ধর্ম নিয়ে উন্মাদ ভারতিয় নাগরিকদের বিরাট একটি অংশ।
এই পুরো সপ্তাহটি ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া এবং টিভি মিডিয়া অ্যাঙ্করদের উভয়ই মালদ্বীপের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানোর সাথে সাথে তারা যেন ঘৃণা করার জন্য একটি নতুন “শত্রু” খুঁজে পেয়েছে।
লাক্ষাদ্বীপ ভারতের ক্ষুদ্রতম কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। লাক্ষাদ্বীপ হল ৩২ বর্গ কিমি আয়তনের ৩৬ দ্বীপ নিয়ে গঠিত একটি দ্বীপপুঞ্জ।
সম্প্রতি লাক্ষাদ্বীপে গিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে তিনি সাদা বালির উপর দিয়ে হেঁটেছেন, সমুদ্রের তীরে বসে সাগরে হাওয়া খেতে খেতে নানা পোজের ছবি তুলেছেন । স্কুবা ডাইভ বা ডুবুরী মত সাগরে নেমে সেই নানা ছবি আর ভিডিও ।প্রধানমন্ত্রীর অবসরযাপনের ছবিতে ছয়লাব হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া এবং বর্তমানের গদি মিডিয়া টিভি চ্যানেল গুলিও ।
এটি প্রিয় নেতা নরেন্দ্র মোদীর লাক্ষাদ্বীপ সফরের সাথে শুরু হয়েছিল, যার পরে জল্পনা শুরু হয়েছিল যে এটি মালদ্বীপের জন্য একটি বার্তা। ইন্ডিয়া লাক্ষাদ্বীপ কে মালদ্বীপ এর মত তৈরি করবে । লাক্ষাদ্বীপ একটি অপূর্ব সুন্দর জায়গা। এবং এখানকার প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে হুবহু মালদ্বীপের মতো।
কিন্তু সেটা যে মালদ্বীপ মত তৈরি করা কোনভাবেই সম্ভব নয় হুজুগেমাতাল ভারতিয়রা বুঝতে নারাজ।
তারপরে, মালদ্বীপের তিন মন্ত্রীর অবমাননাকর মন্তব্যের পরে, ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া মালদ্বীপ বিরোধী অনুভূতিতে ফেটে পড়ে।
টিভি সংবাদে গদী মিডিয়া স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রাইমটাইমের একটি উদার অংশ মালদ্বীপকে ঘৃণা করার জন্য উত্সর্গ করেছিল।
রিপাবলিক ভারতের সৈয়দ সুহেল এবং টাইমস নাউ নবভারতের সুশান্ত সিনহা বলেছেন যে এটি হাস্যকর যে একটি জাতি, আকারে “মালদ্বীপের মতো ছোট” ভারতের বিরুদ্ধে লড়াই করার চেষ্টা করছে।
এদিকে, News18-এর রাহুল শিবশঙ্কর সবচেয়ে মৌলিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার জন্য তার সমস্ত ভয়ঙ্কর শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করেছেন।
যখন এই সব চলছে, ইন্ডিয়া টুডে এবং টাইমস নাউ টিভি ভারতিয় হাফ পর্নস্টার শার্লিন চোপড়া এবং মডেল পুনম পান্ডেকে ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছে।
তারা আলোচনা করে এবং বলে কখন ও তারা আর মালদ্বীপ ছুটি কাটাতে যাবে না লাক্ষাদ্বীপ যাবে। মালদ্বীপ বর্জনের নানা হুঙ্কার তো চলছে।সেখানে মুসলিম প্রধান মালদ্বীপ কে নিয়ে নানান টিপ্পনী!
গোদীমিডিয়ার মিথ্যা তথ্যবিলি!
