Thursday, November 21, 2024
Homeসাহিত্যবিজ্ঞান কল্পকাহিনীবিজ্ঞান কল্প কাহিনী 'আমি'

বিজ্ঞান কল্প কাহিনী ‘আমি’

লেখকঃ সৈয়দ রিয়াজুল হক

এক”

স্পেসশিপ অথেলো। ক্যাপ্টেন লিওন কন্ট্রোল টাওয়ারে একা বসে আছে। এইমাত্র অথেলো হাইপার স্পেস জাম্প শেষ করে একটা ওয়ার্ম হোল দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। অন্যান্য সবকিছু ঠিকঠাক ঘটলেও লিওনের কেমন যেন লাগছে। শুধু মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা বড়সড় ঘাপলা আছে কিন্তু লিওন ব্যাপারটা ধরতে পারছে না। সামনের স্ক্রিনে চারপাশের মহাকাশ দেখাচ্ছে। ওখানে একটা নীল রঙের গ্রহ দেখা যাচ্ছে। লিয়ন সামনের কন্ট্রোল প্যানেল এর উপরে ঝুঁকে পড়ে ভিজুয়াল স্ক্রিনে নীল গ্রহটার ডিটেলস বের করে আনে। মুহূর্তে লিওনের চোখ বড় বড় হয়ে যায় আর গলা দিয়ে অস্ফুট একটা শব্দ বেরিয়ে আসে ও মাই গড। নীল গ্রহটা অন্য কিছু নয় ওটা পৃথিবী। লিওন এখন গোলমালটা ধরতে পারছে। সম্ভবত তারা একটা ওয়ার্ম হোল বাইপাসিং এর খপ্পরে পড়েছে। ওয়ার্মহোল স্থান-কালের একটা সুরঙ্গ। বাইপাস লিংকগুলো অনেকটা সুড়ঙ্গের মাঝে উপ সুড়ঙ্গের মত। স্পেসশিপটা সম্ভবত ওয়ার্ম হোলের প্রধান সুড়ঙ্গ থেকে কোন বাইপাস সুড়ঙ্গ ধরে বেরিয়ে এসেছে। ফলে তারা নির্ধারিত স্থানে না গিয়ে অন্য কোন স্পেস টাইমে চলে এসেছে। কিন্তু লিওন ভাবছে এক্ষেত্রে স্পেস তো ঠিকই আছে তারা পৃথিবী থেকে যাত্রা শুরু করে আবার পৃথিবীতে ফিরে এসেছ। তাহলে সময়, লিওন আরও একবার আঁতকে ওঠে। নিশ্চয় সময় ঠিক নেই। কারণ অথেলো হয়তো দূরত্ব পরিভ্রমণ করেনি সময় পরিভ্রমণ করে আবার আগের জায়গায় ফিরে এসেছে।

