দখলদার

দখলদার
দখলদার- নূর-এ-তাহির আরাবি

নূর-এ-তাহির আরাবি

‘শোনো, ছেলের ক্যালকুলেটর লাগবে। আগেরটায় চলতেছে না। ব্যবস্থা কইরা ফেইলো,’ ফোনে বললেন নিদারা আক্তার। স্বামী অনেকদিন পর ছুটিতে আসবেন ঢাকা থেকে। কী কী লাগবে, তার এক লম্বা ফিরিস্তি তৈরি করে ফেলেছেন তিনি।
‘একা মানুষ আমি, কয় জায়গায় দৌড়াইয়া কয় রকমের জিনিস আর আনবার পারমু? তা-ও, দেখি কী করা যায়।’ ফোন রেখে দিল মজনু মিয়া।
নিদারা ঠিকই জানেন স্বামী সবগুলো জিনিসই নিয়ে আসবেন। এর আগেও অনেকবার এমনটা হয়েছে। মাঝেসাঝে অবশ্য তিনি ভাবেন, মর্গের নাইট গার্ডের চাকরি করে এত টাকা মজনু পান কোথায়?
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে। মজনু আরও সজাগ হয়ে উঠেছে। ঢাকায় হলেও জেনারেল হাসপাতালের মর্গটা চারপাশে ঘন গাছগাছালিতে ঘেরা। শো-শো আওয়াজ হচ্ছে। শীতের প্রকপ বাড়ছে। কানের ওপর দেওয়া মাফলারটা আরও শক্তভাবে লাগালো সে। আজকে তার মনটা বেজায় ভালো। এর আগের কর্মস্থল, আরেক মর্গে যে কাজটা প্রায়ই সে করত, এবার এখানেও সেটা করতে যাচ্ছে।
তবে এর জন্য সতর্কতা প্রয়োজন। ব্যাপারটা কেউ জেনে ফেললে মজনুর পরিণতি ভালো হবে না। মনে মনে হাজারো মনকলা খেতে খেতে রাত হওয়া পর্যন্ত সময়টা কাটিয়ে দিল সে।
প্রস্তুত হয়ে মর্গের দরজাটা খুলতে যাবে, তখনই একটা অ্যাম্বুলেন্স এসে ঢুকল রাস্তা দিয়ে। চট করে আবার কাঠের টুলটায় বসে পড়ল সে। নতুন লাশ এসেছে, বেওয়ারিশ। কেউ খোঁজ নেয়নি। শেষে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে এই মর্গে।
যথাস্থানে লাশ রাখতে রাখতে, আরও কিছু কাজ সম্পন্নের পর একঘন্টা মতো কেটে গেল। এরইমধ্যে চলে গেল অ্যাম্বুলেন্সটা। এখন আর কারও আসার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।
বেওয়ারিশ লাশ। কাজ করতে আরও সুবিধা।
চুপিসারে ভেতরে ঢুকল মজনু। এখন আর ভয় লাগে না তার। ডেইলী লাশ দেখে দেখে সয়ে গেছে। সারি সারি করে রাখা সাদা কাপড়ে মোড়া আত্মাবিহীন দেহ। বেশিরভাগেরই পা’ খোলা। বুড়ো আঙ্গুলে লাগানো হয়েছে নেমট্যাগ।
সদ্য রাখা লাশটার সামনে এসে দাড়ালো মজনু। এই কাজে হাত পাকা তার। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটা থেকে সাবধানে বের করল কাঁচি, সার্জিকাল নাইফ। তারপর শুরু হলো কাঁটাকাঁটির কাজ। আন্ডারওয়ার্ল্ডে দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের দাম কম না। এই কাজটা না করলে দিনে এনে দিনেই খেতে হতো তাকে।
কাঁপা কাঁপা হাতে কাটা অংশ দিয়ে হাত ঢুকিয়ে দিল মজনু। গøাভস পরা হাতটায় হৃৎপিন্ডের শীতল স্পর্শ অনুভূত হলো। তবে কেমন একটা অনুভূতি যেন হতে থাকল তার। কী যেন একটা মিলছে না। কাঁটা জায়গাটা আরও বড় করল সে। এবার টর্চের আলো ফেলল ভেতরে।
কালো রঙের হৃৎপিন্ড। দেখতে কিম্ভূতাকার, তার ওপর কয়েক জায়গায় ছিদ্র। অদ্ভুতদর্শন কতগুলো রক্তনালী চলে গেছে ওগুলোর মধ্যে দিয়ে।
যা বোঝা গেল, এটা কোনো মানুষের হার্ট হতে পারে না।
হাত-পা অবশ হয়ে আসল মজনুর। হাত থেকে মোবাইলটা খসে পড়ল তার। পা দুটোতে যেন শিকড় জন্মেছে। ওর চোখ আটকে গেছে জিনিসটার ওপর।
এদিকে বন্ধ হয়ে থাকা চোখ খুলে গেল লোকটার… মানে ওটার। ভয়ংকর লাল চোখ যেন দৃষ্টি দিয়েই ভস্ম করে ফেলবে মজনুকে। তার হাত দুটো ধীরে ধীরে এগোতে থাকল মজনুর বুকের দিকে। শেষ মুহূর্তে সংবিৎ ফিরে পেল মজনু, কিন্তু ততক্ষণে আর কিছুই করার নেই। মৃত্যুর আগে মজনু বুঝতে পেল, ওর হার্টটাকে নিয়ে নিয়েছে শয়তানটা, আর ওকে দিয়ে গেছে তার হার্ট।

