-মুহাম্মদ নূর ইসলাম
রতনের কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিলো না ঐ বাড়িতে ভূত আছে। ওর বন্ধু হরেন ঠাকুমার কাছ থেকে শুনেছে করোনার সময় ঐ বাড়ির সবাই করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ার পর ওদের আত্মা নাকি ভূত হয়ে সারা বাড়ি পাহারা দেয়, যেন কেউ ঐ বাড়ির আসবাবপত্র চুরি করতে না পারে। এই ভয়ে অবশ্য কেউ ঐ বাড়ির গেট পেরিয়ে ভেতরে যাওয়ার সাহস পায়নি। বাড়ির আঙিনায় মাঝারি সাইজের একটি আমড়া গাছ, থোকায় থোকায় ঝুলে থাকা আমড়াগুলো পেকে পড়ে থাকে মাটিতে। গাছের ডালে বাসা বেঁধেছে এক জোড়া কাক, সন্ধ্যা হলে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় এসে ঝুলে থাকে গাছে, চামচিকা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়ে ঘরে। ঐ বাড়িটি আগে ঝকঝকে থাকলেও এতদিনে পোকামাকড়ের আস্তানায় পরিণত হয়েছে, অনেকের কাছে ভুতুড়ে বাড়ি নামেই পরিচিত ঐ বাড়িটি।
রতন বয়সে ছোট হলেও ভীষণ সাহসী আর দস্যিপনায় ইঁচড়ে পাকা। ছোটবেলা থেকে এ পর্যন্ত ভূতের অনেক গল্প শুনেছে রতন, রতনের মাসতুতো ভাই রাহুল ভূতের ভয়ে রাতে প্রসাব করতেও বাইরে বের হয় না একা একা। প্রসাবের বেগ এলে হয় বাবাকে ডাকবে, না হয় মাকে। মাঝে মাঝে জানালা দিয়েই কাজ সেরে আবার শুয়ে পড়ে। গল্পে গল্পে একদিন রাহুলের মুখ থেকে একথা শোনার পর রতন হেসে কুটিকুটি। একদিন রাহুলকে দেখে রতন বলে উঠলো “কিরে ভিতর ডিম! রাতে এখনো কি জানালা দিয়ে মুতিস?” রাহুল কিছুটা লজ্জা পেলেও তর্ক করে বললো “যেদিন ভূত তোর ঘাড় মটকে দিবে সেদিন বুঝবি ভূত নিয়ে ঠাট্টা করার কি মজা।” রতন হো হো করে হাসতে হাসতে বললো “ধুর পাগল! ভূত বলতে জগতে কিছু আছে নাকি? তুই কখনো ভূত দেখেছিস যে ভূতের কথা শুনলে ভয়ে কাঁপিস?” রাহুল বললো “তা দেখিনি, কিন্তু ভূত আছে এটা তো সত্যি।” রতন বললো “আচ্ছা ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম, কিন্তু ভূত কোথায় আছে সেটা কী জানিস?” রাহুল বললো ” হুম জানি, তুই কি শুনিসনি ঐ বাড়িতে ভূত আছে? আমি হরেনের ঠাকুমার কাছে শুনেছি ঐ বাড়ির সবাই করোনায় মারা যাওয়ার পর ওরা নাকি ভূত হয়ে ঐ বাড়ি পাহারা দেয়।” রতন বললো “তাই নাকি, তাহলে চল আমরা আজ বিকেলে ঐ বাড়িতে ভূত দেখতে যাবো।” রাহুল বললো রাম! রাম! একথা খবরদার আর মুখে আনিস না। ওরা ভূত হয়ে সারা পাড়া ঘুরে বেড়ায়, ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা শুনতে পেলে ওরা কিন্তু ঘাড় মটকে দিবে। ঐ বাড়ি তো দূরের কথা, আমি ঐ বাড়ির আশেপাশেও যাবো না ভাই, তোর সাহস থাকলে তুই যা।”
লোকমুখে শোনা কথা বিশ্বাস করার পাত্র নয় রতন, ভূতের কথা তো একদমই বিশ্বাস করে না। কিন্তু ঐ বাড়িতে যে ভূত নেই একথা বিশ্বাস না করেও উপায় নেই কারো। রতন একদিন সিদ্ধান্ত নিলো, যে করেই হোক রাহুলকে সাথে নিয়ে ঐ বাড়িতে ভূত দেখতে যাবে সে। রাহুলকে অনেক অনুরোধ করার পর যেতে রাজি হলো একটি শর্তে। রাহুল বললো “আমি তোর সাথে ঐ বাড়ি পর্যন্ত যাবো তবে গেটের ভেতর ঢুকবো না। তোর ভূত দেখার শখ তুই একাই বাড়ির ভেতরে ঢুকিস।” রতন বললো “ঠিক আছে, তুই গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকিস আমি একাই ঐ বাড়ির ভেতরে ঢুকবো।” যেই কথা সেই কাজ, রতন ওয়াল টপকে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো তারপর ভাঙা জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো ঘরের ভেতর কয়েকটা চামচিকা আর টিকটিকি ছাড়া কেউ নেই। ভাঙা জানালা দিয়ে রাতুল ঘরের ভেতরে ঢুকতেই ঘরে থাকা চামচিকাগুলো বেরিয়ে বাড়ির চারপাশে উড়তে লাগলো, রাহুল চামচিকা দেখে ভয়ে চিৎকার দিয়ে দিলো এক দৌড়। এদিকে রতন সারা বাড়ি ঘুরে দেখলো ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে কয়েকটি মরা ইঁদুর আর একটি মোটা কালো বিড়াল। বিড়ালটি রাতুলকে দেখে ভয়ে আক্রমণ করতে তেড়ে আসতেই রাতুল হাতে থাকা লাঠি দিয়ে বিড়ালের মাথায় কষে বাড়ি মারলো, আর অমনি বিড়ালটি ঘরের ভেতর কয়েক পাক মেরে চার-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়লো।
রাতুল মরা বিড়ালটি কাপড়ের ব্যাগে ভরে জানালা দিয়ে বের হয়েই দেখলো গেটের ওপাশে অনেক লোক ভীড় করে দাঁড়িয়ে আছে, রতন হাসতে হাসতে সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো “এই দেখো ভূত মেরে ব্যাগে ভরে এনেছি।” একথা শুনে সবার চোখ যেন ছানাবড়া হয়ে গেলো! হরেনের ঠাকুমা কাঁপা কাঁপা গলায় বলতে লাগলো “পালাও পালাও ভূতেরা রতনকে মেরে রতনের বেশ ধরে এসেছে। এবার ভূত আমাদের সবার ঘাড় মটকাবে।” রতন কিছুটা ধমকের স্বরে ব্যাগ থেকে মরা বিড়ালটি বের করে বললো “ঠাকুমা তুমি একটা ভীতুর ডিম, তুমি সবাইকে ভূতের ভয় দেখিয়ে ভীতু বানিয়ে রেখেছো। এই দেখো তোমাদের ঘাড় মটকানো ভূত! এবার বিশ্বাস হলো তো আমায়? আমি তোমাদের আগেই বলেছিলাম- এই বাড়িতে তো দূরের কথা, পৃথিবীর কোথাও কোনো ভূত নেই। তোমরা যেই ভূতের কথা বলো এবং যেই ভূতকে ভয় পাও সেটা হলো তোমাদের মনের ভূত।”