, যখন আমি ঘুমাই।
পিকলুর ভূত দেখার খুব ইচ্ছে।
তাই সে কাঠবেড়ালিকে বলল, একদিন তোমার ভূত বন্ধুকে আমাকে দেখাবে?
– আচ্ছা, ওকে বলে দেখি, কি বলে।
– ঠিক আছে। আমার বন্ধু হামিদা তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল পর্শু।
– তাই নাকি?
– হ্যাঁ, তুমি তো ছিলে না এখানে, তোমার মাসির বাড়ি গেছিলে।
– ঠিক আছে, তবে আর একদিন নিয়ে এসো তোমার বন্ধুকে।
– আচ্ছা, আমি বলে দেখব ওকে, দেখি আবার নিয়ে আসতে পারি কিনা।
এইভাবে ভালই দিন কাটছিল পিকলুর। কিন্তু একইভাবে ভাল কারোর চিরদিন কাটে না।
কিছুদিন পর একদল সাপুরে এসে পুকুরের পাশে ছোট মাঠটায় তাঁবু গাড়ল। তাদের কাজ সাপ, বেজী, পাখি এসব ধরে হাটে-বাজারে বিক্রি করা। একদিন কাঠবেড়ালিটাকেও ওরা ধরে ঝুড়িতে পুরে কোথায় নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দিল।
কাঠবেড়ালি বন্ধুকে হারিয়ে পিকলু খুব মুষড়ে পড়ল। কিছুদিন এই মনখারাপ নিয়ে কাটল তার। স্কুলে পিকলুর মুষড়ে পড়া ভাব দেখে, চম্পা জানতে চাইল, কি হয়েছে তোর?
পিকলু তখন চোখের জল না আটকাতে পেরে, কেঁদে বলল, জানিস চম্পা ওই সাপুরেরা আমার বন্ধু কাঠবেড়ালিকে ধরে নিয়ে গেছে। ধরে নিয়ে গিয়ে কোথায় বেচে দিয়েছে।
শুনে চম্পা বিস্মিত হয়ে বলে, তাই নাকি?
– হ্যাঁ-রে চম্পা
– তুই কাঁদিস না, কাঁদলে কি আর তোর বন্ধু ফিরে আসবে?
– না, তা আসবে না। তবে তুই বল, এতে কান্না পায় কিনা?
চম্পা তা শুনে, সান্ত্বনার সুরে বলে, তবু তুই কাঁদিস না।
পিকলু হাতের উল্টো পিঠের চেটো দিয়ে চোখের জল মুছে নিল।
এরপর দ্বিতীয় আঘাত নেমে এলে এল পিকলুর জীবনে। পিসি হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেল একদিন। আর বাড়ি ফিরল না। অনেক খোঁজা-খুঁজি করেও তার আর কোন সন্ধান পাওয়া পাওয়া গেল না কোথায়ও। থানা পুলিশ করেও কোনও লাভ হল না। পুলিশ গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করল না এর। কারণ পিসি যে দু’টি বাড়িতে রান্নার কাজ করত, সেখানে গিয়ে পুলিশ একবারের জন্য অনুসন্ধান করেনি। পাড়ায় এসেও তার সম্পর্কে কোন খোঁজ-খবর নেয়নি।
তারই কিছুদিন পর, সংসার চালাবার মতো খরচ ঘরে না থাকায়, একজন কাঠের দোকানদারকে ডেকে ঠাকুর্দা ওই শিরীষ গাছটা দু’হাজার টাকায় বেচে দিলেন। তাদের লোকজন এসে শিরীষ গাছটা করাত দিয়ে কেটে, ভ্যান বোঝাই করে গুঁড়িগুলি নিয়ে চলে গেল।
এরপর পিকলু একেবারে একা হয়ে গেল। এর কিছু পর বাবা বাড়িতে ফিরে এল। পিকলুর জন্য নতুন প্যান্ট-শার্ট কিনে নিয়ে এসেছে। সে পিকলুকে তার সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইল। ঠাকুর্দা শুনে বললেন, তোর নিজেরই তো থাকা খাওয়ার ঠিক নেই। ছেলেকে নিয়ে রাখবি কোথায়? ঠাকুর্দা পিকলুকে ছাড়তে রাজী হল না তার সঙ্গে। বলল, ও আমাদের সঙ্গেই এখানে থাকবে।
এ কথা শুনে, বাবা আর কিছু বলতে ভরসা পেল না। বাবা বাড়িতে দু’চার দিন থেকে আবার বেরিয়ে পড়লেন। যাবার দিন পিকলুকে খুব আদর করলেন। পিকলুর চোখে জল এসে গেল।
তারও খুব ইচ্ছে করছিল, বাবার সঙ্গে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে। কিন্তু সে কি করবে? সে তো খুব ছেলেমানুষ। কে আর তার কথার গুরুত্ব দেবে?