লিওন দ্রুত ভি স্কিনে একটি জটিল ক্যালকুলেশন করে। তারা এখন মোটামুটি ৫০০ বছর সামনে অথবা পেছনে আছে। ২৫০৬ সালে লিওন অথেলো নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল মাত্র কয়েকদিন আগে। এখন তাহলে তারা আছে অতীতে ২০০০ সালে অথবা ভবিষ্যতে ৩০০০ সালের কাছাকাছি কোন সময়ে। লিওন আর দেরি না করে সর্বোচ্চ সতর্কতা এলার্ম বাজিয়ে দিল। তিন মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে অথেলোর সমস্ত ক্রু কন্ট্রোলরুমে একত্রিত হয়ে গেল। লিওন একবার সামনে সবাইকে দেখে নিয়ে শুরু করল। ভদ্রমহোদয় এবং ভদ্র মহিলাগণ, আমরা ওয়ার্মহোল বাইপাসিং এর শিকার হয়েছি। সামনের যে নীল গ্রহটা সবাই দেখতে পাচ্ছেন তা আপনাদের অতি পরিচিত পৃথিবী ছাড়া আর কিছুই নয়। আমরা যে ওয়ার্মহোলটা তৈরি করেছিলাম তাতে কি করে বাইপাস হলো সেটা বের করতে হবে। আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে ফিরে যাওয়ার জন্য সেটা জরুরি। তার আগে আমাদের জানতে হবে আমরা এখন কোথায় আছি, আইমিন কোন সময় আছি। আমরা মোটামুটি ৫০ মাইক্রোসেকেন্ড ওয়ার্মহোলে ছিলাম। তা থেকে হিসাব করে বের করা যায় আমরা হয় ৫০০ বছর ভবিষ্যতে নয়তো ৫০০ বছর অতীতের পৃথিবীতে ফেরত গেছি। ঠিক কোনটা ঘটেছে তা জানা একান্ত জরুরি। আমরা ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৃথিবীতে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। জেন আর ওয়েসিস। দুজনে একসাথে ইয়েস স্যার বলে উঠল। আপনারা রিভার্স রকেট গুলি চালু করে ওথেলোর গতি কমিয়ে আনুন। এডওয়ার্ড। ইয়েস স্যার। গতি কমে আসলে কোর্স পরিবর্তন করবেন। স্যার। অন্যান্য সবাই যার যার সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব পালন করবে। সবাই যত দ্রুত এসেছিল তার চেয়েও দ্রুত কন্ট্রোল রুম খালি করে বেরিয়ে গেল । প্রায় ৫০ মিনিট পর এডওয়ার্ড লিওনকে রিপোর্ট করতে আসলো। যদিও সে ভি ফোনে তা করতে পারত তারপরও একটা জরুরী পরিস্থিতিতে সশরীরে আসাটাকে সে অধিকতর সমীচীন মনে করল। এডওয়ার্ড বলল আমরা উপমহাদেশের একটা পাহাড়ি অঞ্চলে ল্যান্ড করতে যাচ্ছি। শুধুমাত্র এই একটা এলাকার আশেপাশে ছাড়া বাকি পৃথিবীতে কোন মানুষ বা তার কাছাকাছি টাইপের কোন প্রাণী পাওয়া যায়নি। বলেন কি আমার জানামতে ২০০০ সালের পৃথিবীতে মানুষ মানুষে গিজগিজ করত। আপনি ভালো করে খুঁজে দেখেছেন তো। স্যার জেরিনা এইমাত্র ওর স্ক্যান রিপোর্টগুলো আপনাকে ফরওয়ার্ড করেছে। আপনি চাইলে ওকে রিপোর্টটা পুনরায় তৈরি করতে বলি। কোন দরকার নেই। স্যার আমার মনে হয় আমরা ২০০০ সালে নয়, ভবিষ্যতে ৩০০০ সালের কাছাকাছি কোন সময়ে চলে এসেছি। হু আমারও তাই মনে হচ্ছে কিন্তু ৩০০০ সালে মানুষেরা এত কমে গেল কেন। সেটা ওদের সাথে কথা বলেই হয়ত জানা যাবে। ঠিক আছে ঐখানে পাহাড়ের পাশে জংলা মত জায়গাটাই ল্যান্ড করুন। লিওন ভি স্কিনের একটা নির্দিষ্ট জায়গাতে নির্দেশ করে কথাগুলো বলল।

“দুই”

