তৈমুর খান
জীবনানন্দের কবিতায় জীবনের খই ফুটে আছে। বেঁচে থাকা জীবনের যাবতীয় ঘ্রাণ— প্রবৃত্তির কণ্ঠস্বর, দুঃখের অন্তরাল, ভয়ঙ্কর মানব পশু এবং পশু মানুষের আচরণ সবই ধরা আছে। সেই সঙ্গে জেগে উঠেছে প্রকৃতি— মানব রূপান্তরের দৃশ্য ও আশ্রয়। আমরা, আমাদের ঘর ও বাহির, ক্ষুধা, ঘুম, জাগরণ ক্রিয়াযজ্ঞের অবিরত আহুতির নিবিড় সংশ্লেষণ। কবিতাতে তা-ই থাকে, কিন্তু জীবনানন্দীয় মিথ এক সর্বব্যাপী স্বতন্ত্র পথে প্রবাহিত। শব্দে ভাষায় চিত্রকল্পে এক অন্য উচ্চারণ মুদ্রা ধরে রাখে। কবিতা হয়ে ওঠে আমাদেরই জীবনপথের বাঁক্ আর রহস্যের দ্যোতনা। চাঁদও সেখানে অন্যমাত্রা পায়। পৃথিবীর বাতাসকেও অচেনা লাগে। আমাদেরই গৃহ-সংসার—নারী সব কোনো কুয়াশার থেকে উঠে আসা। ঘোড়া, হরিণ,শৃগাল সবই নিয়ত লীলার অমোঘ রূপ। দেখার চোখটি স্বাভাবিকের ভেতর দিয়েও অস্বাভাবিক কোনো দুর্মর লোকে আমন্ত্রণ জানায়। অনুভবের সীমাহীন দৌড়ে জীবনের ক্রান্তদর্শী দ্রাঘিমাকেই পাড়ি দিতে বলে। প্রতিটি বোধ আর আশ্রয়ের মগ্নচারি ভাষা শাব্দিক বিধান ছেড়ে ব্যঞ্জিত হয় স্বয়ংক্রিয় কোনো পর্যবেক্ষণের মনোলোকে।
তবু মনে হয় আমাদের সব বোধ বোধিবৃক্ষ রচনা করার পর তার ছায়ায় আত্মসমর্পণের নিবেদনে রাখে প্রেম ও মৃত্যু, দুঃখ ও হতাশ। হতাশ-কাতরতার শেষ পর্যবসিত পরিণতি এই প্রেমই। বেঁচে থাকার যে ইচ্ছে, আত্মপরিষেবার যে ক্রম সান্ত্বনার ক্ষেত্র, জন্মান্তরের যে প্রস্তুতি ভাবনা সবই প্রেমের কাছে আসে যায়। প্রার্থনা করা থেকে নারী—কামনার সব চূড়া ছুঁয়ে থাকে এই বোধ। জীবনানন্দ এখানেই জীবনের খেই ধরে উঠে আসেন। তাঁর যাবতীয় গান গেয়ে ওঠেন। এমনকী নীরব থাকার মর্মক্ষণটিতে প্রেমের বোধে নির্ণীত হন। আসলে পৃথিবীর ধুলো-জঞ্জালে যে প্রেম হারায়— সে প্রেমের মৃত্যু হয় না। কামনা মনের ভেতর জন্মালে তাকে ধ্বংস করা যায় না। এই কামনাই একদিন মনের ভেতর থেকে তার বিস্তৃতি চায়। স্থায়িত্ব চায়। মানুষ মরে গেলেও মানুষের মন বেঁচে থাকে। এক মন থেকে সে আরেক মনে চলাচল করে। এই চলাচলের বোধটি জীবনানন্দ অনুধাবন করেছিলেন। তাই হাজার বছর ধরে পথ হাঁটার অভিব্যক্তিটি সহজেই নিবন্ধন করেছেন। চেনা পৃথিবীর কাছে নিজের চেনা সত্তাটি বিভিন্ন রূপে মিলিয়েছেন। হাঁস, পাখি, দোয়েল, লক্ষ্মীপেঁচা, মেঠো ইঁদুর—এগুলি চিত্রকল্প হয়ে এসেছে ঠিকই কিন্তু এরই অন্তরালে কবি ও মৃত্যু বাস করেন।
মৃত্যু কবিকে ধ্বংস করে।
জন্ম কবিকে নতুন প্রাণ দেয়।
বোধের পারস্পরিক বিহিতটি দারুণ সোজা। আমরাও এই ক্রিয়ার সামিল হয়ে উঠি। বোধের মিছিলে এই দুটিকে অনবরত খুঁজে পাই। কবি মাত্রই এই জন্ম-মৃত্যুর ফাঁকটি ভরিয়ে তুলতে চান। এই ফাঁকটুকুর শূন্যতাকে নিয়েই কবিতা রচনা করেন। তখন কবিতা হয় সেতু।
প্রেম যেমন একটা নীল-আকাশ হতে পারে, তেমনি একটা আশ্রয় স্থলও। ক্লেদ, রিরংসা, দুঃখ ও সংঘাতব্যাপৃত পৃথিবীতে আপন ব্যক্তিত্বের চাওয়া-পাওয়াটুকু মরে যেতে বসে। সমাজ, অর্থনৈতিক অবস্থা, নানা প্রতিকূল পরিবেশে সব সময় কবিকে যুদ্ধ করে বাঁচতে হয়। তাঁর পলায়নী বৃত্তি কখনো কখনো মাথাচাড়া দেয়, কিন্তু ভালোবাসার কাছে সেও একদিন পরাজিত হয়। যার উদ্দেশ্যে কবি গান গেয়ে চলেন, সে না শুনলেও কবিকে গাইতেই হয় :