বাবা চলে যাবার পর, পিকলু আবার খুব একা হয়ে পড়ল। পিসি নেই, কাঠবেড়ালি বন্ধু নেই, এমনকি শিরীষ গাছটাও আর নেই। পিকলু আজকাল পুকুরপারের দিকটায় গেলেই, শিরীষ গাছটা নেই দেখে বুকের ভিতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে। পিসির কথা মনেহয়। আর মনেহয় পিসির দেখা ভূতটা এখন কোথায় থাকে? পুকুর পাড়ের দিকটায় আজকাল খুব একটা যায় না পিকলু।
পিসির মৃত্যুর পর ঠাকুর্দাও কেমন মন মরা হয়ে পড়েছে। একা একা বসে কি ভাবে। পিকলুকে একদিন কাছে ডেকে নিয়ে বলে, তোর মতো দুর্ভাগ্য খুব কম আছে। জন্মের সময় মাকে হারালি। এখন আবার তোর পিসিকে হারালি। বাবাটাও তোর ভবঘুরে মানুষ। এবার থেকে তোর নিজের দায়িত্ব নিজেকে বুঝে নিতে হবে।
– কেন দাদাভাই? তুমি তো আছো?
– আমি আর কতদিন?
– ও কথা তুমি বোলো না, দাদাভাই। আমার খুব কষ্ট হয়।
শুনে ঠাকুর্দা আর কিছু বললেন না। চুপ করে থেকে, কী ভেবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কি জানি, কী সব ভাবেন দাদাভাই ! আজকাল পিকলু কাকা কাকিমাদের ঘরে খায়। থাকে নিজের ঘরে।
পিকলু সেখান থেকে উঠে যায়। ঘরের সামনের পেয়ারা গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়ায়। আজও টিয়া পাখিরা পেয়ারা খেতে আসে। পাকা পেয়ারা গাছের নীচে পড়ে থাকে। কিন্তু পিকলুর আজকাল আর পেয়ারা খেতে মন চায় না। ওদিকে তাকিয়ে দেখতেও মন চায় না।
পিকলুদের বাড়িটা কলোনির ভিতরে হলেও, বড় রাস্তার মোড়ে। বাড়ির পিছন দিকে বড় একটা পুকুর। প্রোমোটিংয়ের জন্য আদর্শ একটা প্লট। কলোনীতে বহুদিন আগে থেকেই প্রোমোটিং শুরু হয়েছে। পিকলুর দাকুর্দার কাছেও কয়েকবার কয়েকজন প্রোমোটার প্রোমটিংয়ের প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিল। তিনি দূর দূর করে তাদের তাড়িয়েছেন।
বলেছেন, আর কখনও যেন তোমাদের এমুখো হতে না দেখি। এ সব খবর পাড়ার লোকেরা জানে। তাই আজকাল আর কোন প্রোমোটার তার কাছে ঘেষতে ভরসা পায় না।
পিকলু চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে, পাড়ার চরিত্রটা কেমন বদলে যাচ্ছে। পিকলুরা যখন এই কলোনীতে এসে বসতি গড়েছিল। তখন পিকলুর বয়সছিল দু’বছর। এখন পিকলুর বয়স দশ বছর। মাত্র আট বছরে
আশে পাশের মাঠগুলি ভরে উঠেছে কাঁচা-পাকা বাড়িতে। আগে যে মাঠে পিকলুরা ঘুড়ি উড়াত, সে কত রকমের ঘুড়ি। যেমন- ময়ূরপঙ্খী, চাঁদিয়াল, মুখপোড়া, পেটকাট্টি, চন্দ্রমুখি, চাপরাশী, সতরঞ্জী, মোমবাতি,কড়িটানা, চৌরঙ্গী প্রভৃতি।
বিশ্বকর্মা পূজার সাতদিন আগে থেকে
ঘুড়ি উড়ানো শুরু হতো।শেষ হতো পূজার সাতদিন পর। সে যে কী উন্মাদনা ! মজায় দিনগুলো কেটে যেতো, তা আর কি বলবো?
