টানাপোড়েন চলছে। একটি দুঃসহ মুহূর্তকে সহ্য করতে হচ্ছে যথারীতি। ¯øাইড গøাসে ঢাকা জানালার ওপারে ঢলে পড়া আকাশের বুকে এক দঙ্গল বিষণœ দাঁড়কাক কা কা করছে তো করছেই! এমন ঝাঁঝালো আওয়াজে আমি মুষড়ে পড়ছি বারবার। শ^াসকষ্ট বেড়ে যাচ্ছে অনুপের। ইনহেলারের মাউথপিসে মুখ রেখে ক্যানিস্টারে চাপ দিয়ে শ^াস নিচ্ছে সে। ওর বেডের পাশে বসে আমরা সবাই তখন মুমূর্ষু। অনুপের হার্ট রেট ফর্টিতে নেমে এসেছে। হার্টের পাম্পিং অর্গান আগের মতো অতটা অ্যাক্টিভ নয়। একগাদা টেস্টের রিপোর্ট, প্রেসক্রিপশন আর মেডিসিন বক্স ছাড়া তেমন কিছু রাখা হয়নি অনুপের বেডরুমে। হিজ ফিজিক্যাল কন্ডিশন ইজ গেটিং ওর্স ডে-বাই-ডে। হাউ টু অ্যাকসেপ্ট ইট? রুহিতা ওর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে খুব ক্রিয়েটিভ মাইন্ডে কী যেন ফিল করছে ভেতর থেকে! অনুপ বলল, কী দেখছ আপু?
-কই, কিছু না তো!
-তুমি বোধ হয় নস্টালজিয়ায় ভুগছ?
-হোয়াট ইজ নস্টালজিয়া? আই অ্যাম নট সাফারিং ফ্রোম এনিথিং। ওষুধ খেয়েছিস?
-খেয়েছি। আর কত খাব এভাবে?
-সারা জীবন খাবি। উই উইল ফিড ইউ।
হেসে উঠল অনুপ। জোর করে হাসল মনে হলো! ওর চোয়াল দুটো অস্বাভাবিক রকম ভেঙে পড়েছে। রাতদিন শুয়ে থাকতে থাকতে আর কত ভালো থাকা যায়? মাঝে মাঝে ওর শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। বড় বড় করে শ^াস নিচ্ছে। ক্যান বি সেভড লাইক দিস? চেস্ট ব্রেথিং টেস্টস ডিফারেন্ট। করনারি এনজিওগ্রামের পর স্টেনটিং করালেই বোধ হয় বেটার ফিল করবে অনুপ। বেডে শুয়ে আছে সে। ওর ছায়ার ওপর দুঃসংবাদের খড়গ ঝুলছে অনবরত। তার সাথে আমরাও পুড়ছি। পুড়ছে আমাদের হৃদয়ও। শারীরিক যন্ত্রণা মেটানো গেলেও মানসিক যন্ত্রণা আমরা কীভাবে মেটাব? অনুপের জন্য কোলেস্টেরল ফ্রি গ্রিন-টি নিয়ে এল টপি। বলল, ভাইয়া ওঠ। গ্রিন-টিটা খেয়ে নে। ইট উইল অ্যাজ অ্যান অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ফর ইয়োর বডি। চুপচাপ শুয়েই রইল অনুপ। বলল, আমি এখন কিছু খাব না। খিদে নেই।
-কী বলছিস? কিছু না খেলে পাম্পিং অর্গান আরও নিস্তেজ হয়ে পড়বে।
-পড়–ক! আব্বুকে দেখেছিস টপি?
-ফার্মেসিতে গেছে। তোর কটা ওষুধ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাছাড়া ট্রায়াল স্পেকট্রাম পরিষেবার অ্যাম্বুলেন্স কোম্পানির সাথেও না কি অ্যাগ্রিমেন্ট
করবে! এখনো ফেরেনি।
-আবার অ্যাম্বুলেন্স? ট্রায়াল স্পেকট্রাম সার্ভিস এদেশে কোথায় চালু হয়েছে? নাাথিং নিডস টু বি ডান ফর মি। আই ওন্ট গো অ্যানিহয়ার অ্যালস।
-বললেই হলো? তুই চুপ করবি ভাইয়া?
