ইব্রাহিম জুয়েল
তখন রাত ঠিক আটটা। জনমানুষের আনাগোনা যেন একদমই নেই। রাস্তার দু পাশে ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলো দেখতে ভীষণ ভালোই লাগছে। রাস্তার ওভার ব্রীজ গুলোতে ছোট্ট ছোট্ট লাল- নীল বর্ণের বাতিতে পুরো রাস্তা যেন রঙিন হয়ে উঠলো। রাফি দশম শ্রেণিতে পড়ে রাতের শহর তেমনটা ঘুরা হয়না বললেই চলে। তার কাছে রাতের এই দৃশ্যটা যেন অপরূপ লাগছে।
রাফি আর মুন্না দুজনে তাড়াহুড়ো করে রওনা দিলোএকটি হাসপাতালের উদ্দেশ্যে।
সন্ধা থেকে মুন্নার ফোনে শতকের অধিক ফোন এসেছে। যেকোনো মূল্যেই হোক তাকে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে। কারণ মুন্নার বোনের আজকে ডেলিভারি পেইন উঠেছে। মুন্না রাফিকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিল। হঠাৎ তার ফোনে রিং বেজে উঠলো। তার আম্মু তাকে বললো,”ডাক্তার বলেছেন ইমারজেন্সি রক্ত লাগবে।যে কোনো মূল্যেই হোক তোকে রক্ত ম্যানেজ করতে হবে।” তারা দুইজন তখন গাড়িতে। এক এক করে সকল সামাজিক সংগঠনের নিকট ফোন করে তাদের আহাজারি, সাড়ে নয়টার দিকে A+ (‘এ’ পজিটিভ) গ্রুপের রক্তের খবুই প্রয়োজন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত, কোনো সংগঠনই লোক রক্ত খুঁজে দিতে পারছিল না।এক এক জন লোক এক এক অজুহাত দিতে থাকে। তার সাথে ঘড়ির কাটা যেন দ্রুত ঘুরতে লাগলো এবং বাড়তে লাগলো তাদের বুকের ধুকধুকানি। কাউকে পাচ্ছি না।
বারবার ফোনে আকুল আবেদন, এক সংগঠন থেকে অন্য সংগঠন। কোনো সংগঠন বাদ দেইনি তারা। যদি রক্ত না ম্যানেজ করতে পারে তাহলে যেকেনো অঘটন ঘটে যেতে পারে।নিরব আর্তনাদে খুঁজে বেড়াচ্ছে প্রতিটি সেচ্ছাসেবীর ইউনিট। শেষমেশ একটা লোক ম্যানেজ করে দিল একটি ইউনিট। তার ফোন নাম্বার অনুযায়ী তারা লোকটিকে ফোন করে হাসপাতালে আসার ঠিকানা দেয়। লোকটি সেই অনুযায়ী চলে এলো। টানা ১ টা ঘন্টা রক্তের জন্য কি হাহাকার না করলো তারা ! বুকভরা ছিল ভয়। যা-ই হোক কিছুটা ভয় কেটে উঠল। তাকে নিয়ে চলে গেলো হাসপাতালে। হাসপাতালে পৌছানোর পর শুনতে পায় রক্ত দানের লোক নাকী হাসপাতাল কতৃপক্ষ নিজেরাই ম্যানেজ করে দিয়েছে।
অথচ মুন্নার আম্মু তাদের কিছু জানায়নি। সারা রাস্তায় কি একটা হয়রানির মধ্যেই না ছিলো!পরে তাদের সাথে আনা লোকটিকে হাসিমাখা মুখে বিদায় দিলো। এখন অপেক্ষা করতে লাগলো কখন তাদের আপুর সন্তান পৃথিবীতে আগমন করবে ।রাফি হুমায়ুন আহমেদের বিশাল বড় ভক্ত। হুমায়ুন আহমেদ বই হাতে নিলে নিমিষেই খাবারের মত বই শেষ করে পেলে। তখনই রাফি হুমায়ুন আহমেদ স্যারের একটা কথা খুবই মনে পড়লো— “এই শহরে আছেন নানান ধরনের মানুষ ;আর তাদের আছে বিচিত্র রকম অপেক্ষা।” হাসপাতাল জুড়ে সকল মানুষ করছে এক এক রকমের অপেক্ষা!
মুন্নার এর আগেও ২ জন ভাগ্নে ছিল। তারা ২ জনেই ছিল ছোট্ট এবং অনেক মিশুক। তাদের কে একটু স্বান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছে রাফি ও মুন্না। তাদের ভাগ্নেদের মনে অনেক প্রশ্ন -আম্মুকে কখন অপারেশ থিয়েটার থেকে বের করবে? কখন তারা ছোট্ট সোনামণিকে দেখবে– এই নিয়ে তারা দু’জন বোন চিন্তা করেই যাচ্ছে।
বেশকিছুক্ষণ পর মুন্নার আম্মু খবর নিয়ে এলো ছেলে হয়েছে।সবাই মহাখুশি।
অপেক্ষমান সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ দূর হয়েছে। কিন্তু, পরক্ষণেই হঠাৎ আবার সকলের মন ভেঙে গেলো যখন মুন্নার আম্মু বলে উঠলো তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। তাকে সুস্থ করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে ডাক্তাররা। তার নাকি একটা সমস্যা হয়েছে। এটা শুনে সকলে আতংকিত হয়ে গেলো। রাফিকে ডেকে বলা হলো তার কানে আজান দেওয়ার জন্য। প্রথমবার রাফি কারো কানের সামনে আজান দিল। রাফি দেখতে পেল ফুটফুটে একটি শিশু। তার কান্না যেন রাফি প্রাণে গিয়ে লাগলো। আজান শেষ হলে ডাক্তার তাদের উদ্দেশ্য করে বলেন বাচ্চাটিকে এখনই আইসিউ তে নেওয়া লাগবে। যেভাবে হোক তকে বাঁচাতে হলে দ্রুত চিটাগং বা ঢাকা নিয়ে যেতে হবে।ডাক্তার মুন্নাদের লক্ষ্য করে বলেছে ১ ঘন্টার মধ্যে কিছু একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। রাফি ও মুন্না ছোটাছুটি করছে এম্বুল্যান্সের আশায়। মনে মনে রাফির মানতে কষ্ট হচ্ছে সবে মাত্র দুনিয়াতে আসা ছেলেটা এত কষ্টে আছে।
তখন কেন জানি, রাফির রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের বাতিগুলোর দিকে চোখ পড়লো। বাতিগুলো তখন দেখতে কেমন অপরূপ লাগছে। সবগুলো সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে আছে। তার মধ্যে একটি মাত্র বাল্ব নিভুনিভু ভাবে জ্বলছে। দেখে মনে হল এখনই নিভে যাবে। নিভে গেলেই অন্ধকার হয়ে পড়বে তার আশপাশ এই দৃশ্য দেখতে দেখতে রাফির কানে হঠাৎই খবর আসে শিশুটি এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে। হাসপাতালে প্রিয়জনদের আহাজারি আর চিৎকার স্পষ্ট রাফির কানে ভেসে আসছিলো। ইব্রা দুঃখ মনে চয়ে রইলো সেই ল্যাম্পপোস্টের বাতিটার দিকে।অবাক করা বিষয় হল ঠিক ওই মূহুর্তে বাল্বটিও আলো দাওয়া বন্ধ করে দিল। অন্যদিকে কোল আলোকিত করা শিশুটি ও মুহূর্তেই হারিয়ে গেল।
প্রতীক্ষার অবসান
Facebook Comments Box