তিন সপ্তাহ হলো আমি জঙ্গলে লুকিয়ে আছি। গতকাল আমার খাবার শেষ হয়ে গেছে। তখন থেকে শুধু পানি খেয়ে আছি। পানির কোন সমস্যা নেই আমি যেখানে ঘুমায় তার পাশেই একটা ঝর্ণা আছে। সপ্তাহখানেক আগে একটা গাড়ি আমার খোঁজে রাস্তা পর্যন্ত এসেছিল। আমি পাহাড়ে উঠে দেখেছি। তারপরেই আমি বনের আরো গভীরে সরে এসেছি। বনের লতাপাতা আর ফলমূল এখন থেকে খাবার হিসেবে ব্যবহার করতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা যেভাবে করতো, আমি ইতিহাস বইতে পড়েছি। আমার কাছে একটা অটোমেটেড লেজার গান আছে। যাতে ফিফটি পার্সেন্ট চার্জ আছে। ওটা দিয়ে গোটা বিশেক ফায়ার করা যাবে। আমি পাহাড়ের উপর সমতল মতো এক চিলতে জায়গায় বসে আছি। ভাবছি আগামী দিনগুলো কিভাবে মোকাবেলা করব। আর কতদিন এভাবে টিকে থাকতে পারবো। সবচেয়ে বড় কথা হলো এভাবে টিকে থেকে লাভটাই বা কি? হঠাৎ আকাশ বিদ্যুৎ চমকের মতো জ্বলে উঠলো। বাজ পড়ার শব্দের চেয়ে দশ গুণ বেশি শব্দ করে আকাশ বিদীর্ণ হয়ে গেল। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আকাশের একটা জায়গায় অত্যুজ্জ্বল আলোকিত হয়ে দানবের মত দেখতে একটা স্পেসশিপ বেরিয়ে এলো। প্রায় পাঁচশো বছর আগে এই ধরনের স্পেসশিপ দেখা যেত। এগুলোর কোনটা এখনো সচল আছে আমার জানা ছিলনা। প্রায় দুইশত বছর আগেই সমস্ত রকম মহাকাশ প্রকল্প বাদ দেয়া হয়েছিল। হয়তো পুরনো কোন গুদাম থেকে একটা বের করে ওরা আমাকে খুঁজতে এসেছে। ওরা স্পেসশিপে করে আমাকে খুঁজছে! দেখামাত্র ফায়ার করে বাষ্পীভূত করে দেবে। আমি সহজাত প্রবৃত্তিবশে লেজারগানটা উপরে তুললাম ফায়ার করার জন্য, ততক্ষণে শীপটা পাহাড়ের নিচে গাছপালার ওপাশে হারিয়ে গেছে। আমি নিশ্চিত মুহূর্তের মাঝে ঝাঁকে-ঝাঁকে ওরা শীপ থেকে লাফিয়ে পড়ে আমার দিকে ছুটে আসবে। হাতে সময় খুব অল্প।

“তিন”

ভি ফোনে এডওয়ার্ড কল করেছে। লিওন একটা বাটন টিপে কলটাকে অনুমোদন দিল। সাথে সাথে এডওয়ার্ডের হলোগ্রাফি লিওনের সামনে ভেসে উঠলো। এডওয়ার্ড ইঞ্জিন রুমের একটি কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসে আছে। সে হাসি হাসি মুখে বলল এই মাত্র ওথেলোর সফল ল্যান্ডিং সম্পন্ন হয়েছে স্যার। ওহ খুব ভালো। আপনাদের সবাইকে আমার অভিনন্দন। ধন্যবাদ স্যার। হলোগ্রাফিক এডওয়ার্ড অদৃশ্য হল। প্রায় সাথে সাথেই জারিনা ছুটে এসে ক্যাপ্টেনের কক্ষে ঢুকলো। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল স্যার বামপাশের পাহাড়ের উপরে একটা আশ্চর্যজনক মুভমেন্ট মনে হচ্ছে একজন মানুষ, ভীত আর নিজেকে লুকিয়ে রেখেছে। এগুলো সাররাউন্ডিং স্ক্যান রিপোর্ট। লিওন উত্তেজিত হয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেলো, রাখো তোমার ফরমালিটি রিপোর্ট। আমাকে ওখানকার লাইভ ইমেজ দাও এখনই। হলোগ্রাফি চালু হয়ে গেল, একজন মানুষ গাছের আড়ালে লুকিয়ে ওদের স্পেসশিপের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে অস্ত্র আছে। ওর সাথে কথা বলতে হবে, জেরিনা।ওকে অক্ষত অবস্থায় আমি এই স্পেসশিপে চাই। শাশা আর ডেনিম এই দুইজন যাবে অস্ত্রসহ। কিন্তু ওকে কোনো রকম আঘাত করা যাবে না। হয় কথা বলে না হয় কোন কৌশলে ওকে শীপে আনতে হবে। ওদেরকে লাইনে আনুন। জেরিনা কন্ট্রোল প্যানেল এর একটি বাটন চেপে বলল শাশা এবং ডেনিম এই মুহূর্তে লাইনে আসুন। আলাদা আলাদা ভাবে দুইজনের হলোগ্রাফি ভেসে উঠলো ওরা দুইজন প্রায় একসাথে বলে উঠল ইয়েস স্যার। একটু আগে কি বলেছি শুনেছেন তো আপনারা এখনই যাবেন। অবজেক্ট যেন অক্ষত থাকে সে ব্যাপারে বিশেষ খেয়াল রাখবেন। ওকে স্যার। ওদের দুজনের হলোগ্রাফি অদৃশ্য হল।

