বৃষ্টিতে পাওয়া

0
386
আখতারুল ইসলাম খোন্দকার 

          কোরবানি ঈদের পরদিন ঘুরাঘুরির সুবাদে দু’বন্ধু মিলে মোটরসাইকেলে ফুপুর বাসায় বেড়াতে গেলাম। অনেক পরিকল্পনা ছিল ফুপাতো বোনদের নিয়ে একটু আড্ডা দেব তেমনটা হলোনা। বর্ষার আগমনে দুপুরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করেই বাসায় ফেরার প্রস্তুতি নিলাম। কেননা, বাঁধ সাধলো গোমড়া মুখ করে ঢেকে দেওয়া কাল মেঘ। কখন যে বৃষ্টি নামে তা বলা মুশকিল, এখনকার আবহাওয়ার এতোটুকুও বিশ্বাস নেই। বোন দুটো আমাদের পেয়ে রীতিমতো আনন্দের সাগরে ভাসছে আর অসংখ্য বায়নার ফুলঝুরি সাজিয়ে রেখেছে। কোন ভাবেই বেরুনোর সুজোগ দেবেনা, অন্তত আজকের রাতটা যেন এখানে কাটায় বলে পিড়াপীড়ি তাদের। কিন্তু আমরাও ছিলাম নাছোড়বান্দা তাই ব্যার্থ চেষ্টা ফলপ্রসূ হলোনা। তবে সামান্য বকা-ঝকা ও মধুর অপমানের মর্মবাণী সহ্য করতে কার্পণ্য করিনি। 

            কিছুদূর না আসতেই শো শো শব্দে আকাশ ভাঙ্গা বড় ফোটার বৃষ্টি শুরু হলো। কোথাও একটু দাঁড়াবো সেই সুজোগ নেই যেহেতু রাস্তার পাশে চায়ের দোকান কিম্বা বাড়ি-ঘর দেখলামনা। বড় একটা বিলের মধ্যে দিয়ে সরু মেঠো পথ। অনেকটাই ভিজেছি, হটাৎ সামনে একটা বাড়ি দেখতে পেয়ে বাইক থামিয়ে দেয়াল ঘেঁষে মাথা লুকালাম। তাল পাতার ছাওনি দোচালা পুরানো একটা মাটির ঘর। বাতাসে চালার কিছু কিছু অংশ উড়ে গেছে। বৃষ্টির পানি থেকে খুব একটা রেহাই পাচ্ছিনা তবু নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভাল এই বিশ্বাসে ভেজার হাত থেকে বাঁচার সংগ্রাম।  

           কিছুক্ষণ পর কচর-মচর ও হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ার শব্দ পেয়ে ফিরে তাকালাম। দেখি এক মধ্য বয়সী মহিলা দরজা খুলে আমাদের ডাকছে। কিছু না ভেবেই ভেতরে প্রবেশ করে আহাম্মুক হয়ে গেলাম। জরাজীর্ণ এই ঘরের চালা দিয়ে দিনের বেলা সূর্য এবং রাতে চাঁদ দেখার অপূর্ব সুজোগ আর একটু আকাশের পানিতে থালা,বাটি, গ্লাস, হাড়ি-পাতিল দিয়ে প্রতিরোধের প্রান-পণ উদ্যোগ যেন ফারাক্কায় কয়েক বস্তা বালু দিয়ে বাঁধ দেওয়ার অপচেষ্টা মাত্র। নড়বড়ে একটা টুলে সে আর আমি পিঁড়াতে বসলাম। কিন্তু ভিষণ লজ্জায় গুটিয়ে গেলাম দরিদ্র মানুষের করুণ পরিস্থিতি মোকাবিলার করুণ জীবন- যুদ্ধ দেখে। যদিও এখানে যথেষ্ট সুবিধা হচ্ছেনা বরং বাইরে দাঁড়ানোই ভাল ছিল কিন্তু উঠে যেতেও পারছিনা। হঠাৎ চোখে পড়লো একটা ষোড়শী চৌকির এক কোনে বসে ছেঁড়া কাথাঁ গায়ে জড়িয়ে বৃষ্টির সাথে পাল্লা দিচ্ছে। আঁধার ঘরে জ্যোৎস্নার ছটা যেন আমার চোখে পড়লো। মেয়েটি দেখতে সত্যিই অসম্ভব সুশ্রী যা ভাষায় প্রকাশ করতে পারছিনা। মায়াবী চোখে কেমন স্যাঁত স্যাঁতে রুপালী চমকের ঝিলিক আর দুরুদুরু কাঁপা টসটসে ঠোঁট দু’টোর অব্যক্ত আকুতি আমাকে বাকরুদ্ধ করে দিয়েছে। বুঝলাম, বেচারাদের দুমুঠো ভাতও ঠিক মতো জোটেনা আরও লুকিয়েছে তার ছেঁড়া কামিজ যেন দৃষ্টিগোচর না হয়। কিন্তু আমার শকুনি চোখের নজর তা এড়ায়নি। অপরুপ সুন্দর মিষ্টি চাঁদমুখ হতো দরিদ্র ঘরে ‘গবরে পদ্মফুল’ না ফুটে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম হলে ওর পেছনে কোটিপতির ছেলেরা লাইন ধরতো। কিন্তু মেয়েটিকে মন থেকে সরাতে পারছিনা বরং হৃদয়ের অন্তগভীরে উঁচু টিলার মতো জায়গা করে নিয়েছে। ক্রমশই আমি যেন তার মুগ্ধতার অসিম গহবরে তলিয়ে যাচ্ছি। আমার বাকি জীবনে চলার পথের উত্তম সঙ্গীনির সন্ধানে দৌড় গড়ায় পৌছেছি।  

            কখন যে বারি বর্ষণ বন্ধ হয়েছে বলতে পারিনা। বারংবার ডেকেও যখন সাড়া দেইনি বাধ্য হয়ে একরুপ টেনে-হেঁচড়েই বন্ধুটা আমাকে বাইরে নিয়ে যাচ্ছে। তবে লক্ষ্য করলাম বৃষ্টিতে পাওয়া মেয়েটি যেন কিছু বলতে চাই। কিন্তু চোখের ভাষা না বুঝলেও একঠাঁই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকা বাঁকা চাহনি এই দুষ্টু মনে দাগ কেঁটে দিয়েছে। কোন অবস্থাতেই তাকে ছেড়ে আসা আমার পক্ষে সম্ভবপর ছিলনা। আবার ওর জন্য কিছুই করতে পারলাম না ভেবে বুকের পাঁজরে খঁচ করে বিদঘুটে ব্যাথা অনুভব করলাম। আমি নিজেকে আর গুছিয়ে রাখতে পারলামনা দুচোখ ছাপানো টলটলে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। 

Previous articleআমাকে ডেকে নাও
Next articleঈদের দিন
প্রতিধ্বনি
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here