ফারদিন নূর আরো একটি রহস্যের নাম।৪ নভেম্বর দুপুরে মায়ের সঙ্গে ভাত খেয়ে বুয়েট ক্যাম্পাসে যাওয়ার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়েছিল ফারদিন। বের হওয়ার সময় ওর মাকে বলেছিল, পরীক্ষা শেষ করে শনিবার দুপুরে বাসায় ফিরে একসঙ্গে খাবে। ঘটনার দিন রাত ১১টার দিকে ফারদিনের নম্বর থেকে ওর মায়ের নম্বরে কল এসেছিল। তখন ব্যস্ততার কারণে ফোন ধরতে পারেনি ওর মা। কিছুক্ষণ পরে ওর মা ফোন দিলে ফারদিন আর ফোন ধরেনি। যে ছেলেটি পরীক্ষা শেষে ফিরে এসে মায়ের সাথে ভাত খাবে বলে কথা দিয়েছিল সেই ছেলেটিই নাকি আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করেছে এই কথাটি আমার মত সাধারণ কোনো মানুষের মনগড়া কথা নয় বরং দায়িত্বশীলদের বক্তব্য। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী ফারদিন নূর হত্যা মামলার তদন্ত নতুন মোড় নিয়েছে। তাঁর মৃত্যুর কারণ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নানা পর্যায় থেকে বিভিন্ন তথ্য তুলে ধরা হলেও এখন তদন্তকারী সংস্থা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) দাবি করেছে, ফারদিন আত্মহত্যা করেছেন।
আমরা ধরে নিলাম সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য সঠিক। তাহলে প্রশ্ন হলো বস্তাবন্দী হিসেবে তার লাশ কিভাবে পাওয়া গেল? এর মানে কি এই যে ফারদিন নূর শুধু আত্মহত্যাই করেনি বরং নিজে আত্মহত্যা করে লাশটাকে বস্তাবন্দী করেছে কিংবা বস্তাবন্দী হয়ে তারপর আত্মহত্যা করেছে। একজন মৃত মানুষ কিভাবে বস্তার মধ্যে ঢুকলো সেটা বিস্ময়কর আবার একজন মানুষ বস্তার মধ্যে ঢুকে বস্তার মুখ বাইরে থেকে বন্ধ করে তারপর সেই বস্তাটা নদীতে ফেলে দিয়ে কোন যাদুশক্তিবলে আত্মহত্যা করলো সেটাও একটা রহস্য। জেকে রাউলিং এখানে তব্দা খেয়ে বসে আছেন।
শুরুর বক্তব্য আর এখনকার বক্তব্যের মিল নেই। গত ৭ নভেম্বর ফারদিনের লাশ পাওয়ার পর ময়নাতদন্ত করেন নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা শেখ ফরহাদ। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ফারদিনের পুরো মাথার বিভিন্ন অংশে আঘাত পাওয়া গেছে। বুকের ভেতরে আঘাতের চিহ্ন আছে। প্রাথমিকভাবে মনে হয়েছে, এটি অবশ্যই হত্যাকাণ্ড।
তবে ডিবি এখন বলছে, তারা ফারদিনের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকের সঙ্গেও একাধিকবার কথা বলেছে। ভিসেরা প্রতিবেদন পেলে চিকিৎসকেরা পূর্ণাঙ্গ মতামত দেবেন। সংস্থাটির দাবি, ফারদিনের মাথায় খুব সামান্য আঘাত ছিল, এ আঘাতের কারণে অজ্ঞান হতে পারেন। কিন্তু মৃত্যু হবে না বলে মৌখিকভাবে চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন। গণমাধ্যমের সামনে চিকিৎসক মাথায় অসংখ্য আঘাতের কথা বলেছিলেন। কিন্তু আঘাত থাকলে পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে আসত। সুরতহাল প্রতিবেদনে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আগের প্রতিবেদন গুলো ফলোআপ করলে দেখতে পাই ফারদিনের লাশ পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে ফারদিনের বাবাকে জোর করা হচ্ছিল নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা করার জন্য। আবার মামলায় যাকে আসামি করেছিলেন, পুলিশ আগেই বলেছে, তিনি নির্দোষ। এটা কেন করল তা অবশ্য ভাবনার বিষয়। এছাড়াও মামলা করার জন্য রামপুরা থানায় ফারদিনের বাবাকে চার–পাঁচ ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হয়েছে।