“চার”

শীপটা ল্যান্ড করার সাথে সাথে লেজার গানের সবটুকু চার্জ দিয়ে ফায়ার করে উড়িয়ে দিতে হবে। আমি ছুটলাম। আমি সর্বোচ্চ গতিতে দৌড়াচ্ছি। প্রায় পৌঁছে গেছি। গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে দেখতে পাচ্ছি দানবাকার শীপটা দাঁড়িয়ে আছে। আমার পৌছাতে দেরি হয়ে গেছে। শীপের কাছাকাছি দুইজনকে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওরা স্পেসস্যুট পরে আছে কেন? ওগুলো তো মহাকাশে পরার জন্য। পৃথিবীতে ল্যান্ড করার পরেও স্পেসস্যুট এর দরকার কি? আমি একটা গাছের কাভার নিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে থাকি। স্পেসস্যুট পরিহিত দুইজন ক্রমেই পাহাড় বেয়ে উপরে উঠে আসছে। তাদের হাতে উদ্যত অস্ত্র। ওগুলো নিশ্চিতভাবেই R M 600 মডেলের লেজার ব্লাস্টার। আমারটার চেয়ে দশগুণ উন্নত। আমি গাছের ফাঁকে ফাঁকে সরে ওপাশের কোন একটা বড় পাথরের আড়ালে যেতে চাচ্ছি। ওখান থেকে ওদেরকে পেছনে ফেরা অবস্থায় পাওয়া যাবে। আমাকে প্রথম সুযোগটাকে কাজে লাগাতে হবে। ভাবছি নাকি পালিয়ে থাকায় উপযুক্ত ছিল। কিন্তু ওরা একবার যখন শীপ নিয়ে ল্যান্ড করেছে সমস্ত জঙ্গল চষে ফেলবে। আমার উচিত হবে চোরাগুপ্তা হামলা চালিয়ে সবগুলোকে শেষ করে শীপটা নিয়ে অনেক দূরে পালিয়ে যাওয়া। দুইজন বেরিয়ে এসেছে। কিন্তু শীপে আর কতজন আছে কে জানে। ২০ এর অধিক হলে আমি কি করবো। আমার লেজার গানের চার্জতো ২০ বার ফায়ার করার পরেই শেষ হয়ে যাবে। হঠাৎ একটা বুদ্ধি মাথায় আসতে আমার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। এদের দুইজনকে মারার পরে ওদের অস্ত্রগুলো আমাকে সংগ্রহ করতে হবে। আমি সুবিধামতো জায়গাতে পৌঁছে গেছি। সামান্য মাথা তুলে দেখি ওরা প্রায় উঠে এসেছে। আরেকটু উঠলেই একেবারে সমতল মতো জায়গায় পৌঁছে যাবে। আমি লেজার গানটা ওদের দিকে তাক করে অপেক্ষা করতে থাকি। ওরা একদম উপরে পৌঁছালেই ফায়ার করবো। এখন ফায়ার করলে ওরা অস্ত্রসহ নিচে গড়িয়ে যাবে। কিন্তু ওদের মূল্যবান অস্ত্রগুলো আমার দরকার। আমি শ্বাসরুদ্ধকর ভাবে অপেক্ষা করছি শরীরের সমস্ত পেশী টানটান হয়ে গেছে। ট্রিগার বাটনে আঙুল চেপে বসেছে। ওদের উঠা সম্পন্ন হয়েছে। এইবার আমি ফায়ার করতে যাচ্ছি।

“পাঁচ”