নিজের হাতে ঘুড়ি তৈরী করে নিতাম। সে ঘুড়ি উড়াবার মজাই ছিল আলাদা। সে সব এখন স্মৃতি। বিশ্বকর্মা পূজার দিন তো সারা আকাশ জুড়ে ঘুড়ির মেলা থাকত সে’সময়। আকাশে তাকালে আজকাল আর সে’রূপ চোখে পড়ে না তার। মনটা কেমন উদাস হয়ে যায়,রুক্ষতায় ভরে ওঠে।
তাছাড়া অন্য সময়গুলি কাটত – গোল্লাছুট, দাঁড়ি-বান্দা, হা-ডুডু, ডাংগুলি খেলে, সেগুলি এখন আর নেই। আগে ছিল মাটির সরু রাস্তা, পায়ে হাঁটা পথ। দু’পাশে ছোট-বড় নালা। তাতে কচু ও জংলা গাছ হয়ে ভরে থাকত। বর্ষাকালে বৃষ্টির জলে সেই নালাগুলিই ভরে উঠত যখন, সেখানে কই,সিঙ, মাগুড়, ল্যাটা মাছের আমদানী হত। পিন্টু আলপিন বাঁকিয়ে বড়শি বানিয়ে কত মাছ ধরেছে সেখান থেকে। আজকাল সেই নালাগুলি নেই। সেই নালাগুলি ভরাট করে রাস্তা বড় হয়েছে। মাটির রাস্তা ইট সুড়কি দিয়ে পাকা করা হয়েছে। সেখানে আজকাল সাইকেল, ঠেলা, রিক্সা, চার চাকার ভ্যান চলাচল করে। আগে দু’পায়ে চলা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। কাঁচা রাস্তা উঁচু-নীচু থাকার ফলে সাইকেল চালানোও সম্ভব ছিল না। শোনা যাচ্ছে কিছুদিনে মধ্যেই বিজলি বাতির পোস্ট বসবে। কিছুদিন আগেও এখানে শিয়ালের ডাক শোনা যেত। দূরে ঝোপে ঝাড়ে তাদের দেখা পাওয়া যেত, আজকাল আর তাদের দেখা পাওয়া যায় না। তাদের ডাকও শোনা যায় না।
পিকলু যেবার প্রাথমিক স্কুল থেকে পাশ করে হাইস্কুলে ভর্তি হল, সেবার ঠাকুর্দা তাকে একটা স্কুল ব্যাগ কিনে দিয়েছিল। খুব সুন্দর নীল রঙের ব্যাগ। পিকলুর খুব পছন্দ হয়েছিল ব্যাগটা। বই খাতা, জলের ব্যাগ, ছাতা সব রাখার আলাদা আলাদা জায়গা আছে ব্যাগটায়। পিকলু সেটা নিয়েই নতুন হাই স্কুলে যেত। এটা ছেলেদের স্কুল। এখানে কত নতুন বন্ধু হয়েছে তার ক্লাসের ছেলেরা সব।
হাই-স্কুলটা ছিল বেশ মজার জায়গা।
টিফিনের সময় মাঠে ফুটবল খেলা হতো। পিকলুর ফুটবল খেলতে খুব ভাল লাগত। সে খেলতোও খুব ভাল। অন্য স্কুলের সঙ্গে পিকলুদের স্কুলের ইন্টার- স্কুল টুর্মামেন্ট ম্যাচ হতো। যখন সে এইট-নাইনে পড়ে। স্কুলের হয়ে পিকলু সে খেলায় সুযোগ পেতো। টুর্নামেন্ট কাপও জিতে এনেছে, স্কুলের হয়ে। ফলে স্কুলের শিক্ষকরা তাকে স্নেহ করতেন, ভাল বাসতেন।
তখন পাড়ায়ও এপাড়া সাথে পাশের পাড়ার ফুটবল ম্যাচ হতো। পিকলুকে হায়ার করে অন্যপাড়ার জন্যও খেলতে নিয়ে যেতো। সে ম্যাচে জিতলে, তার সম্মানে, খেলার পরে জুটতো ডবল ডিমের মামলেট, আর ঘুগনি পাউরুটি। সেটা খুব আনন্দদায়ক ছিল পিকলুর কাছে।
পাশের পাড়ায় দু’টি ফুটবল টিম ছিল। ‘চ্যাং’ দা আর ‘ব্যাং’ দার টিম। চ্যাং-দা মানে চয়ন চ্যাটার্জীদার টিম। আর ব্যাং-দা মানে বিমল ব্যাানার্জীদার টিম। তারাও পিকলুকে হায়ার করে দূরে দূরে খেলতে নিয়ে যেতেন, গাড়িতে করে।
কখনও বিবেকানন্দ পার্ক। কখনো রবীন্দ্রসদন স্ট্যাডিয়াম। খেলে সেরে বাড়ি ফেরার সময় চ্যা-দা বিশটা টাকা হাতে গুজে দিতেন। সে ছিল তখন পরম প্রাপ্তি। সেই টাকা ইচ্ছে মতো খরচ করতে পারতো পিকলু, কাউকে কোন হিসেব দিতে হতো না। স্বাধীনভাবে খরচ করো। কেউ কিছু বলার নেই।
