-নাঈমুল হাসান তানযীম
সেদিন বিকেলে অদ্ভুত এক লোকের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। মাথায় আধা পাকা চুল। পরনে পুরোনো লুঙ্গি আর গায়ে একটা জীর্ণ শার্ট। নদীর পাড়ে বসে আশ্চর্য এক ভঙ্গিমায় গান গাচ্ছিলেন। গানে গানে ঝরে পড়ছে হৃদয়ের সবটুকু প্রেম, বিরহ আর সঙ্গী হারানোর বিয়োগব্যথা। লোকটির আশপাশে তখন কেউ ছিল না। আমি দূর থেকে সবকিছু লক্ষ করছিলাম। কিছুক্ষণ পর যখন গান থামিয়ে দিলেন, আমি চুপিচুপি লোকটির পাশ ঘেঁষে বসি। আমার দিকে তাকিয়ে কোনোরূপ বিরক্ত হলেন না। বেশ কিছুক্ষণ নদীর জলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে কফোঁটা জল। অবাক হলাম। মনের ভেতর কী যেন খচ করে উঠল। ভাবলাম, হয়তো মানুষটির জীবনে কখনও এমন কেউ এসেছিল, যে এমনই এক শ্রাবণসন্ধ্যায় নদীর জলে ভেসে যাওয়া খড়কুটোর মতো হারিয়ে গেছে। নীরবতা থামিয়ে আমিই প্রথম মুখ খুললাম,
‘চাচা! আপনাকে চিনলাম না! কোথা থেকে এসেছেন? আর এখানে বসে কাঁদছেন যে?’
লোকটি নিরুত্তর। তবে বিরক্ত যে হননি, সেটা তাঁর চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর আবার একই কথা বললাম। লোকটি এবার মুখ খুললেন।
‘বাবা! সে অনেক লম্বা কাহিনি।’
আমি এবার সুযোগ পেয়ে বসলাম যেন। বললাম, যত লম্বা কাহিনিই হোক, শেষ হওয়া অবধি উঠছি না আজ। লোকটি ঈষৎ মুচকি হেসে বলে চললেন,
‘আমার নাম জাফর আলী। বাড়ি কুমোরগঞ্জে। জীবনে আপন বলতে আমার যারা ছিল, আজ তারা কেউই নেই।’
‘সময়টা তখন উত্তপ্ত। সারা দেশে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গায় কঠিন নজরদারি রাখছে। মাঝেমধ্যে কোনো কোনো গ্রামে ঢুকে অকস্মাৎ হামলা চালাচ্ছে। হত্যা করছে সর্বসাধারণকে। এমন উত্তাল সময়টাতে আমি ছিলাম পার্শ্ববর্তী জেলায়, নানাবাড়িতে। সেখানেই পড়াশোনা করতাম। নানা ছিলেন সে এলাকার মুক্তিবাহিনীর প্রধান কমান্ডার। গোপনে গোপনে তিনি যুদ্ধের নকশা আঁকতেন। আমি তো তখন ছোট ছিলাম, ওসব বুঝতাম না। একদিন সন্ধ্যায় আমাদের গাঁ থেকে কয়েকজন লোক পালিয়ে এলেন নানার কাছে। সবার চোখেমুখে ভয়ের চিহ্ন। গলা শুকিয়ে গেছে। কী যেন বলতে চান তাঁরা। কিন্তু কান্নার কারণে বলতে পারছেন না ঠিকমতো। আমাদের সবার শরীর ভয়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ভীষণ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। নানা পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে খুলে বলো।”
‘এরপর যা শুনলাম, সেটা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। নানা সঙ্গে সঙ্গেই মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। আমি এবং নানি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। সেদিন নানাবাড়ির কী অবস্থা হয়েছিল, বলে বোঝাতে পারব না। আম্মা-আব্বার মৃত্যুসংবাদ শোনার পর থেকে আমার নাওয়াখাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কয়েক মাস পর নানাও যুদ্ধে শহীদ হন। আপন বলতে এক মামা ছিলেন। নানাবাড়িই তখন আমার বাড়ি। এভাবেই দিন যাচ্ছিল। সপ্তাহ গড়িয়ে মাস। মাস গড়িয়ে বছর। আমিও বড় হলাম। শৈশব-কৈশোর পেরিয়ে আমি যখন টগবগে তরুণ, ঠিক তখন আমার জীবনে সে এসেছিল। অনেকটা সান্ত্বনা হয়েই আসে সে। তাকে পেয়ে আমি ভুলেই গিয়েছিলাম মা-বাবা, নানা-নানিকে হারানোর বেদনা। তার আগমন আমার একাকিত্বকে দূর করে দেয়। আমার বিশুষ্ক হৃদয়ে সৃষ্টি করে প্রবল জলোচ্ছ্বাস।
‘কিন্তু…সে-ও যে আমাকে একলা ফেলে এভাবে হারিয়ে যাবে না-ফেরার দেশে! দূরের অচিনপুরে, তা কি আদৌ কল্পনা করেছিলাম! এখন যে আমি বড় একা! বড় অসহায়!’ এইটুকু বলে তিনি ডুকরে কেঁদে উঠলেন। আমার চোখের কোণেও অশ্রু চিকচিক করে ওঠে। ওদিকে পশ্চিমের আকাশে টকটকে লাল সূর্যটা বিদায়ের পূর্বপ্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। একটু পরই হয়তোবা হারিয়ে যাবে নিকষ কালো আঁধারের বুকে। মানুষেরা যেমন হারিয়ে যায়।