আমি পর পর দুই বার ফায়ার করলাম। প্রায় সাথে সাথেই। প্রথমে সামনের জনকে তারপর কয়েক হাত পিছিয়ে থাকা জনকে। কিন্তু একি, আমার ফায়ার দুটোই ওদের শরীর স্বচ্ছ কাচের মত ভেদ করে ওপাশের পাথরগুলোকে ছাই করে দিয়েছে। প্রথমে আমি মনে করেছিলাম আমি মিসফায়ার করেছি। আবার লেজার তুলে ফায়ার করতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মুহূর্তেই বুঝে গেলাম ওরা সত্যিকারের কিছু নয়। হলোগ্রাফি, দুইজন স্পেস স্যুট পরিহিত মানুষের হলোগ্রাফিক ছবি। ধোকা দিয়েছে, ওরা আমাকে……… প্রায় সাথে সাথেই একটা ইলেকট্রনিক জাল এসে আমাকে ঘিরে ধরল। আমি পিছন ফিরে দেখলাম সত্যিকারের ওরা দাঁড়িয়ে আছে। আমি জালে বন্দী হয়ে গেছি। অচেতন হয়ে যাচ্ছি, একটা আঙ্গুল নাড়ানোর শক্তিও নেই। সমস্ত স্নায়ু অবশ হয়ে আসছে, আমি জ্ঞান হারালাম।

“ছয়”