একবার বিবেকানন্দ মাঠে ফাইন্যাল ম্যাচ। পিকলুকে হায়ার করে নিয়ে গেছে ব্যাং-দা।
মাঠে নেমে পিকলু দুরন্ত খেললো। কিন্তু অপর পক্ষ, প্রতিপক্ষকে গোল করার কোন সুয়োগ দিল না। খেলার হাফ-টাইম পর্যন্ত ড্র। কেউই গোল করতে পারেনি। হাড্ডা-হাড্ডি লড়াই হয়েছে।
দ্বিতীয় হাফে মাঠে নেমে, পাঁচ মিনিটের মধ্যে একটা গোল দিয়ে দিল পিকলুদের। সময় ফুরিয়ে আসার আগেই গোল পরিশোধ করতে হবে। খেলা হচ্ছে খেলা হচ্ছে, এমন সময় একটা কর্ণার কিপ পেয়ে গেল পিকলুরা। বাদল কর্ণার কিক করলো। পিকলু প্রতিপক্ষকে আড়াল করে, নিজের পায়ে বলটা নিয়ে, একপাক ঘুরেই বলটা গোলে কিক করলো। গোলকিপার ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বল ধরতে উল্টো দিকে ঝাঁপ দিলো। ‘গোল’ ‘গোল’ বলে মাঠে প্রতিধ্বনি উঠলো। দলের সহ-খেলোয়াররা ছুটে এসে পিকলুকে জড়িয়ে ধরল।
তারপর বাকী সময়টা দু’দলের মধ্যেই টানা-টানি রেশা-রেশির খেলা চললো। খেলা শেষ হওয়ার ঠিক দ’মিনিট আগে পিকলুদের দলের খেলোয়ার
সুমন একটা গোল দিয়ে দলকে জিতিয়ে দিলো।
ম্যাচে জিতে শীল্ড পাওয়ার পর, ব্যাং-দা তো একটা ম্যাটাডোর ভাড়া করে শীল্ড নিয়ে খেলোয়ারদের সঙ্গে করে, হৈ হৈ করে পাড়ায় ফিরে ছিল, আনন্দ করে। সেদিন ব্যাং-দা খেলোয়ারদের দু’টো করে বড় রাজভোগ খায়িয়ে ছিলো। রাজভোগ দু’টো এতো বড় ছিল যে পিকলুর পেট আধা ভরে গেছিলো। বাড়ি ফেরার সময় ব্যাং-দা পিকলুকে হাতে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে, বলেছিল, এটা রাখ্। তোর খেলা ভাল হয়েছে।আরও ভাল করে খেলবি।
সে সময় পিকলু ভেবে ছিল, বড় হয়ে সে সত্যিই খেলায় মন দেবে। খেলোয়ার হবে।
দেখতে দেখতে স্কুলটা পুরনো হয়। স্কুলের বন্ধুরাও পুরনো হয়। পুরনো হযে ঠাকুর্দার নতুন কিনে দেওয়া ব্যাগটা ছিঁড়ে যায়। দেখতে দেখতে পাঁচটা বছর কেমন করে কেটে যায় পিকলু টের পায় না। এ বছর মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে সে। এখন তার বয়স ষোল। কৈশোরের দিনগুলি কেমন করে কেটে গেল, সে বুঝতেও পারল না। এর মধ্যে তার বাবা দু-তিন বার বাড়িতে এসেছিল। দু-চার দিন কাটিয়ে আবার চলে গেছেন। বাবার জন্য পিকলু আজকাল আর তেমন কোন টান অনুভব করে না নিজের ভিতর।
সামনে মাধ্যমিকের টেষ্ট পরীক্ষা হবে। তারই প্রস্তুতি চলছে এখন পিকলুর। পিসি থাকলে খুব খুশি হত। মায়ের স্নেহ-মমতা পাওয়া পিকলুর ভাগ্যে ঘটেনি। তার সে অভাব পূরণ করেছিল পিসি। তাই পিসির কথা তার খুব মনে পড়ছিল।
দেখতে দেখতে টেষ্ট পরীক্ষা এসে গেল। পিকলু দিন-রাত এক করে পড়ে পরীক্ষা দিল। পরীক্ষার ফল বের হবার পর দেখা গেল, পিকলু ভাল ফল করেছে টেষ্টে। ষাটের উপরে সব বিষয়েই তার মার্ক। ঠাকুর্দা তা দেখে খুব খুশি হলেন। কয়েকদিন পর তিনি একটা নতুন ঘড়ি কিনে এনে পিকলুকে উপহার দিলেন। পিকলু ঘড়িটা পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেল।
