Sunday, February 23, 2025

গ্রামঘর

পঙ্কজ শীল

শহর ছেড়ে অনেক দূরে, মাঠ-নদী-জঙ্গলে ঘেরা ছোট্ট এক গ্রাম। নাম “নবগ্রাম”। বিশাল অশ্বত্থ গাছের ছায়ায় ঘেরা, সরু মাটির পথের দু’পাশে খড়ের ছাউনি দেওয়া কাঁচা ঘর। এখানেই জন্মেছে হরেন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান।
হরেন ছোটবেলা থেকেই একরকম শান্ত স্বভাবের ছেলে। শহরের চাকচিক্য, বিলাসিতা, এমনকি পড়াশোনা নিয়েও তার খুব একটা আগ্রহ ছিল না। মাটির গন্ধ, নবান্নের ধানের সুবাস, কাকডাকা ভোরের সজীবতা—এসবই ছিল তার ধ্যান-জ্ঞান। তাই মাধ্যমিক পাস করেই সে বাবার মতো কৃষিকাজে মন দিল।
গ্রামের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই একসময় শহরমুখী হয়, কেউ লেখাপড়া করতে, কেউবা কাজের খোঁজে। কিন্তু হরেনের মধ্যে সেই বাসনা কখনো জাগেনি। গ্রামের মাটিতে, খেতের ফসলের মধ্যে, সোনালি ধানের শীষে সে আপন অস্তিত্ব খুঁজে পেত।

নবগ্রামের মানুষ সহজ-সরল, কিন্তু একে অপরের প্রতি প্রবল টান। বিশেষ করে উৎসবের সময় পুরো গ্রাম যেন এক আত্মীয়তায় জড়িয়ে যায়। পুজো-পার্বণে মন্দিরে সবার সমাগম হয়, কীর্তনের আসরে হারিয়ে যায় ক্লান্তি।
কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদল আসতে থাকে। পাশের গ্রামের রাস্তা পাকা হয়ে যায়, ইলেকট্রিসিটি আসে, মোবাইলের টাওয়ার ওঠে। শহরের টান বাড়তে থাকে গ্রামের ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
একদিন হরেনের বন্ধু সোমনাথও জানিয়ে দেয়, সে শহরে গিয়ে কাজ করবে। সে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করে, “শহরে গেলে তুই সুখী হবি না সোমা। মাটির গন্ধ ভুলে গেলে?”
সোমনাথ হাসে, “জীবন চালাতে টাকা লাগে হরেন! ফসল ফলিয়ে আর কতটুকু পাবো?”
হরেন কিছু বলে না। নিজের উঠোনে বসে শোনে মাটির সোঁদা গন্ধ, বাতাসের শব্দ। তার মন বলে, শহর হয়তো চাকচিক্যময়, কিন্তু সেখানে নেই এই সবুজের স্নিগ্ধতা।

বছর পাঁচেক পর।
গ্রামের রূপ বদলে গেছে। আগে যেখানে মাঠ ছিল, সেখানে এখন ইটভাটা। খাল-বিল শুকিয়ে খটখটে মাটি। কাঁচা রাস্তার জায়গায় কংক্রিট ঢালা পথ।
হরেনের বয়স এখন তিরিশ ছুঁইছুঁই। বাবার মৃত্যুর পর পুরো কৃষিকাজের দায়িত্ব এখন তার কাঁধে। তবুও সে একাই দাঁড়িয়ে আছে, তার বিশ্বাস মাটির টান একদিন আবার সবাইকে ফিরিয়ে আনবে।
একদিন সন্ধ্যেবেলা হরেনের উঠোনে এক গাড়ি এসে দাঁড়ায়। গাড়ি থেকে নামে সোমনাথ। দামি প্যান্ট-শার্ট, হাতে মোবাইল। সে এখন শহরের বড় ব্যবসায়ী।
“কেমন আছিস হরেন?”
হরেন ম্লান হেসে বলে, “তুই ফিরলি?”
সোমনাথ হাসে, “ব্যবসার জন্য। এ গ্রামে কিছু জমি কিনবো।”
“কেন?”
“কারণ এখানে একটা রিসোর্ট বানাবো! শহরের মানুষ গ্রাম দেখতে চায়। বিশাল রিসোর্ট হবে, সুইমিং পুল থাকবে, আধুনিক সুবিধা থাকবে।”
হরেন চুপ করে থাকে। তার মাটির ঘর, উঠোন, শস্যখেত—এগুলো কি সত্যিই পর্যটকদের দেখার জন্য? নাকি শহরের আধুনিকতা সব গ্রাম্য সৌন্দর্যকে গিলে ফেলবে?

লিখুন প্রতিধ্বনিতেলিখুন প্রতিধ্বনিতে

বছরখানেক পর রিসোর্ট তৈরির কাজ শুরু হয়। গ্রামবাসীদের অনেকেই এতে কাজ পায়, রোজগার বাড়ে। কিন্তু হরেনের মন খারাপ হয়ে যায়। তার চেনা গ্রাম বদলে যাচ্ছে, গ্রামের কোলাহল যেন কৃত্রিম হয়ে উঠছে।
একদিন রাতের বেলা ঝড় ওঠে। রিসোর্টের আধা-বাঁধা কাঠামো ভেঙে পড়ে। এক সপ্তাহের মধ্যে বিনিয়োগকারীরা সরে যায়।
সোমনাথ এসে হরেনের কাছে বসে।
“হয়তো তুই ঠিক ছিলি হরেন। গ্রামকে গ্রামই থাকা উচিত।”
হরেন একটা হাসি দেয়।
সকালে উঠোনে দাঁড়িয়ে সে দেখে, সূর্যের আলোয় ঝলমল করছে তার মাটির ঘর। গ্রামের প্রকৃত সৌন্দর্য হয়তো এটাই—যা কোনো শহরের মানুষ কেনার ক্ষমতা রাখে না।

Facebook Comments Box
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনিhttps://protiddhonii.com
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।
এই ধরণের আরো লেখা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here

- Advertisment -
Google search engine

সাম্প্রতিক লেখা

Recent Comments