মানুষটাকে শীপে তুলে আনার ১৫ মিনিট পর এডওয়ার্ড হন্তদন্ত হয়ে লিওনের রুমে ঢুকলো। লিয়ন জিজ্ঞাসু চোখে ওর দিকে তাকালে এডওয়ার্ড বলল ওরা আমাদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে ফেলেছে স্যার। প্রায় শ’খানেক, সবাই ই সশস্ত্র। ওরা কারা ? পৃথিবীর মানুষ। সবাই একই রকম দেখতে। আমরা যে মানুষটাকে শীপে এনেছি, সবাই তার মতো দেখতে হুবহু এক। শুধুমাত্র মনে হয় আমাদের অবজেক্টের বয়সটা একটু বেশি। কি বলছ তুমি ? শ’খানেক মানুষ হুবহু একই রকম দেখতে ? আমার মনে হয় মানুষটাকে ধরে আনা অন্যরা পছন্দ করেনি। এইজন্য অস্ত্রসহ আমাদেরকে ঘিরে ফেলেছে। সব রকম ডিফেন্স সিস্টেম একটিভ রাখো।যাকে আনা হয়েছে, তার কি ঘুম ভেঙেছে। এইমাত্র স্যার। আপনি কি তার সাথে সরাসরি কথা বলবেন। আপাতত হলোগ্রাফিক লাইনে দাও পরে সরাসরি সাক্ষাৎ করা যায় কিনা বিবেচনা করবো। এটা ইমিউনোলজিক্যাল ডিফেন্সের জন্য। এ পর্যন্ত কেউ তো তার সাথে সরাসরি কন্টাকে যায়নি, নাকি ? নো স্যার। তবে স্পেশাল স্যুট আর গ্লাভস ব্যবহার করে। ওকে ফাইন। আমাকে লাইন দাও। লিওনের কক্ষে হলোগ্রাফি ফুটে উঠলো।সেখানে সম্পূর্ণ সাদা একটা ঘরে, একজন লোক, সাদা একটা বিছানায় বসে আছে। ঠিক একইভাবে সাদা ঘরটাতে লিওনের হলোগ্রাফিক প্রতিমূর্তি ফুটে ওঠার সাথে সাথে লোকটি চমকে তাকালো। হ্যালো, আমি লিওন। এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন। আপনার নাম ? আমার নাম! হ্যাঁ আপনার নাম কি ? কে আপনি? আমি, আমার নাম আমি। লিওন খানিকটা বিচলিত বোধ করলেও হাল ছেড়ে দিলো না। আমি আসলে জানতে চাচ্ছি আপনার পরিচয় কি ? আমি সপ্তম সাইকেল ১৮৭৭৫. এডওয়ার্ড পাশ থেকে বলে উঠলো ও মাই গড। নাম্বার দিয়ে আইডেন্টিটি। লিওন অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে বলল ‘সপ্তম সাইকেল ১৮৭৭৫’ ব্যাপারটা বুঝলাম না। আমি সপ্তম জেনারেশন ক্লোন, নম্বর ১৮৭৭৫. এই সপ্তম জেনারেশন ব্যাপারটা কি? প্রতিবার নতুন এক একটা জেনারেশন ক্লোন তৈরি করা হয়। নতুন ক্লোনরা আগের ক্লোনদের অপসারণ করে। অষ্টম জেনারেশন ক্লোনরা, সমস্ত সপ্তম জেনারেশন ক্লোনদের অপসারণ করেছে। একমাত্র আমি পালিয়ে বেঁচে আছি। আমাদেরকে আপনার বন্ধুরা ঘিরে ফেলেছে। আমার মনে হয় আপনাকে এখানে আনাটা ওরা সহজভাবে নিতে পারেনি। আমরা আসলে আপনার কোন ক্ষতি করতে চাচ্ছিলাম না। আমি আসলে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আমার বন্ধুরা ? আপনাদেরকে ঘিরে ফেলেছে ? হ্যাঁ, আপনিই দেখুন। লিওন ভিজুয়াল স্ক্রীনের কয়েকটি টাচ বাটন ক্লিক করলো। সাদা ঘরটিতে মহাকাশযানের বাইরের দৃশ্য ফুটে উঠল। লিওন জিজ্ঞাসা করল, এরা কারা? ওরা আমরা। মানে বুঝলাম না। ওরাও আমি। আমরা সবাই একইরকম। কিন্তু ওরা অষ্টম জেনারেশন ওরা আমাকে অপসারণ করার জন্য খুঁজছে। ওরা তাহলে আপনার বন্ধু নয়। না। ওরা আমাকে অপসারণ করবে। অপসারণ করবে মানে কি ? ঠিক কিভাবে অপসারণ করবে ? এটমিক ব্লাস্টার দিয়ে ফায়ার করে শরীরের সমস্ত সিস্টেম নষ্ট করে দেবে অথবা হিটিং চেম্বারে নিয়ে গলিয়ে দেহের সমস্ত মলিকুল আলাদা করে ফেলবে। এডওয়ার্ডো লিওন পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করল। কেন এমন করবে। নতুন একটা জেনারেশন আসলে পুরাতনদের অপসারণ করে সমস্ত দায়িত্ব তারা নিয়ে নেবে। ঠিক যেমন আমরা ষষ্ঠ জেনারেশনকে অপসারণ করে দায়িত্ব নিয়েছিলাম। আচ্ছা আপনাদের এটা কোন সময়। কোন সময় মানে বুঝতে পারলাম না। এটা কত সাল। ৩০৩৮. তাহলে আপনি এই মহাকাশযান এর বাইরে যেতে চান না। অবশ্যই না। বাইরে গেলেই আমরা আমাকে অপসারণ করবে। কিন্তু আপনারা কারা আপনারা প্রত্যেকে আলাদা আলাদা দেখতে কেন। আমরা এমনই। সময় হলে সব বুঝতে পারবেন। লিওন হলোগ্রাফিক চ্যানেল বন্ধ করে দিল। এডওয়ার্ড। স্যার। টেক অফ করার ব্যবস্থা করুন। অথেলোর চারপাশে শক্তিবলয় পূর্ণমাত্রায় রাখবেন। ঠিক আছে স্যার। পরবর্তী ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে অথেলো মাটি থেকে আকাশের উঠা শুরু করল ধীরে ধীরে। শতশত লেজার গান আর এটমিক ব্লাস্টারের ফায়ার অথেলোকে লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। কিন্তু শক্তিবলয়ে আঘাত করে সমস্ত ফায়ার আতশবাজির মতো ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। কোনোটা ভেদ করে অথেলোর ভিতরে ঢুকতে পারল না। সে এক দেখার মত দৃশ্য।

“সাত”