আজকাল পিকলুর মনেহয়, কাঠবিড়ালির সঙ্গে কি তার সত্যিই কোন কথা হয়েছিল? নাকি সেটা ছিল একটা অলীক কাল্পনিক ভাবনা। ঠিক জানে না পিকলু। সত্যি-ই জানে না।
একসময় যে পিসি ছিল তার একান্ত আপন। পিসি যে ছিল তার কাছে , আজ তো সেটাই তার কাছে অলীক মনে হচ্ছে। বাবা যে আছে তার একটা কোথায়ও, এটাও তো তার কাছে বাস্তব মনেহয় না অনেক সময়।
পিকলু নিজেও আজকাল আর আগের মতো কল্পনাপ্রবণ নেই। অনেক কঠোর কঠিন রূঢ় বাস্তব হয়ে গেছে তার হৃদয়। আগে যেমন তার মনটা একটা কাঁচা কাদার তালের মতো নরম ছিল। আজকাল তার রস-কষ সব শুকিয়ে খটখটে মাটির ডেলা হয়ে গেছে।
পিকলুর মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে কাল থেকে। তার পরীক্ষার সিট পড়েছে দেশবন্ধু হাই স্কুলে। বাসে করে সেখানে যেতে হয় তাকে। প্রথমদিন বাংলা পরীক্ষা হয়ে গেছে। আজ ইংরেজী পরীক্ষা। পিকলু ঠাকুর্দার দেওয়া ঘড়িটা পরে স্কুলে পরীক্ষা দিতে যায় রোজ। সময় মেপে পরীক্ষার সব প্রশ্নের যেন সময়ের মধ্যে দেওয়া যায়, সে কথা ভেবেই সে ঘড়িটা পড়ে পরীক্ষা দিতে যায়।
আজ পরীক্ষা দিতো দিতে পিকলু দেখলো, পাশের ছেলেটা খাতার নীচে লেখা কাগজ রেখে, তা দেখে টুকে লিখছে। দেখে তার খুব শঙ্কা হলো। সে মন স্থির করে প্রশ্নগুলি বুঝে উত্তর দিতে না পারলে তো সে পাশ করতে পারবে না। কিন্তু পাশের ছেলেটাকে কাগজ দেখে টুকতে দেখে মাথাটা কেমন গুবলেট হয়ে গেছে।
সে গার্ডকে বলে, উঠে একবার বাথরুমে গেল। বাথরুম সেড়ে, চোখে-মুখে জল দিয়ে কিছুটা শান্ত হয়ে ফিরে এলো। দেখলো ছেলেটা টোকা-টুকি করতে গিয়ে গার্ডের হাতে ধরা পড়ে, লেখা কাগজের টুকরোটা তার খাতার মধ্যে গুঁজে দিয়েছে।
সে বাথরুম থেকে ফুরতেই, গার্ড তাকে, সেই কাগজের টুকরোটা দেখিয়ে বললো, এ কাগজ তোমার?
– না স্যার। আপনি খাতা মিলিয়ে দেখুন, এ কাগজের লেখা কিছু আমার খাতায় পাবেন না।
গার্ড দু’জনের খাতাই মিলিয়ে দেখে, কাগজের টুকরোর লেখা , ছেলেটার খাতায় পেলো।পিকলুর খাতায় পেলো না। পিকলুকে রেহাই দিয়ে, ছেলেটাকে হল থেকে বহিষ্কার করলো। পিকলুর গা দিয়ে জ্বর সারলো। এবার শান্ত মনে পরীক্ষা শেষ করে হল থেকে বের হলো পিকলু।
এ রকম অভিজ্ঞতা তার প্রথম হলো।
বাকী পরীক্ষাগুলি নির্বিঘ্নেই সম্পন্ন হলো পিকলু।
সুবোধ মল্লিক রোড চওড়া হবে, তাই পাশের ফুটপথের অনেকগুলি দোকান ভাঙা পড়বে। তার মধ্যে কাকার দোকানটাও আছে।
ঠাকুর্দা শুনে বললো, কি করবি এখন সুনীল?
– কি করবো, বুঝতে পারছি না।
– এতে বোঝা-বুঝির কি আছে?
– মানে?
– সরকার দোকান ঘরটা ভাঙার আগে, তুই দোকানের মালপত্র সব বাড়িতে নিয়ে আয়। তারপর দোকানের কাঠামোটা ঠেলা কিংবা ভ্যানে করে বাড়ি নিয়ে এসে, বাড়ির সামনে দোকানটা লাগা। পাড়ায় তো সিগারেট বিড়ির দেকান নেই। সেসব কিনতে বড় রাস্তায় যেতে হয়। লাগিয়ে দ্যাখ, চলে কিনা?