*
পরদিন সকালে প্রত্যেকটা পত্রিকার হেডলাইন হয়ে গেল এরকম: “মর্গের লাশ থেকে এবার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সরানোর চেষ্টা। নাইট গার্ডকে পাওয়া গেল বন্দি অবস্থায়।”
মজনু মিয়া জানালো, মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করা হয়েছিল তাকে। এরপর বেঁধে রাখা হয় একটা গাছের সাথে। আর কিছু সে জানে না।
ব্যাপারটা নিয়ে সাময়িক উত্তেজনা শুরু হলো, শেষও হলো কয়েকদিনেই। যেমনটা হয় আরকী!
মজনু মিয়া তার স্ত্রীকে জানালো, বিশেষ কারণে আটকা পড়েছে সে। বাড়ি ফিরতে আরও কয়েকদিন দেরি হবে।
তবে কয়েকদিন পর হট নিউজ বেরোল আরেকটা। তবে ব্যাপারটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তবে নিশ্চিতভাবেই সেটা ভয়ংকর। সারা দেশের বিভিন্ন জায়গার এগারো জন মানুষ অজ্ঞাত কারণে নিহত হয়েছেন। তাদের চেহারা দেখে বোঝাই গেল, ভয়ানক ছিল মৃত্যুর সময়টা। আর সেই বেওয়ারিশ লাশ এখন আর বেওয়ারিশ নেই। কয়েকজন সেটাকে নিজেদের আত্মীয়ের বলে দাবি করে নিয়ে গেছে তাদের গ্রামে।
সেই লাশে যে এখন অরিজিনালি মজনুর হার্ট, সেটা কি কেউ জানে?

*
গ্রামে ফিরেছে মজনু। জানা কথা, সব জিনিসপত্রই ঠিক ঠিক এনেছে সে। শুধু নিদারা আক্তার খেয়াল করেছেন, স্বামীর আচরণ কেমন জানি হয়ে গেছে। সে যেন আর সেই মজনু নেই।
‘তোমার কি শরীর খারাপ? চোখও তো লাল হয়া আছে,’ চিন্তিত স্বরে বললেন নিদারা।
‘আরে নাহ্। ঠান্ডা লাগছে একটু। সমস্যা নাই, ঠিক হয়া যাবে,’ বলল মজনু। গায়ে শার্ট জড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় সে। শুনেছে নতুন একটা লাশ কবর দেওয়া হবে গোরস্তানে। সে আসল মজনু না হলেও এই স্বভাবটা তারও আছে। অবশ্য শয়তান দানবদের মৃতদেহ পছন্দ করারই কথা! গ্রিক পুরাণে আছে এই দানবদের কথা। নাম অ্যাবিসটেলন। জন্ম হয় মাটির নীচে। অন্ধকারে থাকতেই এরা বেশি পছন্দ করে। মূলত দেহ হয় তিন মাথাওয়ালা একটা সাপের মতো। তবে যেকোনো সময় যেকোনো রুপ ধারণ করতে সক্ষম এই পিশাচরা। বিভিন্ন কুয়ো থেকে বেরিয়ে আসে এরা। পুরাণে লেখা আছে, একসময় পৃথিবীর দখল নিয়ে নেবে অ্যাবিসটেলনরা।
কয়েকদিনের মধ্যে মজনুর গ্রামের অনেকের আচরণেই দেখা গেল পরিবর্তন। কেমন যেন রুক্ষ হয়ে উঠেছে তারা। মজনুরুপী অ্যাবিসটেলনদের সংখ্যা বাড়তেই থাকল।
নিজের ঘরে বসে কিছুক্ষণ পর পরই হেসে ওঠে মজনু। ভীষণ আনন্দ হয় ওর ব্যাপারটা ভেবে। সারা দুনিয়ায় শুধু ওরা থাকবে, আর কেউ না! চমৎকার!
পাশের ঘরে বসে মজনু মিয়ার ছেলে রিফাত বুঝে উঠতে পারে না, তার বাবা হঠাৎ হঠাৎ এভাবে হেসে ওঠে কেন!
(শেষ)

Facebook Comments Box
Previous article প্রতীক্ষার অবসান
Next article সোনালি রোদে শুকনো ধানের মধুগন্ধ
প্রতিধ্বনি একটি অনলাইন ম্যাগাজিন। শিল্প,সাহিত্য,রাজনীতি,অর্থনীতি,ইতিহাস ঐতিহ্য সহ নানা বিষয়ে বিভিন্ন প্রজন্ম কী ভাবছে তা এখানে প্রকাশ করা হয়। নবীন প্রবীণ লেখকদের কাছে প্রতিধ্বনি একটি দারুণ প্ল্যাটফর্ম রুপে আবির্ভূত হয়েছে। সব বয়সী লেখক ও পাঠকদের জন্য নানা ভাবে প্রতিধ্বনি প্রতিনিয়ত কাজ করে চলেছে। অনেক প্রতিভাবান লেখক আড়ালেই থেকে যায় তাদের লেখা প্রকাশের প্ল্যাটফর্মের অভাবে। আমরা সেই সব প্রতিভাবান লেখকদের লেখা সবার সামনে তুলে ধরতে চাই। আমরা চাই ন্যায়সঙ্গত প্রতিটি বিষয় দ্বিধাহীনচিত্ত্বে তুলে ধরতে। আপনিও যদি একজন সাহসী কলম সৈনিক হয়ে থাকেন তবে আপনাকে স্বাগতম। প্রতিধ্বনিতে যুক্ত হয়ে আওয়াজ তুলুন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here