আরাফাত রহমান আসিফ
উপন্যাসটার উপসংহার কিছুতেই শেষ করতে পারছি না। তাই ফজর নামাজ পড়েই খাতা কলম নিয়ে বসে পড়লাম। এমন সময় দেখি রাস্তা দিয়ে এক লোক যাচ্ছে। লোকটাকে দেখে সন্দেহ হলো। লোকটা কিছুদূর যাচ্ছে আর চোরের মত এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। এত সকালে এরকম লোক দেখে কৌতূহল জাগলো। নিচে নেমে সোজাসুজি প্রশ্ন করলাম, এই যে কিছু খুঁজছেন? উপর থেকে দেখে যতটা জোয়ান মনে হয়েছিল ততটা জোয়ান নয়। কমপক্ষে সত্তরের ওপরে বয়স হবে। কিন্তু চোখ-মুখ দেখে মনে হল কি তেজ রে বাবা! এরকম তেজ আমাদের শরীরেও নেই বুঝি। সে ঘুরে দাঁড়াতেই বুঝলুম নতুন লোক এ তল্লাটে আগে কোনোদিন দেখিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কে? তিনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর আপাদমস্তক নিরীক্ষা করে বললেন, আমি! আমি একজন প্রবাসী।
প্রবাসী! তা আপনার দেশ কোথায়? তিনি পুনরায় কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর স্বগর্ভে হাসি দিয়ে বললেন, আমার দেশ! আমার দেশ হলো সোনার বাংলা; সোনার বাংলাদেশ। মনে মনে বললুম,লোকটা পাগল নাকি! মুখে বললুম, এটাই তো বাংলাদেশ। লোকটা তখন তাচ্ছিল্যের সুরে বললেন, হ্যাঁ এটা বাংলাদেশ কিন্তু ‘সোনার বাংলা’ নয়। আমি বললাম,
মানে-
লোকটা হঠাৎ ভীষণ রকম ক্ষেপে গিয়ে বলতে শুরু করল, মানে বুঝলেন না! এটা কি রকম করে সোনার বাংলা হলো? আমি কিঞ্চিত ভয় পেয়ে গেলাম। যে মানুষটা এতক্ষণ কথাই বলছিল না সে যেন এখন কথার খই ফোটাতে শুরু করেছে। তার বলা চলতে থাকল, যে দেশ দুর্নীতিতে ভরে গেছে; দুর্নীতির রাজনীতিতে ভরে গেছে, যে দেশে প্রতিদিন মা-বোনেরা ধর্ষিত হচ্ছে; যে দেশে এখনো টাকার অভাবে মেধাবী শিক্ষার্থীরা টোকাই থেকে ভয়ঙ্কর জঙ্গি হয়ে উঠছে সে দেশকে আপনি সোনার বাংলা বলছেন! যে দেশে এখনো টাকার অভাবে মানুষ মাংস কিনে খেতে পারে না; যে দেশে শিশুরা মায়ের দোয়া নিয়ে পরীক্ষা দিতে যায় আর ফিরে আসে সড়ক দুর্ঘটনায় লাশ হয়ে; যে দেশে প্রতিদিন হাজার তরুণের হাজার ইঞ্জিনিয়ারের স্বপ্ন বড় বড় ট্রাকের তলে চাপা পড়ে সে দেশকে আপনি সোনার বাংলাদেশে বলছেন? যে দেশে এখনো মাত্র পাঁচ হাজার টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় বাবার কাঁধে ছেলে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কবরস্থানে যায় সে দেশকে আপনি সোনার বাংলা বলছেন? এ দেশের জন্যই কি আমরা যুদ্ধ করেছিলাম; হায়নাদের এত অত্যাচার সহ্য করেছিলাম? এই দেশের জন্যই কি নিজের বা হাতটি হারিয়েছিলাম-বলেই গায়ের চাদর খুলে ফেললেন। দেখলাম কাঁধের নিচ থেকেই বা হাতটি নেই। কিছু বলার আগেই লোকটি বলে উঠলেন, একাত্তরে হায়েনাদের গুলি লেগেছিল। তবু দুঃখ পাইনি, আমার দেশটা সোনার বাংলা হবে বলে। জানেন, আপনাদের সাথে গলা মিলিয়ে এখনো গাই,
‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।
কিন্তু বিশ্বাস করেন এখনো আমি আমার সোনার বাংলাকে খুঁজছি। এরপর আমরা দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলাম। তিনি হঠাৎ হাসি মুখে বললেন, আপনি যদি আমার সোনার বাংলা আমার দেশ খুঁজে পান দয়া করে আমাকে জানাবেন -বলেই চলতে শুরু করল। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কিন্তু আপনি কে? সে ঘাড় ফিরিয়ে সহাস্যমুখে মুখে বলল, প্রথমেই তো বললাম আমি একজন প্রবাসী। বলেই চলতে শুরু করল।
আমি থ হয়ে তার চলে যাওয়া দেখলাম। হঠাৎ বিকট হর্নের আওয়াজে সাইডে দাঁড়াতেই পাশ দিয়ে একটি ট্রাক চলে গেল। চারদিকে তাকিয়ে দেখলাম সকাল হয়ে গেছে।