ঠাকুর্দার কথা শুনে কাকা তাই করলো। আগে দোকানের সব মালপত্র ঘরে এনে রাখলো। পরের দিন দোকানের কাঠামোটা ঠেলায় করে বাড়িতে নিয়ে এলো।
বাড়ির সামনে দিয়েই পাড়ার লোকের চলাচলের মাটির কাঁচা রাস্ত। রাস্তার পাশেই একটা ভাল দিন দেখে, দোকান ভাল করে সাজিয়ে, পুরোহিত ডেকে পুজো দিয়ে দোকান খুললো।
সকাল বেলা কাকা উঠে দোকান খোলে। একটু বেলার দিকে উঠে কাকিমা চা করে, কাকাকে চা বিস্কুট দিয়ে যায়। ঠাকুর্দাকেও দেয়। নিজেও খায়। পিকলু চা খায় না। সে শুধু বিস্কুট খায়।
মাস দুয়েক এইভাবে চালিয়ে, তেমন কিছু সুবিধা করতে পারলো না। বিক্রি-বাটা নেই। পাড়ার লোক দু-চার পয়সার বিড়ি কেনে। তাতে চায়ের জলও গরম হয় না। কাকা একদিন ঠাকুর্দাকে সে কথা জানালো। ঠাকুর্দা কাকার কথা শুনে কিছুক্ষণ ভাবলেন। তারপর বারান্দার টেবিলটা দেখিয়ে বললেন, দোকানের পাশে টেবিলটা পেতে, চায়ের দোকান লাগিয়ে দে। বিড়ি সিগারেটের দোকানের সঙ্গে পাঁচ দশ কাপ চা বিক্রি হলে মন্দ কি?
– আমি তো চা বানাতে পারি না
– শিখে নিবি। খুব কঠিন কাজ না। কেউ চা খেতে এলে, প্রথম প্রথম বৌমা ঘর থেকে চা করে পাঠাবে। তুই শিখে নেবার পর, বৌমা ঘরের কাজে হাত আটকা থাকলে, তুই নিজেও করতে পারবি।
পরদিন থেকে বিড়ি সিগারেটের দোকানের সঙ্গে চায়ের দোকানও শুরু হয়।
প্রথম দিন মোট সাত কাপ চা বিক্রি হয়। বিড়ি সাগারেটের বিক্রি সামান্য বাড়ে।
এক সপ্তাহের মধ্যে কাকাও ভাল চা বাননো শিখে নেয়।
প্রথম মাসটা চা সিগারেট বিড়ি বিক্রির বৃদ্ধির কারণে, আয় একটু বাড়ে।
কাকিমা বুদ্ধি দেয়, চায়ের সঙ্গে ঘুগনি আলুর দম বিক্রির ব্যবস্থা রাখো না কেন? আমি ঘরে করে, ডেকচি ভরে দোকানে পাঠিয়ে দেবো।
কাকার মুখে, ঠাকুর্দা এই কথা শুনে বলে, বাঃ, বেশ। বৌমা তো বেশ ভালই বলেছে। তুই তাই কর তাহলে।
ঘুগনি আলুর দম চা বিস্কুট বিড়ি সিগারেট পান-পরাগ, লজেন্স সব পাওয়া যায় বলে, দোকানে আজকাল বেশ ভিড় হয়। বিশেষ করে সকালে সন্ধ্যায়। আয়ও বেশ ভাল হচ্ছে। সংসারের দুরাবস্তা কিছুটা ঘুচছে।
পাড়ার শিবনাথ বিশ্বাস কাঠের কাজ করেন। তিনি একদিন কাকাকে বলেন, কয়েকটুকরো কাঠ জোগাড় করো। তোমাকে দু’খানা বেঞ্চি তৈরী করে দি। পাড়ার লোকেরা চা ঘুগনি খেতে এসে বসতে পারবে। কাকার মনে কথাটা ধরে।
ঠাকুর্দাকে তিনি কথাটা বলেন। ঠাকুর্দা শুনে বলেন, বিশ্বাস তো বেশ ভালো কথাই বলেছেন। কি মাপের কাঠ লাগবে, বিশ্বাসের কাছ থেকে মাপটা লিখে, কাঠের দোকান থেকে কিনে নিয়ে আয়। যা টাকা লাগে আমি দেব।
দেখতে দেখতে দু’দিনে দুখানা শক্ত পোক্ত বেঞ্চ তৈরী করে দেয় শিবনাথ বাবু। কাকা তাকে বললো, আপনাকে মজুরী কত দেবো বলুন।
– আমি আর কি বলবো? আপনি যা খুশি দ্যান।
কাকা তাকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট দিতে। সে খুব খুশি হয়।
শিবনাথ বাবু লোকটি শান্ত প্রকৃতির নিরিহ মানুষ। পাড়ায় সেই অর্থে তার কোন বন্ধু নেই। আবার সকলের সঙ্গেই তার ভাব। তিন-চারটা ছেলে মেয়ে। তাদের খিদে মেটে না।
