জাকারিয়া জুবায়ের
ব্যবসা: অনন্য এক ইবাদাহ। নবী সাহাবা সকলের কর্মাদর্শ বা সুন্নাত। একেবারে নবী সিদ্দিক শহীদ পূর্ণবান সবার সাথে আখেরাতে অবস্থানের মহাসুযোগ। ভাবা যায়!
যুগে যুগে অজস্র পীর, আউলিয়া, ঈমানদার মুসলমান ছিলেন ইলমি খেদমতের পাশাপাশি ব্যক্তি জীবনে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী।ব্যবসার কারণে তাঁদের ছিল না তেমন কোনো অর্থনৈতিক ক্রাইসিস। ফলে জ্ঞানগত ও অর্থগত/জ্ঞানার্জন এবং বিতরণ সবদিক থেকেই ইসলামের খেদমত করে যেতে পেরেছেন নিরলসভাবে। ইমামে আজম আবু হানিফা রাহমাতুল্লাহি আলাইহি ছিলেন তাদেরই একজন। ব্যক্তি জীবনে ছিল তাঁর রমরমা কাপড়ের ব্যবসা। সাথে ইসলামী ফিকহ অনুষদ পরিচালনা তো ছিলই।
ব্যবসা দিন দিন বড় হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে তার সুনাম সুখ্যাতি পাড়া মহল্লায় শহরে নগরে। সাথে আছে হাদিস ও ফিকহের নিয়মতান্ত্রিক দরস। এবং কুরআন হাদিস অনুসন্ধান ও গবেষণা করে, জীবন সংশ্লিষ্ট হাজারো মাসআলা মাসায়েল বের করার গুরুদায়িত্ব। বাঘা বাঘা চল্লিশ জন ইমামের সমন্বয়ে গঠিত ইসলামী ফিকহ অনুষদের পরিচালনা। চাট্টিখানি কথা!
ব্যবসায় সহকারী না হলে নয়। ইলমের খেদমতের জন্য নিজেকে অবসর করতেই সহকারী গ্রহণের ভাবনা। ব্যবসার বোঝা সহকারীর হাতে হস্তান্তর করলেন। মোটামুটি হিসেব-নিকেশ বুঝিয়ে দিলেন। সহকারি তো আহ্লাদে আটখানা। জামানার বিখ্যাত ইমাম ও বুজুর্গের সহকারী হওয়ার সৌভাগ্য। কয়জনেরই বা আছে এমন শুভ নিয়তি। মাজায় গামছা বেঁধে ব্যবসায় মনোযোগ দিলেন।
-আসসালামুয়ালিকুম, বণিক ভাই!
– ওয়ালাইকুম আসসালাম। জনাব সু আমন্ত্রিত। বলুন আপনার কী লাগবে?
– ভালো মানের কাপড় দেখান।
– মানসম্মত সব কাপড়ের গাদ চোখ বন্ধ করে নিতে পারেন। মান নিয়ে একদম ভাববেন না।
– আস্থা আছে বণিক ভাই। আপনাদের উপর আস্থা না রাখলে তো পাপ হবে। এই কাপড়টা বেশ মনে ধরেছে। এটাই নিতে আগ্রহী।
– যেটা ইচ্ছা সেটাই নিতে পারেন। আপনার পূর্ণ অধিকার সংরক্ষিত।
কিছুক্ষণ পর…….
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলেন ইমামে আজম আবু হানিফা রহিমাহুল্লাহ। তোড়জোড় হয়ে কি যেন খুঁজছেন। কপালে তার চিন্তার ভাজ। রাশি রাশি কাপড় আলু থালু করে খুঁজে ফিরছেন। অনন্তর তিনি অনন্ত খুঁজে পেলেন না তার কাঙ্ক্ষিত বস্তু। উৎকর্ণ হয়ে কি যেন ভাবছেন।
– হযরত আপনাকে বড় চিন্তিত মনে হচ্ছে। মনে হয় কোন কিছুর তলবে উতালা। বিস্ময়েমাখা জিজ্ঞাসা সহকারীর। -এখানে একটা কাপড় ছিল, সেটা কোথায়?