ফারদিনকে হত্যা করা হয়নি বরং সে আত্মহত্যা করেছে বলে মতামত ব্যক্তকরার পাশাপাশি ডিবি থেকে যুক্তি হিসেবে পারিবারিক চাপ, দুই ভাইয়ের পড়াশোনার টাকা জোগানো, ধারাবাহিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষার ফল খারাপ হওয়া ও বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে স্পেনে যাওয়ার টাকা সংগ্রহ করতে না পারাকে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করছে।এ ধারণার পক্ষে যুক্তি দিয়ে ডিবি বলছে, ফারদিন অন্তর্মুখী ছিলেন। সবাইকে সবকিছু বলতেন না। তাঁর পরীক্ষার ফলও ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছিল। ফারদিন প্রথম সেমিস্টারে ৩.১৫ সিজিপিএ পেয়েছিলেন। পরের সেমিস্টারে পান ২.৬৭। বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে স্পেনে যাওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকার দরকার ছিল, সেটা জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। বন্ধুরা তাঁকে ৪০ হাজার টাকা জোগাড় করে দিয়েছিলেন।
ডিবির তথ্যানুযায়ী, ফারদিন চার জায়গায় ছাত্র পড়াতেন। সেই টাকা দিয়ে নিজের ও ছোট দুই ভাইয়ের পড়াশোনার খরচ চালাতেন। এতগুলো ছাত্র পড়াতে গিয়ে তাঁর বাসায় ফিরতে দেরি হতো। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাসায় ফেরার জন্য তাঁকে পরিবার শাসন করত। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকা নিয়েও পরিবার থেকে বাঁধা ছিল। ঘটনার দিন তিনি যেভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন, তাতে মনে হয় তখন ফারদিনের মানসিক অবস্থা ভালো ছিল না।
ফারদিন সম্পর্কে ডিবির দেওয়া বক্তব্য সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়েছিল বুয়েটের ছাত্রকল্যাণ পরিচালক অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে। তিনি বলেন, ফারদিন পরীক্ষায় কিছুটা খারাপ করেছিল। স্পেনে যাওয়ার টাকা জোগাড় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিদেশে ওদের একটা দল যাচ্ছিল। তাঁদের প্রত্যেকের জন্য বুয়েট থেকে ২৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এখন আসি ডিবির বক্তব্য প্রসঙ্গে। তাদের ভাষ্যমতে স্পেন যাওয়ার জন্য ৬০ হাজার টাকা দরকার ছিল এবং তা জোগাড় করতে ফারদিন হিমশিম খাচ্ছিল। আবার তারাই বলছে ফারদিনের বন্ধুরা নাকি তাকে অলরেডি ৪০ হাজার ম্যানেজ করে দিয়েছিল। অন্যদিকে বুয়েটের ছাত্রকল্যাফ পরিচালক বললেন প্রত্যেকের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকৈ ২৫ হাজার বরাদ্দ ছিল। তাহলে ফারদিনের জন্য যদি মোট ৬০ হাজার টাকা দরকার হয় এবং বন্ধুরা ৪০ হাজার দিয়ে থাকে সেটার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের বরাদ্দকৃত ২৫ হাজার যোগ করলে মোট ৬৫ হাজার টাকা হয়ে যায়। টাকা জোগাড় হচ্ছেনা বা করতে পারছে না বলে হতাশ কথাটাতো তাহলে প্রযোজ্য হচ্ছে না। আরও বরং মোট খরচের চেয়েও ৫ হাজার টাকা বেশি জোগাড় হয়ে গেছে!