-আম্মু কোথায়?
-কিচেনে।
-মনজু ভাইয়াকে লাঞ্চ করিয়েছিস?
-আম্মু রেডি করছে। তুই উঠে বস তো! চা-টা খেয়ে নে।
আমি অনুপকে রেস্ট নিতে বললাম। আমার অ্যাসিডিটির প্রবলেম অনুপ। লাঞ্চ করব না ভাবছি। ইউ ডন্ট বি এক্সাইটেড ফর মাই লাঞ্চ। ওর হাত ধরে উঠে বসালাম। চায়ের কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললাম, খেয়ে নাও। দেখবে, ফ্রেশ লাগছে। হার্টের পাম্পিং লেভেলটাও ইমপ্রæভ হতে থাকবে। সিনস ইউ আর অ্যা হার্ট প্যাসেন্ট, ইউ নিড টু ইট কোলেস্টেরল ফ্রি ফুড রেগুলারলি। নট অনলি হার্ট প্রবলেম বাট অলসো ইন কেস অব এনি কাইন্ড অব ডিজিজ, রুলস নিড টু বি ফলোড। ইন অ্যা ওয়ার্ড, হোয়াট ইজ কল্ড রুটিন লাইফ।
-আর কত রুটিন লাইফ ভাইয়া?
-যতদিন পর্যন্ত তুমি সেরে না উঠছ!
-আমার কি আদৌ কোনো ইমপ্রæভ হবে?
-কেন হবে না? আমরা তোমাকে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশনে আবার অ্যাডমিট করাব। রিনাউন্ড হার্ট স্পেশালিস্টরা তোমার ট্রিটমেন্ট করবেন।
প্রয়োজনে অপারেশনের মাধ্যমে হার্টকে রভিাইভ করার ট্রাই করা হবে। দ্যাটস কল ম্যাক্সিম্যাম ইফোর্ট উইল বি মেইড।
-রিয়েলি?
-বেশি কথা বললে শ^াসকষ্ট বেড়ে যাবে তোমার। বি কোয়াইট অ্যান্ড ফিনিশ ইয়োর টি অ্যান্ড গো টু বেড।
অনুপের বেডরুম ছেড়ে আমি ড্রয়িংরুমে এলাম। আজ অনুপের হার্ট অপারেশনের ডেট ফিক্সড। ওকে এখনো জানানো হয়নি! ইটস অ্যা কমপ্লিকেটেড অপারেশন। লেটার হি উইল নো। সো দ্য অপারেশন ওয়াজ কেপ্ট অ্যা সিক্ট্রেট ফ্রোম হিম। খুব ক্লান্ত লাগছে। লাঞ্চ আওয়ার। রুহিতা ডাইনিং টেবিলে লাঞ্চ রেডি করে বলল, লাঞ্চ করবেন না?
-না। আমার কেন জানি খিদে নেই! পেটে অ্যাসিডিটির প্রবলেম। তোমরা লাঞ্চ সেরে নাও। হাসপাতালে যেতে হবে না?
-খালি পেটে অ্যাসিডিটি তো বাড়বেই। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে আসুন। শাওয়ারও নিতে পারেন।
-এখন না।
রুহিতা আমার প্রতি ভীষণ কেয়ারিং। অ্যাজ অ্যা ওয়াইফ শি ইজ ভেরি সিনসিয়ার অ্যান্ড সুইফ্ট অ্যাট হার ডমেস্টিক লাইফ। চোখ বুজে সোফা সেটের সাথে হেলান দিলাম। এসি অন করলাম। অপেক্ষা আরও গুরুগম্ভীর হতে লাগল। ধীরলয়ে এগিয়ে যেতে থাকল প্রতিটি শ^াস-প্রশ^াসের নীল রঙ।
দুই.