বর্ণ ও ধরন বলে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন ইমামে আজম। সহকারী হতচকিয়ে গেল অজানা আশঙ্কায়। বুকে কিছুটা সাহস নিয়ে বললেন হযরত সেটা তো এইমাত্র…….
-এইমাত্র কি করেছ? তড়িৎ কৌতূহলে দুমড়ে মুচড়ে কথাটা পাড়লেন।
-এইমাত্র বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু কি আছে তাতে? আপনাকে এত বেচাইন দেখাচ্ছে কেন?
-কত দামে বিক্রি করেছ?
সহকারীর প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে ফের প্রশ্ন পাড়লেন ইমামে আজম।
-হযরত আপনার নির্ধারণ করে দেওয়া মূল্যে।
শুনে বুকটা টনটন করে উঠলো ইমামে আজমের।
-যা ভেবেছিলাম তাই হল পরিশেষ!!
-কিন্তু আপনি বিচলিত হচ্ছেন কেন হযরত?
– ওই কাপড়টা ছিল স্বল্পমূল্যের। কিন্তু এই গাদ/গাটের পাশে থেকে যায়। তোমাকে বলতে ভুলে যাই। পরক্ষণে মনে পড়ে। তারপর কী হয়েছে তার প্রত্যক্ষদর্শি তো তুমি নিজেই।
চাপা কষ্ট ও দুশ্চিন্তায় হৃদয়ে রাজ্য তোলপাড়। ভাবনার অকুল দরিয়ায় হাবুডুবু খেতে লাগলেন। কী করবেন এই অর্থ! কোথায় ব্যয় করবেন তিনি!
আল্লাহর অভিসম্পাত আছে যে এমন ব্যবসায়ীদের উপর। (সূরা মুতাফফিফিন-১) একজন মুমিন হিসেবে তা কিভাবে হজম যোগ্য হয়। সাথে আছে রসুলের নিরঙ্কুশ ফরমান” হে বণিকের দল! কারবারে মিথ্যা প্রতারণা সব কিছুরই সম্মুখীন হবে।( সুতরাং নবী সিদ্দিক শহীদ ও পূণ্যবানদের সাথে হাশরে অবস্থান করতে চাইলে) সততার সাথে ব্যবসা করো।
(আবু দাউদ -৩৩২৬ নাসাঈ- ৭/১৪-১৫)
যার দিবারাত কাটে হাদিস কোরআনের গবেষণায়। তার সামনে কি এ সম্পর্কিত কোরআন ও হাদিসের হুমকি-ধমকি ও ভীতিবোধ কথামালা ছিল না? তাহলে কিভাবে তিনি হবেন স্থির। শান্ত। অনুক্ষণ এমন ভাবনার দূর্বিপাকে পই পই করে ঘুরতে লাগলেন। পরিশেষে তিনি সতর্কতাবশত কাপড়ের পুরো মূল্যটাই ধরে সদকা করে দিলেন।
( আল খাইরাতুল হিসান ফী মানাকিবিল ইমাম আবু হানিফা আন নোমান -৪৩)
নির্যাস,
মিথ্যা জালিয়াতি ধোঁকা প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যবসা করে কী লাভ! চাক্ষুষ দু পাঁচ পয়সার ঝনঝনানি কানকে মুখরিত করতে পারে। মুহূর্তের এই আত্মতৃপ্তি বুকে অনন্ত শান্তি প্রশান্তির যোগান দিতে পারে। কিন্তু পরোক্ষভাবে পাঁচশত টাকার লোকসান হয়ে যাবে অজান্তে। আর কিয়ামতের বিচারের কাঠগড়া তো অনিঃশেষ প্রস্তুতি নিয়ে আছে। যেদিন কারো প্রতি কোনরূপ অত্যাচার করা হবে না। পাইপাই হিসাব করে সবই তাকে প্রদান করা হবে।