ভারতে কি মাত্র ৪ শতাংশ লোক আছে যারা মাসে ৭০হাজার টাকা আয় করেন। ভারতে খুব কম লোকই আছেন যারা বছরে ৮.৫ লক্ষ টাকা আয় করেন। গোল্ডম্যান স্যাকস নামের একটি বৈশ্বিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ভারতের ধনী ব্যক্তিদের নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এই প্রতিবেদনে প্রতি মাসে সত্তর হাজার টাকা আয় করা ব্যক্তিকেও ধনী বলা হয়েছে।
আপনার মনে থাকবে যে ২০২২ সালের মে মাসে একটি সরকারী প্রতিবেদন এসেছিল। বলা হয়েছিল যে ভারতে প্রতি মাসে ২৫হাজার রুপি উপার্জনকারীরা দশ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
আমরা যদি এই দুটি পরিসংখ্যানকে একসাথে দেখি, তাহলে আমরা ভারতে দারিদ্র্যের বিশাল সমুদ্র দেখতে পাব এবং মুষ্টিমেয়কিছু যারা ৭০ হাজার মাসে আয়করে । আর যারা সবচেয়ে ধনী তাদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
যে দেশে আয় এত কম সেখানে পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনীতি হওয়ার ঘোষনার জন্য এত উদযাপন।
প্রতিনিয়ত জিডিপির আকাশচুম্বী মিথ্যা পরিসংখ্যান বেরিয়ে আসছে, এখন দুই অঙ্কের কথা থেমে গেছে, সাত শতাংশের ওপরে যাওয়ার সম্ভাবনায় ঢোল বাজানো হয়।
বাবারী মসজিদ ভেংগেফেলার কথা তো আমরাজানেই অযোধ্যার রামমন্দিরে (মুর্তি স্হাপন) প্রাণপ্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান নিয়ে গত কয়েকদিন ধরেই তোলপাড় চলছে ভারতিয় মিডিয়ায়। একদিকে অযোধ্যাধাম ও রামমন্দির প্রাণপ্রতিষ্টা অনুষ্ঠানের ব্যাপক কভারেজ হচ্ছে।
অন্যদিকে, চারজন শঙ্করাচার্যের আপত্তি ।
আদি শঙ্করাচার্য হিন্দুদের কাছে জগৎগুরু হিসাবে বিবেচিত হন। কারণ বেদশাস্ত্রের প্রচারকার্যে তিনি ছিলেন অগ্রদুত সারা ভারতে এই বৈদিক সমাজ ও সংস্কৃতির প্রচারের জন্য তিনি বহু কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। কেরালা রাজ্যের ফালাদিতে ৭৮৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন এক ব্রাহ্মণ পরিবারে ।
সনাতন ধর্মকে (হিন্দু ধর্ম) প্রতিস্ঠা করার উদ্দেশ্যে আদি শঙ্করাচার্য ভারতের চার কোণে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।ধর্ম গ্রহন্ত বেদ প্রচারের উদ্দেশ্য ছিল এর মধ্যে অন্যতম ।
শঙ্করাচার্য আশ্রমগুলি ভারতের সর্বাধিক শ্রদ্ধেয় তীর্থস্থানগুলির মধ্যে গণ্য করা হয়।এই চারটি প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে ভারতের প্রধান শঙ্করাচার্য হিসাবে বিবেচনা করা হয়। আদি শঙ্করের চারটি মঠ হ’ল:
১।কর্ণাটকের চিকমাগলুরে শ্রী শৃঙ্গেরী শারদা পীঠম।
২। উত্তরাখণ্ডের গাড়ওয়াল অঞ্চলে জ্যোতির মঠ।
৩।গুজরাটের দ্বারকায় কালিকা মঠ।
৪।ওড়িশার পুরীতে গোবর্ধন মঠ।
এই মঠ গুলিই থেকেই মুলত হিন্দুদের প্রধান বেদশাস্ত্র , পুরাণ এবং গীতাসমূহ সহ ধর্মিয় নিয়ম নিতি গভীরভাবে পর্যালোচনা করে গ্রহন করা হয় এই চার মঠ প্রধানরাই হিন্দুধর্মের পুনর্জাগরণের জন্য সদা সচেষ্ট ।
একই সময়ে, রামমন্দির ইস্যুতে, বিজেপি কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করেছে যেখানে তাদের পরিস্থিতি সামনে একটি কূপ এবং পিছনে খাদের মতো হয়ে গেছে।
বিজেপি এবং আরএসএস দ্বারা বন্দী রাম মন্দির প্রাণ প্রতিস্ঠা বা উদ্ভোধনের সরকারী দল বিজেপি পত্র পাঠিয়ে কংগ্রেস কোণঠাসা করেছিল । কংগ্রেস পরেছিল দো টানায় গেলে ও মুসলিমার অসন্তস্ট আবার না গেলে বিজেপি হিন্দু দের কে উসকিয়ে দেবে ।দেখ কংগ্রেস কত খারাপ ভগবান শ্রী রাম কে মানে না।
এদিকে, এমন কিছু ঘটল যা কংগ্রেসের জন্য পালানোর পথ খুলে দিল, যা অযোধ্যায় যাবে কি না তা নিয়ে দ্বিধায় আটকে ছিল।
প্রকৃতপক্ষে, দেশের সিদ্ধপীঠের চার শঙ্করাচার্য অযোধ্যায় অনুষ্ঠিতব্য এই মহা দিব্য রামলালা প্রাণপ্রতিষ্টা অনুষ্ঠানে যেতে অস্বীকার করেছিলেন।
জনৈক শঙ্করাচার্য তো কড়া ভাষায় বললেন, তিনি সেখানে গেলে ভাবার বিষয় হবে, এরপর মোদীজির স্থান কী হবে? আমরা সবাই জানি নরেন্দ্র মোদী চায় প্রচার ,মিডিয়া কভারেজ।
মন্দির কম বেশি ৩০% কাজ শেষ হয়েছে ।
এই অসম্পূর্ণ মন্দিরের পবিত্রকরণ ৪ মঠের চার জনই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান এবং শঙ্করাচার্যের অসন্তোষের কারন।
চার শঙ্করাচার্যই রাম মন্দির প্রতিষ্ঠায় অংশ নিচ্ছেন না বলেছেন।
এদিকে, দ্য ওয়্যারের এক সাক্ষাৎকারে করণ থাপারকে আরও একটি বড় কথা বলেছেন জ্যোতির্মথ অভিমুক্তেশ্বরানন্দের শঙ্করাচার্য।
বলেছিলেন যে তিনি আমন্ত্রণেও যেতেন না কারণ মন্দিরটি অসম্পূর্ণ, তবে এটিও ভুল যে তিনি আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
কারণ সত্যটি হল তাকে আদৌ আমন্ত্রণ জানানো হয়নি !!