শিবনাথ বাবুর স্ত্রী মায়ারানী সারা দিন ছেলে মেয়দের খাবার জোগাড় করতে ব্যস্ত। অকর্মন্য শিবনাথ বাবুকে ধারে কাছে দেখতে পেলে ঝাল ঝারেন।
আর কাকেই বা ঝাল ঝারবেন? ভীষণ মুখরা। মুখে যা খুশি আসে, তাই বলে দেন, যার তার সামনে। তাই শিবনাথ বাবু পারত পক্ষে স্ত্রীর মুখোমুখি হতে চান না। কাকার চায়ের দোকানে এসে বসে থাকেন। সবার কথা একগাল হাসি নিয়ে শোনেন। কাউকে কোন মতামত বা পরামর্শ দেন না। আর লোকেরাও তার তার কাছে কোন পরামর্শ চায় না। আর মুখোমুখি হয়ে পড়লে, স্ত্রী যা বলেন, তার কোন জবার দেন না। নির্লিপ্ত ভাবে বসে থাকেন। দেখে মনে হয় না যে তার কানে স্ত্রীর কথাগুলি ঢুকছে।
স্ত্রী মুখ ঝামটা দিয়ে, তাকে খেতে ডাকলে, তিনি রান্না ঘরে গিয়ে ঢোকেন নিরিহ ভঙ্গীতে, অপরাধীর মতোন। তা দেখে তার স্ত্রীর খুব মায়া হয়। তিনি আর কিছু বলেন না। যত্ন করে তাকে খাবার বেড়ে দেন।
শিবনাথ বাবু তাকে বলেন, তুমিও বসো আমার সঙ্গে।
– আহা আর ঢঙ করতে হবে না। তুমি বসো।
শিবনাথ বাবু ভয়ে ভয়ে, সাহস করে তার হাতটা ধরে টেনে নিয়ে তার পাশে বসিয়ে দেয়। মায়ারানী কিছু না বলে, হতভম্ব হয়ে শিবনাথ বাবু মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। খাবার বলতে, শুধু বাড়ির পাশের পুকুরের কলমি শাক চচ্চরি আর লাল চালের মোটা ভাত।
শিবনাথ বা্বু যত্ন করে শাক দিয়ে ভাত মেখে, একগ্রাস ভাত কলাই করা থালা থেকে তুলে নিয়ে
তার মুখের সামনে তুলে ধরে। মায়ারানী এবার আর না করতে পারে না। লাজুক ভঙ্গিতে মুখটা ফাঁক করে হা করে।
শিবনাথ তার হা করা মুখের ভিতরে ভাতের গ্রাসটা ভরে দেয়। তারপরের গ্রাসটা নিয়ে সে নিজের মুখে তুলে দেয়। এক থালাতেই তারা দু’জনে খেতে থাকেন। এমন মোহময় দৃশ্য খুব একটা দেখা যায় না আজকের পৃথিবীতে।
সেবার বর্ষায়, টানা দু’দিন প্রবল বৃষ্টি হওয়ায় পর, পিকলুদের বাড়ির পাশের পুকরটা জলে ভরে গিয়ে পাড়ের চারপাশটা ভেসে যায়। রাস্তা-ঘাট জলে ভরে ওঠে। পিকলুদের বাড়ির উঠোনে জল চলে আসে। ঘরে অবশ্য জল ঢোকেনি। সকালে উঠে পিকলু দেখে লাইন দিয়ে কই মাছ উঠে এসেছে উঠোনে। পিকলু সেগুলি ধরতে গিয়ে হাতে প্রথমটায় মাছের কাঁটা খায়। পরে হাতে মোটা করে গামছা জড়িয়ে নিয়ে পিকলু সাতটা কই মাছ ধরে, তারপর একটা হাড়িতে জলে দিযে সেগুলি ভরে রাখে। বেলার দিকে ঠাকুর্দা ঘুম থেকে উঠে হাড়িতে মাছগুলি দেখে অবাক হয়ে জানতে চায়, এগুলি ধরলো কে?
পিকলু বলল, আমি
– কি ভাবে ধরলি, হাতে কাঁটা মারেনি?
– প্রথমটা ধরতে গিয়ে, হাতে কাঁটা খেয়েছি। ঠাকুর্দাকে ডান হাত তুলে দেখাল সে। তারপর বলল, পরের মাছগুলি হাতে গামছা পেঁচিয়ে ধরেছি।
তিনি সে কথা শুনে পিকলুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলে উঠলেন, সাবাস ব্যাটা।
তারপর একটু উদাস হয়ে গিয়ে বললেন, তোর পিসি এখন এখানে থাকলে খুব খুশি হত। কই মাছ তার খুব পছন্দের ছিল। তেল-কইয়ের ঝাল খুব ভাল রাঁধত সে।
পিসির কথা মনে পড়ায়, তার মনটাও খুব খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, কাউকে কিছু না বলে, পিসি কোথায় উধাও হয়ে গেল? কেন?