দু-পা এগিয়ে গেলাম লবির দিকে। লবিতে তখন নৈঃশব্দের গাঢ় গোঙানি চলমান। এত নিশ্চুপ কেন লবিটা? কতদিন আসা হয় না এখানে! কেন জানি আমি স্থির থাকতে পারি না! বেশিক্ষণ স্থির থাকলে দম বন্ধ হয়ে আসে আমার। আজ এতদিন পর দম ফেলতে এসে অস্তিত্বে খুঁজে পেলাম স্বস্তির স্পন্দন। রুহিতাকে ড্যাশবোর্ডের ওপর থেকে গোল্ডলিফের প্যাকেটটা নিয়ে আসতে বললাম! সে সিগারেটের প্যাকেট হাতে আমার পাশে এসে দাঁড়াল। বলল, এই নিন! প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে জ¦ালালাম। কী নির্দয়ভাবে নিজেকে পোড়াতে শুরু করল সিগারেটটা! আমাকে তৃপ্ত করাটায় যেন ওর মৃত্যুলগ্ন প্রতিজ্ঞা! সিগারেটের ধোঁয়ায় রুহিতার তেমন কোনো প্রবলেম হয় না আর। প্র্যাকটিসিং হয়ে উঠেছে সে। বেশ এনজয় করে এখন। সিগারেট ফুঁকছি এক নাগাড়ে। ধোঁয়া গিলছি, ধোঁয়া ছাড়ছি। ঝাঁঝ লাগছে কলিজায়।
-আমি রুহিতার দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার দাঁতের মাড়ির পেইন কমেছে?
-কমেছে!
-ওষুধ খেয়েছ?
-জি, খেয়েছি!
-এক্সরে ফিল্মে তোমার দাঁতগুলো দেখে আঁতকে উঠেছিলাম।
-কেন?
-কী বীভৎস আর কী বিকট দেখাচ্ছিল!
-প্রোক্লাইনটিভের মতো?
-ইয়েস, অ্যাজ লাইক দ্যাট!
দাঁত বের না করেইঠোঁট টিপে মৃদু হাসল রুহিতা।
-যাহ, কী যে বলেন না আপনি?
-একটা গান শোনাবে রুহিতা? কতকাল তোমার গান শুনি না!
-আমি তো এখন আর গান করি না! প্র্যাকটিসও নেই আগের মতো। জানেন না বোধ হয়?
-পারফেক্ট ইয়োর ভয়েস ফর সিং অ্যা সং। প্র্যাকটিসটা চালিয়ে গেলেও তো পারতে!
-সে আর হলো কই? আপনার সংসারের মাপজোক করতে করতেই তো গলা থেকে গান বিদায় নিয়েছে অভিমানে। আচ্ছা,আপনি
আর কতদিন বাসায় থাকবেন?
-কেন, আজ হঠাৎ থাকাথাকির কথা বলছ যে?
-আপনি জার্নালিস্ট না! কখন, কোথায়, কোন দিকে যেতে হয়- তার কোনো টাইম টেবল আছে?
-তা অবশ্য ঠিকই বলেছ। তবে আপাতত পত্রিকা অফিস থেকে তেমন কোনো ডিরেকশন নেই।
-সন্ধ্যায় কি আমাকে একটু সময় দিতে পারবেন?
-কেন, কী হয়েছে তোমার?
-অনুপের হার্টের প্রবলেমটা বেড়েছে।হসপিটালে আবার অ্যাডমিট করাতে হবে ওকে।
-কে বলল?
-টপি ফোন করেছিল। বলল- আপু, ছোট ভাইয়া হেবি ক্রিটিক্যাল কন্ডিশনে আছে। তোমরা এসো একবার!
