অল্পের জন্য হলো না। জীবনের ম্যাচে চিতার মতো দম রাখতে পারলেন না। এই তো কিছুদিন আগেই ছাড়লেন শেষনিঃশ্বাস। বেঁচে থাকলে এ বছর ৭৭ তম জন্মদিন পালন করতেন ফুটবল কিংবদন্তি ইউসেবিও। ‘কালো চিতা’ নামেও যিনি বিখ্যাত।
১৯৪২ সালে পর্তুগালের সাবেক উপনিবেশ মোজাম্বিকের বস্তিতে জন্মেছিলেন ইউসেবিও দা সিলভা ফেরেইরা। রেলশ্রমিক শ্বেতাঙ্গ বাবা লরিন্ডো এবং আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ মা এলিসার ঘর আলো করে জন্ম। জন্ম হয়েছিল আফ্রিকার চিরায়ত দারিদ্র্যের অভিশাপকে সঙ্গী করে। তবে সৃষ্টিকর্তা দুই পায়ে ঠিকই দিয়ে দিয়েছিলেন জাদুকরি ফুটবল প্রতিভা। সেই প্রতিভার জাদু দিয়েই ষাট-সত্তরের দশক মন্ত্রমুগ্ধ করেছেন গোটা দুনিয়াকে।
মাত্র আট বছর বয়সে বাবাকে হারানো ইউসেবিওর ছেলেবেলা থেকেই ছিল ফুটবলের প্রতি দুরন্ত নেশা। স্কুল পালিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবলে মেতে উঠতেন হরহামেশাই। বুট তো দূরের কথা, বল পর্যন্ত ছিল না। খবরের কাগজ আর ছেঁড়া মোজা দিয়ে বল বানিয়ে ফুটবল খেলতেন। চিতার মতো দুর্দান্ত-দুর্দমনীয় গতি, বল নিয়ন্ত্রণে দক্ষতা, দুই পায়ে শট নেওয়ার ক্ষমতা, ড্রিবলিং—ইউসেবিওর প্রতিভার কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে চারদিকে।
১৬ বছর বয়সে প্রথম ক্লাব হিসেবে স্পোর্টিং লিসবনের সহযোগী ক্লাব স্পোর্টিং ডে লরেন্সো মারকেসের হয়ে খেলা শুরু করেন। সেখান থেকে প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটিয়ে নজর কাড়তে বেশি সময় নেননি। ১৮ বছর বয়সী বিস্ময়-বালক খুব দ্রুতই বেনফিকার কিংবদন্তি কোচ বেলা গাটম্যানের নজরবন্দি হন। এখানে আছে মজার গল্প।
লিসবনের সেলুনে বসে ব্রাজিলের সাও পাওলোর কোচ বাওয়ার মোজাম্বিকে দেখা এক কিশোর ফুটবলারের প্রশংসায় মেতে উঠেছিলেন। যে কিশোরের নাকি কালো চিতার মতো দম। যে কিনা মাত্র ১১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার দৌড়ায়। যার সঙ্গে গল্প করছিলেন তিনি ছিলেন গাটম্যান।
বেনফিকা দলে ভেড়াতে চাইল ইউসেবিওকে, অন্য দিকে স্পোর্টিং লিসবন হাতছাড়া করতে নারাজ। ৫ ফুট ৯ ইঞ্চির ইউসেবিওকে নিয়ে রীতিমতো যুদ্ধে মেতে উঠেছিল পর্তুগালের দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্ব্বী ক্লাব। শেষমেশ মোটা অঙ্কের টাকা গুনেই ইউসেবিওকে ছিনিয়ে নেয় বেনফিকা। চুক্তি করেও নিশ্চিত হতে পারছিল না বেনফিকা। পাছে স্পোর্টিং বাগড়া দেয়, সে জন্য ইউসেবিওকে কিনে পাঁচ মাস লুকিয়েও রেখেছিল!