এখানেই শেষ নয়। ডিবি থেকে যে বলা হয়েছে ফারদিন অর্ন্তমূখী ছিলো বা পারিবারিক চাপ ছিল সেই প্রসঙ্গে গেলে আমরা দেখতে পাই নারায়ণগঞ্জের পাগলা এলাকায় ওদের বাড়ি রয়েছে। তবে পেশাগত দায়িত্ব ও সন্তানদের লেখাপড়ার স্বার্থে ফারদিনের বাবা কখনো ঢাকার মিরপুর, কখনো পেয়ারাবাগে এবং দীর্ঘদিন ধরে ডেমরার কোনাপাড়ায় থাকছেন। ফারদিন সেখানকার একটি অখ্যাত স্কুল থেকে বুয়েট পর্যন্ত এসেছিল। পাশাপাশি ফারদিন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যেত। টিএসসিতে আবৃত্তি শিখত। নিজের ব্যস্ততার কারণে ছেলের খুব বেশি খোঁজ রাখতে না পারলেও তার বাবার ভাষ্যমতে,ফারদিন নিজেই নিজেকে তৈরি করেছে। যেকোনো পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে চলতে পারত। এমন একটি ছেলে একরাতের ব্যবধানে হতাশায় আত্মহত্যা করবে এটা কি কেউ বিশ্বাস করবে? টাকা যোগাড় করতে না পারায় হতাশা জন্মানোর সুযোগ ছিল কিন্তু টাকাতো যুক্তি দিয়ে দেখানো হলো যে পরিমানের চেয়েও বেশি টাকা জোগাড় হয়েছিল। যারা বিতর্ক করে,বই পড়ে,সামাজিক কার্যক্রমে যুক্ত থাকে তাদের মন মানসিকতা কতটা শক্ত হয় তা আমরা জানি। ফারদিন আত্মহত্যা করেছে এই বক্তব্য তাই সবার মধ্যে একরকম দ্বিমত তৈরি করেছে। এটাইতো স্বাভাবিক। তাছাড়াও যেহেতু লাশ বস্তাবন্দী পাওয়া গেছে তাহলে সবচেয়ে বড় আর বোল্ড কোশ্চেনতো এটাই যে লাশ কিভাবে বস্তার মধ্যে ঢুকলো কিংবা একজন মানুষ বস্তার মধ্যে ঢুকে কিভাবে আত্মহত্যা করতে পারে বা করলেও সেই বস্তা কিভাবে নদীতে ফেলে দিতে পারে? এই প্রশ্নের উত্তর কি পৃথিবীর কেউ দিতে পারবে? স্পেনের মাদ্রিদে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের কথা ছিল তার। সেখান থেকে একটা সুনাম নিয়ে আসতে পারত বাংলাদেশ। ফারদিনের বাবা মা শুধু সন্তান হারায়নি, দেশ হারিয়েছে এক মেধাবীকে। এটা সবচেয়ে বেশি কষ্টের।
তদন্তকারী সংস্থা নিজেদের মত করে যেকোনো বক্তব্য দিতে পারে না আর যদি সেটা তাদেরই অন্য একটি পক্ষের বক্তব্যের বাইরে চলে যায় তখন তা আরো বেশি প্রশ্নবিদ্ধ হবে এটাই স্বাভাবিক। প্রয়োজনে সময় নিয়ে তদন্ত করে তারপর মতামত ব্যক্ত করতে পারতো। যদিও অবশ্য যথেষ্ট সময় নিয়েছে। আমাদের সামনে এখন অনেক অনেক প্রশ্ন ফারদিন নূর নিয়ে। কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই। হয়তো আরও দশটা ঘটনার মতই এই রহস্যও কোনোদিন মিমাংসা হবে না। কালের গর্ভে এভাবেই হারিয়ে যায় ফারদিন নূরদের মত ভাগ্যবিড়ম্বিতরা। দোষ যারা করে আমরা তাদেরকে দোষ দিতে পারি না। বাধ্য হয়ে দোষ দিই ভাগ্যের। আফসোস করে বলি ভাগ্যের পরিহাস। আসলেই কি এসব ভাগ্যের পরিহাস নাকি একরকম……..
১৫/১২/২০২২