কী যেন এক অদ্ভুত রকমের বেদনা, বুকভরা যান্ত্রিক কষ্টগুলো ছন্দপতন ঘটাতে থাকল আমাদের মাঝে। কোথায় যেন হারিয়ে যেতে থাকলাম দুজন! রুহিতা আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও ওকে কেন জানি অপরিচিতা মনে হতে লাগল হুট করেই। বুঝলাম না ব্যাপারটা! সামনের দিকে তাকালাম। দেখলাম পানির টাঙ্কির ওপরঅনেকগুলোশ্যাওলা জমেছে। ওদিকে তাকিয়েও আত্মপ্রত্যয়ী হতে চেয়েও পারলাম না কেউই। রুহিতা একটা চাপা দীর্ঘশ^াসছাড়ল। সেই দীর্ঘশ^াসজুড়ে কেবলই বিষণœতার রঙখসা ছায়া।
-ওকে বললাম, তুমি এত টেন্সড কেন?
-কই, না তো! কফি করব আপনার জন্য?
-করবে? না, থাক। এখন না!
-বুঝতে পারছেন না কেন, কফি আর গল্প-গল্প আর সিগারেটে সময় আরও দিক বদলাবে দ্রæত।
-তাই বুঝি? দরকার নেই। তুমি এখন একটু রেস্টনাও।
রুহিতা আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।এরকম একটা টেকসই সঙ্গই বোধ হয় বহু বছর বেঁচে থাকতে উৎসাহ জোগায়। সত্যি, এত বছর পর রুহিতার অমন স্পর্শ আমাকে ক্ষণে ক্ষণে নতুন করে প্রেমিক হতে বাধ্য করছিল। ওর হাত দুটো ধরে ইজি চেয়ারে বসিয়ে দিলাম।
বললাম, অনুপের জন্য খারাপ লাগছে খুব?
-না না, অতটা নয়!
রুহিতার কন্ঠে জড়তা স্পষ্ট। কষ্টগুলোকে লুকাতেই বেশি ভালোবাসে সে। হাতের ওপর থুতনি রেখে রুহিতা বলল- আপনি কখনো নিয়ম ভেঙে ভাঙা প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ঘন অন্ধকারে জ্যোৎ¯œাকে নিয়ে রিপোর্ট করেছেন? রেললাইনে কি কখনো নিঃসঙ্গ কাউকে আত্মহত্যা করতে দেখেছেন?
-আমি বললাম, কী বলছ এসব রুহিতা?
-কেন, কবিতা! আপনি তো জানেন, মন খুব খারাপ থাকলে কবিতা আমার ভীষণ ভালো লাগে।
-হ্যাঁ, তা তো জানি।
-আপনি যখন আর্টিকেল কালেক্ট করতেদু-এক সপ্তাহের জন্য বাহিরে যান, তখন তো আমি আমাকে খুঁজে ফিরি কবিতা কিংবা গানের পঙক্তিজুড়ে। আমার নিজস্ব সত্তাটাকে বাঁচাতে নির্মেদ কোনোরাত্রিকে ভালোবেসে একা একা প্রতীক্ষায় থাকি আপনার ফিরে আসার। শূন্যতা যখন বুকটাকে খামচে কামড়ে রক্তাক্ত করে ফেলে, আমি তখনো আপনাকেই ধারণ করি মন ও মগজে।
-আমি ভীষণ অবাক হয়ে রুহিতাকে দেখছি। এত গভীর ও পবিত্র আসক্তি আমার প্রতি ওর?
-সে বলল, কী হলো, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলেন না কি?
-তা হব কেন?
-তাহলে কিছু বলছেন না যে?
-কী বলব?
রুহিতা হাসতে লাগল। কী পরিতৃপ্তির হাসি! বলল, বুঝলেন মনজু, পৃথিবীটা বড্ড মায়ার! এখানে চিরকাল থাকতে ইচ্ছে করে, একে অপরকে আঁকড়ে ভালোবাসাবাসির সাধও জাগে, অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িয়ে চোখে চোখ রেখে হারাতে ইচ্ছে করে দুজন দুজনাতে। আমি আবারওবিস্মিত হলাম।
-বললাম, কী হয়েছে তোমার রুহিতা?