১৯৬১ সালে বেনফিকার হয়ে অভিষেক ম্যাচেই হ্যাটট্রিক করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। তারপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পরের মৌসুমে ইউরোপিয়ান কাপ (বর্তমান চ্যাম্পিয়নস লিগ) ফাইনালে ডি স্টেফানো-পুসকাসের ইতিহাস বিখ্যাত রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে ইউসেবিও জাদুতে ইউরোপিয়ান কাপের মতো বড় আসরও জয় করেছিল বেনফিকা। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত বেনফিকার হয়ে মোট ১৫ বছর খেলেছেন ইউসেবিও। এই ১৫ বছরে বেনফিকা ১০টি লিগ এবং ৫টি পর্তুগিজ কাপ জিততে পেরেছিল কেবল ইউসেবিওর একক নৈপুণ্যে। যে দশবার বেনফিকা লিগ জিতেছিল, সাতবারই লিগের শীর্ষ গোলদাতা ছিলেন ইউসেবিও! বেনফিকা মহাকাব্য লিখতে ৩০১ ম্যাচে করেছেন ৩১৭ গোল! ম্যাচ প্রতি গোলের হারটা একবার দেখুন।
জাতীয় দলের হয়েও ইউসেবিওর কীর্তি অম্লান। তিনিই প্রথম পর্তুগালকে ‘প্রতিষ্ঠিত ফুটবল পরাশক্তি’ হিসেবে বিশ্বের কাছে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। একটা সময় ছিল যখন বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব উত্তরণে হিমশিম খেতে হতো পর্তুগালকে। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের মাধ্যমে ফুটবল মানচিত্রে পর্তুগালের ফুটবলকে শক্ত অবস্থানে তুলে দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে প্রায় একক দক্ষতায় ভাঙাচোরা পর্তুগাল দলকে নিয়ে গিয়েছিলেন সেমিফাইনাল পর্যন্ত। কোয়ার্টার ফাইনালে দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে ইউসেবিওর পারফরম্যান্স রূপকথাকেও হার মানায়। মাত্র ২৪ মিনিটের মধ্যে ৩ গোল হজম করে বিশ্বকাপ থেকে ছিটকেই যাচ্ছিল পর্তুগাল। কিন্তু ‘কালো চিতা’ জ্বলে উঠল। তাতেই ছিন্নভিন্ন দক্ষিণ কোরিয়া। পর্তুগাল ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত জেতে ৫-৩ গোলে। ৫ গোলের ৪টিই করেন ইউসেবিও।
সেমিফাইনালে পর্তুগাল মুখোমুখি হয় স্বাগতিক ইংল্যান্ডের। ম্যাচজুড়ে কড়া পাহারায় রাখা হয়েছিল ইউসেবিওকে। তবে ম্যাচের ৮২ মিনিটে পেনাল্টি থেকে ঠিকই গোল আদায় করে নিয়েছিলেন। সেই গোলের আগে টানা ৭ ম্যাচে মোট ৭০৮ মিনিট ইংল্যান্ড কোনো গোল হজম করেনি। গোলের পর তাই ইংলিশ গোলরক্ষক গর্ডন বাঙ্কসকে মাঠেই শ্রদ্ধাসূচক সালাম ঠুকে দিয়েছিলেন ইউসেবিও। খেলোয়াড় হিসেবে যত বড় মাপের ছিলেন, মানুষ হিসেবে ছিলেন তার চেয়েও বড়।
ওই বিশ্বকাপে অবশ্য সেমিফাইনাল থেকেই কান্নাভেজা বিদায় হয় পর্তুগালের। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাঁদতে কাঁদতে মাঠ ছাড়ছিলেন ইউসেবিও। সেই কান্না ইতিহাস বিখ্যাত। পর্তুগালের মানুষের কাছে ম্যাচটি ‘জোগো দাস লাগরিমাস’ (কান্নার ম্যাচ) হিসেবে পরিচিত। স্বপ্নভঙ্গের সেই বিশ্বকাপেও ৯ গোল করে ঠিকই ‘গোল্ডেন বুট’ জিতে নিয়েছিলেন। দেশ না পারলেও খেলোয়াড় ইউসেবিও তো চ্যাম্পিয়ন! শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে হারিয়ে তৃতীয় হয় পর্তুগাল, যা বিশ্বকাপে এখন পর্যন্ত পর্তুগালের সেরা অর্জন।
পর্তুগালের সাবেক শীর্ষ গোলদাতা ইউসেবিও জাতীয় দলের লাল জার্সি গায়ে ৪১ গোল করেছেন মাত্র ৬৪টি ম্যাচ খেলে। সম্প্রতি ইউসেবিওকে পেছনে ফেলে পর্তুগালের যৌথ শীর্ষ গোলদাতা (৪৭ গোল আর আছে পলেতার) হয়েছেন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। ইউসেবিওর রেকর্ডটি পেরিয়ে যেতে রোনালদোকে খেলতে হয়েছে ১০৬টি ম্যাচ।
ক্যারিয়ারজুড়ে গোলের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন। ৭৪৫টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে করেছিলেন ৭৩৩টি গোল। সর্বকালের সেরা ফুটবলার পেলে ক্লাব ক্যারিয়ারের প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে ৬৫৬ ম্যাচে করেছিলেন ৬৪৩ গোল। এখান থেকেও ইউসেবিওর প্রতিভা অনুমান করে নেওয়া যায়।
প্রাপ্তির খাতায় অনেক কিছুই আছে। শুধু বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। কারও কারও মতে, বিশ্বকাপ জিতলে হয়তো পেলে-ম্যারাডোনার ওপরেই থাকতেন ইউসেবিও। অপ্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে একবার বলেছিলেন, ‘আমি আমার সময়ের সেরা খেলোয়াড় ছিলাম। ইউরোপ এবং গোটা বিশ্বের শীর্ষ গোলদাতা ছিলাম। সম্ভাব্য সবকিছুই করেছি, শুধু বিশ্বকাপটা জিততে পারিনি।’
তার পরও তাঁর কীর্তি অম্লান। ইউসেবিও চলে গেছেন। কিন্তু থেকে গেছে তাঁর ফুটবলীয় রূপকথা। সেই রূপকথা থাকবে।
সুত্র: দৈনিক প্রথম আলো।