“আমার এ গান
কোনোদিন শুনিবে না তুমি এসে—
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,
তবুও হৃদয়ে গান আসে।
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি—
তবু ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে।” ( সহজ)
কবি নিঃসঙ্গ, ব্যথিত। সর্বত্রই আর্তস্বর বেজে ওঠে। ভালোবাসা সর্বব্যাপী হয়। ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে শুয়ে নিজের হরিণ-সত্তার এই ভালোবাসা যাপন আর উপলব্ধির নিরন্তর মানসিকতায় কবি খুঁজে পান :
“ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদেরো হৃদয়
কথা ভেবে—কথা ভেবে-ভেবে।
এই ব্যথা—এই প্রেম সব দিকে র’য়ে গেছে—
কোথাও ফড়িঙে-কীটে—মানুষের বুকের ভিতরে,
আমাদের সবের জীবনে।
বসন্তের জ্যোৎস্নায় ওই মৃত মৃগদের মতো
আমরা সবাই।”(ক্যাম্পে)
উল্লেখ্য প্রেমের চরিতার্থতা, প্রেমের আদিমতা, সমস্তই প্রেমের কাছে নিরুদ্ধ নিরূপিত। তাই অবদমিত ঘাই হরিণীরা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়। বন্দুকের শব্দ শুনে কবির হৃদয়েও অবসাদ জমে ওঠে। কারণ বন্দুক তো কোনো শক্তি—যা শুধু বিচ্ছিন্ন করে, মৃত্যু দেয়,শাসন করে, সবকিছু অপূর্ণ রাখে। ঠিক যেমন করে মহীনের ঘোড়াগুলি ঘাস খায় কার্তিকের জ্যোৎস্নার প্রান্তরে। কিংবা জন্ম-জন্ম শিকারের তরে দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ে বনের ভিতরে নীরবে প্রবেশ করে সেই সব শেয়ালেরা।
মানুষ উন্নত জীব হলেও প্রবৃত্তির মুক্ত হতে পারে না। যেমন সে সম্পূর্ণ দিন নয়, তেমনি তার সমগ্রতা মানুষ হতে পারে না। আলো-অন্ধকার, মানুষ-পশু, আবছা-ভোর সবমিলিয়ে তার রহস্যের সীমানা। প্রজাতি হিসেবে সমস্ত প্রাণীরই উৎসস্থল এক। সে ক্ষেত্রে এ যুক্তি অনৈতিহাসিক, অবৈজ্ঞানিক এবং অযৌক্তিক নয়। প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকার আমরাই যেন বহন করে চলেছি। ঘুমে জাগরণে নিত্য তার যাওয়া-আসা। কবি যেন এখানে মানস-বিজ্ঞানী। পর্যবেক্ষণের সফল প্রমাণ উদ্ধার করে মানুষের নিহিত তাৎপর্য তুলে ধরেছেন। চিত্রকল্পগুলি মানুষেরই কোনো কোনো রূপ। অপ্রাপ্তির রূপক। সব বিস্ময় আমাদের কাছে এভাবেই মিলে যায়।
ঘুরেফিরে জলের মতো আমরা যে কথা বলি, যে গান গাই, যে বোধ আমাদের মাথার ভেতর দিয়ে বয়ে চলে— তা শুধু অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়। আরও এক বিপন্ন বিস্ময় আমাদের অন্তর্গত কাজ করে। সব কাজের মধ্যেও তার স্থান আলাদা। আলাদা করে তাকে ভাবতে হয়। ভালোবেসে, ঘৃণা করে মেয়ে মানুষকে যতই দেখা হোক না কেন, তারা ভালোবাসুক, ঘৃণা করুক অথবা ঘৃণা করে দূরে সরে যাক— তবুও পৃথিবীতে ঘুম আর অন্ধকারের ভেতর তাদের কথা মনে পড়ে। ভালোবাসার ইচ্ছাটি জেগে ওঠে। এই ইচ্ছাটিই চারিত হয় পৃথিবীময়। পুরুষ নিষ্ক্রিয় ‘অন্ধকার স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকতে’ চাইলেও কবি পরম প্রকৃতির কাছে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। প্রকৃতিও নারী। বয়স্ক পৃথিবীর সঙ্গে আর প্রকৃতির সঙ্গে নারীকেই কবি বারবার মিলিয়ে দেন। তাই কবি বলেন:
“সুরঞ্জনা, আজো তুমি আমাদের পৃথিবীতে আছো
পৃথিবীর বয়সিনী তুমি এক মেয়ের মতন ;
কালো চোখ মেলে ওই নীলিমা দেখেছো ;” ( সুরঞ্জনা)
“সবিতা, মানুষজন্ম আমরা পেয়েছি
মনে হয় কোনো এক বসন্তের রাতে;
ভূমধ্যসাগর ঘিরে সেই সব জাতি,
তাহাদের সাথে
সিন্ধুর আঁধার পথে করেছি গুঞ্জন ;” (সবিতা)
“সুচেতনা, তুমি এক দূরতর দ্বীপ
বিকেলের নক্ষত্রের কাছে,
সেইখানে দারুচিনি-বনানীর ফাঁকে
নির্জনতা আছে।” ( সুচেতনা)
এই পৃথিবীর রণ-রক্ত-সফলতা সত্য হতে পারে; কিন্তু এটাই শেষ সত্য নয়। হৃদয় বলেও কিছু আছে ।সেখানেই মানুষের ক্রমমুক্তি। সে অনেক শতাব্দী ধরে মনীষীর কাজ। তবুও এই ভালোবাসার জয়ের দ্বারাই পৃথিবীর সবকিছু হওয়া সম্ভব। প্রাণের একান্ত কথাটি কবির উচ্চারণে নিবিড় হয়ে উঠেছে। এ জন্ম না হলেই হয়তো ভালো হ’তো অনুভব করে শেষে এসে যে লাভই হয়েছে তা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই অর্ধনারীশ্বর ইচ্ছাটিও কবির পরিব্যাপ্ত হয়। অনন্ত সূর্যোদয়ের উপমাটিও আগামীর প্রত্যয় নিরিখ রচনা করে। এখানেই ভালোবাসার পূর্ণতা । প্রেমের আশাবাদ। ‘হাজার বছর শুধু খেলা করে’ কবিতায়ও এই প্রেমের বোধটি নিরন্তর প্রতিধ্বনি তোলে। ইতিহাস অথবা ভূগোল এখানে এসে যায়। সমূহ মানবের ইচ্ছা-প্রবাহও ব্যঞ্জিত হয়। আদিম যুগ থেকে ক্রমাগত যুগের ধারাটিও প্রবহমানতায় আমাদেরই অস্তিত্বের কোনো নিহিত ফসিল সর্বময় বস্তুগত রূপের আড়ালে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তারা শুধু বস্তু নয়, নীরব প্রোজ্জ্বল তাদেরও কবি দেখেন :
“হাজার বছর শুধু খেলা করে অন্ধকার জোনাকির মতো :
চারিদিকে পিরামিড— কাফনের ঘ্রাণ ;
বালির ওপরে জ্যোৎস্না— খেজুর ছায়ারা ইতস্তত
বিচূর্ণ থামের মত : এশিরিয়— দাঁড়ায়ে রয়েছে মৃত, ম্লান।”
এই মৃত-ম্লানদের মধ্যেও জীবনের ঢেউয়ের স্বপ্ন আমাদের তৃতীয় চোখের কোনো গভীরে আলোড়ন তোলে। জীবনের সব লেনদেন ছেড়ে দিলেও ‘বনলতা সেন’কে আমরা ভুলতে পারি না। সে-ই শাশ্বত, সে-ই প্রাণ, সে-ই মর্ম,কায়ায়, কায়াহীনতায়, ছায়ায় তার বোধ ও উপলব্ধি। স্বপ্নে, স্বপ্নহীনতায় সে যায়-আসে। সে-ই বাঁচিয়ে রাখে ব্যক্তি মানবকে এবং সমষ্টি মানবকে। এর কাছেই শেষ আশ্রয়। এ শুধু নারী নয়, নারীর মতন। একে ভালবাসার মাধুর্যের সুখের দুঃখের জীবনের মৃত্যুর সকলের মধ্যে পাওয়া যায়। আসলে এ প্রেমেরই একটি রূপান্তর। তাই বাস্তবে নারী হিসেবেই তাকে আমরা খুঁজি। কবিরও বিস্মৃতিকে থেকে ধাক্কা মারে :
“মনে আছে? শুধাল সে—শুধালাম আমি
শুধু বনলতা সেন।”
শুধু বনলতাকেই নয়, নামের পদবীটিও কবি মনে রাখেন। এখানেই আমরাও বলে উঠি, সবকিছু চলে গেলে থাকে শুধু প্রেম। নারীটিও থেকে যায়।