পাড়ার লোকেরা অবশ্য আড়ালে-আবডালে বলে পিসি কারও হাত ধরে পালিয়ে গিয়ে আবার বিয়ে করেছে। তাকে নিয়ে চলে গেছে কোথায়ও।
পিসির আগে একবার বিয়ে হয়েছিল মাছঅলা গোপাল দাসের সঙ্গে। তার সঙ্গে বছরখানেক সংসার করেছিল। তারপর কি হল কে, তাদের মধ্যে কারণে-অকারণে ঝগড়া লেগেই থাকত। ঘরে ঝগড়া অশান্তি করে পিসি মাঝে মাঝেই এখানে চলে আসত। এরপর একদিন তাদের বিয়েটা ভেঙে যায়, পিকলু জানে না, কেন।
পিসি তারপর থেকে এখানেই থাকত। দু’একটা বাড়িতে রান্নার কাজ করে নিজের খরচ চালাত। কারও কাছে হাত পাততো না। তার খুব আত্মসন্মান বোধ ছিল। বিবাহ বিচ্ছেদের পর উকিল তাকে খোরপোশের দাবি করতে বলেছিলেন। পিসি তাতে রাজি হয়নি। বলেছে, যে আমায় নিয়ে সংসার করতে চায় না, তার কাছে কেন আমি খোরপোশের দাবি করব? আমি কোনও খোরপোশের দাবি তার কাছে করব না। তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিলাম।
এর কিছুদিন পর গোপাল দাস এক এক মাছের আরতদারের ছোট মেয়ে চম্পাকে বিয়ে করে, এখন বেশ সুখেই আছে মনেহয় তারা।
পিকলুর মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষ হযেছে কিছুদিন আগে। ফল প্রকাশ হতে দু’তিন মাস দেরী। এই সময়টা পিকলু কি করবে ভাবতে গিয়ে, তার মনেহল, কম্প্যুটারের প্রথমিক পাঠটা এসময়, স্বল্প খরচে, একটা সরকারী কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হয়ে, শিখে নিলে মন্দ হয় না। স্কুলের আরও কয়েকজন বন্ধু ভর্তি হবে সেখানে।
ঠাকুর্দাকে সে কথা জানাতে। তিনি তা শুনে বললেন, তুইও ভর্তি হয়ে যা সেখানে, যা খরচ লাগে আমি দেব। এই কথা শুনে পিকলুর মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আনন্দে।
পিকলুর ঠাকুর্দার ব্যাঙ্কে সামান্য কিছু টাকা জমানো আছে, ভবিষ্যতের বিপদ আপদের কথা ভেবে। পিকলুকে টাকাটা তিনি সেখান থেকে তুলেই দেবেন। এটা পিকলুর ভবিষ্যতের ব্যাপার। একটা কিছুতে লেগে না থাকলে সে, এই সময় তার অস্থির মনে কামনার কু-প্রভাব কম পড়বে। এই বয়সটায় কামনার চঞ্চলতা তরুণ মনকে অস্থির করে তোলে। আর তার ব্যর্থতায় মন নানারকম নেশার দিকে ধাবিত হয়, সামান্য স্বস্থির আশায়। কিন্তু সেটা ক্রমশই আসক্তিতে পরিণত হয়ে, তাকে তীব্র আকর্ষণে টেনে ধরে, বিবেক স্খলনের দিকে তাকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে, ধীরে ধীরে তাকে অসামাজিক জীব করে গড়ে তোলে। তাই এই সময়ে এমন একটা কিছু নতুন বিষয় শেখাকে আক্রে ধরলে কিছুটা এর আক্রমণ থেকে নিস্তার পাওয়া গেলেও, যেতে পারে।
কম্প্যুটার সেন্টারে ভর্তি হয়ে পিকলু মনদিয়ে কম্প্যুটার শিখতে লাগল। তিনমাসের মধ্যে কম্প্যুটারের প্রাথমিক পাঠ সে সাফল্যের সঙ্গে শেষ করে ফেলল। তার কম্প্যুটার শেখার আগ্রহ, কম্প্যুটার সেন্টারের ইনস্ট্রাকটারে চোখে পড়ল। তার নিষ্ঠা ও সততা তাকে খুশি করল। সে তাকে কম্প্যুটার সেন্টারের দেখভালের দায়িত্ব দিল। তাতে তার আগ্রহ আরও বেড়ে গেল। কম্প্যুটারের হার্ডওয়ার শেখার ইচ্ছে হল তার।
মাধ্যমিকের ফল বেরোলে দেখা গেল।
পিকলু দ্বিতীয় বিভাগে পাশ করেছে।
তার কিছুদিন পরেই পিকলুর বাবা আবার বিয়ে করে, নতুন বউকে নিয়ে বাড়ি এলো। ঠাকুর্দা তা দেখে একেবারে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো। বললো, হারামজাদা তুই এটা কি করেছিস, আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে?
(চলবে…)