-কী আবার হবে? মাঝে মাঝে নিজেকে নিজের ভেতর খুঁজতে গিয়ে বিপন্ন হয়ে উঠি। হৃদয়ের মানচিত্র ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে খÐিত অসুখগুলো।
দুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে পুরোনো দিনের হিসেবের খেরোখাতা।
-সাহিত্যিকের মতোঅত ভারি ভারি কথা বলছ কেন আজ?
-বাহ রে, সাহিত্যিক কি শুধু আপনার মতোপত্রিকাওয়ালারায় হতে পারে, আর কেউ পারবে না?
-তা কেন পারবে না? তাছাড়া আমি আবার সাহিত্যিক হলাম কবে থেকে?
-প্রিন্ট কিংবা ইলেক্ট্রিক মিডিয়ার ট্যালেন্টেড জার্নালিস্টরা তো সাহিত্যিক-ই! একটা আর্টিকেল লিখতে গেলে কত রকম শব্দের ব্যবহার শিখতে হয়!
-রাইট ইউ আর। প্লেয়িং উইথডিফারেন্ট ওয়ার্ডস আর ভেরি স্কিলফুল অ্যাক্টিভিটি।
-বুঝলেন, পৃথিবীতে এসে আমরা দিন দিন কেবল জন্ম-জখম বাড়াচ্ছি!
আজ এত অভিমান কেন রুহিতার বুকে? সে কি তাহলে ভেতর থেকে কিছু খুঁজছে? রুহিতার হাই বøাড প্রেসার। আজ নির্ঘাৎ ওর প্রেসার লিপিডের পরিমাণ বেড়ে যাবে। গত সপ্তাহে ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম ওকে। দাঁতের মাড়িরপ্্রচÐ ব্যথায় কাবু হয়ে গিয়েছিল। ওপিজি করার পর এখন বেটার ফিল করছে সে। ইজি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল রুহিতা।
-ওকে বললাম, গরম পানির থ্যারাপি দিয়েছ মাড়িতে?
-না।
-আজ একটু বেশিই ডেসপারেট হয়ে গেছ তুমি। ওরাল ওষুধে মাড়ির ব্যথা সম্পূর্ণ ভালো না হলে স্ট্রংলি সেনসিটিভ ইনজেকশনের কম্বাইন্ড ডোজ পুশ করতে হতো। বাট ইউ আর সো লাকি দ্যাট, ইউ আর ফিলিং বেটার বাই দ্য ওরাল মেডিসিন অ্যান্ড বয়েল-ওয়াটার থ্যারাপি।রুহিতার সারা মুখ কেন জানি ঘামছিল!
-বললাম, তুমি এত ঘামছ কেন?
-ঘামছি? ঝাঁই লেগে আছে মাথার মধ্যে। ঘাড়ের রগগুলোয় টান অনুভব করছি।
-প্রেসার উঠছে?
-বোধ হয়া!
বেডরুমে নিয়ে গেলাম রুহিতাকে।বিশ মিলিগ্রামের একটা ওল্মেসিপ খাইয়ে বেডে শুইয়ে দিলাম ওকে।
তিন.
সিট না পেয়ে বাসে উঠে দাঁড়াতেই ওপরের লাগেজ বক্সের সাথে মাথাটা জোরসে সেঁটে গেল আমার। তবুও দাঁড়ালাম। সারবন্দী আরও অনেকেই দাঁড়িয়ে। সামনের কোনো স্টপেজে অনেকেই নেমে যাবে। অল-পারপাস ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা একজন ভদ্র মহিলার সাথে গা ঘষা লাগতেই তিনি আমার দিকে খেঁকিয়ে তাকালেন। কিন্তু কিছুই বললেন না কেন জানি! চোখে গগলস, দামি পারফিউমের স্মেল শরীরে, ওয়েল ড্রেসড, ভীষণ স্মার্ট! আমি দ্রæত দৃষ্টি সরিয়ে নিলাম। হুট করেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, মনজু না? জার্নালিস্ট!
