লেখকঃ সালাহ উদ্দিন শুভ্র
গানের বিচারে কবীর সুমনের গুরুত্ব অন্য কারো কারো তুলনায় কম। যেমন বলা হয় গানের কথা। সুমন আটপৌরে কথা দিয়ে গান লিখেছেন, যা বাংলা আধুনিক গানে নতুন। আমাদের আজম খান তার আগেই সালেকা মালেকা, আলাল ও দুলাল এসব সহজ, মুখের ভাষা ও দৈনন্দিন ঘটনা নিয়ে গান লিখেছেন। আমাদের ব্যান্ড সঙ্গীতেও এমন গান আছে অনেক। প্রতিবাদী-বিক্ষোভী গান।
সুমনের আগে কলকাতায় মহিনের ঘোড়াগুলির গানও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তারা রাবীন্দ্রিকতার বিরুদ্ধে এক বিশেষ ধরনের শিল্প তৈয়ার করছেন এবং সফল হইছেন। তারা মেট্টোপলিটন মনটাকে ধরতে পারছিলেন। মহিনের ঘোড়াগুলির গানে বিদ্রোহ, বিপ্লবের মতো মিষ্টি মাখানো ছিল না। ছন্দবদ্ধ, স্লোগান সর্বস্ব কথা দিয়ে তারা গান লেখেন নাই।
সুমন মহিনের ঘোড়াগুলিরও পরের গান। তিনি স্বর, শব্দ, উচ্চারণে রাবীন্দ্রিকতাকে পুনঃস্থাপন করছেন।
যদি সার্ভে করা হয়, তাইলে আধুনিক মনস্কা, ক্ল্যাসিক্যাল বাঙালি মেয়েরা পছন্দ করবে কোন পুরুষ চরিত্রকে? সুমনের মতো ভরাট গলা আর শুদ্ধ উচ্চারণের ছেলেকে।
সুমনকে পছন্দ করার ভিত্তি ওটা। ওনার গান নিয়ত এক্সপেরিমেন্টাল। রাগের বিভিন্ন সুরকে আত্মস্থ করার চেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন। কিন্তু সুর বা গলার কাজ প্রধান ওনার গান না। কথা সর্বস্ব গান। আধুনিক, পেপার পড়া, মার্ক্সবাদের সঙ্গে পরিচিত, অসাম্প্রদায়িক, অবস্থাপন্ন বাঙালি উচ্চ ও মধ্যবিত্ত রাস্তায় না নেমেও যে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাতে পারেন, সুমন হচ্ছেন সেই স্বর।
আমাদের তপন চৌধুরীর ইত্যাদির তুলনায় ভালো গায়ক তিনি। প্যানপ্যানে প্রেম, বিরহের গান থেকে তিনি শিক্ষিতদের কানকে তুলনামূলক আরাম দিয়েছেন।
কলকাতার চেয়ে তিনি বাংলাদেশে অধিক জনপ্রিয়। এর প্রধান কারণ তিনি বামগন্ধী গায়ক এবং রাবিন্দ্রীক। রবীন্দ্রনাথের প্রতি বশ্যতা না থাকলে বাংলাদেশে এলিট, ক্ষমতাশীল, প্রগতিবান গোষ্ঠী সুমনকে এই মর্যাদা দেবেন না। সুমনের গানে যুগপৎ আপস এবং বিদ্রোহ আছে। রাজনৈতিক অর্থে ধরলে সোস্যাল ডেমোক্র্যাট। তবে রাস্তায় না নামার সুবিধা সুমন নিয়মিতই নেন। তিনি গানে নকশালদের বন্দনা করেন আবার অগানে তাদের গালিগালাজ করেন৷ তার রাজনীতি করার কথা সিপিএমের সঙ্গে, করেন তৃণমূলের সঙ্গে। আবার তৃণমূল মানে তার কাছে এখন শুধুই মমতা। গোটা তৃণমূল চোর-বাটপারে ভরা, একলা মমতা ভালো।
এত ফ্ল্যাকচুয়েশনে কলকাতায় তার মর্যাদার আসন টলেছে। বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলনে তিনি গান লিখেছেন। কেন, কী লিখেছেন জানি না। আমি কলেজ জীবনের পর তার গান আর নিজে বাজিয়ে শুনি না।
তবে খবর রাখি। তিনি আসিফ আকবরের সঙ্গে এখন গান করেন আর খেয়ালের চেষ্টা করেন।
গানে সুমনের যে রাজনৈতিক প্রস্তাব বা ডাক-তা যতটা উদ্ধার করতে পারি কলকাতার জন্য জরুরি। বাংলাদেশের ক্রাইসিস ডিফরেন্ট। এখানকার কলকাতামুখী প্রগতিশীলরা অবশ্য তাকে জরুরি মনে করতে পারেন।
গানে সুমন তার আসন দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য খেয়ালে মনোনিবেশ করছেন ইদানিং। তাও তার খেয়ালে আগ্রহ কম শ্রোতাদের। বাংলা খেয়াল গেয়ে সুমন গানের ইতিহাসে একটা জায়গা পেতে চান। তিনি জানেন তার আগের গান টিকবে না। খেয়াল গেয়ে সুমন কী করবেন বা কী গাইছেন জানি না, কমপ্লিট কিছু পেলে শুনব।
তার রবীন্দ্র সঙ্গীত অবশ্য ইউনিভার্সিটিতে শুনতাম। এখন আর সেটাও ভালো লাগে না। রবীন্দ্র সঙ্গীতে রাবীন্দ্রিকতা আমার ভালো লাগে না।
তার গাওয়া ‘গগনে গগনে আপনার মনে’ গানটা পছন্দের ছিল। ইদানিং আবিষ্কার করলাম পঙ্কজ মল্লিকের গলায় ওই গান আরো ভালো শোনায়।
তো সুমনের গানের অনুষ্ঠান শেষ হলে শাহবাগে একটা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী মানববন্ধনের আশায় রইলাম।