৪০মিনিটের একটি সাক্ষাৎকার, প্রশ্ন ছিল তিনি ২২শে জানুয়ারী সোমবার অযোধ্যার রাম মন্দিরে রাম লালা মূর্তিটির প্রাণ প্রতিস্থা (পবিত্রকরণ) কীভাবে দেখেন??
তিনি তা দীর্ঘ ব্যাখ্য করেছেন, জ্যোতিষ পীঠের শঙ্করাচার্য।
যদি তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় তবে তিনি অবশ্যই অযোধ্যায় যাবেন, তবে তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন যে তিনি প্রাণপ্রতিস্থা (পবিত্র) অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন না।
স্বামী অভিমুক্তেশ্বরানন্দ সরস্বতী বলেছেন যে তিনি জানেন না অন্য শঙ্করাচার্যদের (পুরী, দ্বারকা, শৃঙ্গেরির) আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে কিনা ??
তবে সমানভাবে স্পষ্টভাবে বলেছেন যে চার শঙ্করাচার্যের কেউই প্রাণ প্রতিষ্টা অনুষ্ঠানে যোগ দেবেন না।
সংবাদপত্র ও নিউজ চ্যানেলের নামকরা সাংবাদিকতা নিয়ে বিশেষ উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়।
রামনামী সাংবাদিকতার কোলাহলে মিডিয়ার আরেকটি দেউলিয়াত্ব দেখা গিয়েছিল কংগ্রেস পার্টির সিদ্ধান্তের পরে।
যখন কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা সোনিয়া গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়গে এবং অধীর রঞ্জন চৌধুরী অযোধ্যায় প্রস্তাবিত প্রাণপ্রতিষ্টা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করেছিলেন।
এরপর গদী মিডিয়ার সাংবাদিকরা তাদেরই টিভি শো গুলিতে তাদের ওপর হামলা চালাতে থাকে।
রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা মল্লিকা অর্জুন খর্গে বলেন শুধুমাত্র কংগ্রেস দলই এই সিদ্ধান্তের ভালো-মন্দ বুঝতে পারে, কিন্তু আমার সীমিত রাজনৈতিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতে আমি বলতে চাই যে এই কর্মসূচিতে উপস্থিত না থাকার জন্য সমগ্র বিরোধীদের সাথে কংগ্রেসের সিদ্ধান্তটি দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোনা লাগলেও এবং দীর্ঘমেয়াদী রাজনীতির এটি ভাল ।
ভারতে গণতন্ত্রে প্রতিস্থাপিত হয়েছে ধর্মতন্ত্র।
এই থিওক্রেসির সামনে ভারতের গণতন্ত্রের ছবি ঝাপসা হয়ে আসছে, আসলে থিওক্রেসি এতটাই প্রাধান্য পেয়েছে যে তা ছাড়া আপনি আজকের ভারতে গণতন্ত্র দেখতেও পারবেন না।
ধর্মতন্ত্রের অর্থ এমন হয়ে গেছে যে দলগুলি এমন সংগঠনে পরিণত হচ্ছে যা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
আগে ধর্ম থেকে দূরত্ব বজায় রাখলেও এখন দলগুলো রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে শুরু করেছে।
পুঁজির চাপে রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে রাজনীতির অবসান ঘটিয়ে এখন ধর্মের নামে রাজনৈতিক দলগুলো গণতন্ত্রের মাঠ থেকেই নির্মূল হয়ে যাচ্ছে।
“ধর্মীয় চরিত্র যদি গণতান্ত্রিক চরিত্রে প্রাধান্য পায় তাহলে তা গণতন্ত্রকে নাটকে পরিণত করবে। একদিন ধর্মও ছটফট করতে শুরু করবে।”
আমার এই উক্তিটি লিখেরাখতে পারেন।