-জি, মৃদুস্বরে উত্তর দিলাম। আপনি?
-কীসের আপনি? আমি তোমার ব্যাচমেট!
-ব্যাচমেট? চিনতে পারছি না তো!
-সৌমি। ঢাকা ইউভার্সিটির ম্যাস কমিউনিকেশন অ্যান্ড জার্নালিজম ডিপার্টমেন্টের দুই হাজার দুই-এর ব্যাচ।
-ওহ নো সৌমি! রিয়েলি অ্যাট ফার্স্ট আই ডিডেন্ট নো ইউ। গগলস চোখে তোমাকে ক্লিয়ারলি বোঝা যাচ্ছিল না!
-নো ফ্যাক্ট। ইটস ওকে। কোন পত্রিকায় কাজ করছ এখন?
-ইত্তেফাক, ক্রাইম রিপোর্টার। তুমি?
-আমি বিদেশে সেটেল্ড। কদিনের জন্য দেশে এসেছি। তুমি এখন কোথায় যাচ্ছ মনজু?
-পত্রিকা অফিস। সময় করে এসো একদিন আমার বাসায়। কফি খেতে খেতে কথা হবে। তোমার ভাবী খুব ভালো কফি মেকার।
-তাই? ভাবী তো ভালো গানও করে শুনেছি। বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমিতে না কি গানের তালিম নিত?
-জি! এখন আর অতটা প্র্যাকটিসের সময় পায় না।
সৌমির ম্যানেজমেন্ট সাইকোলজি ভীষণ অ্যাক্সেপটেবল। যেকোনো পরিস্থিতিকে ট্রাকেল দিতে পারত সে। আমরা তখনো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কথা বলছিলাম। একটা সিট খালি হলে ওকে সেখানে বসিয়ে দিলাম। বাসের জানালা দিয়ে আসা কর্কশ-রু²-ধূলিময় বাতাসগুলো আমাদের চোখে-মুখে আছড়ে পড়ছিল। এত ভিড়-ভাট্টার মধ্যেও কন্ডাকটর ঠেলাঠেলি করতে করতে একবার এমুড়ো, আরেকবার ওমুড়ো যাওয়া আসা বন্ধ রাখেনি। কী জিন্দেগি ছেলেটার! একটুও ক্লান্তির ছিটে-ফোটা নেই চোখে-মুখে। দাঁড়িয়ে থাকতে খাকতে কারও কারও শরীর ভেঙে ভেঙে আসছিল। আমার অবশ্য দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস দীর্ঘ দিনের। একটা আর্টিকেল কালেক্টের জন্য কতকিছুই না করতে হয়! সৌমি সিটে হেলান দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আনমনে কী যেন দেখছে! চোখে ঢুলুনি ঘুম দেখতে পেলাম ওর।
বাস চার-পাঁচ মিনিটের স্টপেজ দিলে সৌমি নেমে গেল। বলল, কথা হবে ওভার কলে। লেট মি ইন্ট্রোডিউস উইথ ইয়োর ওয়াইফ ওয়ান-ডে। স্টে সেভ অ্যান্ড বেস্ট। সিটে বসে আমি ওর চলে যাওয়া দেখলাম। আজকাল ঢাকা শহরের গাড়িগুলো বড্ড বেশিই ম্যাড়মেড়ে হয়ে উঠেছে। একবার স্টপেজ দিলে চার-পাঁচ মিনিটের জায়গায় পনের-বিশ মিনিট ওয়েস্ট করে। কী একটা ডিজগাসটিং অবস্থা! স্থির দৃষ্টিতে বাইরে দেখছি। অনুপের জন্য রুহিতার অমন অস্থিরতা আমাকেও যে ভেতর থেকে বিষণœ করে তোলেনি- এমনটা তো নয়! ওভার টেনশনে রুহিতার প্রেসার বাড়ার অভ্যাসটা ওর স্টুডেন্ট লাইফ থেকেই। ঘুমাতেও পারে না সারা রাত। সিডাক্সিন কিংবা ডরমিকাম খাইয়ে দিতে হয় কখনো কখনো। বাসের মধ্যে একঘিয়েমি লাগছে খুব। বাইকটা যে কেন নিয়ে এলাম না? মানসিকভাবে বিষিয়ে উঠছি। সেলুলয়েড ফিতার মতো নিজেকে নিজের ভেতর গুটিয়ে রাখতে চেয়েও পারছি না। দূরের পথ ভেঙে ভেঙে আসাটা কি সহজ কথা? কেমন যেন নিরাসক্ত হয়ে উঠছে আমার চোখ, আমার ঠোঁট, আমার হৃৎপিÐের বিকট ওঠানামা। বাসে যাতায়াত করাটা সত্যিই হরিবল অ্যান্ড ইরিটেটিভ। আমাদের পাশ কেটে খটখট শব্দে চলে যাচ্ছে আরও কত গাড়ি!