অথেলো অন্য একটা জনমানবহীন বিরান ভূখণ্ডে ল্যান্ড করল। এডওয়ার্ড আর লিওন মূল কন্ট্রোলরুমে সশরীরে পাশাপাশি বসে আছে। দীর্ঘ নীরবতার পর এডোয়ার্ড মুখ খুলল- ক্যাপ্টেন স্যার আমরা তো এখন জানি এটা ৩০৩৮ সাল। সেইমতো কোর্স ঠিক করে হাইপার স্পেস জাম্প দিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট গন্তব্যে চলে যাচ্ছি না কেন। আমরা এখানে ল্যান্ড করে শুধু শুধু সময় অপচয় করছি কেন। লিয়ন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে এডওয়ার্ডের দিকে তাকালো। যারা হাইপার ড্রাইভ দিতে পারে তাদের কাছে সময় বলে কিছু নেই।সময়ের কোনো অর্থ নেই। অপচয় করবে কিভাবে। কিছু সময় বিরতি দিয়ে লিওন আবার শুরু করল। যাইহোক আমার কিছু পরিকল্পনা আছে। কি ধরনের পরিকল্পনা স্যার। আচ্ছা এডওয়ার্ড একটা অত্যাধুনিক বায়োলজিক্যাল ল্যাব তৈরি করার মতো প্রয়োজনীয় উপকরণ কি অথেলোতে আছে। আপনার কথা কিছু বুঝতে পারছি না মহামান্য লিওন। আপনি খামোখা বায়োল্যাব তৈরি করবেন কেন। এটাতো পৃথিবী অন্য কোন গ্রহ নয় যে তার জীব-বৈচিত্র মূলক তথ্য সংগ্রহ করতে হবে। আপনি ঠিক বুঝতে পারেননি। আমি অন্যরকম একটা বায়োল্যাবের কথা বলছি। আমি বলছি হিউম্যান ক্লোন করার মত ল্যাব তৈরি করা সম্ভব কিনা। এডওয়ার্ড হা করে তাকিয়ে থাকে। কি কিছু বলছেন না যে, সম্ভব একটা ক্লোন ল্যাব তৈরি করা। এডওয়ার্ড চিন্তিতভাবে বললো সম্ভব স্যার। আমাদের প্রয়োজনীয় ইকুইপমেন্ট নেই। কিন্তু আমাদের যা আছে তা দিয়ে ও ধরনের যন্ত্রপাতি, ক্যাপসুল ইত্যাদি প্রস্তুত করে নিতে পারব। তারপরও আমি জীববিজ্ঞানী ইয়াং থর্পের সাথে আলোচনা করে আপনাকে কনফার্ম করছি। আপনাকে কিছুই করতে হবে না। তাকে এখানে ডাকুন। মোটামুটি গোলগাল চেহারার ডক্টর ইয়াং থর্প কন্ট্রোল রুমে ঢুকে তাদের সাথে আলোচনায় যোগ দিলো। সবকিছু শোনার পর তিনি বললেন অবশ্যই সম্ভব। আমাদের যা আছে তা দিয়ে এই মুহূর্তে কয়েকশ ক্লোন তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু আমি একটাও করব না। মানুষ বাদে অন্য কোন প্রাণী হলেও ভেবে দেখতাম। ক্লোনিং প্রটোকল সম্বন্ধে আপনি মনে হয় ভালোভাবেই জ্ঞাত আছেন। তারপরেও এধরনের কাজ কেন করতে চাচ্ছেন। লিয়ন সেই মুহূর্তে খানিকটা উত্তেজিত হয়ে জোরে জোরে কথা বলতে শুরু করে। আমার কথা মন দিয়ে শুনুন, এই ৩০৩৮ সালের পৃথিবীতে ল্যান্ড করার পর থেকে যা কিছু ঘটেছে আপনারা সবাই সবকিছু অবগত আছেন। এই পৃথিবীটা দেখেন মাত্র কয়েক শত বা কয়েক হাজার ক্লোন মানুষ টিকে আছে। তাও মোটামুটি পৈচাশিক উপায়ে। সমস্ত সভ্যতা ধ্বংস হয়ে গেছে। তারা সবাই ক্লোন। বার্ধক্যে উপস্থিত হয়ে তারা একদল নতুন ক্লোন তৈরি করে এবং নিজেদের আত্মাহুতি দেয় বা নতুন ক্লোনদের দ্বারা অপসারিত হয়। এটা কোন সভ্যতা হলো। আপনার কি মনে হয় তাদের মধ্যে কোন মানবিক গুনাবলী অবশিষ্ট আছে। তারা মনুষ্যত্ব বর্জিত হয়ে গেছে। দেখুন আপনার চোখের সামনে পৃথিবীর ভবিষ্যৎ। ৩০৩৮ সালে পৌঁছে পৃথিবী কোথায় গেছে দেখুন। ঠিক কি কারণে এমনটা হয়েছে বা এই ধরনের সভ্যতা গড়ে উঠেছে আমরা কেউই জানিনা। কারণ ২৫০৬ সাল থেকে হঠাৎ করেই আমরা সবাই ৩০৩৮ সালে হাজির হয়েছি। মাঝখানের ৫০০ বছরের ইতিহাস আমাদের কারো জানা নেই। কিন্তু আমি একটা চেষ্টা অন্তত করতে চাই। ঐ সমস্ত ক্লোন মানুষদের মানবিকতা ও মনুষ্যত্ব ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা। ডাক্টর থর্প এবং এডওয়ার্ড একদৃষ্টিতে লিওনের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি মহাকাশযানে সবচেয়ে স্বাস্থ্যবান আর সুন্দরী মেয়েটার কয়েকশো ক্লোন তৈরি করে ওদের মাঝে ছেড়ে দেব। তারা একে অপরকে পছন্দ করবে ভালোবাসবে। বংশবৃদ্ধির সঠিকধারায় তারা ফিরে যাবে। পরবর্তী প্রজন্ম জন্ম নেবে মাতৃগর্ভে। ডক্টর থর্পের মুখ খানিকটা হাসিহাসি হয়ে গেল। এডওয়ার্ড বলল কিন্তু ক্যাপ্টেন অন্যরকমও তো হতে পারে। তারা তো ক্লোন মেয়েগুলোকে হত্যাও করতে পারে। হ্যাঁ তা পারে কিন্তু আমাদের তো চেষ্টা করতে হবে। এটা মানব সভ্যতার ব্যাপার। পুরো পৃথিবীর ব্যাপার। আর আমার মনে হয় না তা করবে। সপ্তম সাইকেল ১৮৭৭৫ কে ভালো করে দেখুন। ওরা সবাই একই রকম তাদের মানসিকতাও একই রকম হবে। ওদের পৃথিবীতে কোন স্ত্রী লিঙ্গের মানুষ নেই। ১৮৭৭৫ এই মানুষটার সাথে জেরিনার কেমন ভাব হয়েছে খেয়াল করেছেন। আমার মনে হয় এই “আমি” নামক লোকটা জেরিনাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। একজন জেরিনাকে ভালবাসতে শুরু করেছে মানে সবাই করবে। কারণ তারা সবাই একই মানুষ। ডক্টর থর্প বললেন- তার মানে আপনি চান আমি জেরিনার কাছ থেকে স্যাম্পল সংগ্রহ করি। খানিকক্ষণ চুপ থেকে লিয়ন হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।