অনেকেই লাগেজগুলো নামিয়ে নিতে শুরু করল লাগেজ বক্স থেকে। মুহূর্তেই যেন সবাই ব্যস্ত হয়ে উঠল খুব। টার্মিনালে গাড়ি এসে পড়ল না কি? জানালার গøাসে মাথা ঠেকালাম আমি। কন্ডাকটর এসে বলল- স্যার, ভাড়াটা?
-কত?
-দুজন মিলে পঁয়ষট্টি টাকা।
-দুজন মানে?
-ওই যে একজন ম্যাডামের সাথে কথা বললেন না তখন!
-সৌমি?
-নামটা তো জানি না।
-ওহ, তাই তো! পঁয়ষট্টি টাকা কেন? সত্তুর টাকা কেন নয়?
-আপনারা দুজন সিট না পেয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন তো, তাই!
-তাই?
-জি, পাঁচ টাকা আপনাদের জন্য কনসিডার।
-আচ্ছা, ওই ম্যাডাম নেমে যাওয়ার সময় তোমাকে ভাড়া দেয়নি?
-ভিড়ের মধ্যে সুযোগ পায়নি বোধ হয়! তাছাড়া আপনারা দাঁড়িয়ে ছিলেন বলে আমিও নিতে আসিনি। ভেবেছিলাম সিট পেলে ভাড়া নিতে আসব।
তার আগেই তো উনি স্টপেজ দিলে নেমে গেছেন।
-কোনো ব্যাপার না! এই নাও ভাড়া। সত্তুর টাকায় দিলাম। তোমার বিবেকের পরিধি আমাকে মানবিকতার নতুন কিছু শব্দের ব্যবহার নতুন করে
শেখাল। বুঝলে, বিবেকের চেয়ে বড় কোনো বিচারিক আদালত পৃথিবীতে নেই।
-কী যে বলেন না স্যার? এই নিন পাঁচ টাকা!
-আরে এই পাঁচ টাকা তোমার বিবেকের দাম। যদিও যৎসামান্য। রেখে দাও।
-স্যার, আপনি কোথায় নামবেন?
-কারওয়ান বাজার, ইত্তেফাক বিল্ডিং।
-তাহলে উঠুন। সার্ক ফোয়ারা মোড়েই আপনাকে নামতে হবে।
-কেন?
-ফার্মগেট থেকে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ সড়ক হয়ে আমাদের ভেয়িকল সার্ভিস সার্ক ফোয়ারা পর্যন্তই।
-কী বলছ?
-জি। আমরা এখন ফিলিং স্টেশনে ঢুকব। গ্যাসের সার্ভিস রেঞ্জও কমে এসেছে। সিলিন্ডার ফুল করতে হবে। রোড পার্মিটের লিমিটেশন চার্ট
দিয়েছে সিটি করপোরেশন।
-কারণ কী?