” আট”

৩০৫৫ সাল। মহাকাশযান অথেলো উড়ে যাচ্ছে ক্লোন বসতির দিকে। ওখানে সম্ভবত এখন নবম সাইকেল চলছে। আমি অবজারভেশন রুমে বসে আছি। অথেলো শহরের উপরে আসলে আমি পরিচিত রাস্তাঘাট আর দালানকোঠা দেখতে পেলাম। যেখান থেকে সতেরো বছর আগে আমি পালিয়ে গেছিলাম। আমার ভেতরে এক ধরনের হাহাকার তৈরি হলো। আমি পাশে বসে থাকা জেরিনা কে জড়িয়ে ধরলাম। আমার যখন এমন হয় তখন জেরিনকে জড়িয়ে ধরতে অনেক ভালো লাগে। আমার বিশ্বাস অন্যান্য ‘আমি’দেরও ঠিক একই রকম লাগবে। তাদের জন্য অথেলোর তিনটি হলরুম ভর্তি কয়েকশো জেরিনা অপেক্ষা করছে। জেরিনা আমাকে একটি নাম দিয়েছে, “আলীন”। আমাকে এখন ও আর ১৮৭৭৫ নামে ডাকে না। আমাকে ডাকে আলীন। এর মানে বিস্তৃত।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
RELATED ARTICLES

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

Most Popular

Recent Comments