-মেট্রোরেল প্রজেক্টের জন্য।
-আপনি রিপোর্টার হয়েও জানেন না? মশকরা করছেন? না কি রিপোর্ট কভার করছেন, স্যার?
-আমি তো ক্রাইম রিপোর্টার! তাছাড়া তুমি কীভাবে বুঝলে আমি জার্নালিস্ট?
-ড্রেসকোড ও গলায় ঝুলিয়ে রাখা আইডি কার্ড দেখে।
-তাই? তুমি এডুকেটেড?
-ইন্টারমেডিয়েট অব্দি।
-অনার্সে অ্যাডমিশন নাওনি?
-নিয়েছিলাম, সরকারি আজিজুল হক কলেজে। তারপর পুঁথিগত বিদ্যার শেষ অধ্যায়ে শেষ দাগ টানতে হয়েছে।
-বগুড়া না?
-জি। আপনি চেনেন?
-হ্যাঁ। আমাদের জার্নালিস্ট ফোরাম থেকে দু-তিনবার সাংবাদিক সম্মেলনে ওই কলেজে গিয়েছিলাম। র্যাঙ্কিং প্লেসে থাকা রিনাউন্ড কলেজ ওটা।
অনার্সটা শেষ করলেও তো পারতে!
-সংসার বোঝেন স্যার? আমার কাছে সংসার মানে অসুখ, সংসার মানে শরীরের রক্তকে সাদা করা!
ছেলেটাকে বেশ ইনোসেন্ট মনে হলো। স্পিকিং স্কিল মনকাড়ল আমার। ওর সরল সোজা মানবিক বিবেচনা সম্পর্কে তো আগেই আঁচ করতে পেরেছিলাম।
সার্ক ফোয়ারা মোড়ে গাড়ি ¯েøা করতেই নেমে পড়লাম। এভাবে কখনো এপথে আসা হয়ে ওঠেনি। দু-চার মিনিট হাঁটার পর পত্রিকা অফিসে যখন ঢুকলাম তখন বিকেল সাড়ে তিনটে। স্ট্রিক্টলি ক্রাইম ডেস্কে গিয়ে বসে পড়লাম। আমার অপজিটে শিফ্ট ইনচার্জ ডেস্কে তপু ওর পিসিতে ভীষণ-ই বিজি। সে কি আমাকে দেখেনি? বললাম, কী ব্যাপার তপু- তোমাকে আজ খুব ক্রিয়েটিভ মনে হচ্ছে!
-আরে মনজু ভাই, কখন এলেন? আমি তো খেয়ালই করিনি!
-এখনি এলাম। কী নিয়ে অতটা অ্যাক্টিভ তুমি?
-জুনিয়রদের কি আর অ্যাক্টিভিটির শেষ আছে? তা আপনাকে অমন দেখাচ্ছে কেন?
-আর বল না, বাসে এলাম। এত ঝক্কি ঝামেলা কি সহ্য করা যায়?
-কেন, আপনার বাইক?
-ইচ্ছে করেই আনিনি।
-চিফ এডিটর আপনার একবার খোঁজ করলেন। দেখা করতে বলে গেলেন।
-যাব। কফি খেয়েছ তুমি?
-জি, আপনি আসার আগেই খেয়েছি।
ফ্লাস্ক থেকে এককাপ কফি ঢেলে খেতে শুরু করলাম। ধোঁয়া উড়ছে। কফির ধোঁয়া আমাকে কেন জানি নিঃসঙ্গ সময়ের কাছ থেকে টেনে তোলে প্রতিবার, খিঁচড়ে যাওয়া মেজাজকে সামাল দিয়ে আমার ফুসফুসকে ফ্রেশ করে দেয়। প্রতিদিনকার কথাগুলো এভাবেই জমতে জমতে হয়ে ওঠে অসমাপ্ত দিনলিপি।
এম মনজুরুল ইসলাম,
শিবগঞ্জ, বগুড়া।